আল্লাহর
শরীয়তের পরিবর্তে অন্য আইন মোতাবেক ফয়সালা করা
অনবাদ
: মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
লেখক
: সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান
আল্লাহ
তাআলার প্রতি ঈমান রাখা ও তাঁর ইবাদত করার দাবী হল তাঁর হুকুম মেনে নেয়া, তাঁর শরীয়তের
প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং কথাবার্তা, মৌলিক নীতিমালা, ঝগড়াÑঝাটি ও জানÑমালসহ সকল অধিকারের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের
সৃষ্টি হলে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহই প্রধান
বিচারক এবং প্রত্যেক ফয়সালার সময় তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করা উচিত। অতএব সকল শাসনকর্তার
দায়িত্ব কর্তব্য হল আল্লাহর অবতারিত নির্দেশ অনুযায়ী হুকুম পরিচালনা করা। আর প্রজা
সাধারণের ও উচিত আল্লাহ স্বীয় গ্রন্থে যে হুকুম অবতীর্ণ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতে যা কিছু বর্ণিত আছে, সে অনুযায়ী ফয়সালা মেনে নেয়া। আল্লাহ
তাআলা শাসকবর্গের ক্ষেত্রে বলেন:
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ بَصِيرًا ﴿৫৮﴾ سورة النساء
‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানতসমূহ প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও।
আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে করবে।’
আর প্রজাদের
ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ﴿৫৯﴾ سورة النساء
‘হে ঈমানদারগণ!
তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে শাসন ক্ষমতার
অধিকারী। তারপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও
তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যাবর্তন কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী
হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।
এরপর
আল্লাহ বর্ণনা করেন যে, তাঁর অবতীর্ণ শরীয়তের পরিবর্তে অন্য আইনের প্রতি বিচার প্রার্থনা
করার সাথে ঈমানের কখনো সখ্য স্থাপিত হয় না। তিনি বলেন:
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ﴿৬০﴾
‘আপনি
কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে
যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা ঈমান এনেছে? তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়,
অথচ একে প্রত্যাখ্যান করার নির্দেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে
পথভ্রষ্ট করতে চায়।
এর একটু
পরেই আল্লাহ বলেন:
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿৬৫﴾ سورة النساء
‘কিন্তু
না, আপনার রবের কসম! তারা মু’মিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিবাদÑ বিসম্বাদদের বিচার ভার আপনার উপর
অর্পণ না করে। অতঃপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে। এবং হৃষ্টচিত্তে
তা মেনে নেয়।’
আল্লাহ
তাআলা এখানে শপথের দ্বারা দৃঢ় ভাবে ঐ ব্যক্তি থেকে ঈমানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন,
যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে বিচার চায় না এবং তাঁর হুকুমের প্রতি
সন্তুষ্ট থাকে না ও তা মেনেও নেয় না। অনুরূপভাবে তিনি সেই সব শাসকবর্গকেও কুফুরী, জুলুম
ও ফাসেকী প্রভৃতিতে ভূষিত করেছেন যারা আল্লাহর শরিয়ত অনুযায়ী হুকুম পরিচালনা করে না।
তিনি বলেন:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴿৪৪﴾سورة النساء
‘আল্লাহ
যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী যারা হুকুম দেয় না, তারাই কাফির’
وَمَنْ لَمْ
يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ﴿৪৫﴾سورة النساء
وَمَنْ لَمْ
يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ﴿৪৭﴾ سورة النساء
‘আল্লাহ
যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী যারা হুকুম দেয় না, তারাই যালিম।’
আল্লাহর
অবতারিত শরীয়ত অনুযায়ী হুকুম পরিচালনা করা এবং উলামাদের মধে ইজতেহাদী যতসব মতভেদ রয়েছে,
সকল ক্ষেত্রে হুকুমের জন্য আল্লাহর অবতারিত গ্রন্থের প্রতি প্রত্যাবর্তন করা অত্যাবশ্যক।
ইজতেহাদী
এ সকল মাসআলায় সেটিই গ্রহণযোগ্য হবে, যা হবে কুরআন ও সুন্নাহের মুওয়াফিক হতে তা তারা গ্রহণ করবে এবং যা এ-দু-ভয়ের
বিরোধী হবে কোন গোড়ামী ও পক্ষপাতিত্ব না করেই তা তারা প্রত্যাখ্যান করবে, বিশেষ করে
আক্বীদার ক্ষেত্রে। কেননা খোদ ইমামগণই এরূপ অসিয়ত করে গেছেন এবং এটাই ছিল তাদের সকলের
মত। অতএব এখন যারা তাদের সে মতের বিরোধিতা করবে, তারা তাঁদের অনুসারী হতে পারে না।
যদিও তারা তাঁদের প্রতি নিজেদেরকে সম্পর্কিত করে থাকে। এ ধরনের লোকদের ব্যাপারেই আল্লাহ
তাআলা বলেন:
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ ﴿৩১﴾ سورة التوبة
‘তারা
আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণকে সংসার-বিরাগী দেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং
মরিয়ম তনয় মাসীহকেও’
সুতরাং
আয়াতটি নাসারাদের সাথে খাস নয়। বরং যারাই তাদের অনুরূপ কাজ করবে তাদের সকলকেই আয়াতটি
শামিল করছে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশের বিরোধিতা করে মানুষের মধ্যে আল্লাহর
অবতীর্ণ হুকুম ব্যতীত অন্য আইন মোতাবেক ফয়সালা দেয়, অথবা তার প্রবৃত্তি ও ইচ্ছার বশবর্তী
হয়ে তা করে থাকে, সে মূলত: তার ঘাড় থেকে ইসলাম ও ঈমানের বন্ধন খুলে ফেলল। যদিও তার
ধারণা যে, সে মু’মিন। কেননা আল্লাহ তাআলা যারা এরূপ করতে চায় তাদের প্রতি স্বীকৃতি
জ্ঞাপন করেননি এবং তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। আয়াতে উল্লেখিত يزعمون শব্দটির ব্যবহার থেকে বুঝা যায়
যে, এ দ্বারা তাদের ঈমানকে মূলত: অস্বীকার করা হচ্ছে। কেননা يزعمون শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কথা ও
কাজে বিরোধপূর্ণ মিথ্যা দাবিদারদের জন্যই ব্যবহৃত হয়। এ ব্যাপারেটি নিম্ন বর্ণিত আয়াত
দ্বারা আরো সুস্পষ্ট হয়। এ ব্যাপারটি নিম্ন বর্ণিত আয়াত দ্বারা আরো সুস্পষ্ট হয়। আল্লাহ
তাআলা বলেন:
وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ ﴿৬০﴾ سورة النساء
‘অথচ
তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করা তাওহীদের একটি রুকন।
যেমন
সূরা বাকারার একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿২৫৬﴾سورة البقرة
‘ যে
তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে মূলত: এমন এক মযবুত রশি ধারণ করল
যা কখনো টুটবে না।’
যদি মু’মিনের
হৃদয়ে এ রুকনের অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সে একত্ববাদী নয়। বস্তুত্ব তাওহীদ হলো ঈমানের
ভিত্তি, যা থাকলে সকল আমল শুদ্ধ হয় এবং না থাকলে সকল আমল বরবাদ হয়ে যায়। নিম্ন বর্ণিত
আয়াতটিতে সে কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে।
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى
‘যে তাগুতকে
অস্বীকার করবে ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, সে মূলত: এমন এক মজবুত রশি ধারণ করল যা কখনো
টুটবে না।
কেননা
তাগুতের কাছে ফায়াসলার জন্য যাওয়া ও তার হুকুম মানা প্রকৃত পক্ষে তাগুতের প্রতি ঈমান
আনারই নামান্তর।
আল্লাহর
শরীয়ত অনুযায়ী যে ব্যক্তি ফয়সালা গ্রহণ করে না তার ঈমান না থাকাটাই প্রমাণ করে যে,
আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী হুকুম ও ফায়সালা প্রদান করাই হল ঈমান, আক্বীদা ও আল্লাহর ইবাদত।
এটা মেনে নেয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি। অন্য দিকে আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী হুকুম ও ফায়সালা শুধু এজন্য না দেয়া চাই যে, মানুষের জন্য এটাই সর্বাধিক উপযোগী
ও নিরাপত্তার সবচেয়ে বেশি নিশ্চয়তা প্রদানকারী।
কিছু লোক এ দিকটির উপর সম্পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করে এবং শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা দেয়া যে
ঈমান ও ইবাদাত, এ প্রথম দিকটি ভুলে যায়। অথচ আল্লাহ তাআলা নিজে এমন লোকদের সমালোচনা
করেছেন যারা তাঁর ইবাদাতের দিকটি বাদ দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে শরীয়ত অনুযায়ী
ফয়সালা গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا
دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُونَ
﴿৪৮﴾ وَإِنْ يَكُنْ لَهُمُ الْحَقُّ يَأْتُوا إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ ﴿৪৯﴾ سورة النور
‘তাদের
মধ্যে ফয়সালা করার জন্য যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন
তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর ‘হক’ তাদের পক্ষে হলে তারা বিনীতভাবে রাসূলের নিকট ছুটে
আসে’
তারা
তাদের প্রবৃত্তির ঈপ্সিত বস্তুর প্রতিই শুধু গুরুত্ব আরোপ করে এবং যা কিছু তাদের প্রবৃত্তির
বিপরীত, তা হতে তারা মুখ ফিরিয়ে রাখে। কেননা তারা মূলত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের কাছে ফয়সালার জন্য যাওয়ার জন্য যাওয়ার দ্বারা আল্লাহর ইবাদাত করে না।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment