আল-কোরআন : একটি মহা মুজিযা
ড:
সাইদ বিন আলি বিন ওয়াফ
অনুবাদ:
মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান
আল্লাহ তাআলার প্রশংসা এবং
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ ও সালামের পর।
হে আল্লাহর বান্দাবৃন্দ, মহান
আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- কে সত্যায়ন ও
সমর্থনকারী অসংখ্য মুজিযা দান করেছেন। সেগুলো তাঁর নবুওয়তকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ
করেছে।
আরবি পরিভাষায় মুজিযা বলা হয়,
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও চ্যালেঞ্জের সময় প্রতিপক্ষ যার উত্তর দিতে অপারগ হয়ে যায়।(কামূসুল
মুহিত)।
মুজিযা এমন এক আশ্চর্যজনক
জিনিস, যা সকল মানুষ সম্মিলিতভাবে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করলেও তার মত
আরেকটি জিনিস বানাতে সক্ষম নয়, আল্লাহ তাআলা নবুওয়তের জন্য যাকে নির্বাচন করেন
কেবল তাকেই তা দান করেন। যাতে সেটি তাঁর নবুওয়তের দলিল হয় এবং রিসালাতের সঠিকত্ব
প্রমাণিত হয়।
মহা গ্রন্থ আল-কোরআন নবী মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত কালাম। এটিই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ
মুজিযা যা সদা সর্বত্র বিদ্যমান, পূর্বের এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত পরের সব সময়ের
জন্য মুজিযা।(মানাহিলুল ইরফান ফি উলুমিল কোরআন ২২/১)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন:
«ما من الأنبياء نبيّ إلا أعطي من
الآيات على ما مثله آمن البشر، وإنما كان الذي أوتيته وحياً أوحاه الله إليّ،
فأرجو أن أكون أكثرهم تابعاً يوم القيامة»([1]).
প্রত্যেক
নবীকেই তার মত করে কোন না কোন মুজিযা দেয়া হয়েছে, তার উপর লোকেরা ঈমান এনেছে।
আর আমাকে যা দেয়া হয়েছে তা হল ওহী, আল্লাহ তাআলা আমার উপর প্রত্যাদেশ দিয়েছেন। আমি
আশা করি কেয়ামতের দিন তাদের চেয়ে আমার অনুসারী বেশি হবে।(বুখারি)
এই
হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য এই নয় যে কোরআনের মধ্যেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর মুজিযা সীমাবদ্ধ।
এটাও উদ্দেশ্য নয় যে, তাকে এমন
কোন মুজিযা দেয়া হয়নি যা র্স্পস করা যায়।
বরং উদ্দেশ্য হল কোরআনুল
কারিম এমন এক অভিনব মুজিযা যা কেবল তাকেই দেয়া হয়েছে আর কাউকে দেয়া হয়নি। কেননা
প্রত্যেক নবীকে এমন মুজিযা দেয়া হয়েছিল যা শুধু তার সাথেই খাছ ছিল, তার মাধ্যমে
যাদের নিকট তাকে পাঠানো হয়েছিল তাদেরকেই শুধু চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। প্রত্যেক নবীর মুজিযা তার জাতির অবস্থার সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। এ কারণে মূসা আ.-এর কওমের মধ্যে যখন যাদু বিদ্যা ছড়িয়ে পড়েছিল
তখন তিনি তাদের নিকট লাঠি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং লাঠির মাধ্যমে তাই বানাতে
লাগলেন, তারা যাদু দিয়ে যা বানাত। কিন্তু মূসা আ.-এর যাদু তারা যা বানাল তা খেয়ে
ফেলল। অর্থাৎ তার যাদু হুবহু তাদের যাদুর মত হল না।
যখন চিকিৎসা বিদ্যা খুবই
উন্নতি লাভ করল, তখন ঈসা আ. আবির্ভূত হলেন এমন চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে যা দেখে সে
সময়ের সকল চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ তিনি দেখালেন তার বিদ্য দিয়ে তিনি
মৃতকে জীবিত করতে পরছেন, কুষ্ঠ ও বধির রুগীকে সুস্থ করেত পারছেন।
আর কাজগুলোর ধরন তাদের কাজের
মতই ছিল কিন্তু তাদের ক্ষমতা ঈসার আ.-এর ক্ষমতার মত শক্তিশালী ও কার্যকর ছিল না।
আরবের লোকেরা যখন ভাষার
অলংকারের উচ্চ শিখরে পৌঁছে গেল তখন আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুজেযাস্বরূপ এমন কোরআন দিলেন, যার প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ
বলছেন,
لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ
বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না,
না সামনে থেকে, না পেছন থেকে। এটি প্রজ্ঞাময়, সপ্রশংসিতের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। (সূরা
হা-মীম আস্ সাজদাহ ৪২ আয়াত)
কিন্তু কোরআন বিষয়ক মুজিযা অন্য
সমস্ত মুজিযা থেকে আলাদা। এটি চলমান দলিল যুগ যুগ ধরে আবহমান থাকবে। অন্যান্য নবীদের
প্রমাণাদি তাদের যুগ শেষ হওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে। সে সম্পর্কে শুধু সংবাদই জানা
যায় বাস্তবে অবশিষ্ট তার কিছুই নেই। আর কোরআন এখনো প্রমাণ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে শ্রোতা
যেন এখনো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে শুনছে। আর চলমান থাকার
কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«فأرجو أن أكون أكثرهم تابعاً يومَ القيامة»([2]).
আমি আশা করি কেয়ামতের দিন সকলের চেয়ে
আমার অনুসারী বেশি হবে। (বিদায়া নিহায়া ২/৬৯)
কুরআনুল কারিম স্পষ্ট দলিল, এটি অনেক
দিক দিয়ে মুজিয: যেমন, শাব্দিক দিক দিয়ে। গাথুনির দিক দিয়ে। বালাগাতের দিক দিয়ে
অর্থাৎ শব্দ তার ব্যাপক অর্থের উপর দালালাত করার দিক দিয়ে। ঐ সমস্ত অর্থের দিক
দিয়েও মুজিয যার নির্দেশ আল্লাহ তাআলা করেছেন। এবং সেসব অর্থের বিবেচনায়ও যা
দ্বারা আল্লাহ তাআলা, তাঁর নাম ও গুণ সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছে।
কোরআনের
অলৌকিকত্বের আরও আছে তার ভাষার অলংকার, বর্ণনা ভঙ্গি ও বাক্য গঠন প্রণালী। সমস্ত
মানুষ ও জিনকে এসব বিষয় দ্বারা চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা এর মত রচনা করতে
অপারগ হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ
الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَ الْقُرْآَنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ
بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا ﴿88﴾
বল, যদি মানুষ ও জিন এ কোরআনের অনুরূপ
হাজির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাজির করতে পারেব না যদিও তারা
একে অপরের সাহায্যকারী হয়। ( সূরা বানী ইসরাইল, আয়াত: ৮৮)
أَمْ
يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَلْ لَا يُؤْمِنُونَ ﴿33﴾ فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ
مِثْلِهِ إِنْ كَانُوا صَادِقِينَ ﴿34﴾
তারা কি বলে, সে এটা বানিয়ে বলছে?
বরং তারা ঈমান আনে না। অতএব, তারা যদি সত্যবাদী হয় তবে তার অনুরূপ বানিয়ে নিয়ে
আসুক। (সূরা আত-তুর, আয়াত: ৩৩-৩৪)
এই চ্যালেঞ্জের পর অনেক দিন অতিবাহিত
হয়েছে তারা কেউ এগিয়ে আসেনি, তাদের রশি আরো ঢিল করে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
তোমরা এর মত দশটি সূরা নিয়ে আসো,
أَمْ
يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ
وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ﴿13﴾
নাকি তারা বলে, সে এটা রটনা করেছে?
বল, তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার
ডেকে আন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা হুদ ১৩ আয়াত)
তারা অপারগ হল আল্লাহ তাআলা তাদের
রশি আরও ঢিল করে দিয়ে বললেন:
أَمْ
يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ
اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ﴿38﴾
নাকি তারা বলে, সে তা বানিয়েছে? বল,
তবে তার মত একটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডাক, যদি তোমরা
সত্যবাদী হও। (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩৮)
মদিনায় হিজরতের পর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আবার চ্যালেঞ্জ করলেন:
وَإِنْ
كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ
مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ﴿23﴾ فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ
تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ ﴿24﴾
আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল
করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের
সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। অতএব যদি তোমরা তা না কর-আর কখোনা
তোমরা তা করবে না-তাহলে আগুনকে ভয় কর যার
জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য। (সূরা আল-বাকারা,
আয়াত: ২৩-২৪)
আল্লাহ তাআলার কথা فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ
تَفْعَلُواতোমরা অতীতে পারনি এবং ভবিষ্যতেও কখনো পারবে না, এর
মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ প্রমাণিত হয়ে গেছে। তারা পারবে না
কুরআনের সূরার মত একটি সূরা বানিয়ে আনতে পরবর্তী যুগেও। যেমন ইতিপূর্বে এর সংবাদ
দেয়া হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেছিলেন যখন তিনি মক্কায়
ছিলেন, তিনি বলেছিলেন:
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ
يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَ الْقُرْآَنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ
بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا ﴿88﴾
বল, যদি মানুষ ও জিন এ কোরআনের অনুরূপ
হাজির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাজির করতে পারবে না যদিও তারা
একে অপরের সাহায্যকারী হয় । ( সূরা বানী ইসরাইল, আয়াত: ৮৮)
আল্লাহ তাআলা রাসূলকে সাধারণভাবে
নির্দেশ করার কারণে তাঁর মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টিজীবকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সেখানে
তাদের অপারগতার কথা বলা হয়েছে এই বলে যে, এ কাজে তারা সকলে যদি একত্রিতও হয় এবং পরস্পর
সাহায্য সহযোগিতা করে তা সত্ত্বেও তারা পারবে না। এই চ্যালেঞ্জ সমস্ত সৃষ্টির জন্য।
যারা কুরআন শুনেছে ও বুঝেছে চাই বিশেষ লোক হোক বা সাধারণ লোক, রাসূলের নবুওয়ত
লাভের দিন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কেউ একটি মাত্র সূরাও তার
মত বানিয়ে নিয়ে আসতে পারেনি।
পবিত্র কোরআনে হাজার হাজার মুজিযা
রয়েছে। কেননা, তার সূরার সংখ্যা ১১৪টি। চ্যালেঞ্জতো দেয়া হয়েছে একটি সূরা দিয়ে।
তার সবচেয়ে ছোট সূরা হল, সূরা আল কাউসার। যার আয়াত সংখ্যা মাত্র তিনটি, আয়াত তিনটিও
অতি ছোট বটে। ছোট বড় মিলে কোরআনের আয়াত সংখ্যা মোট ছয় হাজার দুইশটি। এই হিসাবে
চ্যালেঞ্জ গণনা করলে কত হবে একবার চিন্তা করে দেখুন। এ জন্য কোরআনুল কারিম অন্য
সমস্ত মুজিযা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যে ব্যক্তি অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখবে এবং ভাল করে
শুনবে তার কাছে এ বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আল-কোরআন
মুজেয হওয়ার এটিও একটি দিক যে, এর মধ্যে অনেক অদৃশ্য-গায়েবের কথা আছে যার জ্ঞান
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছিল না। আর তাঁর মত মানুষের এগুলো জানারও
কোন রাস্তা ছিল না। এটাই প্রমাণ করে যে তা আল্লাহ তাআলার বাণী, বিষয়টি কারো নিকটই
অস্পষ্ট নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَعِنْدَهُ
مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ
وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي
ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ﴿59﴾
আর
তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি অবগত
রয়েছেন স্থলে ও সমুদ্রে যা কিছু আছে। আর কোন পাতা ঝরে না, কিন্তু তিনি তা জানেন এবং
যমিনের অন্ধকারে কোন দানা পড়ে না, না কোন ভিজা এবং না কোন শুস্ক; কিন্তু রয়েছে
সুস্পষ্ট কিতাবে। (সুরা আনআম, আয়াত: ৫৯)
গায়েব সম্পর্কে সংবাদের অনেকগুলো
প্রকার রয়েছে:
অতীতের অদৃশ্য সংবাদ, যা সুন্দর
সুন্দর ঘটনাবলীর মধ্যে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ অতীত সম্পর্কে রাসূলকে সংবাদ দিয়েছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের বর্তমানকালীন অদৃশ্যের সংবাদ: যেমন, মুনাফিকদের ভেতরগত অবস্থা, এ সম্বন্ধে
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূলকে অবগত করতেন। সেসব ভুলচুক মুসলমানগণ মাঝে-মধ্যে যাতে
জড়িয়ে যেতেন আর মহান আল্লাহ সে বিষয়ে রাসূলকে জানিয়ে দিতেন। এছাড়া আরো অনেক বিষয়
যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানতেন না, তিনি সেসব বিষয়ে রাসূলকে অবগত করতেন।
গায়েবের আরেকটি দিক, ভবিষ্যতে
সংঘটিতব্য অদৃশ্য বিষয়াবলীর সংবাদ। আল্লাহ তাআলা সেসব বিষয়াদি সম্বন্ধেও তাঁর
রাসূলকে জানিয়ে দিতেন। তিনি যেভাবে সংবাদ দিতেন পরে তা সেভাবে সঙ্ঘটিত হত। এই
বিষয়গুলো এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, পবিত্র কুরআন আল্লাহ তাআলার কালাম, আর
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল।
কুরআনুল কারিমের অলৌকিকত্বের মধ্যে
শরিয়তের বিধান বিষয়ক অলৌকিকত্বও আছে: কোরআনুল কারিম পরিপূর্ণ হেদায়েত ও দিক-নির্দেশনা
নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। সর্ব যুগের সর্বস্থানে সকল শ্রেণীর মানুষের সকল প্রয়োজন পূরণ
করার যাবতীয় দিক নির্দেশনা রয়েছে তাতে। কেননা, যিনি অবতীর্ণ করেছেন তিনি মানবকুলের
যাবতীয় প্রয়োজন, সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। তিনি সকলের
সৃষ্টিকর্তা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা, কিসে তাদের কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ সে বিষয়ে
পরিপূর্ণরূপে জানেন। সুতরাং যখন কোনো বিধান তাঁর পক্ষ থেকে এসেছে তা পূর্ণ প্রজ্ঞা
ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এসেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ
وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ ﴿14﴾
যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন
না? অথচ তিনি অতি সূক্ষ্মদর্শী, পূর্ণ অবহিত। (সূরা মুলক ১৪ আয়াত)
মানব প্রণীত আইন কানুনের দিকে দৃষ্টি
দিলে এ বিষয়টি আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে যায়। সে আইন কানুন মানুষের সমস্যার সমাধান করতে
পারে না এবং সর্ব যুগে বা স্থানে চলে না। যার কারণে তার প্রণয়নকারীরা সব সময় তার
মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন ও বাড়াতে কমাতে থাকে। গতকালের বানানো আইন আজ অচল, আজকের
প্রণীতটি আগামীকাল অকেজো এ হচ্ছে মানব রচিত আইনের অবস্থা। তার কারণ মানুষের মধ্যে ভুল-ত্রুটি-অজ্ঞতা
রয়েছে, তারা জানেনা কাল পৃথিবীর মধ্যে কি পরিবর্তন আসবে, কোথায় কোন কোন জিনিস
তাদের উপযোগী হবে। আর কোন কোনটি অনুপযোগী হবে।
আর এটাই হল মানুষের অপারগ হওয়ার
প্রকাশ্য দলিল, তারা এমন অইন বানাতে পারে না যা সকল মানুষের জন্য উপযোগী ও
প্রযোজ্য হবে এবং তাদের স্বভাব-চরিত্রকে শুধরাবে। অপর দিকে পবিত্র কোরআন সর্ব
প্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত, মানুষের স্বার্থ রক্ষার জিম্মাদার। তাদেরকে ইহকাল ও পরকালের যুগপৎ কল্যাণের দিকেই
পথ প্রদর্শন করে। মানুষ যদি সর্বতোভাবে কোরআনকে আঁকড়ে ধরে এবং কোরআনের হেদায়েতের
উপর চলে তাহলে তাদের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সুনিশ্চিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ
هَذَا الْقُرْآَنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ
الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا ﴿9﴾
নিশ্চয় এ কুরআন এমন একটি পথ দেখায় যা
সবচেয়ে সরল এবং যে মুমিনগণ নেক আমল করে তাদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে
মহা পুরুস্কার। (সূরা বনী ইসরাইল ৯ আয়াত)
মোট কথা আল্লাহ তাআলার কিতাব যেসব
শরয়ি বিধি-বিধান দিয়েছে, তার ভিত্তি তিনটি উপকরণের উপর:
প্রথম উপকরণ, ছয়টি জিনিসের উপর থেকে
অনিষ্ট দূর করা: সত্বা, জ্ঞান, ধর্ম, বংশ, সম্মান, সম্পদ হিফাযত করা।
দ্বিতীয় উপকরণ, উপকার খুঁজে বের করা।
কোরআনুল কারিম সব কিছু থেকে উপকার বের করে আনার দরজা খোলা রেখেছে আর ঐ সব রাস্তা
বন্ধ করে দিয়েছে যা ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।
তৃতীয় উপকরণ, উত্তম চরিত্রের উপর চলা
এবং ভাল অভ্যাস গড়ে তোলা।
কোরআনুল কারিম ঐ সমস্ত আন্তর্জাতিক
সমস্যার সমাধান করেছে যা সমস্ত মানুষ করতে অপারগ হয়েছে।
দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের প্রয়োজন
হবে আর কোরআন তার জন্য নিয়ম-নীতি বলেনি এমনটি কোনো ক্ষেত্রেই হয়নি। বরং আল কোরআন
মানুষের জন্য সেসব প্রয়োজনের সবচেয়ে উপযোগী ও সর্বাধিক সুন্দর পদ্ধতি বলে দিয়েছে।
কোরআনের অলৌকিকত্বের মধ্যে বর্তমান
যুগের আধুনিক বিজ্ঞানের অলৌকিকত্বও রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
سَنُرِيهِمْ
آَيَاتِنَا فِي الْآَفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ
الْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ﴿53﴾
বিশ্বজগতে ও তাদের নিজেদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার
নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে এটি (কোরআন) সত্য; তোমার রবের
জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কি যে, তিনি সকল বিষয়ে সাক্ষী? (সূরা হা-মীম আস সাজদা আয়াত: ৫৩)।
অনেক পরে এসে আমাদের রবের পক্ষ থেকে এ অঙ্গীকারও পূর্ণ
হয়েছে, মানুষ সৃষ্টি জীবের মধ্যে সূক্ষ্ম যন্ত্র দ্বারা আল্লাহর নিদর্শন দেখতে
পেরেছে। যেমন উড়োজাহাজ, সাবমেরিন ইত্যাদি সূক্ষ্ম যন্ত্র, যেগুলোর মালিক হয়েছে মানুষ
মাত্র কিছুদিন আগে।
এ সমস্ত অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে ১৪৩০ বছর পূর্বে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কে সংবাদ দিয়েছিল? আল-কোরআন আল্লাহর কালাম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সত্য রাসূল এটা তার প্রকৃষ্ট দলিল। আর এই বৈজ্ঞানিক
অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হয়েছে পৃথিবীতে, আকাশে, সমুদ্রে, মানুষের মধ্যে, জিব-জন্তুতে, বৃক্ষ
তরুলতাতে পোকা মাকড় ইত্যাদিতে। সব উদাহরণ দিতে গেলে এখানে জায়গা সংকুলান হবে না।
সর্বশেষ কোরআনের সেই বিখ্যাত আয়াতকে স্মরণ করেই লেখার
ইতি টানছি যাতে মহান আল্লাহ দাবি করে বলেছেন, জিন-ইনসান সকলে মিলে চেষ্টা করলেও এই
কোরআনের অনুরূপ বানাতে পারবে না। ইরশাদ হচ্ছে,
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ
يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَ الْقُرْآَنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ
بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا ﴿88﴾
বল, যদি মানুষ ও জিন এ কোরআনের অনুরূপ
হাজির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাজির করতে পারেব না যদিও তারা
একে অপরের সাহায্যকারী হয়। ( সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৮৮)
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment