দর্শক সংখ্যা

Friday, February 22, 2013

সন্তানের লালন-পালন ও তালীম-তরবিয়ত ইসলামিক দৃষ্টিকোণ- ৩

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : ভালোমন্দ নির্ণায়ক শৈশব এটা হলো শিশুর ষষ্ঠ বা সপ্তম বছর থেকে শুরু করে বয়োঃপ্রাপ্তি অথবা তার বয়স পনের বছর হওয়া পর্যন্ত বয়োঃস্তর। শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এ দুই- দুইটি স্তরই এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যা সর্বসাকুল্যে অনধিক নয়টি বছর। এটা একটা দীর্ঘ সময়, যার শুরুটা সংযুক্ত থাকে অবুঝ শৈশব স্তরের সঙ্গে, আর শেষটা পৌরুষ স্তরের সঙ্গে। সুতরাং এ স্তরটা এখান থেকে কিছু এবং ওখান থেকেও কিছু গ্রহণ করে। অতএব সে প্রথমিক শৈশব জীবন ত্যাগ করেছে বটে কিন্তু এখনো পূর্ণাঙ্গ পৌরুষে পৌঁছতে পারেনি। ইবনুল কাইয়িম রহ. শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের স্তরবিন্যাস প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘শিশুর বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে তার বুদ্ধি ও বিবেচনারও বিকাশ সাধিত হয়ে তা ভালোমন্দ নির্ণায়ক বয়স পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে এর জন্য কোন নির্ধারিত বয়স নেই, বরং কোন মানুষতো পাঁচ বছর বয়সেও ভালোমন্দ নির্ণয় করতে শিখে ফেলে। মাহমুদ বিন রাবি’ র. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পানির ছিটা দেয়ার মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হয়ে ছিলাম- যা তাদের কূপের কাছে রাখা বালতি থেকে তিনি আমার মুখে নিক্ষেপ করে ছিলেন। অথচ আমার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। আর সে কারণেই শিশুর পাঁচ বছর বয়সকে শ্রবণের তীক্ষèতার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ বা আবার এর চেয়ে কম বয়সেও ভালোমন্দ নির্ণয় করতে শিখে ফেলে। নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য ঘটনা বহুদিন পর্যন্ত স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে
; অথচ সেগুলো সংঘটিত হয়েছে যখন তার বয়স পাঁচ বছরেরও নীচে। তবে যখন তার বয়স সাত বছর পূর্ণ হয়ে গেল তখনতো সে রীতিমত ভালোমন্দ নির্ণায়ক বয়সে অনুপ্রবেশ করল। নামাজের জন্য নির্দেশ প্রাপ্তির অন্তর্ভুক্ত হলো। সুতরাং এরপর যখন তার বয়স দশ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে তখন তার শক্তি-সামর্থ, বুদ্ধিমত্ত্বা ও এবাদত করার সামর্থও বৃদ্ধি পাবে। ফলে তাকে নামাজ পরিত্যাগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ অনুযায়ী প্রহার করতে বলা হয়েছে। তবে এই প্রহারটা হতে হবে কেবল শিষ্টাচার শিক্ষাদান ও নামাজের অনুশীলনের লক্ষ্যে। দশ বছর পূর্ণ হয়ে গেলে তো এক নতুন অবস্থার সূচনা হবে, তখন থেকে তার বিবেচনা ও জ্ঞান পরিপক্ক হতে থাকবে। সে কারণে অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম এ অবস্থায়ই তার ওপর ঈমান গ্রহণ আবশ্যক করেছেনÑ যা পরিত্যগে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। এটা আমার শ্রদ্ধেয় পিতা ও অন্যদের পছন্দনীয় মত, এবং তা খুবই শক্তিশালী অভিমত। যদিও বিস্তারিত অনুশাসনের ক্ষেত্রে শিশুর থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ সৃষ্টিকর্তার পরিচিতি, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি ও তাঁর নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাসের হাতিয়ার তো তাকে প্রদান করা হয়েছেই। সে তার নিজের মতো করে দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রমাণ দিতে সক্ষম, যেমনিভাবে সে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা ও পার্থিব উন্নতি বুঝতে সক্ষম। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে কুফরীর ক্ষেত্রে তার কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান স্থাপনের প্রমাণগুলো তার আহরিত সকল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে অনেক অনেক দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্ট। এছাড়া বয়োঃপ্রাপ্তির পূর্বে পৃথিবীতে তার ওপর অন্য কোন বিধান অবর্তিত হবে না। এর অর্থ এই নয় যে, পরকালেও তার ওপর কোন বিধান আরোপিত হবে না। এ অভিমতটি ইমাম আবু হানিফা রহ. ও তাঁর সঙ্গিদের থেকে সংরক্ষিত, তবে এটা অত্যন্ত শক্তিশালী মত। এরপর দশ বছর থেকে বয়োঃসন্ধিক্ষণ পর্যন্ত তাকে বলা হবে কিশোর ও স্বপ্নদোষের নিকটবর্র্র্র্র্র্র্র্তী।
 
প্রথম অধ্যায় :  
বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি এই বয়সটা পূর্বের সকল বয়োঃস্তরের তুলনায় অসংখ্য অনন্য বৈশিষ্ট্য ও নান্দনিক গুণাবলির অধিকারী। যার মধ্য হতে কয়েকটি গুণাবলি সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো : ভালোমন্দ নির্ণয় এর অর্থ হলো শিশুর এক প্রকারের অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তা যার মাধ্যমে বস্তুসমষ্টির মধ্যে সে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে। পার্থক্য করতে পারবে তার মধ্য হতে কোনটা তার জন্য ক্ষতিকর আর কোনটা উপকারী। সে ধীর-স্থীরভাবে নিজের আহার্য গ্রহণ করতে পারবে। যেমনিভাবে সে জানে কিভাবে একা পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। অন্যান্য সকল কর্মকাণ্ড ও তার ওপর আবর্তিত ফলাফল- এ সবই সে বুঝতে পারে। তবে তার এই বিবেচনা শক্তি প্রাপ্ত বয়স্কদের (যারা বিবেক-বুদ্ধিতে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে) বিবেচনা শক্তির সমকক্ষ নয়। সে বক্তব্য অনুধাবন করে তার উত্তর দিতে পারে। যখন জ্ঞানীদের কাব্যগাঁথা আলোচনা করা হয় তখন সে ওটা বুঝতে পারে ও তার সুন্দর করে উত্তরও দিতে সক্ষম হয়ে থাকে। শিশুর বিবেচনা ও ভালোমন্দ নির্র্ণয়ের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ও পরিপক্ক ও তার অনুভূতি সম্প্রসারিত হতে থাকে বিবেচনার প্রথম স্তর থেকে মধ্যম স্তর ও সেখান থেকে শেষ স্তর পর্যন্ত। এমনি করে এক সময় শিশুর কাছে যুক্তিপূর্ণ গবেষণার দ্বার উম্মোচিত হয়ে যাবে। ঘটনা প্রবাহ ও তার কার্যকারণসমূহের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যাবে। যেমনিভাবে বস্তুসমূহের মধ্যে লুক্কায়িত সম্পর্ক উদঘাটিত হওয়ার মাধ্যমে তার সামর্থের বিকাশ ও নতুন গবেষণা উপস্থাপনের সক্ষমতা সূচিত হয়। কিন্তু সেটাও আদিষ্ট ব্যক্তিদের তুলনায় অসম্পূর্ণ ; চাই সেটা বুদ্ধিগত ক্ষমতা বা অর্জিত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই হোক না কেন। এই বিবেচনাসম্পন্ন শিশুর ওপর (সে একজন বিচক্ষণ শিশু হিসেবে) ফিকাহ শাস্ত্রে অনেক আদেশ নিষেধ আরোপিত হয়েছে। সকল মায্হাবের ফুক্বাহায়ে কেরাম ফেক্বাহ শাস্ত্রের অধিকাংশ অধ্যায়ে শধু বিবেচনাসম্পন্ন শিশুর হুকুম আহ্কাম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আপনি দেখতে পাবেন : বিবেচক শিশুর ইসলাম গ্রহণ, ধর্মান্তরিত হওয়া, তার নেতৃত্ব, তার ইমামতে জুমআ’র নামাজ অনুষ্ঠান, রমজান মাসের আগমন সম্পর্কে তার সাক্ষ্য গ্রহণ, শপথ ও অন্তিম উপদেশের (ওছিয়ত) কার্যকারিতা ও ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি; এ জাতীয় অসংখ্য হুকুম সম্পর্কে তারা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। যা এই বয়োঃস্তরের অসামান্য গুরুত্বেরই পরিচায়ক। এটা পূর্ববর্তী সকল বয়োঃস্তর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এক্ষেত্রে আদিষ্ট হওয়ার দিক থেকে শিশুদের সংরক্ষণ ও পরিচর্যায় অত্যাধিক গুরুত্বারোপের দায়িত্বটা অভিভাবকদের ওপর গিয়ে বর্তায়। যেহেতু তার কর্মকাণ্ডের ওপর শরিয়তে হুকুম আবর্তিত হয়। নির্দেশনা ও প্রতিপালনের উৎস সমূহের প্রকরণ একটি শিশুর এই বয়োঃস্তরে এসে গৃহের বাহিরে যাওয়ার প্রবণতা বেশ বৃদ্ধি পায়। বহিরাগত প্রভাব বিস্তারকারীর ভূমিকা বিকাশ লাভ ও তার ওপর ক্রিয়াশীল হতে আরম্ভ করে। সুতরাং অভিভাবক বা শিক্ষকের ভূমিকা-প্রভাব শিশুর যতœ ও প্রতিপালনে প্রতিফলিত হবে এটাতো নিয়মের কথা। যেমনিভাবে শিক্ষা কারিকুলামের প্রভাব তার প্রদত্ত তথ্যের মাধ্যমে শিশুদের ওপর পড়ে থাকে। আরো প্রতিফলিত হয় সহপাঠিদের সঙ্গে সংশ্রব, চলার পথ ও প্রতিবেশীর প্রভাব, যখন এই উৎসমূলগুলোর বিভিন্ন প্রকরণ হবে এবং তার তৎপরতা থাকবে পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে। সেক্ষেত্রে বাবা-মা ও শিক্ষকবৃন্দ সকলের কর্তব্য হলো সেই বিষয়গুলো খুঁজে বের করা ও উত্তমরূপে তাকে রক্ষার চেষ্টা করা। তাকে পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে যে, সে অভিভাবককে না জানিয়ে সহপাঠী বা তার সমবয়সী কারো কথা বা কাজের কখনো যেন অনুসরণ না করে। সে যাকে চিনে না এমন লোকের অনুসরণ থেকেও তাকে সতর্ক করতে হবে। যদি তারা তাকে একথাও বলে, ‘আমরা তোমার বাবার বন্ধু’ অথবা এজাতীয় অন্য কোন কথা। অপরিচিত লোকের সঙ্গে প্রাইভেটকারে আরোহণ ও তাদের সঙ্গ দেয়া হতেও তাকে সতর্ক করতে হবে। এমন কি যদি তারা একথাও বলে, ‘আমরা তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেবো।’ যেমনিভাবে শিশুর থেকে প্রকাশিত প্রতিটি নতুন আচরণকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অভিভাবককে অনুসন্ধান করে জানতে হবে এটা কোত্থেকে আসতে পারে বা শিশু কোত্থেকে অর্জন করতে পারে। অতঃপর আচরণটা যদি সুন্দর হয় তাহলে তাকে ধন্যবাদ দেবে। আর যদি এর বিপরীত হয় তাহলে ধীর-স্থিরভাবে পথ চলবে ও তার সাথে বহিরাগত উৎসের প্রভাবও কমিয়ে দিতে হবে। এ প্রেক্ষিতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ হলো; বাবাকে প্রথম থেকেই একটি এমন বিদ্যালয় সন্ধানে সচেষ্ট হতে হবে যেখান থেকে তার সন্তানের সুষ্ঠ ও সঠিক বিকাশ ঘটতে পারে। এমনিভাবে বসবাসের জন্য ভালো এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রচেষ্টা থাকতে হবে। কারণ এলাকার অধিবাসীই হবে তার প্রতিবেশী। তাদের সন্তানরা হবে তার সন্তানের বন্ধু-বান্ধব।  
অনুভূতির উম্মেষ ও তার বিকাশ একটি শিশু এই বয়সে পৌঁছলে তার অনুভূতি জাগ্রত হয় ও উপলব্ধি শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সে সময়কেও অনুধাবন করতে সক্ষম হবে যেমনিভাবে পার্থক্য করতে পারবে ডান হাত ও বাম হাতের মধ্যে। মুয়ায বিন আব্দুল্লাহ বিন খুবাইব জুহানী রা. তার স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, ‘শিশুরা কখন নামাজ পড়বে?’ উত্তরে তিনি (স্ত্রী) বললেন, ‘আমাদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি রয়েছেন যিনি বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যদি শিশু ডান বাম চিনতে পারে তাহলে তাকে আদেশ কর!’ শিশুর উপলব্ধি একের পর এক বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে এই বয়োঃস্তরের মাঝখানে ও শেষের দিকে। উপরোন্তু শিশুর নিকট প্রমাণ পেশ ও তার প্রয়োগ বুঝা, কোন প্রমাণবিহীন বিষয় অগ্রাহ্য করা, এবং জ্ঞাত তথ্যসমূহের মধ্যে ভুলত্র“টি ও বিরোধ উদ্ঘাটন করার মত সামর্থ সৃষ্টি হবে। সে কারণেই শিশুর সামর্থকে শুধুমাত্র গবেষণার ওপর ছেড়ে দিয়ে তার ব্যাপারে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা যে, ‘সে এই স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে অসমর্থ’ এটা উচিত নয়। কারণ কোন কোন শিশুতো এমনও আছে যাদের নিকট বহু পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। বরং কখনো সে এমন প্রশ্নও করে বসে থাকবে, যা দেখে তার চেয়ে বয়সে যারা অনেক বড় তারা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে যায় অথবা উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এ বয়সে শিশুর নিকট বহু প্রশ্ন দানা বাঁধতে থাকে যা ইতিপুর্বে কখনো তার মধ্যে উদয় হয়নি। কিন্তু অভিভাবকের নিকট যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকে তাহলে সে কি করবে? এক্ষেত্রে কোন কোন অভিভাবককে দেখা যায় যে, দায়সারাভাবে একটা উত্তর দিয়ে দেয় অথচ সে জানে যে এটা অশুদ্ধ। আবার কোন অভিভাবক উত্তর দিয়ে থাকেন বটে অথচ সে নিজেও জানে না যে, তার উত্তরটি শুদ্ধ না অশুদ্ধ। আবার কেউ বা শিশু অথবা ঘরে অথবা শ্রেণী কক্ষের অন্য কারো সঙ্গে কোন সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন ; যাতে শিশুটি প্রশ্ন করা থেকে বিরত ও নতুন তৎপরতা থেকে নিবৃত্ত থাকে। আবার কেউ বলেন, আমি ক্লান্ত, কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন করো ! এই আশায় যে, পরে শিশু এটা ভুলে যাবে। অথচ এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকের যে পথ অবলম্বন করা উচিত তা হলো, এই উত্তরটি দিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেন ; যেন তিনি বলবেন: ‘এটা একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রশ্ন, আমি তোমার ভাইদের কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করে দেখতে চাই যে, কে এর সঠিক উত্তর দিতে পারে।’ তখন যে কোন সন্তান বা শিক্ষার্থীর কথাই হয়ত বা বিশুদ্ধ উত্তরের পথ পরিষ্কার করে দিতে পারে। উপরোন্তু অভিভাবকের জন্য এরকম ঘোষণা দেয়াও সম্ভব হবে যে, তিনি তার সন্তানদের উত্তর খুঁজে বের করার জন্য একদিন অথবা সমপরিমাণ সুযোগ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সঠিক উত্তর দাতার জন্য পুরস্কারও নির্ধারণ করে দিতে পারেন। এটা হলো একটি উৎকৃষ্ট পন্থা যা অভিভাবকের জন্য উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে। কখনো ‘প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর একজন মহাজ্ঞানী রয়েছে’ শিশুকে শিক্ষা দেয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে এই পন্থা। সাধারণত মানুষের জ্ঞান বিভিন্ন শ্রেণীর হয়ে থাকে। মানুষকে জ্ঞান দান করা হলেও তার পক্ষে সর্ববিষয়ে পূর্ণ মাত্রায় জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়। না জেনে থাকলে ‘আমি জানি না’ এ কথা বলা তার কর্তব্য। তবে কখনোই ত্র“টিপূর্ণ উত্তর দেওয়া উচিত হবে না। সতরাং এর দ্বারা তারা উত্তম আচরণ অবলম্বনের প্রতি শিশুরা উৎসাহ পেয়ে থাকবে। এ জাতীয় বিষয়গুলো অভিভাবকের জন্য অবলম্বন করা কর্তব্য। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে ‘আমি জানি না’ বলা জ্ঞানের এক তৃতীয়াংশের সমান। কেনই বা হবে না মুসলিম বিদগ্ধ ওলামাগণ যে বিষয় জানতেন না সেক্ষেত্রে ‘আমি জানি না’ কথাটি বলতে কখনোই তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। এ বিষয়ের ওপর অসংখ্য প্রসিদ্ধ ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে অভিভাবক চাইলে সেখান থেকে তার ইচ্ছামত সংগ্রহ করতে পারেন। একজন হিতৈষী অভিভাবক হচ্ছেন তিনিই, যে এই বিকল্পসমূহ থেকে উপযুক্তটা নির্বাচন করতে সক্ষম যা শিক্ষার্থীর অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু যদি অভিভাবকের নিকট উত্তরটি জানা থাকে বটে কিন্তু বিষয়টি স্পর্শকাতর, এছাড়া উত্তর দানে অন্য কোন অন্তরায় নেই। যেমন : প্রশ্নটা এমন বিষয় নিয়ে যা নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট। এমতাবস্থায় একজন অভিভাবক কি করবেন? এক্ষেত্রে একাধিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এখানে কয়েকটি বিষয় এমন রয়েছে যা অভিভাবক কোন ক্রমেই উপেক্ষা করতে পারবেন না। তা হলো- ক্স অভিভাবক কর্তৃক অশুদ্ধ উত্তরদান পরিহার করা। ক্স শিশুকে এ জাতীয় প্রশ্ন করার জন্য তিরস্কার করা হতে বিরত থাকা। ক্স উত্তর দানে কালক্ষেপণ পরিহার করা, বিশেষ করে যখন দেখবেন যে, প্রশ্নটা শিশুর চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করছে। কারণ, সে তখন এর উত্তর খুঁজতে যে এর উত্তর দিতে সক্ষম তার নিকটই যাবে। তার অন্য পথ খুঁজে নেয়া যার শুদ্ধাশুদ্ধতা আপনার জানা নেই, তার চেয়ে বরং প্রশ্নের উত্তরটা আপনার নিজের পক্ষ থেকে দেয়াই উত্তম। এক্ষেত্রে অন্যতম উপকারী বিষয় হলো অভিভাবক ক্ষুদ্র অথচ অর্থবহ বাক্য দ্বারা উত্তর দানে ক্ষান্ত করবে। ব্যাখ্যা ব্যাতিরেকে তার বিষয় বস্তু থাকতে হবে সংক্ষিপ্ত। যেমনিভাবে ইঙ্গিত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যার উল্লেখ করা অশোভন মনে করা হয়েছে আল কুরআন ও হাদীস শরীফে, সেক্ষেত্রে অসংখ্য ইঙ্গিতসূচক বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা সঙ্গমকে مباشرة (সহবাস) শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করেছেন। যেমন : আল্লাহ তাআ’লার বাণী- ولاتُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ . (البقرة-১৮৭) ‘তোমরা মসজিদে ইতিক্বাফ অবস্থায় তাদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ো না।’ আবার কখনো رفث শব্দ দ্বারা সঙ্গমের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তার বাণী- أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ. (البقرة-১৮৭) ‘সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে।’ হাদীস শরীফের মধ্যেও এ সংক্রান্ত অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। উল্লেখিত উপস্থাপনযোগ্য বিষয়ের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হলো আল-কুরআনুল কারীমের একটি আয়াত অথবা একটি হাদীস শরীফের মাধ্যমে উত্তর প্রদান।
 সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন : শিশুর ঘর থেকে বারংবার বেরিয়ে মসজিদ কিংবা বিদ্যালয় গমনের ফলে ঐ সকল স্থানসমূহে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সংশ্রব শিশুর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের সূচনা করবে যা পূর্বের সম্পর্কের চেয়ে ব্যাপকতর (যা সীমাবদ্ধ ছিল তার ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে)। সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব স্থাপনের উৎসাহ, তদসংশ্লিষ্ট ফলাফল, তাদের দ্বারা অভিভূত হওয়া, তাদের প্রতি নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও ব্যক্তিগত মতামত অথবা সাক্ষাৎকার আদান প্রদানের প্রতিক্রিয়া শিশু থেকে প্রকাশ পাবে। এ জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে কখনোই বারণ করা উচিত নয়, বরং তাকে অনুপ্রেরণা ও সাহস যোগাবে। এমনিভাবে সে সমাজের মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহার শিখতে সক্ষম হবে। অদূর ভবিষ্যতে সে একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে। সুতরাং এ বিষয়ে তাকে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু অভিভাবককে শিশুর বন্ধুদের যতœ ও পরিচর্য়ার ধরন সম্পর্কে অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ শিশুর এ বয়োঃস্তরে এগুলোরও একটা ভূমিকা রয়েছে। যাতে তার বিচারিক অনুভূতি অথবা শিশুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের সীমা অতিক্রম করে যেতে না পারে। কারণ সে কিছু সময় ধরে যে কথা/কর্মটি পর্যবেক্ষণ করছিল সে দিকেই সে ফিরে যাবে। বিশেষ করে যদি তার কোন সহপাঠি অথবা বন্ধু থেকে তা প্রকাশ পায়। এই জন্যই বিদগ্ধজনেরা বলেছেন: সঙ্গী হলো প্রবল আকর্ষণকারী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য এর থেকে আরো সূস্পষ্ট। ‘মানুষ তার বন্ধুর আচার আচরণের ওপর গড়ে উঠে। অতএব তোমাদের কেউ বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চাইলে লক্ষ্য করতে হবে সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে ?’
 দ্বিতীয় অধ্যায় :
 অন্তরায় ও সমস্যাবলী এই বয়োঃস্তরে এসে অভিভাবক যে অন্তরায় ও সমস্যাবলীর সম্মুখীন হবে তার সিংহভাগই পূর্ব বয়োঃস্তরে সৃষ্ট সমস্যার অনুরূপ। অভিভাবক যদি একটু ভালো করে সমস্যাগুলো নিরসন ও পরাস্ত করার চেষ্টা করেন তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় শিশুর বয়সের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই সমস্যাও দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এই বয়োঃস্তরে এসে ভিন্ন আঙ্গিকের কিছু অন্তরায় ও সমস্যাবলী পরিলক্ষিত হয়ে থাকবে যা ইতিপূর্বে প্রকাশ পায়নি ও যেগুলো বহিরাগত সমাজ সংশ্রবের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে সামগ্রিকভাবে সর্বাপেক্ষা বিপদজনক হলো, দুষ্ট সাহচর্য। যার ওপর ভর করে অনেক মন্দ আচরণ শিশুর ওপর আপতিত হতে পারে। যেমন : ধুমপান করা, পর্ণ ম্যাগাজিন, ভিডিও ক্যাসেট, চরিত্র বিধ্বংসী সিডি অথবা কাটপিস ফিল্ম ইত্যাদি হস্তগত হওয়া। এ প্রেক্ষিতে একজন অভিভাবকের কর্তব্য, নিজ সন্তান অথবা যার পরিচর্যা ও প্রতিপালন তিনি করতে চান তাকে এমন একজন মানুষের সন্ধান দিতে হবে যার সাহচর্য শুধুমাত্র কল্যাণের দিকেই ধাবিত করে থাকে। তার নিকট স্পষ্ট করতে হবে যে এছাড়া অন্য সাহচর্যে কোন উপকারিতা নেই। বরং তা কেবল অকল্যাণ ও ব্যর্থতাই টেনে আনতে পারবে। এক্ষেত্রে তার সামনে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করবে ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী উল্লেখ করবে- ‘মুমিন ভিন্ন কারো সাহচর্য গ্রহণ করো না।’ এরপর খুব কাছ থেকে তার ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করবেন। ফলে তিনি এ বিষয় বিচক্ষণতা লাভ করতে সক্ষম হবেন। অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত শিশু যেন তার বন্ধুদের কাছ থেকে কোন বই, পত্রিকা অথবা ক্যাসেট ইত্যাদি ধার না নেয়। এ বিষয়টা তিনি খুব সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে থাকবেন। শিশু যে স্কুলে বিদ্যা আহরণ করছে পিতার জন্য একাধিক বার সেই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও শিক্ষকবৃন্দের নিকট তার সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা উচিত। তখন শিশু সন্তানটি তাকে যেন স্কুলে দেখতে পায় সে ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকতে হবে যাতে করে সে বুঝতে পারে তার বাবা তাকে পর্যবেক্ষণ ও তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। ফলশ্র“তিতে এটা তাকে সঠিক পথে চলতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে শিশুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি অবশ্যই পরিহার করে চলতে হবে বরং কেবলমাত্র তার আচরণ সুসংহত ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে তার আচরণ অবগতির জন্যই এ প্রয়াস। কারণ গোয়েন্দাগিরি একটা নিন্দনীয় চরিত্র যা থেকে আল্লাহ তাআ’লা নিষেধ করেছেন। আর শরিয়ত যে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তার মধ্যে কোন কল্যাণ অথবা উপকারিতা থাকতে পারে না। বরং তা মানব সমাজের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বিষয়। অতএব শিশুর অনুপস্থিতিতে তার স্কুল ব্যাগ খোলার পরিবর্তে গৃহে প্রত্যবর্তনের পর সে যখন তার ভাই-বোনদের থেকে দূরে থাকে, আপনি তাকে সরাসরি বলতে পারেন- ‘তোমার স্কুল ব্যাগটি খোলো। এর মধ্যে কি আছে আমাকে দেখাও! এটা শুধু তখনই প্রয়োগ করবে যখন শিশুর পরিচর্যা ও প্রতিপালনের জন্য অগত্যা এর প্রয়োজন পড়বে। বরং আপনি যদি তার বন্ধুদের থেকে যে ম্যাগাজিন ও গল্পগুলো ধার এনেছে সে সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করেন; তাহলে অবশ্যই সে সত্যি করে উত্তর দেবে যদি পূর্ববর্তী বয়োঃস্তরে সে সততার ওপর অভ্যস্ত হয়ে থাকে। উপরোন্তু যদি উপলব্ধি করতে পারে যে, আপনি তার প্রতি স্নেহপূর্ণ পরিচর্যায় তৎপর, তাহলে উক্ত গল্পসমূহ ও ম্যাগাজিন সম্পর্কে আপনার প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে সে অগ্রিম বলে দেবে, ঐটা কি তার জন্য সমীচীন? অথবা অগুলোর মালিকের কাছে তা ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। কিন্তু যদি তার নিকট অমার্জিত গল্পগুচ্ছ ও অবাঞ্ছিত ম্যাগাজিন পাওয়া যায়, অভিভাবক এক্ষেত্রে কি করবেন? তখন উত্তম হবে তাকে উপদেশ প্রদান ও উল্লেখিত বস্তুগুলোর মধ্যে নিহিত ক্ষতিকর দিকগুলো তার সামনে তুলে ধরা। সম্ভব হলে দ্বীন-দুনিয়ায় এর নিশ্চিত ক্ষতির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করা। তবে তাকে গালি দেয়া, লজ্জিত করা অথবা প্রহার করতে উদ্যত হওয়া ঠিক হবে না কোনক্রমেই। বিশেষ করে যখন এমন হবে যে, এই প্রথমবার সে এটা করেছে। এ প্রেক্ষিতে তার জন্য একটা উপযুক্ত বিকল্পের ব্যবস্থা করা অভিভাবকের কর্তব্য। কারণ শুধূমাত্র নিষেধাজ্ঞাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।  
তৃতীয় অধ্যায়  
পদ্ধতি ও উপকরণ : এটা প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখিত পদ্ধতি ও উপকরণসমূহের সম্পূরক আলোচনা। তথাপি বিষয়বস্তু স্তরসমূহের পার্থক্যের আলোকে সাজানো হয়েছে। কারণ, এই বয়োঃস্তরের উপযোগী পর্যাপ্ত বিষয় দ্বারা আলোচনাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার পর পূর্বোল্লেখিত বিষয়ের মধ্যে সাযুজ্যও এখানে আলোকপাত করা হয়েছে।
 সংঘটিত ঘটনাবলী দ্বারা শিক্ষা প্রদান : ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে প্রতিপালন ইসলামী পরিচর্যা ও প্রতিপালনের মূল নির্দেশিকা। কারণ কাংক্ষিত অবকাঠামো বিনির্মাণে সংঘটিত ঘটনাবলীকে মহার্ঘ্য জ্ঞান করা হয়ে থাকে। যেহেতু তখন বাস্তব ঘটনা এবং প্রতিপালন-পরিচর্যার মধ্যে একটা ভারসাম্য ও সামাঞ্জস্য স্থাপিত হয়ে যায়। এর সংঘটনের মধ্য দিয়ে গভীর জ্ঞান ও বিরাট প্রতিক্রিয়া সূচিত হবে। এ পর্যায়ে কুরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াত ঘটনার পেছনে এসেছে ; যেগুলো ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে শিশুর পরিচর্যা ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। أفك (অপবাদ) এর ঘটনা ও তার মধ্যে মুসলিম সমাজ প্রতিপালনের যে শিক্ষা উৎসারিত হয়েছে তার দিকে লক্ষ্য করুন। যে আদেশ ও নিষেধাবলী কোন ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তা নিজে একা কোন ফল দিতে পারে না। সে কারণে মুসলমানদের ওপর এই ঘটনার মাধ্যমে সৃষ্ট জটিলতা দূর করার জন্য আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন- لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ. (النور-১১ ) ‘এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না ; বরং এটা তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর।’ এমনিভাবে আমরা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের প্রতি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো তাঁর সিংহভাগেই এ জাতীয় পরিস্থিতিতে এই পদ্ধতির ব্যবহার প্রমাণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নশ্বর পৃথিবীর মর্যাদা ও পার্থিব বিষয়কে তুচ্ছ করে দেখাতে সংকল্প করলেন। তখন তিনি একথা বলেননি, ‘পৃথিবী হলো নিকৃষ্ট যা কোন বস্তুরই সমকক্ষ হতে পারে না’ এর ওপরই ক্ষান্ত করতে পারতেন যা তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সংক্রান্ত বক্তব্যের জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের রা. মনের মধ্যে এই মর্মবাণী বদ্ধমূল করার জন্যে উপস্থিত ঘটনাকে মূল্যায়ন করার নীতি গ্রহণ করলেন। যাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা এক বাজারের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় একটি বড় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। লোকজন তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে জনৈক ভদ্রলোক একটি মৃত জন্তু নিয়ে অতিক্রম করছিলো অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ জন্তুটার কান ধরে বললেন, ‘এটাকে এক দিরহামের বিনিময় ক্রয় করতে কেউ পছন্দ করবে? আমরা বললাম, ‘আমরা কেউই পছন্দ করি না, কারণ এটা আমাদের কোন উপকারে আসবে না, আর তা ছাড়া এর দ্বারা আমরা করবোই বা কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা কি চাও এটা তোমাদের জন্য হোক? উত্তরে তারা বললেন, ‘আল্লাহর শপথ ! যদি জন্তুটি জীবিতও থাকতো তাহলেও তো এর মধ্যে ত্র“টি ছিলো, কারণ সেটা হলো লিঙ্গবিহীন আর এখন তো তা মৃত; তাহলে কিভাবে হবে? অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর শপথ! তোমাদের জন্য পৃথিবীটা আল্লাহ তাআ’লার নিকট এর চেয়েও তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের মধ্যে অনুরূপ অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। শিশুর সম্মুখে সংঘটিত ঘটনাবলীকে সুুবর্ণ সুযোগ মনে করে তা দিয়ে শিক্ষা দেয়া অভিভাবকের কর্তব্য। ফলে কাংক্ষিত পরিচর্যা ও প্রতিপালনের মাধ্যম হিসেবে অভিভাবক তা গ্রহণ করতে পারবেন।
 পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা : সাধারণত একটি শিশু এ বয়োঃস্তরে পৌঁছে পড়া ও লেখা শিখতে আরম্ভ করে থাকে। যত দিন যায় তার এ পড়া লেখার মান উত্তরোত্তর উন্নত ও সুন্দর হতে থাকে। শিশুর সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তার বয়োঃস্তরকে বিবেচনা করে সম্পূর্ণ নিজস্ব আঙ্গিকে ও অভিভাবকের আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী একটি উপযুক্ত পাঠাগার স্থাপন করা উচিত। সেখানে এমন গ্রন্থের সমাহার অবশ্যই থাকবে যা মৌলিকভাবে এই বয়োঃস্তরের জন্যই বিশেষভাবে রচিত। এ পর্যায় নির্বাচন ও চয়নের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাউকে শেয়ার করতে পারেন। কোনরূপ পছন্দ ও খোঁজ খবর না নিয়ে বাজারে যা পাওয়া যায় সেগুলো সংগ্রহ করা ঠিক হবে না। পছন্দ ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিশুকে শেয়ার করতে কোন আপত্তি নেই। বরং এটা করা উচিত ; কারণ এর মধ্যে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিনির্মাণ, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ ও নিজে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনুভূতি নিহিত রয়েছে। কিন্তু তা হতে হবে নির্ভুল পর্যবেক্ষণ ও সঠিক দিকনির্দেশনার সঙ্গে। এরূপ একাধিক পাঠাগার থেকে উপকৃত হওয়া উচিত। এটা যেন নিরেট ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য না হয়। অতিথিগণ ঘরে প্রবেশ করেই যেটা দেখতে পারবে। উক্ত পাঠাগার এমনভাবে তালাবদ্ধ করে রাখাও উচিত নয় যে, নির্ধারিত সময় ছাড়া তা শিশুর জন্য খোলা হয় না। যেমন : সপ্তাহের শেষে। বরং উম্মুক্ত রাখবে যখন মন চায় অথবা উৎসাহ জাগে শিশু যেন সেখানে অনায়াসে যেতে পারে। সমৃদ্ধ পাঠাগারের গ্রন্থসম্ভার যেন তার পাঠ পুণঃআলোচনা, শিশুর থেকে কাংক্ষিত প্রশিক্ষণের সমাধান ও উত্তর দানে দিকনির্দেশনা প্রদান ও পর্যবেক্ষণে সহায়ক হয়ে থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।   পাঠাগারের পরিবেশ অবশ্যই পাঠের উপযুক্ত হওয়া উচিত, কোন রকমের সংকীর্ণতা ও হৈ চৈ মুক্তভাবে শিশু সেখানে বসতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতে পারে। স্থানটিতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাম্প্রতিক কালের পাঠাগারগুলো শুধু কাগুজে পাঠাগার হিসেবে তৈরি করা হয় না, বরং তা অনেক উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। বরং তাতে একদিকে থাকে শ্র“তি নির্ভর পাঠাগার, অন্যটা দৃষ্টি নির্ভর ও তৃতীয়টা থাকে ইলেক্ট্রনিক্স। প্রত্যেকটাই কাম্য তবে তা হতে পারে পর্যাপ্ত আর্থিক স্বচ্ছলতার গণ্ডির মধ্যে থেকে।
 শিশুকে গবেষণায় অভ্যস্ত করা : পরিচর্যা ও প্রতিপালনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কাংক্ষিত জ্ঞান আহরণের লক্ষ্যে শিশুকে এই পাঠাগারে গবেষণা করতে অভ্যস্ত করা। শিশু যখন কোন প্রশ্ন করে ও তার উত্তর এই পাঠাগার থেকেই জানতে চায়, তখন তার ধারণা অনুযায়ী তাকে পথ দেখানো অভিভাবকের জন্য উত্তম। তিনি চাইবেন শিশু নিজের থেকেই যেন উত্তর খুঁজে বের করতে পারে, অভিভাবক কেবল তা পর্যবেক্ষণ করবেন। এক্ষেত্রে অভিভাবক উত্তর দিতে যাবেন না। কারণ তাহলে সে জানতে পারবে কিভাবে গবেষণা করতে হয়। ফলে খুঁজে বের করার গুরুত্বও অনুধাবন করতে পারবে এবং আত্ম নির্ভরশীল হয়ে স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছে সফলতার স্বাদও উপলব্ধি করতে পারবে। এরপর অভিভাবকের কর্তব্য হলো শিশুটি তার কাংক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলো কি না এ ব্যপারে নিশ্চিত হবে। ফলশ্র“তিতে শিশুর মানসিক সুগঠন সূচীত হবে। অনেক অভিভাবক আছেন যারা এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে না। তারা বিলম্বকে কালক্ষেপণ মনে করে তাদেরকে কোন পথনির্দেশ অথবা গবেষণার প্রতি উদ্বুদ্ধ না করেই নিজেদের পক্ষ থেকে শিশুর প্রশ্নের ত্বরিত উত্তর প্রদান পছন্দ করেন। এভাবে অবশ্যই তারা শিশুর অন্তস্থিত গবেষণার প্রাণটাকে গলাটিপে হত্যা করেন। যা ঐ শিশু ও তার সমাজের জন্য অকল্যাণকর সাব্যস্ত হয়। এক্ষেত্রে একটি নিন্দনীয় বিষয় সংঘটিত হয় তা হলো, মা-বাবা অথবা অভিভাবকগণ মূলতঃ শিশুদের জন্য নিদৃষ্ট বিষয়ের কুইজ প্রতিযোগিতার প্রশ্নমালার সমাধান তাদের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতার পুরস্কার জেতার আশায় দিয়ে থাকেন। ফলে ক্ষণিকের জন্য যদি তারা সফলকাম হয়েও থাকে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা শিশুর পরিচর্যা ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। ব্যাহত হয় প্রতিযোগিতা আয়োজকদের উদ্দেশ্যও।
সাপ্তাহিক শিক্ষামূলক সেমিনারের আয়োজন করা : শিশুর পরিচর্যা ও প্রতিপালনের অন্যতম উপায় হলো পারতপক্ষে সপ্তাহে পারিবারিক একটি সেমিনারের আয়োজন করা যার প্রতি অধিকাংশ অভিভাবক ভ্রুক্ষেপই করেন না। যেখানে মা-বাবার সঙ্গে সমবেত হবে ছেলে ও কন্যা শিশুরা; প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালন, পরস্পর সহমর্মিতার প্রসার ও ভাই-বোনদের মাঝে অটুট বন্ধন প্রতিষ্ঠার জন্য। সাথে থাকবে সংস্কৃতিক অথবা শিক্ষামূলক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন যা সন্তানদের নিকট অর্জিত অভিজ্ঞতা ও তাদের স্মৃতিতে যে শিষ্টাচার ও জ্ঞান অঙ্কিত রয়েছে তা পরিমাপ করতে সক্ষম হবে। এমনিভাবে এই বৈঠকের মাধ্যমে কুরআনে কারীম থেকে কিছূ আয়াত পাঠ করতে হবে, উক্ত আয়াতসমূহের সংক্ষিপ্ত ব্যখ্যাসহ তাজবীদের নিয়মাবলী জানার জন্য পেশ করবে। এরপর কোন বই থেকে নির্বাচিত পাঠ। পাঠের পর পাঠের সকল বিষয়বস্তু চিত্রায়িত করবে। তাদের সৃষ্ট কোন অস্পষ্টতা নিরসনের জন্য সন্তানদের পক্ষ থেকে কোন প্রশ্ন থাকলে তা উত্থাপনের সুযোগ দিতে হবে। মা-বাবার পারিবারিক বৈঠকগুলো শুধুমাত্র শিক্ষামূলক বিষয়ের মধ্যে (যা শিশুটি স্কুলেই শিখে থাকে) সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কারণ যদি কেবল শিশুর পাঠ-পর্যালোচনা করে অথবা তার থেকে কাংক্ষিত বিষয়ের সমাধান দেয় তাহলে শিশু মনে করবে অভিভাবক শুধুমাত্র ঐ দায়িত্বটাই পালন করেছেন যা তার একান্ত কর্তব্য ছিলো। অবশিষ্ট সময় শিশু যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে। যেমন : খেলাধুলা, নিদ্রা অথবা দুষ্টামি ইত্যাদি।
 শত্র“তা সৃষ্টি হয় না এমন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা : জ্ঞান আহরণ, শিষ্টাচার শিক্ষা অথবা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অধ্যাবসায় ও অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে শিশুদের উদ্বুদ্ধ করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো; তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার প্রাণ সঞ্চার করা। সালাফে সালেহীন থেকে এ প্রসঙ্গে বর্ণনা রয়েছে। সাঈদ বিন যুবাইর রা. থেকে বর্ণিত : ইবনে আব্বাসের রা. নিকট জনৈক ভদ্রমহিলা তার দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর একটি চিঠি নিয়ে উপস্থিত হলো। তখন এটা তাঁর ছেলেকে পড়তে দিলে কোন রকম দায়সারাভাবে পাঠ করে তা শেষ করে ফেললো। অতঃপর আমাকে দিলে আমি তা সুন্দরভাবে পাঠ করে শুনাই। অতঃপর তিনি নিজ সন্তানকে বললেন, ‘তুমি মিশরী বালকের মত চিঠিটা এত দ্রুত কেন পড়লে ? এই পদ্ধতিটা যে শুধুমাত্র শিশুর এ বয়সের সঙ্গে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। বরং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এ দুই বয়োঃস্তরের জন্যও প্রয়োগযোগ্য। তবে এক্ষেত্রে কেবলমাত্র আলোচ্য বিষয়ের পার্থক্য হতে পারে। হাদীস শরীফের মধ্যে এ সংক্রান্ত অসংখ্য আলোচনা এসছে।  
চতুর্থ অধ্যায়  
পুরস্কারও শাস্তি পুরস্কার : পুরস্কার মানব আত্মাকে অনুপ্রাণিত করে ও তাকে দান দাক্ষিণ্য করতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। চাই সেটা ছোট হোক বা বড়। সে মতে প্রতিদান ও পুরস্কার যেন ইসলামী প্রতিপালন বিষয়ক পরিচর্যা-প্রতিপালনে প্রকাশ্য শিক্ষকতুল্য। কথামালা, কর্মসমূহ ও অপরাপর সকল কর্মকাণ্ডের মধ্য হতে শিশুর প্রশংসনীয় বিষয়গুলোর ওপর শিশুর মূল্যায়ন করা ও এমন বিচিত্র পটভূমির বিপরীতে অভিভাবকের পুরস্কার প্রদান করা উচিত। কিন্তু শিশুর এই বয়োঃস্তরে পৌঁছার পর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো : এসব কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি, বান্দার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, প্রশংসা এবং তার সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। যাতে পুরস্কারকে নিরেট পার্থিব বৈষয়িক প্রতিদান দেয়ার দিকে রূপান্তরিত করা না যায়। তাহলে আল্লাহ পাকের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে সেটা বিশুদ্ধ সংকল্প বিনষ্টের কারণ হবে যা প্রতিটি আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত। যদিও এটা কখনো কখনো পার্থিব প্রতিদান ও পুরস্কার দেয়ার পরিপন্থী নয়। ইমাম গাজ্জালী রহ. বলেন, ‘শিশুর থেকে যখন কোন নান্দনিক চরিত্র ও প্রশংসনীয় কর্ম প্রকাশিত হবে তখন তাকে সম্মান করা ও সে যাতে আনন্দ পায় ও প্রকাশ্যে জনসাধারণের মাঝে প্রশংসা করা এমন কিছুর মাধ্যমে তাকে পুরস্কৃত করা উচিত।’ প্রতিদানকে কর্ম সম্পাদনের জন্য কোন প্রকারের শর্তারোপ করা ঠিক হবে না। তাহলে শিশুকে তা না দিলে সে ঐ কাজটি করবে না। কারণ প্রতিদান যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিদান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার শিক্ষামূলক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। আর যখনই সেটা কোন শর্ত অথবা শিশুর কোন আবদারের সঙ্গে সংযুক্ত হবে, তখন অভিভাবকের পক্ষে এই পদ্ধতি প্রয়োগ ছাড়া শিশুর কাছ থেকে কোন কাজই আর আদায় করা সম্ভব হবে না। অতএব ফলাফল দাঁড়ালো এই যে, পুরস্কার শিক্ষা ও প্রতিপালনের আসল মূল্য হারিয়ে ফেলবে ও তার বিপরীতটা নিয়ে আসবে। সতরাং কোন কথা বা কর্মের বিনিময় পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে অভিভাবকের এ বিষয়টা বিবেচনায় রাখা একান্ত কর্তব্য।
 শাস্তি : শিশু স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তার সহপাঠি ও বন্ধুদের সঙ্গে একাডেমিকাল অর্জনের ক্ষেত্রে উচ্চ অথবা সর্বোচ্চ স্থান দখল করার জন্য প্রতিযোগিতা করে থাকে। মা-বাবার নিকট তখন একটি নতুন বিষয়ের আবির্ভাব হয়। তখন অধিকাংশ মা-বাবার প্রতিপালনের ক্ষেত্রে একটাই টার্গেট হয়ে থাকে-শিশুকে নিরেট তথ্য শিক্ষা দেয়া ও সেটা সংরক্ষণ ও স্মরণ রাখা এবং পরীক্ষার সময় তার পুনরাবৃত্তি করা। কারণ তাদের নিকট পরীক্ষায় উচ্চ স্থান অর্জন পরিচর্যা ও প্রতিপালনের কার্যকর সফলতার নিশ্চিত নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এমনকি শিশুর আচার আচরণে তার কোন প্রতিফলন যদি নাও ঘটে থাকে।
   শাস্তি প্রদানের নিয়মাবলী শাস্তি দানের কারণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া : এ বয়সে যে সকল কারণে মা-বাবা তাদের সন্তানদের শাস্তি দিয়ে থাকেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আহরণে শিক্ষার্থীর ধীরগতি। সর্বোচ্চ অথবা উচ্চ স্থান অর্জন এমন কর্মসমূহের অন্তর্ভুক্তÑ পরিচর্যা ও প্রতিপালনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর প্রতি কোন রকম শৈথিল্য প্রদর্শন ব্যতিরেকে যার ওপর শিক্ষার্থীকে প্রাণিত ও উদ্বূদ্ধ করা যায়। আমরা অনেক মা-বাবা অথবা অভিভাবককে দেখেছি শিক্ষাঙ্গনে কাক্সিক্ষত স্থান লাভ না করতে পারার কারণে শিশুর প্রতি যারা ভীষণ রাগান্বিত হন। আবার কখনো এ জন্য শিশুটিকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তিও দিয়ে থাকেন। অথচ যথাসময় মসজিদে গিয়ে ইমামের সঙ্গে নামাজ, কথা বলায় সততা, দরিদ্রের প্রতি অনুগ্রহ, সহপাঠিদের সঙ্গে ভালো আচরণ এ সকল নান্দনিক গুণাবলীর প্রতি যতœবান হওয়ার ব্যাপারে তারা কখনো শিশুর সাথে এতটুকু আলোচনা পর্যন্ত করেন না। যা শিশুর অন্তরে দ্বীনের অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহের চেয়ে শিক্ষাগত উন্নতির প্রতি উৎসাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব ও মর্যাবোধ সৃষ্টি করবে বেশি। উপরন্তু ‘সন্তান পরীক্ষায় নকল করেছে’ মর্মে অভিভাবকের নিকট কখনো সংবাদ আসলেও তাকে নিষেধ করার চেষ্টা করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন নিশ্চিত করতে থাকে। শিশু কোন কোন দিন ঘুম থেকে বিলম্ব করে জাগ্রত হয় তখন সকালের নামাজ না পড়িয়ে মা-বাবা তাকে দ্রুত স্কুলের জন্য বের হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে তৎপর হয়ে পড়েন। ‘সঠিক হলো প্রথমে নামাজ আদায় করা যদিও তাতে স্কুলে যেতে বিলম্ব হয়’ এ কথা জানা সত্ত্বেও ; বিশেষ করে তার বয়স যখন দশ বছরে পৌঁছবে ও এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার এমন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে, যার ফলে মানুষের বিকাশ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পছন্দনীয় বিষয়ের ওপর আবর্তিত হবে। যখন আমরা এই মহান লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে কেবলমাত্র একাডেমিক শিক্ষার দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি দিবো ; তখন কোন প্রকারের শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই তার কারণ জেনে নিতে হবে। এই ধীরগতি কি কারণে সৃষ্টি হয়েছে। অমনোযোগিতা, অলসতা ও কালক্ষেপণের ফল না এটা শিশুর শিক্ষাগত স্তর যার বৈশিষ্ট্য বা সামর্থ্যই হলো এরকম ? তবে উভয় বিষয় যে এক সমান নয় এটা নিশ্চিত। যেমনিভাবে শিশুর বয়োঃস্তর ও তার জ্ঞানগত সামর্থ শাস্তি গ্রহণ ভালো মনে করে না। অতএব প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিছু সামর্থ ও যোগ্যতা নিহীত রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বিশুদ্ধ অভিমত হলো শিশুর সামর্থগুলোকে যথার্থ মূল্যায়ন করা। তার নিকট থেকে এমন কিছু কামনা না করা যার বাস্তবায়ন তার পক্ষে অসম্ভব। তাহলে আমরা অসম্ভব দায়িত্বপ্রদানকারী ব্যক্তির মত হবো। মা-বাবা ও অভিভাবকের জানা কর্তব্য যে, সকল মানুষকে একই ছাঁচে রাখা সম্ভব নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমগ্র মানুষের মধ্যে অনেক দিক থেকে পার্থক্য করেছেন। উচ্চতা, রং, পরিমাপ, গঠন, স্বচ্ছলতা, দারিদ্রতা, বুদ্ধিগত সামর্থ ও আভ্যন্তরীণ কর্ম তৎপরতা ইত্যাদি।
  গা ও চামড়ার আগে বিবেককে আঘাত করা : এই বয়োঃস্তরে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে গা ও চামড়ার ওপর শাসন করার চেয়ে বেশি বিবেককে শাস্তির আশ্রয় নেয়া উচিত। কারণ তখন শিশুর নিকট এমন কতিপয় বুদ্ধিগত যোগ্যতার সৃষ্টি হয় যার দ্বারা সে বুঝতে, পরিতৃপ্ত হতে এবং নিজের পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপনে সক্ষম হয়। সুতরাং দৈহিক শাস্তির আশ্রয়ের পূর্বে বিবেককে সম্মোধন করার পৃষ্ঠপোষকতা নেয়া অগ্রগণ্য। কারণ এ বয়সে বিশেষ করে এ স্তরের শেষ বছরে দৈহিক শাস্তি কখনো বা অবাধ্যতা অথবা ঔদ্ধ্যত্যপনা সৃষ্টি করতে পারে- যার পর শিশুটি পুরোপুরি হাতছাড়া হয়ে যাবে। একেবারে বাইরে চলে শিশুটি মা-বাবা অথবা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রনের।
 শাস্তিদানে ধীরতা অবলম্বন : দৈহিক শাস্তির আশ্রয় নেয়ার পূর্বে আরো কতগুলো স্তর রয়েছে শিশুর গঠনের ক্ষেত্রে অভিভাককে যা গ্রহণ করতে হবে। ইমাম গাজ্জালী র. বলেন, ‘কোন অবস্থায় যদি নিয়মের একবার ব্যত্যয় ঘটে তাহলে এর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত। কখনোই তা জনসম্মুখে প্রকাশ করে তার মর্যাদা ক্ষুণœ করবে না। কেউ অনুরূপ দুঃসাহস দেখাতে পারে বলে তিনি ধ্যান করছেন তার কাছে এটাও প্রকাশ করবে না। বিশেষ করে যখন শিশু নিজে তা ঢেকে রাখবে ও লুকানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। সেক্ষেত্রে তার কাছে এর প্রকাশ তাকে আরো দুঃসাহসী হতে প্ররোচিত করবে ফলে সে তা জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ারও কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না। অতঃপর দ্বিতীয় বার কর্মটি করলে গোপনে তাকে তিরস্কার করা উচিত। বিষয়টিকে তার সামনে বড় করে তুলবে ও তাকে বলবে : তুমি সামনে এধরনের কাজ আর করবে না! তোমার এরূপ কর্ম প্রকাশ পেলে তুমি মানুষের কাছে লজ্জিত হবে। প্রতি মুহূর্তে তিরস্কারমূলক কথা বলবে না। তাহলে মন্দ কর্ম সম্পাদন ও তিরস্কার শ্রবণ তার জন্য একটা তুচ্ছ বিষয়ে পরিণত হয়ে যাবে এবং তার অন্তর থেকে কথার মূল্যায়ন হ্রাস পাবে। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে বাবাকে অবশ্যই নিজের ভাবমর্যাদা রক্ষা করে কথা বলতে হবে। সুতরাং শিশুকে তিরস্কার করতে হবে তবে মাঝে মধ্যে। আর মা তো বাবার ভয় দেখিয়েই তাকে মন্দ কর্ম থেকে নিরস্ত্র করবেন।’
 কোন রকমের ক্ষতি ছাড়া কষ্ট দেওয়া অপরাধের ক্ষেত্র অনুযায়ী অভিভাবক যখন যা সমীচীন মনে করবেন সে দৈহিক শাস্তিটাই কেবল নির্বাচন করতে পারবেন। সেকারণে তার ওপর এটা উপলব্ধি করা কর্তব্য যে, দৈহিক শাস্তির মধ্যে কখনো এক প্রকারের যন্ত্রনাও থাকতে হবে। তাহলে প্রত্যাশিত লক্ষ্যটি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু কখনোই তা ক্ষতিকারক হওয়া উচিত হবে না। যার ফলে পরিচর্যা ও প্রতিপালন করছে এই যুক্তিতে হাড় ভাঙ্গা অথবা আঘাত ইত্যাদির মত গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সঠিক প্রতিপালনের প্রয়াস এ জাতীয় কর্মকে অনুমোদন করে না। এমনিভাবে শিশুর মর্যাদা ক্ষুণœকারী কোন বিষয় থাকতে পারবে না তার মধ্যে। কারণ এটা তাকে মর্যাদা রক্ষায় বাড়াবাড়ি করতে অভ্যস্ত করবে। শিশুর মুখমণ্ডলে আঘাত করা ঠিক নয়। কারণ সেটা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। এমনিভাবে তার গায়ে থুথু নিক্ষেপ, শিশুর পোশাক ছিড়ে ফেলা ইত্যাদি অথবা তাকে নিন্দিত শব্দের দ্বারা গালি দেয়া উচিত নয়। কারণ এর মাধ্যমে মানব জাতির মর্যাদার প্রতি লাঞ্ছনা ও অবিচার করা হয়।
 প্রতিশোধের জন্য নয় সংশোধনের জন্য শাস্তি শাস্তি প্রদানের সময় অভিভাবকের স্বেচ্ছাচারিতা ও কঠোরতা কিছুই শিশুকে বুঝতে দেয়া উচিত হবে না। বরং তাকে বুঝাতে হবে যে, শাস্তিটা হলো শুধুমাত্র মমতা ও অনুগ্রহ প্রকাশসহ তার আচরণ সংশোধন ও পুনরায় ভুলটি না করার জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ প্রনিধানযোগ্য। তিনি যখন দেখতে পেলেন-জনৈক সাহাবী একজন মদ্যপকে গালি দিচ্ছে যার ওপর মদ্যপানের অপরাধে ইতিমধ্যে দণ্ডবিধি কার্যকর করা হয়েছে ; তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে গালি দিতে নিষেধ করলেন। আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট মদ্যপায়ী জনৈক ব্যক্তিকে আনা হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন- ‘তাকে তোমরা প্রহার করো! ফলতঃ আমাদের মধ্যে কেউ হাত, কেউ জুতা আবার কেউবা নিজের কাপড় দিয়ে প্রহার করতে লাগলো। অতঃপর যখন সকলে শাস্তি প্রদানের কাজ সম্পন্ন করলো। তখন তাদের মধ্য হতে কেউ বলে উঠলো : আল্লাহ তাআ’লা তোকে অপমানিত করুন! একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমরা এরূপ বলো না! তার বিরুদ্ধে তোমরা শয়তানকে সহায়তা করো না। বরং তোমরা বলো ! আল্লাহ তাআ’লা তোমার প্রতি দয়া করুন।’ উল্লেখ থাকে যে, অভিভাবক শিশুর প্রতি স্নেহ-মমতার অনুভূতি জাগ্রত করার ক্ষেত্রে যে ভুলত্র“টিগুলো করে থাকেন তার মধ্যে অন্যতম হলো: শাস্তি দানের পর সাথে সাথে তাকে আদর করতে তৎপর হওয়া। কখনো বা তাকে কিছু প্রদান অথবা কয়েক টুকরা মিষ্টি বা চকলেট ক্রয় করে দেয়া ইত্যাদি। এটা শাস্তির প্রত্যাশিত ফলাফলকে বিনষ্ট করে দেয়।
 শাস্তির স্তরের বিভিন্নতা সকল দৈহিক শাস্তি একই ধারায় প্রয়োগ করলে চলবে না বরং তারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। প্রথম স্তর হলো শাস্তির উপকরণসমূহ প্রকাশ করা ; যেমন : লাঠি অথবা চাবুক। কারণ এটাই হলো যতœ ও প্রতিপালনের মূল টার্গেট- যা শিশুকে কাংক্ষিত ও নান্দনিক আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘লাঠি ঝুলিয়ে রাখো! এমনভাবে যে, ঘরবাসী তা দেখতে পায়।’ এরপর বারংবার অপরাধ সংঘটিত হলে এর দ্বারা ইঙ্গিত অথবা এটা ব্যবহারের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করা। অতঃপর মৃদু প্রহার যা যন্ত্রনাদায়ক হবে বটে কিন্তু ক্ষতিকারক হবে না। তবে কখনোই শিশুর শরীরের যে কোন স্থানে যথেচ্ছা প্রহার করা উচিত হবে না। কারণ তা শিশুকে অভিভাবকের প্রতি উদ্বেলিত ও তাকে অবমূল্যায়ন করতে প্ররোচিত করবে, যার শোচনীয় পরিণাম সম্পর্কে ইতিপূর্বে সতর্ক করা হয়েছে। এর ওপর যে প্রতিক্রিয়া আবর্তিত হবে তা হবে শিশুর জন্য দুঃশ্চিন্তার কারণ। বরং তার কর্তব্য হলো শিশুকে শাস্তি দেয়ার জন্য শরীরের স্থান নির্ধারণ বা নির্বাচন করা। সুতরাং হাড় ও স্পর্শকাতর স্থানে প্রহার করবে না। একই স্থানে বার বার প্রহার করবে না। হাত এতটা উচু করবে না যে বগলের শুভ্রতা পরিলক্ষিত হয়। বরং তার বাহু পার্শদেশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে মোটা লাঠি অথবা লোহা ইত্যাদি ব্যবহার করা ঠিক হবে না। ইবনে খালদুন বলেন, ‘মুহম্মাদ বিন আবি যায়েদ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করণীয় সম্পর্কে যে গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতে উল্লেখ করেন- ‘শিশুদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারীর প্রয়োজনে তাদের প্রহারের ক্ষেত্রে তিনটি বেত্রাঘাতের বেশি করবে না। এ ক্ষেত্রে উমার রা. এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘শরিয়ত যে ধরনের শাস্তি অনুমোদন করেনি আল্লাহ তাআ’লা সে ধরনের শাস্তিতে সংশোধন রাখেননি।’ লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির মাধ্যমে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে শরিয়ত যে পরিমাণ নির্ধারণ করেছে, ততটুকুই প্রয়োগ করার অধিকার রয়েছে। যেহেতু শরিয়তই তার কল্যাণ সম্পর্কে সম্যক অবগত আছে।
 শাস্তিপ্রদানের সময় উপহাস বা তামাশা না করা আঘাত করে না এবং যার মধ্যে কোন পরিহাস অথবা বিদ্রƒপাত্মক কিছু নেই এমন কোন শব্দ প্রয়োগ অভিভাবকের জন্য গালি বলে বিবেচিত নয়। কিন্তু সেটা শিশুর অপরাধ কর্মের প্রকার অনুযায়ী বিনিময় প্রদানের পর্যায় হতে হবে। এটাও এক প্রকারের প্রতিপালন। অতএব শিশু অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে যখন তাকে বলা হবে হে বিশ্বাস ঘাতক, তার বিশ্বাস ঘাতকতা ও প্রতিশ্র“তি রক্ষা না করার দিকে ইঙ্গিত করার জন্য। তাহলে এটা অকথ্য গালির পর্যায় পড়বে না। বরং এটা তার কর্মের অনুরূপ গালি হবে। যা তার নেতিবাচক আচরণকে ধরিয়ে দেবে ও দ্বিতীয় বার উক্ত কর্মের পুনরাবৃত্তি না করতে উৎসাহিত করবে। তবে অবশ্যই সেই শব্দগুলো তার ব্যক্তিত্ব ক্ষুণœকারী হতে পারবে না। আব্দুল্লাহ বিন বিসির আল-মাযনী রা. বলেন, ‘আমার মা আমাকে একগুচ্ছ আঙ্গুর দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে পৌঁছানোর পূর্বে আমি সেখান থেকে কিছু আহার করে ফেলেছিলাম। অতঃপর আমি যখন তা নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গেলাম, তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কান ধরে বললেন- হে বিশ্বাস ঘাতক! এটা নিঃসন্দেহে শিশুর থেকে একটি অশুদ্ধ আচরণ। সুতরাং এ কথার সঙ্গে কান ধরা ছিলো তার জন্য শিক্ষা ও দ্বিতীয় বার একর্মের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য তার প্রতি অনুপ্রেরণা। অনুরূপ ঘটনা নু’মান বিন বশির রা. এর সঙ্গেও সংঘটিত হয়েছিলো। তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য তায়েফ থেকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রচুর আঙ্গুর এসেছিলো। আমাকে সেখান থেকে এক থোক দিয়ে বললেন- ‘এটা নিয়ে তোমার মাকে দিও!’ আমি তা পথের মধ্যে খেয়ে ফেলি। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘আঙ্গুরের থোকটি কী করেছো? আমি বললাম, খেয়ে ফেলেছি। ফলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বিশ্বাস ঘাতক অভিহিত করলেন। সাহাবী নু’মান রা.ও তখন শিশু ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হিজরতের পর মদিনায় তিনিই হলেন আনসারদের সর্ব প্রথম নবজাতক।

 শিশু যখন আপনাকে জড়িয়ে ধরে অথবা আশ্রয় চায় তখন তাকে অশ্রয় দিন শাস্তি প্রদানের সময় কখনো এমন হয় যে, শিশু যার কাছে সাপোর্ট পাবে বলে মনে করে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার কাছেই আশ্রয় নেয়। বাবার নিকট আশ্রয় নেয় যদি শাস্তিটা মায়ের পক্ষ থেকে হয়। ঠিক যদি শাস্তিদাতা বাবা হন তখন মা অথবা কোন নিকটাত্মীয়র কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। অতএব যিনি শাস্তি প্রদানের নিয়ত করেছেন তার থেকে শিশুর আশ্রয়দাতাকে কোন অবস্থাতেই অবমূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। বরং শাস্তি থেকে এমনভাবে হাত গুটিয়ে নেবে যেন কিছুই ঘটেনি। অন্যথায় শিশুর নিকট আশ্রয়দাতার মর্যাদা ক্ষণœ হবে। বরং এপ্রেক্ষিতে তার নিকট স্পষ্ট করতে হবে যে, সে শাস্তিযোগ্য অপরাধই করেছে বৈকি। তবে যার আশ্রয় নিয়েছে তাকে যদি আজ জড়িয়ে না ধরতো তাহলে তাকে অবশ্যই শাস্তিটা পেতে হতো অথবা তার সঙ্গে ভিন্নরূপ আচরণ করা হতো। এক প্রকারের আশ্রয় হিসেবে শিশু কখনো কোরআন শরীফ স্পর্শ করে থাকে তার মা-বাবার নিকট কোরআনে কারীমের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কে তার অবগতির কারণে। যেহেতু তাদেরকে প্রতিনিয়ত কোরআনে কারীম অধ্যয়ন ও তার পতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দেখে। সুতরাং অভিভাবকের জন্য ক্রোধ তাড়িত হয়ে শিশুকে শাস্তি দেয়া উচিত হবে না। বরং তার অনিবার্য কর্তব্য হলো, এ দিকটাকে মূল্যায়ন করা ও ‘সে এক দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় নিয়েছে’ এমর্মে শিশুর অন্তরে কোরআনে কারীমের মর্যাদা ও মহত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তা না হলে তিনি তাকে অবশ্যই শাস্তি দিতেন। যদি এমন হয় শাস্তি প্রদানের কোন বিকল্প নেই, তাহলে প্রথমে তাকে কোরআন শরীফ যথাস্থানে রেখে আসতে নির্দেশ করবে, তারপর তাকে শাস্তি দেবে। অথবা তাকে বলবে : তোমার কৃতকর্মের জন্য অবিলম্বে তোমাকে জবাবদিহী করবো কিন্তু কোরআন শরীফ রেখে দেয়ার পর; আমি এমন একটি সময়ের অপেক্ষায় আছি যখন তুমি এর থেকে অনেক দূরে থাকবে। কখনোবা শিশু আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকের কর্তব্য হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা ‘কেউ আল্লাহর দোহাই দিয়ে তোমাদের নিকট কিছূ চাইলে তাকে দিয়ে দাও এবং তোমাদের থেকে যে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দাও !....’ এর অনুকরণে তাকে শাস্তি দেয়া হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। কখনো এমন হয় যে, শিশু নামাজের মাধ্যমেও আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে নামাজের মাহাত্ত্ব সম্পর্কে তার অবগতির কারণে। অভিভাবক কোরআনে কারীমের ক্ষেত্রে যে পথ অবলম্বন করেছে এখানেও সেই একই পথে তাকে চলতে হবে। এমতাবস্থায় আবেগতাড়িত হয়ে শিশুকে নামাজ থেকে টেনে বের করা ও তাকে শাস্তি দেয়া অভিভাবকের জন্য চরম অন্যায়। কারণ এ জাতীয় কর্মের দ্বারা শিশুর অন্তর থেকে ইবাদতের ভাব-গাম্ভীর্য বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো শিশুর থেকে এ ধরনের তৎপরতার মধ্যে অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। কারণ অভিভাবক ক্রোধান্বিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দিলে তাতে শিশুর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সে কারণে এ অবস্থায় শাস্তি না দিয়ে বরং এ পরিমাণ কালক্ষেপণ করা উচিত যাতে ক্রোধের তীব্রতা প্রশমিত হয়ে যায়।
 ইচ্ছাকৃত ও ভুলক্রমে অন্যায়, এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কথা অথবা কর্মের বিরোধিতার শাস্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই যার কারণ ইচ্ছাকৃত অবাধ্যতা ও যার কারণ ভুলক্রমে অবাধ্যতা এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা একান্ত কর্তব্য। কারণ সকল অপরাধ মূল্যায়নের ক্ষেত্র এক সমান নয়; মূর্খ্যতা ও অজ্ঞতার সমাধান হলো শিক্ষা, শাস্তি নয়। ‘যে সকল সংঘটিত অবাধ্য কথা ও কর্ম মুর্খতা বা অজ্ঞতার ফসল তাতে কোন শাস্তি নেই’ যখন এটা মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়ে গেলো। তাহলে সে কথা বা কর্ম থেকে যথাযথ পন্থায় বিরত রাখা বা নিষেধ করা এর পরিপন্থী নয়। জনৈক ব্যক্তি নামাজের মধ্যে কথা বলছিল অথচ সে এর হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞ। লক্ষ করুন, এ লোকটি কোন শিশু ছিল না। ছিলো একজন পুর্ণ বয়স্ক পুরুষ। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়টির প্রতিকারের জন্য শুধুমাত্র একটিই ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাহল, তাকে নামাজের নিয়মাবলী শিক্ষা দেয়া। তিনি বললেন- ‘নিশ্চয়ই মানুষের সঙ্গে যেরূপ কথা বলা হয় নামাজের মধ্যে সেই কথা বলা যায় না। বরং নামাজ হলো তাসবীহ, তাকবীর ও কোরআন তেলাওয়াত।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই পদক্ষেপে মুগ্ধ হয়ে উক্ত সাহাবী রা. তার সঙ্গে সংযুক্ত করে বলেছেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবেমাত্র নামাজ সমাপ্ত করেছেন; ‘আমার মা-বাবা তাঁর জন্য উৎস্বর্গ হয়ে যাক! তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে উত্তম শিক্ষক জীবনে আমি দেখিনি। আল্লাহর শপথ ! তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার প্রতি কোন কঠোরতা আরোপ করেননি, আমাকে প্রহার করেননি এবং আমার সঙ্গে একটি কটু বাক্যও ব্যবহার করেন নি।’
 আদেশ পরিত্যাগ ও নিষেধ কাজ করার মধ্যে শাস্তিপ্রদানের ক্ষেত্রে পার্থক্য করা করণীয় পরিত্যাগ করা ও বর্জনীয় সম্পাদনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে। তবে দ্বিতীয়টা বেশ কঠিন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘তোমাদেরকে কোন ব্যাপারে নিষেধ করলে তা পরিহার করো ও কোন কর্মের আদেশ করলে তা যথাসাধ্য সম্পন্ন করো!’ এখানে কাংক্ষিত কর্মটিকে সামর্থের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। অথচ বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ বিষয়টিকে নিঃশর্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ভুলের দিকটাকেও মূল্যায়ন করতে হবে। সুতরাং পার্থিব বিষয় সংক্রান্ত ভুল-ত্র“টির চেয়ে ধর্মীয় বিষয় সংক্রান্ত ভুল-ত্র“টিসমূহ গুরুতর হিসেবে বিবেচিত হবে। আনাস বিন মালেক রা. বলেন, ‘আমি সুদীর্ঘ দশটি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খাদেম ছিলাম। অথচ এ দীর্ঘ সময়ে কখনো তিনি আমাকে এটা কেন করলে? ওটা কেন করনি? এমনকি উহ্ শব্দটি পর্যন্ত বলেননি। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পার্থিব বিষয়ে তাকে কোনরূপ পর্যবেক্ষণ করেননি। অতএব অভিভাবক কর্তৃক শিশুর সঙ্গে আচার-আচরণের মাধ্যমে শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে; ধর্মীয় বিষয়, আচার-ব্যবহার অথবা চারিত্রিক ভুল-ত্র“টি এবং জাগতিক অথবা জীবন সংক্রান্ত ভুল-ত্র“টির মধ্যে পার্থক্য কি? এখানে যে বিষয়টা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হলো, এমন কতিপয় ত্র“টিপূর্ণ কর্ম রয়েছে যা শিশু আরম্ভ করে ফেললে জ্ঞানের কথা হলো, তাকে তা সম্পন্ন করতে সুযোগ দেয়া। ফলে সে নিজের থেকেই তা হতে ফিরে আসতে সক্ষম হবে। কারণ তা সম্পন্ন করা হতে নিষেধ করলে তখন ক্ষতির পরিমাণটা বেশি হয়ে যেতে পারে। যেমন একটি শিশু মসজিদের মধ্যে প্রশ্রাব করছে। আপনি যদি ওকে ধমক দিতে যান তাহলে দেখতে পাবেন আপনার ভয়ে সে মসজিদের অবশিষ্ট অংশও অপবিত্র করে ফেলবে। পক্ষান্তরে তাকে কোনরূপ ভীতি প্রদর্শন না করে প্রশ্রাব পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে ছেড়ে দেন। এরপর যদি মসজিদ হতে কোন সরু পথ ধরে তাকে বের করে আনতে পারেন, তাহলে খুব সহজেই তার ও মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব হবে। অতঃপর তার কাছে মসজিদের মর্যাদা ও গুরুত্ব স্পষ্ট করে তুলে ধরবেন। বলবেন, মসজিদের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণে ঘরের আসবাব পত্রের চেয়ে অনেক বেশি যতœবান হতে হবে। যেহেতু মসজিদ শুধুমাত্র আল্লাহর জিকির ও নামাজের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর শিশুটি যে স্থানটায় প্রশ্রাব করেছে তা আপনি ভালো করে পরিষ্কার ও পবিত্র করে ফেলুন। জনৈক বেদুঈনের মসজিদে নববীতে প্রশ্রাব সংক্রান্ত হাদিসের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যেহেতু অজ্ঞতা ও না জানার দরুণ এমনটি করেছিলো সে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোন শাস্তি দেননি। বরং তাকে সংশোধন ও শিক্ষা দিয়েছেন। উপরন্তু তার চলমান প্রশ্রাব বন্ধ করেও দেননি। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্রাবের ওপর পানি ঢালতে বললেন, যাতে স্থানটি পবিত্র হয়ে যায়। অভিভাবক যখন জানতে পারবে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তার পদ্ধতি কি হবে? সঠিক না ভুল পদ্ধতি। তাহলে সে নিজেকেই একটি প্রশ্ন করবে, সন্তান যদি কোন ভুল করে অথবা কোন ভুল কর্ম করে বসে, তাহলে কি সেই সন্তান তার কাছে গিয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করবে যে, এই ভুল কর্ম থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় অথবা শাস্তির আশঙ্কায় তা তার থেকে লুকাতে চায় ? সন্তান যদি তার অভিভাবকের নিকট আগমন থেকে বিরত না থাকে। বরং তার নিকট এসে তা থেকে বের হওয়ার পথ জানতে চায়। তখন শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার পদ্ধতিটাই হতে হবে একটি সুন্দর পদ্ধতি। পক্ষান্তরে শিশু যদি অভিভাবককের দেখে ভয় পায় ও কোনভাবেই তার অন্যায় অভিভাবকের সম্মুখে প্রকাশ করতে না চায়। উপরোন্তু অপরের ভুল কর্মও অনুসন্ধান করে বেড়ায় ও নিজের কুকর্ম অভিভাবক থেকে লুকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। এ অবস্থায় তার শাস্তির পদ্ধতিটা হবে ভুল।
 পরিমিত শাস্তি দান আমরা এখানে বিশেষভাবে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব যে বিষয়টির ওপর তা হলো, শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে পরিমাপ না করা অথবা শাস্তি প্রদানে বাড়াবাড়ি করা। দুটোই কিন্তু প্রতিপালনের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেষ্ট অভিভাবকের অনুতাপ অথবা দুঃশ্চিন্তার কারণ হবে। এর ফলে শিশুর ওপর যে রোগ ও বিপদ আপতিত হবে আমরণ সেটা তাকে বহন করে বেড়াতে হবে।    
পঞ্চম অধ্যায় :
 নির্দেশনা ও উপদেশাবলি (পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে আলোচিত নির্দেশনা ও উপদেশাবলির সাথে বয়োঃস্তরের পার্থক্য বর্ণনাসহ এটা একটি সম্পূরক আলোচনা)
 সন্তানের জন্য একজন অভিভাবক নিযুক্ত করা অভিভাবকদের নিকট সন্তান পরিচর্যা ও প্রতিপালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে কখনো তাদের অবস্থা ও ব্যস্ততা নিজ সন্তানদের যতœ ও প্রতিপালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। তাই যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা রয়েছে তারা নিজের সন্তানদেরকে অনর্থক ছেড়ে না দিয়ে তাদের জন্য একজন অভিভাবক ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারী নিযুক্ত করে দেবে। আগের যুগের মুসলমানগণ তাদের সন্তানদের জন্য অভিভাবক ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারী নিযুক্ত করতেন। প্রতিপালন বিষয়ে তাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দান করতেন। এরকম অসংখ্য বিষয় তাদের নিকট প্রচলিত ছিলো। তার মধ্য হতে ইবনে খালদুন যা উল্লেখ করেছেন তাও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাদানের সর্বাপেক্ষা উত্তম পদ্ধতি সেটাই যা হারূন রশীদ তার সন্তানদের শিক্ষকের জন্য উপস্থাপন করেছেন। আহ্মারের প্রতিনিধি বললেন- ‘আমার নিকট হারূন রশীদ পাঠালেন তার ছেলে মুহাম্মাদ আল-আমীনকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। অতঃপর হারূন রশীদ বললেন- হে আহমার! আমিরুল মু’মিনীন তার প্রাণীশক্তি ও হৃদপিন্ডের ফল তোমাকে প্রতি অর্পণ করেছেন। সুতরাং তার প্রতি তোমার হাত সম্প্রসারিত করে রাখো। তোমরা আনুগত্য করা তার কর্তব্য। তুমি তার সঙ্গে এরূপ হয়ে যাও যেন আমিরুল মু’মিনীন তোমাকে নিজের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন। তাকে কোরআনে কারীমের পাঠ শিক্ষা দাও। ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করাও। কবিতা আবৃতি ও হাদীস শিক্ষা দাও। হাদীসের সূচনা ও অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট দেখাও। তাকে হাসতে নিষেধ করো কিন্তু শুধুমাত্র তার জন্য নির্ধারিত সময়। বনি হাশেমের মাশায়েখে কেরাম শুভাগমন করলে তাদের সম্মান করতে বল। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যখন তার কাছে আসবে তাদের মর্যাদা দিতে বল। তোমার কাছ থেকে যেন এক মুহূর্তও অনুপস্থিত না থাকে। তাকে কোনরূপ দুঃশিন্তায় ফেলবে না যাতে শিশুর কচি মনটা মরে যায়। তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করবে না। ফলে যখন অবসর পাবে তখন তা করা শুরু করবে যা সে পছন্দ করে। যথাসম্ভব তাকে নৈকট্য ও নম্রতার দ্বারা গঠন করো। পক্ষান্তরে যদি সে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তার ওপর কঠোরতা আরোপ করতে হবে।’ উতবাহ বিন আবু সুফিয়ান তার সন্তানদের শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারী আব্দুস সামাদকে বলেন, ‘কোন শিশু-সন্তানের সংশোধনের পূর্বে তোমার নিজের সংশোধন করে নেয়া উচিত। কারণ শিশুদের চক্ষুসমূহ আপনার চক্ষুর সাথে আবদ্ধ। কাজেই আপনি যা উত্তম মনে করবেন তা-ই ওদের নিকট উত্তম। আর আপনি যা মন্দ মনে করবেন তা-ই ওদের কাছে মন্দ। শিশুদেরকে কোরআনে কারীমের শিক্ষা দিন! তবে এক্ষেত্রে প্রবল চাপ প্রয়োগ করবেন না, ফলে তারা অনীহা প্রকাশ করতে পারে। আবার ওদেরকে একেবারে ছেড়েও দিবেন না যাতে ওরা তা পরিত্যাগ করতে পারে। এরপর কবিতা গুচ্ছ থেকে মার্জিতটুকু তাকে আবৃত্ত করান এবং হাদীস থেকে সর্বশ্রেষ্ঠটা তাকে শিক্ষা দিন! তাদেরকে এক পাঠ ভালো করে না শিখিয়ে অন্য পাঠে নিয়ে যাবেন না। কারণ কানের মধ্যে অনেক কথার ছড়াছড়ি ওদের মনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। আমার ভয় দেখাবেন; কিন্তু আমাকে ব্যতীত শিক্ষা দেবেন। আপনি একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মত হবেন যিনি রোগ নির্ণয়ের পূর্বে ব্যবস্থাপত্র দেন না। তাদেরকে মহিলাদের সঙ্গে কথোপকথন হতে দূরে রাখবেন। ওদের নিকট বিজ্ঞজনদের জীবনালেখ্য বর্ণনা করুন। আপনি ওদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে সমৃদ্ধ করুন আমিও আপনাকে বাড়িয়ে দেব। ওদের শিষ্টাচার শিক্ষাদান বৃদ্ধি করুন আমি আপনার পারিতোষিক বৃদ্ধি করে দেব। এগুলো সন্তানের শিষ্টাচার শিক্ষাদান ও তাদের প্রতিপালনে মহা মূল্যবান কয়েকটি উপদেশ। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিৎ এর থেকে উপকৃত হওয়া।
 নববী শিষ্টাচারের সঙ্গে শিশুকে বেঁধে রাখা এ পর্যায় কিছূ নববী শিষ্টাচার রয়েছে যা এই স্তরের জন্য প্রযোজ্য। ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘তোমাদের সন্তানাদিকে নামাজের শিক্ষা দাও।’ এখানে ওদেরকে নামাজ শিক্ষা দিতে বলেছেন, যখন তারা সাত বছরের শিশু ছিলো। উল্লেখিত বয়সে শিশুদেরকে নামাজের শিক্ষা দেবে নির্দেশ মূলকভাবে অথবা এর পূর্বে সৌজন্য মূলকভাবে। যদি শিশু এটা বুঝতে পারে তাহলে ওদেরকে অজুর পদ্ধতি শিক্ষা দিবেন। অজু ভঙ্গের কারণও জানিয়ে দিবেন। যেমনিভাবে ওদেরকে নামাজ ও প্রত্যেক নামাজের রাকাত সংখ্যা, নামাজের পদ্ধতি ও সময় সম্পর্কে শিক্ষা দিবেন। নামাজ ভঙ্গের কারণও জানিয়ে দিবেন। ওদেরকে স্মৃতি সহজ জিকির ও দোয়াসমূহ মুখস্ত করাবেন। শিশুদেরকে জামাত, জুমআ’র খুতবা, তারাবীহ ও দুই ঈদের নামাজে উপস্থিত হওয়ার প্রতি অনুপ্রাণিত করবেন। একাজে অভ্যস্ত করার জন্য ওদেরকে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যাবেন। শিশুর বয়স দশ বছরে পৌঁছলে এ ব্যপারে কঠোরতা আরোপ করতে হবে। কোন অবস্থাতেই শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। এমনকি এরপরও যে শিশু নামাজে অলসতা দেখাবে তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা ও তিরস্কার করার জন্য প্রহার করা যাবে। তবে পূর্বে উল্লেখিত শাস্তিদান পদ্ধতি এক্ষেত্রে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিছানা পৃথক করে দিতে নির্দেশ করেছেন। যেন প্রত্যেকের জন্য আলাদা বিছানা হয়। বাড়ী যদি প্রশস্ত হয় তাহলে ছেলেদের জন্য আলাদা কক্ষ ও মেয়েদের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করবে। তার মধ্যেও অবশ্যই প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন বিছানা হতে হবে। বিছানা পৃথক করার নির্দেশও এক প্রকারের সতর্কতামূলক পরিচর্যা যা সংশ্রবের ক্ষতিকর বিষয় হতে রক্ষা করবে। এখানে এ দিকেও ইঙ্গিত রয়েছে যে, কন্যা শিশু ও ছেলে শিশুর এই বয়সে তাদের অগোচরে যদি বয়ঃসন্ধি ঘটে যায় তাহলে একই বিছানার সংশ্রবের দরুণ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই বয়োঃস্তরে যে বিষয়টির ওপর একান্তভাবে সতর্ক করা উচিত তা হলো; কন্যা তার ভাইদের সামনে আঁটসাট পোষাকে বের হবে না। যথা- স্কার্ট পরিধান করা অথবা স্কন্ধ ও বাহুযুগল উম্মুক্ত রাখা, উরুযুগল ও পেট খুলে রাখা ইত্যাদি। এ বয়সে কন্যা শিশুটিকে দৃষ্টি অবনমিত রাখতে ও অপরের গোপন অঙ্গ স্পর্শ ও তার দিকে না তাকানোর শিক্ষা দেবে।
 আত্ম সংশোধন শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া শরিয়তের পরিভাষায় আত্মা সম্পর্কে বেশ আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা আত্মা সম্পর্কে বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا . وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا. ( الشمس-৯-১০) ‘নিশ্চয় সে সফলকাম হয়েছে যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে। এবং সে ব্যর্থ হয়েছে যে একে কলুষিত করেছে।’ তিনি আরো বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى . فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى. )النازعات-৪০-৪১) ‘আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাস স্থল।’ এ আয়াতগুলো আত্মার প্রতি যতœ নেয়ার গুরুত্বকে স্পষ্ট করে দেয়। ফলে আত্মা থেকে দোষত্র“টিকে ‘না’ বলে দেয়া হয়। কথা ও কাজের মাধ্যমে আত্মাকে নির্মল ও পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। অভিভাবকের জন্য শিশুর বয়োঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক নয়। এরপর সে শিশুর আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও সমূহ ত্র“টিবিচ্যুটি থেকে নিষ্কলুষ করবে। বরং তার সাথে ভালো-মন্দ নির্ণায়ক বয়স আরম্ভের সাথে সাথে এ বিষয় তার সঙ্গে সূচনা করবে। তার সামনে স্পষ্ট করে তুলবে যে, আল্লাহ তাআ’লা তার সকল ব্যাপারে অবগত, তার কোন কিছুই তার কাছে লুকায়িত নেই। কেরামান কাতেবীন ফেরেশ্তা তার ভালো-মন্দ সকল কর্ম লিপিবদ্ধ করে রাখছেন। সুতরাং তাকে কল্যাণকর কাজের নির্দেশ করবে এবং অন্যায় ত্যাগ ও নিজের আত্মার পর্যবেক্ষণের দিকে আহ্বান জানাবে। তার সামনে ফুটিয়ে তুলবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে তার চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. কে আল্লাহর তাআ’লার ধ্যান করতে এবং আল্লাহ তাআ’লার আদেশ নিষেধ সংরক্ষণ করতে উপদেশ দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পেছনে ছিলাম। তিনি বললেন- ‘হে বৎস, আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিক্ষা দিচ্ছি শোন। তুমি আল্লাহর হুকুম সংরক্ষণ করো। তাহলে আল্লাহ তাআ’লাও তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহর হুকুমকে রক্ষা করলে আল্লাহকে তোমার নিকটেই পাবে.........।’ এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এই ধ্যান মগ্নতার ওপর প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাকে ইহকালে সকল বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন। পরকালে জাহান্নাম ও তার শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন। কারণ, সে আল্লাহর হকসমূহ সংরক্ষণ করলো ও তার সমৃদ্ধি অর্জনে ধন্য হলো। ফলে আল্লাহ তাআ’লা তার সঙ্গী হবেন ও তাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না। অতএব ভারসাম্য রক্ষা করে আত্মশুদ্ধি ও আত্মাকে নির্মল করার দ্রুত প্রশিক্ষণ প্রদান শিশুকে তার প্রতিপালকের ধ্যানমগ্ন হতে ও আত্ম সমালোচনা করতে অভ্যস্ত করবে। ফলতঃ এর একটা ভাল প্রভাব তার পরবর্তী জীবনে পড়বে।
 কোরআনে কারীমের অংশ বিশেষ মুখস্থ করানো কোরআনে কারীম হলো মহামহিমান্বিত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআ’লার বাণী। যার মধ্যে নিহিত আছে সমগ্র মানব জাতির ইহ-পারলৌকিক সার্বিক কল্যাণ ও সৌভাগ্য। অতীতে ও বর্তমানে কোরআনের মর্যাদা অনুযায়ী মুসলমানগণ আপন নেতৃত্ব গ্রহণ করে নিয়েছে। মুসলিম উম্মাহর কাংক্ষিত মর্যাদা ও হৃত গৌরব আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর আনুগত্য ব্যতীত কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সুতরাং কোরআনে কারীম নিজেরা মুখস্থ করা এবং সন্তানদেরকে তা মুখস্থ করানো আমাদের কর্তব্য। আধুনিক পাঠ্যক্রম প্রমাণ করেছে যে, এ বয়সে শিশুর স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর থাকে। অতএব অভিভাবকদেরকে শিশুদের এই সামর্থ্যকে কোরআনে কারীম হেফ্জ করা ও অধিকাংশ মুসলিম দেশসমূহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাহফিজুল কোরআনের আসরে তাদেরকে অংশ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে উত্তমরূপে কাজে লাগাতে হবে। শিশু যেটা হিফ্জ করতে চায় তা কয়েকবারের বেশি তাকে পুনরাবৃত্তি করতে হয় না। এমনি করে সে আল্লাহর ইচ্ছাই হাফেজে কোরআন হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদও রয়েছে। ‘শৈশবের শিক্ষা যেন পাথরে অংকন করা।’ অতীতে ও বর্তমানে এমন অসংখ্য হাফেজ রয়েছে যারা শৈশবকালেই কোরআন হেফ্জ করতে সক্ষম হয়েছেন। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘তাফসীর সংক্রান্ত বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করো। কারণ আমি কোরআন কারীম হেফ্জ করেছি যখন আমি ছোট ছিলাম।’ ইমাম বুখারী রহ. তার গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় রেখেছেন। তার শিরোনাম করেছেন : ‘শিশুদেরকে কোরআনে কারীম শিক্ষা দান।’ কুরআনে কারীম হেফজের দ্বারা শিশুর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এমনকি সে নামাজে জামাতে অগ্রগামী হয় ও অনেক বড় বড় শায়খদেরও ইমামতি করে যদি তার হিফজের পরিপক্কতা তাদের চেয়ে বেশি হয়। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদেরকে বলেছেন, ‘তোমাদের ইমামতি করবে যে তোমাদের মধ্যে বেশি কোরআন সম্পর্কে জানে।’ উমার বিন সালিমাহ রা. তার সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন, ‘তারা লক্ষ করে দেখলেন আমার থেকে বেশি কোরআন সম্পর্কে অভিজ্ঞ কেউ নেই। কারণ আমি অশ্বারোহী (মুসলিম যোদ্ধা) দের কাছে কোরআন শিখেছিলাম। অতএব ইমামতির জন্য তারা আমাকেই সামনে পাঠাল। অথচ আমি তখন ছয় অথবা সাত বছরের শিশু মাত্র।’
 উপকারী খেলাধুলার উপযুক্ত সুযোগ দান শিশুর সময়ের প্রতি অভিভাবককে যতœবান হতে হবে যেন অকারণে সময় নষ্ট না হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করে শিশুকে সকল প্রকার খেলাধুলা-যা মনকে সতেজ ও অন্তরকে প্রশান্তি দেয় থেকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না। খেলাধুলার আয়োজন যদি এ প্রক্রিয়ায় হয় তবে তা অহেতুক সময় অপচয়ের পর্যায় পড়বে না। বরং তা সময়ের প্রতি যতœবান হওয়ারই নামান্তর। কারণ তা অন্তরকে সুসংহত করে ও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে দেয়। আর সে কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন শিশুদেরকে খেলতে দেখতেন তখন এ ধরনের খেলাধুলা থেকে তাদেরকে নিষেধ করতেন না। যেহেতু এর থেকে নিষেধ করলে অন্তরের প্রফুল্লতা ও সতেজতায় একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে। আনাস রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন যখন আমি শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিলাম। তখন তিনি আমাদের সকলকে সালাম করলেন। অতঃপর আমাকে ডেকে তাঁর এক কাজে পাঠালেন।’ এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেলাধুলা করতে দেখেও তাদেরকে নিষেধ কিংবা তিরস্কার করেননি। কারণ শিশুদের এই বয়সে খেলাধুলার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবগত ছিলেন। সেকারণে তাদেরকে বেশ স্নেহ ও মমতা জ্ঞাপক সালাম করলেন। ইমাম গাজ্জালী রহ. বলেন, ‘(শিশুর জন্য ঘোষণা দিবে) পাঠশালা থেকে ফেরার পর সুন্দর খেলাধুলা করবে, যাতে পাঠশালার ক্লান্তি থেকে একটু প্রশান্তি ফিরে পায়। তবে দেখতে হবে খেলাধুলায় যেন আবার ক্লান্ত হয়ে না পড়ে। শিশুকে যদি খেলাধুলা থেকে নিষেধ করা হয় ও সর্বদা তাকে পড়াশুনার মধ্যেই ব্যস্ত রাখা হয়। তাহলে তার অন্তর মরে যাবে, মেধা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে তার জীবনযাত্রা হবে দুর্বিষহ। এমনকি সে তখন মৌলিকভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ফন্দি খুঁজতে থাকবে।
 অগ্রগামীতার প্রশংসা ও অনুপ্রেরণার মাধ্যমে শিশুর বিকাশ সাধন অগ্রগামীতার দু’টি অর্থ। প্রথমতঃ কাংক্ষিত কর্ম বিলম্ব না করে যথাসময়ে সম্পন্ন করা। শিশুদেরকে এ বিষয়ের ওপর অভ্যস্ত করা ও প্রশংসা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদেরকে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা উচিত। যেমন- সময়মত নামাজ আদায়ে পারস্পারিক প্রতিযোগিতা অথবা পাঠ পর্যালোচনা ও প্রশিক্ষণের উত্তর দানে প্রতিযোগিতা। এর ফলাফল সাধারণত তখনই প্রকাশিত হবে যখন কর্মসম্পাদনে কোন অনাহুত অন্তরায় সৃষ্টি হবে অথবা প্রত্যাশিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিলম্ব হবে। যদি প্রতিযোগিতারত অবস্থায় বিলম্ব ঘটে সেক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সাধনে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে কর্মসম্পাদনকে যদি তার সর্বশেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা হয়। এরপর যদি কোন কারণে সেটা আরো বিলম্ব করতে হয়। সেক্ষেত্রে সৃষ্ট বাধার কুফল পুষিয়ে নেয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না। ফলে প্রত্যাশিত কল্যাণ হাতছাড়া হয়ে যাবে অথবা তা সম্পাদনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। সে কারণেই শিশুদেরকে প্রতিযোগিতায় অনুপ্রাণিত করা ও এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করা উচিত। যেমন অভিভাবক নিজেই এ বিষয়ে একজন আদর্শ হতে পারেন। ফলশ্র“তিতে শিশুর প্রতিযোগিতার জন্য তা একটি নির্দেশনা ও মাইলফলক হতে পারে। দ্বিতীয়তঃ প্রতিযোগিতার অর্থ হলো উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শিশুর পক্ষ থেকে স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে অগ্রগামীতা। অর্থাৎ কারো পক্ষ থেকে উক্ত কর্ম সম্পাদনে তাকে আবেদন ব্যতিরেকেই সে অগ্রগামী হয়ে থাকে। যথা- কোন অভাবীর প্রতি অনুগ্রহ করা। দরিদ্রকে সাহায্য করতে অগ্রসর হওয়া। অথবা কম্পিউটার সামগ্রী অন/অফ করতে অগ্রগামীতা যখন সে এটা ভালো করে জেনে থাকবে ও তার নিকটজন এটা অফ করতে ভুলে যাবে তখন সে এটা করতে পারে। এ জাতীয় অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এই অগ্রগামিতাকে সাদরে গ্রহণ করে এ ব্যাপারে শিশুকে আরো উৎসাহিত করতে হবে। কারণ এটা শিশুর দ্রুত পরিপক্ক হওয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। পরিবেশ ও সমাজের সঙ্গে তার আচার ব্যবহারে সমৃদ্ধি আনয়ন করবে। শিশুর এই অগ্রগামিতাই একদিন সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির কারণ হবে। ফলে তাকে পেশ করা যাবে এক যোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে একটি সঠিক দাওয়াতের জন্য যার কারণে সে অফুরন্ত কল্যাণ লাভ করতে পারবে। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি মাইমুনা বিনতে হারেছ এর গৃহে অবস্থান করছিলাম। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য অজুর পানি এনে রাখলাম। অতঃপর তিনি যথাস্থানে পানি দেখে বললেন- ‘এটা কে রেখেছে?’ মাইমুনা রা. উত্তরে বললেন, ‘আব্দুল্লাহ’। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন- ‘হে আল্লাহ, তুমি ওকে দীনে ইসলামের জ্ঞান দান করো ও আব্দুল্লাহকে কোরআনে কারীমের তাফসীর শিক্ষা দাও।’ লক্ষ করুন, এখানে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. কারো প্ররোচনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য অজুর পানি রাখতে অগ্রসর হননি বরং সম্পূর্ণ নিজের পক্ষ থেকেই এমনটি করেছেন তিনি। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করেন এটা তিনি জানতেন বিধায় যথাস্থানে পানি রাখতে অগ্রসর হয়েছেন যাতে তিনি সজাগ হয়েই তা দ্বারা অজু সম্পন্ন করতে পারেন। যা ইবনে আব্বাসের একটি দাওয়াতী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ চরিত্রের অনুকূল দুআ করলেন। মুসলিম উম্মাহ দেখেছে, তিনি মুসলিম উম্মাহর বিদগ্ধ আলেম ও কোরআনে কারীমের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকর হয়েছেন। হাদীস শরীফে ইবনে আব্বাসের রা. অপর একটি তৎপরতার কথা বর্ণিত আছে। একদা তিনি নিজ ফুফি মাইমুনা বিনতে হারেছের রা. গৃহে রাত্রি যাপন করেন, (হাদীসের ধরন ও গঠনে প্রতীয়মান হয় এটা পূর্বের ঘটনা থেকে ভিন্ন এক ঘটনা) এটা দেখার জন্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করে থাকেন? সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলা যখন তাহজ্জুদ নামাজের জন্য দাঁড়ালেন তিনিও তাঁর মত দাঁড়িয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা যা করলেন তিনিও তা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে একাজে উৎসাহিত করছিলেন। তাঁর হস্ত মুবারক ইবনে আব্বাসের রা. মাথায় রাখলেন ও তার কান ধরে মর্দন করলেন যাতে নামাজে ঘুমাতে না পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এই অগ্রগামিতায় তাকে অনুপ্রেরণা দিলেন। ‘সে ছোট তার পক্ষে এ কঠিন কাজ করা সম্ভব নয়’ এই যুক্তিতে তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেননি। পক্ষান্তরে তার এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করার জন্য তার মাথায় হাত বুলালেন ও তার কান মর্দন করলেন। অতএব শিশুর আত্মপ্রত্যয়, উদ্যম ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অগ্রগামী তৎপরতা থাকলে তাকে এ ব্যাপারে আরো উদ্বুদ্ধ করা ও তার এ কর্ম তৎপরতার মূল্যায়ন করা উচিত। কিন্তু কখনো কখনো এ অগ্রগামিতা প্রত্যশার অনুকূল না হয়ে বরং সম্পূর্ণ উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে - এটা বাস্তব- তখন তার সমাধান কি হবে? এ পরিস্থিতিতে শিশুকে ধমকি, গালি কিংবা শাস্তি প্রদান চরম ভুল হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ এটা তার কর্ম তৎপরতাকে দুর্বল অথবা একেবারে নিঃশেষ করে দেবে। তার অগ্রগামী আত্মাকে গলাটিপে মেরে ফেলবে। ফলে সে একজন অথর্ব মানুষে পরিণত হয়ে যাবে। যার নিকট সকল কর্মতৎপরতা স্থবির হয়ে পড়বে। তবুও তা শিশুকে দিকনির্দেশনা দান ও বিষয়টি তার নিকট ব্যাখ্যার পরিপন্থী নয়। ঐ বিষয়গুলোরও উল্লেখ করতে হবে যা প্রত্যাশিত ফলাফল লাভে অনিবার্যভাবে বাধার সৃষ্টি করেছে। ফলে শিশুর জন্য পরবর্তী পরিস্থিতিতে তা একটা শিক্ষণীয় বিষয় হবে যার দ্বারা সে উপকৃত হতে পারবে।
 অতিরঞ্জন ও শৈথিল্য প্রদর্শন পরিহার করা প্রশংসা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন অথবা অনুপ্রেরণা- এগুলো শিশুর প্রতিভা বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক ভুল পথে চলেন। যখন তারা অনুভব করেন অথবা ধারণা করেন যে, শিশুটি তার প্রতিশ্র“ত কাজটি করতে পারবে না। অথবা যখন সে প্রত্যাশা বাস্তবায়নে শৈথিল্য প্রদর্শন করে তখন তারা তাকে বলে: তুমি একটা গবেট, একটা অথর্ব অথবা একটা অলস ইত্যাদি। অথবা তোমার মত লোক কোন কাজে সফল হতে পারে না অথবা এজাতীয় অন্য কোন কথা। যদিও বা কখনো এর দ্বারা অভিভাবকের উদ্দেশ্য শিশুকে উক্ত কর্ম ও কর্মে উৎকর্ষ সাধনে উৎসাহিত করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা ভুল পদ্ধতি, কারণ অদূর ভবিষ্যতে অভিভাবক তাকে যে অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন সে বাস্তবে সেই কর্মটি সম্পাদনেই উদ্যত হয়ে থাকবে। কারণ অভিভাবক তার বাহু ভেঙ্গে ফেলেছেন ও তার সঙ্গে নেতিবাচক বিষয় সংযোজন করে দিয়েছেন। ফলে সে ঐ কর্মটি সম্পাদনের কখনোই চিন্তা বা সংকল্প করবে না। যদি সে চেষ্টা করতো হয়ত বা তার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ ও সফল হতে পারতো। এক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগুলো পরিত্যাগ করতে হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অত্যধিক তিরস্কার করা, লাঠিদ্বারা আঘাত করা ও শিশুর থেকে পূর্ব সংঘটিত কোন শিথিলতার কারণে লজ্জা দেয়া। ফলে দূর অথবা অদূর ভবিষ্যতে তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে ও তাকে একজন ইতস্ততঃকারীতে রূপান্তরিত করবে। ফলে শিথিলতার আশঙ্কায় সে আর কোন কাজই করতে পারবে না। বিশেষ করে যখন এমন কাজ করা উদ্দেশ্য হয়, যার মধ্যে কোন ফলাফল নিহিত নেই। অতিরঞ্জনের কুপ্রভাবের এই অবগতির কারণে শিশুর অন্তরে সেটা বিরোধী আহ্বান ও ভীতিপ্রদ প্রবাদে ব্যবহারে পরিণত হবে। যেমন : এই সেনাবাহিনী অপাজেয়, কার সাধ্য আছে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? এজাতীয় বাক্য যা যুদ্ধ ছাড়াই মনের মধ্যে পরাজয়কে নিশ্চিত করে দিয়ে থাকে। সে কারণই বিদগ্ধজনেরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অতিরঞ্জনকারী অথবা কাপুরুষকে কখনোই মুসলিম যোদ্ধাদলের সঙ্গে বের হতে দেবে না। কারণ তার থেকে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বরং তার বের হওয়ার মধ্যে কোন উপকারিতা নেই। সে কারণে অভিভাবকের হুবহু ঐ পদ্ধতি অবলম্বন উচিত হবে না যা শিশুর আবেগ-উচ্ছাসকে চূর্ণ-বিচূর্ন করে দেবে। তার সামর্থ্যকে করবে ধ্বংস। বরং তার স্থলে অনুপ্রেরণা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পদ্ধতি অবলম্বন করা তার কর্তব্য। সে আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত কাজটি সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে। তার সামান্য দৃঢ়তা ও জিদেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যাবে। এবং তা এভাবেই হবে। অতএব এরূপ পদ্ধতির দ্বারাই উদ্দেশ্যে সিদ্ধি অথবা তার থেকে কিছু সাধনের আশা করা যায়। যেমন : এ পরস্থিতিতে ভাই-বোন ও প্রতিবেশীদের সন্তাদের মধ্যে তুলনা করা উচিত হবে না। বিশেষ করে যখন তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকবে ও সেই পার্থ্যকের যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকবে। এটা একদিকে যেমনভাবে শত্র“তা ও ঘৃণার সৃষ্টির করবে ও অপর দিকে বিজয়ীর সামনে পরাজয় অনুভূতি ও দুর্বলতার জন্ম দেবে যা তার জন্য অপমান ও পরাজয়ভাবের কারণ হবে। কখনো তার ওপর সঙ্গীদের সফলতা দেখে অথবা অনেক বিষয় তার শিথিলতার কারণে মনের মধ্যে শিশুর নিজের পক্ষ থেকে ব্যর্থতার অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে শিশুর অন্তরে উদ্যম ও সতেজতার প্রাণ সঞ্চারে তৎপর থাকা অভিভাবকের কর্তব্য। এবং তার নিকট কয়েকটি দিক উল্লেখ করতে হবে যেখানে সে এই পরাজয় থেকে তার বন্ধুদের ওপর বিজয়ী হতে পারবে। অথবা এমন কয়েকটি দিক উল্লেখ করতে হবে যেখানে সৃজনশীলতার সামর্থ্য প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও তা হয়েছে পরাজিত পদ্ধতিতে। যেমন : তাদের দুজনের মধ্য হতে এমন বিষয় তার থেকে আবেদন করবেন কিন্তু কেউ যেন এ ব্যাপারে টের না পায়। হতে পারে তা যেকোন বিষয়ের পাঠ। অতঃপর তার একজন এসে ঐ বিষয়ের পাঠ তার ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব অথবা সহপাঠীদের সম্মুখে পেশ করবে। কারণ এ জাতীয় তৎপরতা তাকে সর্বোৎকৃষ্ট অবয়বে তাদের সম্মুখে প্রকাশ করবে যা তাকে অনুপ্রেরণা যোগাবে ও তার পরাজয়ের গ্লানি নিরসনে সহায়ক হবে। এমন কিছু পরিস্থিতিও রয়েছে শিশুর, যা থেকে তাকে নিস্কলুষ করার জন্য দিক নির্দেশনা দিতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, অকারণে তার চরম শিথিলতা বা অবহেলা, অথবা এমন একটা কর্ম করে বসল যা তার উচিত হয়নি, অথচ এ সম্পর্কে তার অবহিত করা উচিত ছিল। এক্ষেত্রে অভিভাবক কি করবেন? এ প্রেক্ষাপটে উত্তম হচ্ছে সরাসরি শিশুর ব্যক্তি সত্তার দিকে টার্গেট করে সমালোচনা করবে না। বরং সমালোচনার গতিটা তার কর্ম ও আচরণের দিকে ফিরাবে। যেমন : বলা যেতে পারে, ‘এটা একটি মন্দ কাজ’ অথবা ‘তোমার এ তৎপরতাটা ভালো নয়’ কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন কথা। কখনো তাকে বলবে না : তুমি একটি মন্দ শিশু অথবা তুমি কোন ভালো মানুষ নও। কারণ সরাসরি ব্যক্তিত্বের সমালোচনা সাধারণত সৃজনে নয় বিনাশে সহায়ক হয়। পক্ষান্তরে যে সমালোচনার টার্গেট হয় কর্মতৎপরতা অথবা আচরণ- যার সম্পর্ক থাকে পরিস্থিতির সঙ্গে, ব্যক্তিত্বকে আহত করে নয়। আপনি যদি অধিকাংশ কাফেরদের তৎপরতা লক্ষ করে থাকেন তাদের রাসূলগণের সঙ্গে তাহলে দেখতে পাবেন যে, তারা আচরণ নয় সরাসরি রাসূলদের ব্যক্তিত্বকেই আঘাত করেছে। কারণ সত্য উদ্ঘাটন নয় তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিলো, তা হলো ব্যক্তিত্ব ধ্বংস আর তার মাধ্যমে আদর্শকে ধ্বংস।
 অনুভূতি ও দৃষ্টিভংগির পার্থক্য পর্যবেক্ষণ বক্তব্য গ্রহণ ও তার মর্মার্থ অনুধাবন, এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তির মধ্যে তাদের বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সে কারণে তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত, যাতে অভিভাবক যে বক্তব্য অথবা দিক-নির্দেশনা দিবেন তা উত্তমরূপে গ্রহণ করে শ্রোতা সেখান থেকে ভালভাবে উপকৃত হতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ওপর সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের অসংখ্য উলামায়ে কেরাম সতর্ক করেছেন। লক্ষ করুন, ইমাম শাতেবী এ বিষয়ে কত গুরুত্বপূর্ণ কথাই না বলেছেন, ‘অযোগ্য পাত্রে জ্ঞান সংক্রান্ত মাসআলা আলোচনা থেকে বিরত থাকবেন।’ অথবা ছোট মাসআলা ব্যতীত বড় কোন মাসআলা এমন ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করবেন না যা সে ধারণ করতে সক্ষম নয়। কারণ এটা প্রচলিত প্রতিপালনের পরিপন্থী। ফলে এ জাতীয় পদক্ষেপ সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। সে কারণে আলী রা. বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে তাদের বোধগম্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করো। আল্লাহ তাআ’লা ও তদীয় রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক এটা কি তোমরা পছন্দ করবে?’ এটা অনেক শ্রোতার জন্য পরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি তিনি বলেছেন, ‘এই মর্মবাণীসমূহের প্রতি যতœবান না হয়ে কোন আলেমের জন্য জ্ঞান শিক্ষা দান শুদ্ধ হবে না। আর এটা না হলে তো তিনি কোন অভিভাবকও হতে পারছেন না। বরং তিনি নিজেই দ্বিতীয় আরেকজন আলেমের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বেন যিনি তাকে প্রতিপালন করতে সক্ষম।’ সুতরাং অভিভাবকের একান্ত কর্তব্য হলো এই বয়োঃস্তরকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন ও পরিচর্যা করা। শিশুদের জন্য মনের ভাব প্রকাশক এমন পদ্ধতি ও শব্দমালা চয়ন করা যা তাদের জন্য সহজবোধ্য হবে। কারণ সে যদি এমন বিষয় আলোচনা করে যা শিশুর বোধ ও বুঝের বাহিরে তাহলে তা শুধু কালক্ষেপণ হবে বৈ কি। ফলে এর অন্তরালে সৃষ্টি হবে ভয়ঙ্কর ক্ষতি। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেন, ‘তুমি কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের বুদ্ধির পরিধি পরিমাপ না করে কোন বিষয় আলোচনা করবে না। আর তা না হলে তা তাদের কারো জন্য পথ ভ্রষ্টতার কারণ হয়ে যেতে পারে।’ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা শিশুদের বোধগম্য না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে অথবা উদাহরণ বা উপমা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে যে বিষয়টার উপলব্ধি করানো যায় সেক্ষেত্রে করণীয় কি? ইবনে জারির তার তাফসীর গ্রন্থে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘আবু বকর রা. ও উমার রা. আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট মধ্যবর্তী নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পাঠালেন, অথচ আমি তখন ছোট বালক ছিলাম। তিনি আমার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি ধরে বললেন- ‘এটা হলো ফজর।’ তার পাশের আঙ্গুলটি ধরে বললেন- ‘এটা যোহর।’ এরপর বৃদ্ধা আঙ্গুল ধরে বরলেন- ‘এটা মাগরিব।’ অতঃপর তার পাশের আঙ্গুল ধরে বললেন- ‘এটা হলো এশা’র নামাজ।’ এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমার হাতের আর কোন আঙ্গুল অবশিষ্ট আছে কি? উত্তরে আমি বললাম- ‘মধ্যমা’ আবার বললেন- ‘এবার বলো দেখি আর কোন নামাজ কি অবশিষ্ট আছে? উত্তরে আমি বললাম- ‘আছর’। তখন তিনি বললেন- ‘ঐটাই হলো আছর।’ লক্ষ্য করে দেখুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত সুন্দর করে তার কাংক্ষিত বিষয়ের বিবরণ দিয়েছেন। এমন একটি পদ্ধতিতে যা প্রমাণ করে শিশুর বোধশক্তিকে তিনি কতটা মূল্যায়ন করতেন। তাকে একথা সরাসরি বলে দেননি যে, মধ্যবর্তী নামাজ হলো আছরের নামাজ। বরং তার সঙ্গে এমন পথে চলেছেন যে পথ ধরে প্রশ্নকারী নিজেই তার উত্তর খুঁজে বের করতে পারে।
 ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি প্রদান ও সে শিশু এ যুক্তিতে তার অধিকার খর্ব না করা শিশুও তো একজন মানুষ তারও উপলব্ধি আছে। আছে অনুভূতি। সে বুঝতে পারে মানুষের মধ্যে কে তার সঙ্গে তার বয়সের যোগ্য ব্যবহার করছে ও কে তার সঙ্গে অবুঝ শিশুর মত ব্যবহার করছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এটা বুঝতে না পেরে তাদের সাথে অবুঝ শিশুর মত আচরণ করে থাকে। যেন তাদের কোন উপলব্ধি নেই। নেই কোন অনুভূতি অথবা সে একটি ছোট শিশু। এরূপ আচরণ এক দিক থেকে যেমন শিশুর জীবনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সাথে সাথে অন্য দিক দিয়ে তার সঙ্গে সম্পাদনযোগ্য কর্ম হ্রাস করার জন্য দাবী সৃষ্টি হয়ে থাকে। শিশুকে মূল্যায়ন ও তার ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি প্রতিপালনের এক অনন্য শিষ্টাচারÑ যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রয়োগ করেছেন। নিচের ঘটনা যার প্রমাণ বহন করে। সাহল বিন সা’দ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এক পেয়ালা দুধ আনা হলে তিনি প্রথমে তা হতে পান করলেন। তাঁর ডান পাশে একটি বালক উপবিষ্ট। যে বয়সে সকলের চেয়ে ছোট, অপরাপর গণ্য মান্য সাহাবায়ে কেরাম তাঁর বাম পাশে অবস্থান করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তুমি অনুমতি দিলে আমি আগে বড়দেরকে দিতে পারি?’ উত্তরে সে বলল- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনার থেকে আমার প্রাপ্ত অংশের ওপর আমি কাউকে প্রাধান্য দিতে পারি না।’ অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকেই দিলেন।’ সুন্নতও এটাই ছিল, যে ডানে থাকবে সে বাম পার্শস্থদের ওপর প্রাধান্য পেয়ে থাকবে। ফলে এটা ডানপার্শস্থদের অধিকারে পরিণত হয়ে গেলো। যদিও সে বয়সে সকলের চেয়ে ছোট হোক না কেন। সে কারণে সে বালক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অনুমতি নেয়া প্রয়োজন মনে করলেন অথচ বামপার্শস্থরা ছিলেন বয়সে প্রবীন। এ হাদীসখানা শিশুকে মূল্যায়ন ও তার ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি, তার অধিকারসমূহ উপেক্ষা না করা বরং এক্ষেত্রে তার অনুমতি গ্রহণ নিশ্চিত করেছে। যদি সে গ্রহণ করে তাহলে ভালো ও উত্তম। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলে তাকে দোষারোপ কিংবা এ ব্যপারে তাকে কোন তিরস্কার করা যাবে না। কিন্তু শিষ্টাচারের মাধুর্য হলো তা হতে শিশুটি এমন পদ্ধতি অবলম্বনে মুক্ত থাকার চেষ্টা করবে যার মধ্যে তার মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। ঐ বিচক্ষণ ছেলেটির দিকে লক্ষ করুন, সে কত সূক্ষ্মভাবে আপত্তি তুলে বলল, ‘আমি আপনার থেকে আমার প্রাপ্য অংশে কাউকে প্রাধান্য দিতে পারি না।’ উল্লেখ্য যে, বালকটি ছিল আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. তিনি তখন একটি ছোট শিশু ছিলেন।
 শিশুকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখা প্রকাশ থাকে যে, শিশু শরিয়তের বিস্তারিত বিধানাবলি পালনে আদিষ্ট নয়। আল্লাহ তাআলা যা নিষিদ্ধ করেছেন যদি সে এমন কর্মও করে বসে তবুও তার আমলনামায় পাপ লেখা হবে না। তথাপিও অভিভাবকদের কর্তব্য হলো শিশুকে নিষিদ্ধ কর্মসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখা। শিশু আদিষ্ট নয় বলে তাকে যেন এক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শনে উদ্যত না করে। যাতে সে পাপকর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে না পারে। ফলে অর্থহীন ও নিস্ফল কর্মে শিশুর মূল্যবান জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর সে তা হতে আর মুক্ত হতে পারবে না। অতঃপর এটা তার নির্ঘাত ধ্বংসের কারণ হয়ে যাবে। ইবনে কাইউম রহ. বলেন, ‘শিশু বুদ্ধি সম্পন্ন হলে অন্যায় ও অনর্থক আসর, গানবাজনা, অশ্লীল ও উদ্ভট কথা শ্রবণ ও মন্দ কথন থেকে নিজেদের দূরে রাখা অভিভাবকের কর্তব্য। কারণ সে যদি তার কানের সঙ্গে একবার এর সম্পর্ক করে নিতে পারে তাহলে বড় হলে শিশুর পক্ষে তা বিছিন্ন করা কঠিন হয়ে যাবে। অভিভাবকের পক্ষেও তাকে ওখান থেকে উদ্ধার করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বৈকি। এধরনের পথভ্রষ্টকে পরিবর্তন করা সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ। কারণ তখন আরেকটি স্বভাব প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হবে। বলাবাহুল্য পুরাতন স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসা হলো এক অসাধ্য সাধন। বর্তমানে অসংখ্য উপকরণ প্রচলিত রয়েছে যার মাধ্যমে শিশুর নিকট অন্যায় ও অনর্থক বিষয় পৌঁছে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পর্ণো, ম্যাগাজিন, অশ্লীল চ্যানেল, কাল্পনিক গল্প ও অসংখ্য বিকৃত মিডিয়া। অভিভাবক যখন এ সকল সামগ্রী গৃহে অনুপ্রবেশ না করাতে সক্ষম হবেন, তখনও তাকে অন্য আর একটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তা হলো-শিশু যদি অন্য কোন উপায়ে ঐ বস্তু সামগ্রীর নাগাল না পায়। চাই সেটা তার বন্ধু অথবা সহপাঠীদের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে হোক অথবা তাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে তা নিজের ঘরে উপস্থিত করে হোক। শিশুকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। মোদ্দা কথা হলো সন্তানের সঙ্গী নির্বাচনে অভিভাবকের ভূমিকা রাখা একান্ত কর্তব্য।
 ক্ষমা, উদারতা এবং অত্যাচারীর প্রতিবিধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন যে সকল নান্দনিক চরিত্রে শিশুকে প্রতিপালিত করা উচিত তার অন্যতম হলো ক্ষমা ও উদারতা। এর তাৎপর্য বর্ণনায় কোরআন ও হাদীসের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তবে কখনোই তা অত্যাচার সহ্য ও অত্যাচারীর প্রতিবিধান না করার প্রতি শিশুকে অভ্যস্ত করার সীমায় গিয়ে যেন না ঠেকে। যা শিশুর পরিণত বয়সে অপমান ও অপদস্ত হওয়ার কারণ হবে। একদিকে কোরআনে কারীমের বক্তব্য যেভাবে ধৈর্য ও ক্ষমার প্রশংসা করেছে। যেমন : আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন- فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّه. (الشورى-৪০ ) ‘যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোষ নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট আছে।’ আল্লাহ তাআ’লা আরো ইরশাদ করেন- وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُور. ( الشورى-৪৩) ‘অবশ্য যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, নিশ্চয় তা দৃঢ় সংকল্পেরই কাজ।’ তেমনিভাবে মন্দের সমপরিমাণ মন্দ দ্বারা প্রতিশোধ নেয়ার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। যেমন : আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন- وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا .(الشورى-৪০ ) ‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ।’ আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেন, وَلَمَنِ انْتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهِ فَأُولَئِكَ مَا عَلَيْهِمْ مِنْ سَبِيلٍ.(الشورى- ৪১ ) ‘অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিবিধান করে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।’ শরিয়তের প্রমাণ তারই প্রশংসা করে যে অত্যাচারীর প্রতিবিধান করে। আল্লাহ তাআ’লা ঈমানদারদের প্রশংসায় বলেন, وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُونَ. (الشورى-৩৯ )
 ‘এবং যারা অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ অতএব ক্ষমা ও উদারতার মত চরিত্র মাধুর্য একান্তভাবে কাম্য। যেমনিভাবে প্রতিশোধ ও প্রতিবিধানের চরিত্রও কাম্য। এর যে কোন একটাকে উপেক্ষা করলে অথবা তার আশ্রয় না নিলে জীবন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। যখন অধিকাংশ অভিভাবকের চিন্তা চেতনা শিশুর মনে ক্ষমা ও উদারতার মর্মবাণী দৃঢ়মূল করার দিকে কেন্দ্রিভূত, তখন তাদের মধ্যে অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারীদের প্রতিশোধ ও প্রতিবিধান করার মর্মবাণীও তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর হতে হবে। বিশেষ করে যখন বর্তমান বিশ্বের মুসলমানগণ তাদের আজন্ম শত্র“ ইয়াহুদী খৃষ্টান কর্তৃক আগ্রাসী আক্রমণের শিকার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের মধ্যে এই চরিত্র নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণের মধ্যেও। আয়শা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমার অজ্ঞাতসারে যয়নব রা. অনুমতি ব্যতিরেকে ক্রদ্ধাবস্থায় আমার ঘরে প্রবেশ করেছে। এরপর তিনি বললেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আবু বকরের কন্যা তার হাতের দুটি কংকন দিয়ে দিয়েছে তাতেই কি আপনি সন্তুষ্ট? অতঃপর তিনি আমার দিকে ফিরলে আমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এমন কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেই ফেললেন- ‘যাও! তুমি গিয়ে প্রতিশোধ নাও।’ এরপর আমি তাঁর দিকে মুখ করে তাকাতেই দেখি তার মুখ শুকিয়ে গেছে, ফলে আমার কোন প্রতি উত্তরই তিনি আর করতে পারলেন না। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখমণ্ডলে প্রফুল্লতা লক্ষ করলাম।’ দেখুন, এখানে যয়নব রা. যখন আয়শা রা. প্রতি অবিচার করলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রতিবিধান করার নির্দেশ করলেন। ক্ষমা ও উদারতার নির্দেশ করেননি। বরং তাঁর মুখমণ্ডলে প্রফুল্লতা তখন পরিস্ফুটিত হয়েছে যখন তার অধিকার আদায় করে নিতে দেখলেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক স্ত্রীর কাছে ছিলেন, তখন আমাকে তাঁর আরেকজন স্ত্রী একটি পাত্রভর্তি খানা নিয়ে পাঠালেন। তখন তিনি যে স্ত্রীর ঘরে ছিলেন তিনি আমার হাতে আঘাত করেন; ফলে বরতনটি হাত ফসকে পড়ে ভেঙ্গে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরতনের টুকরাগুলো একত্রিত করলেন, এরপর পাত্রের মধ্যে যে খানা ছিলো তাও একত্রিত করতে লাগলেন ও বললেন- ‘তোমাদের মা অতর্কিত আক্রমণ করেছেন। অতঃপর সেবক (আনাস রা.) খুব সতর্কতার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার ঘরে ছিলেন সেখান থেকে একটি ভাল পাত্র নিয়ে আসলেন। আর ভাঙ্গা পাত্রটি যে ভেঙ্গেছে তার ঘরেই রেখে দিলেন।’
 ঘরের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সমাজের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দান করা শিশুকে সঠিক পদ্ধতিতে সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করতে অভ্যস্ত করা অভিভাবকের কর্তব্য যেখানে সে বসবাস করে। সমাজ বিমুখ ও একগুয়েমীভাবে তার বিকাশ হতে পারবে না। অথবা সে ঘরমুখো হয়ে পড়বে যে তার বাবা অথবা বড় ভাইর সঙ্গ ছাড়া বের হতে চাইবে না। কিন্তু কোন অজ্ঞাত পরিচয় লোকের ওপর এ ঝক্কি রাখা যাবে না এ ব্যাপারে কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যেভাবে বলা হয়ে থাকে। শিশুকে নিরাপদ সময়ে বাড়ীর নিকটবর্তী কোন মুদি দোকানে যাওয়ার জন্য বের হতে ও সেখান থেকে বাসার কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে অভ্যস্ত করবে। এভাবেই তার দায়িত্ব পালনের ওপর অনুশীলন হতে থাকবে। অভিভাবকের পক্ষ থেকে অনুমতি প্রাপ্ত ক্রয়-বিক্রয়ে শিশুর লেনদেন করা শরিয়ত সিদ্ধ। তাকে পথ চলার নিয়মাবলী সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে যাতে কোন দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হয়। সে শুধু সামনের দিকে তাকাবে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া পেছনে তাকাবে না। রাস্তা পারাপারের সময় একবার ডানে ও একবার বামে তাকিয়ে নেবে যাতে কোন গাড়ি তাকে চাপা দিতে না পারে। রাস্তা পারাপারের সময় অপর শিশুদের সঙ্গে কথাবার্তায় মগ্ন হতে পারবে না। সহপাঠির সঙ্গে পথের মধ্যে অবস্থান করবে না। বরং তার থেকে কাম্য দায়িত্ব পালন ও গৃহে প্রত্যাবর্তন তার কর্তব্য। সহপাঠীকে ঘরে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করতে শিশুকে বারণ করবেন না। তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও অতিথির জন্য উপস্থাপণযোগ্য সামগ্রী তার সম্মুখে পরিবেশন করতে নিষেধ করবেন না। অসুস্থ পরশী অথবা সহপাঠীর সেবা শুশ্র“ষার জন্য যেতে অভ্যস্ত করবেন। কিন্তু এহেন পরিস্থিতিতে কাংক্ষিত সুফল পেতে হলে অভিভাবক কিংবা বড় ভাইর শিশুর সাথে থাকা উচিত। ‘আত্মমর্যাদাবোধ ও তার মত লোকের ওপর নির্ভর করা যায়, যে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদন ও দায়িত্ব বহনের যোগ্য’ এরকম চেতনাবোধ শিশুর মনে জাগ্রত করতে হবে। আমাদের সামনে কিছুক্ষণ পূর্বে এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। আবু বকর রা. ও উমার রা. একটি ছোট বালককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পাঠালেন-মধ্যমা নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে। আনাস রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমত করছিলেন যখন তার বয়স ছিলো মাত্র দশ বছর। কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পাঠাতেন। উক্ত কর্ম সম্পাদনে তার ওপর নির্ভর করতেন। উপরন্তু কোন গোপন বিষয়ে তাকে বিশ্বস্ত মনে করতেন। ছাবেত রা. আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নিকট আসলেন আর আমি তখন ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিলাম। তিনি আমাদেরকে সালাম করলেন ও আমাকে একটি কাজে পাঠালেন। ফলে আমার ঘরে ফিরতে একটু বিলম্ব হয়ে যায়। অতঃপর যখন আমি বাড়ী পৌঁছলাম, আমার মা আমাকে বললেন- ‘তোমার কি হলো? দেরি করে বাড়ীতে ফিরলে যে? আমি বললাম, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তাঁর একটি কাজে পাঠিয়েছিলেন। মা বললেন, ‘কি কাজে ?’ উত্তরে আমি বললাম, সেটা গোপন (বলা যাবে না)। তখন আমার মা বললেন- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গোপন বিষয় সম্পর্কে কারো সঙ্গে আলাপ করবে না যেন। আনাস রা. বললেন-‘ ছাবেত, ঐ প্রসঙ্গে আমি যদি কারো সঙ্গে আলোচনা করতাম, তাহলে তোমার সাথে তা আমি অবশ্যই আলাপ করতাম।
 বড়দের সঙ্গ দেয়া ও আলেমদের বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ প্রদান অনেক মানুষ আছেন যারা অবুঝ শিশুদের প্রতি যতটুকু লক্ষ রাখেন এই বয়সের শিশুদের প্রতি ততটুকু ভ্রুক্ষেপ করেন না। ফলে তাদেরকে আলেম-উলামা ও বড়দের মজলিসে যেতে বারণ করে থাকেন। শিক্ষামূলক সেমিনারে উপস্থিত হতেও নিষেধ করেন তা ধারণ করতে তাদের অসমর্থতার আশঙ্কায়। যখন মজলিসে কাংক্ষিত অতিথি শুভাগমন করেন তখন বুঝদার শিশুদেরকে মজলিস থেকে বের করে দেয়া হয় এবং তাদের সাক্ষাৎকার থেকে শিশুদেরকে বঞ্চিত রাখা হয়। অনেকে তো খুবই অতিরঞ্জন করে ফেলেন। শিশুদেরকে একটি কক্ষের মধ্যে বন্দি করে অতিথি বের হওয়া পর্যন্ত তালাবদ্ধ করে রাখেন। এগুলো সবই স্বাভাবিকতার ওপর অতিরঞ্জন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, এতো কিছুর পরও তারা এটাকে শিষ্টাচার হিসেবে গণ্য করে থাকেন। বরং প্রকৃত শিষ্টাচার ও সঠিক তৎপরতা হলো অভিভাবক শিশুদেরকে এ জাতীয় মজলিসে উপস্থিত হওয়ার জন্য সুযোগ করে দেবেন। ফলে তারা সেখান থেকে কথা বলার শিষ্টাচার শিক্ষা করতে পারবে। শিখতে পারবে মজলিসের আদব ও শ্রবণ করার আদব। শুধুমাত্র ঐ কথাগুলোই তারা শুনবে যদ্বারা তারা উপকৃত হতে পারবে। অনুরূপ আচরণ বালিকাদের সঙ্গেও করতে হবে মহিলাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। শিশুদের মনের মধ্যে এ সকল মজলিসে উপস্থিত হওয়ার একটা ভালো প্রভাব পড়বে। কারণ তারা তখন উপলব্ধি করতে পারবে যে, তারা প্রাথমিক শৈশব স্তর অতিক্রম করেছে। ফলে তাদেরকে পরবর্তী স্তরের যোগ্য করে তুলতে খুব দ্রুত কাজ করবে। কোন মজলিসই এ সুবিধাগুলোর আওতামুক্ত নয়। শুধুমাত্র ঐ বিশেষ মজলিসগুলো ব্যতীত যা শুধু বয়স্কদের জন্য। যেমন হিজরতের হাদিসে সংঘটিত ঘটনা : যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরের রা. নিকট এমন এক মুহূর্তে গমন করলেন যে সময় ইতিপূর্বে কখনো যাননি। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘তোমার কাছে যারা আছে তাদের বেরিয়ে যেতে বলো। উত্তরে আবু বকর রা. বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, তারা হলো আমার কন্যাদ্বয় আয়েশা রা. ও আসমা রা.। আরো বললেন, ‘আমি তাদেরকে জ্ঞাত করেছি যে, আমার হিজরতের অনুমতি হয়ে গেছে....।’ সালাফে সালেহীন আপন সন্তানদেরকে সভা সেমিনারে উপস্থিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তখন তো শিশুরা বড়দের সঙ্গে বসার আদব কায়দা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করতে পেরেছিল। তারা চুপ থাকতো, মনোযোগ সহকারে শুনতো ও কোন কথা বলতো না। এমনকি আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে তাদের জানা থাকলেও। তবে কোন কোন সময় তাদের থেকে কিছূ বলার ইচ্ছা অথবা অনুরোধ করা হয়ে থাকতো। সামুরা বিন যুন্দব রা. দিকে লক্ষ করুন। তিনি রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমলে একটি বালক ছিলাম। আমি তাঁর থেকে হাদীস সংরক্ষণ করতাম। সেখানে আমার চেয়ে বয়স্ক লোকদের উপস্থিতি ভিন্ন অন্য কিছুই আমার কথা বলার অন্তরায় হয়নি।’ অনুরূপ আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. এর মজলিসের আদব রক্ষার একটি ঘটনাও বিবৃত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, ইতোমধ্যে ‘যুমার’ আনা হলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘এমন একটি বৃক্ষ রয়েছে যার উদাহরণ হলো মুসলমানের মত। তখন আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, সেটা খেজুর গাছ। তথাপিও আমি উপস্থিত সকলের চেয়ে বয়সে ছোট বিদায় নীরব থাকলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই বললেন, ‘তা হলো খর্জুর বৃক্ষ।’ হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. যখন দেখতে পেলেন যে, তিনি সকলের চেয়ে বয়সে ছোট অথচ সেখানে আবু বকর রা. ও উমার রা. এর মত শীর্ষ স্থানীয় সাহাবীও উপস্থিত রয়েছেন একথা ভেবে চুপ থাকলেন। মনের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীর অনুকূল উদিত উত্তরকে অবদমিত করে রাখেন।
 শিশুকে সুযোগ্য করে গড়ে তোলা সাধারত মুসলিম বিশ্বের একটি শিশু স্কুলে যাতায়াত করা ব্যতীত অন্য কোন কাজ করে না। কিন্তু কিছু হতদরিদ্রের সন্তানের ক্ষেত্রেও যে এর ব্যতিক্রম হয় না এমনটি কিন্তু নয়। যারা এক মুঠো জীবিকার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকে। তারা কোন কর্মই উত্তম রূপে সম্পন্ন করতে পারে না। যদিও তা একেবারে ক্ষুদ্র হয়। গৃহস্থালীর এমন অনেক প্রয়োজনীয় কাজ রয়েছে যা কন্যা শিশুরাই করতে সক্ষম যদি তাদেরকে এ বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এটা বোধগম্য নয় যে, ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক পড়াশুনার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে হবে, যতক্ষণে তার বয়স হবে আনুমানিক তেইশ বছর। এরপর সে কোন কর্মই আর উত্তম রূপে সম্পন্ন করতে পারবে না। ফলে সে মা-বাবার ওপর বোঝা হয়ে থাকবে। অতএব শিশুকে সুযোগ্য করে গড়ে তোলার ব্যাপারে অভিভাবককে যারপর নাই তৎপর হওয়া উচিত। অর্থাৎ তাকে যে কোন কর্ম উত্তমরূপে সম্পন্ন করার যোগ্য করে গড়ে তোলা। ফলে এর দ্বারা সে নিজে উপকৃত হতে পারবে এবং সমাজেরও প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে। প্রকাশ থাকে যে, সম্পাদনযোগ্য কর্মসমূহ সম্পন্ন করার জন্য শিশুর শরীর ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ও কর্মক্ষম হয়ে উঠে। তবে এই কর্মটি সমাজ, যুগ ও এর চাহিদার বিচিত্রতার দরুণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। সালাফে সালেহীনগণ রহ. তাদের সন্তানদেরকে সাঁতার শিক্ষা দিতেন। যেমনিভাবে আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করতে তাদেরকে তীর চালনা ও অশ্বারোহণ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকতেন। মুসলিম জাহানের খলীফা উমার রা. সেনাপতি আবু ওবাইদার নিকট শাহী ফরমান লিখে পাঠালেন- ‘তোমাদের সন্তানদেরকে সাঁতার ও তীর নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ দাও!’ (বর্ণনাকারী) বলেন, টার্গেট ভেদ করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এ বিষয়ে তাদেরকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে সকল কাজের মধ্যে আল্লাহর কোন স্মরণ নেই তাই অনর্থক ও খেলতামাশা। কিন্তু চারটি কাজ খেলা হওয়া সত্ত্বেও এরূপ নয়। ক্স পুরুষের তার বৈধ স্ত্রীর সঙ্গে খেলাধুলা করা ক্স ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেয়া ক্স বিবাদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করা ক্স ও সাঁতার শিক্ষা করা। ’ সময় ও যুগের ব্যবধানে উপকরণ ও প্রয়োজনেরও ব্যবধান হয়ে থাকে। অতএব এ বিষয়টারও মূল্যায়ন করতে হবে।
 শিশুকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ একজন প্রকৃত অভিভাবক কোন যুক্তিতেই শিশুর পর্যবেক্ষণকে অবহেলা করতে পারেন না। বরং তিনি শিশুকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখবেন। কিন্তু অবহেলার এমন কতগুলো প্রকার রয়েছে যে দিকে মানুষ ভ্রুক্ষেপই করে না বরং তারা এর উল্টো মনে করে। আমার নিকট তার বাস্তব উদাহরণ হলো, সন্তানদেরকে আভ্যন্তরীণ আবাসিক বিদ্যালয়সমূহে ভর্তি করানো। যেখানে সপ্তাহে পাঁচ বা ছয় দিন সন্তানদের থেকে তার মা-বাবা বিচ্ছিন্ন থাকেন। যেখানে সকল শিশু একসঙ্গে শিক্ষকবৃন্দের তত্ত্বাবধানে থাকে। এখানে কথিত উপকারিতা হতে ক্ষতিই অনেক বেশি হয়ে থাকে। ক্স প্রতিষ্ঠানিক সমাজের চরিত্রসমূহে চরিত্রবান হওয়া ক্স অপর এমন শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া যাদের সম্মন্ধে মা-বাবা কিছুই জানে না। ক্স মা-বাবার পর্যবেক্ষণ বিচ্ছিন্ন অথবা দুর্বল হওয়ার দরুণ অনেক সমস্যার সৃষ্টি হওয়া। কখনো বা বলা হয়ে থাকে শিক্ষকদের অসামান্য পরিশ্রম ও ভূমিকা এক্ষেত্রে শিশুর দিক নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ করে থাকে। ঠিক কথা, তবে এটা কখনোই মা-বাবার ভূমিকাকে নি®প্র্রয়োজন করতে পারে না। ক্স শিশু ও পরিবারের মাঝে স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্স শিশুদেরকে নিজ পরিবেশের সংশ্রব ও মেলামেশা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়- যা তাকে পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত পাত্রে পরিণত করবে। যদি আমরা মেনেও নেই যে, এ পদ্ধতিতেই জ্ঞান আহরণ উত্তম। তারপরও একথা বলবো শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনই সবকিছু নয়। মা-বাবার চোখের সামনে শিশুর বিকাশ তার চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, শিক্ষায় অসংখ্য মেধাবীমুখ এ সকল বিদ্যালয়ের বাহির থেকেই আবির্ভূত হয়।  
বহিরাগত প্রভাব বিস্তারকারীর আনুগত্য এ বয়োস্তরে শিশুর মধ্যে বহিরাগত প্রভাব প্রতিফলিত হয়। যেহেতু শিশু তখন স্কুল ও পথের দিকে যায়। ফলে অপরের সংশ্রব পেতে শেখে। হতে পারে তারা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কোন গুরুত্ব পায়নি। ফলে স্ববিরোধী প্রভাব শিশুর মধ্যে প্রকাশ পেতে পারে। তার আচার- ব্যবহারে অনাহুত পরিবর্তন সাধিত হবে আর উম্মেষ ঘটবে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনার। বিশেষ করে বিশাল বিশাল মনগড়া তথ্য তৈরীর ছত্র ছায়ায় আমাদের সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমাদেরকে যার শরণাপন্ন হতে হবে। যদিও এ ধরনের গবেষণার জন্যও গৃহ, বিদ্যালয়, মিডিয়া ও সরকারী সংস্থাসমূহের ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। কারণ আমাদের পক্ষে এর পুর্ণাঙ্গ পর্যায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। এ মহৎ কর্মে অভিভাবকই মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তিনিই তো সম্যক অবগত কু-চিন্তা ও মন্দ দৃষ্টিভঙ্গী অথবা অসৎ পরিকল্পনা সমাজে কেমন ঢেউ খেলে। ফলে সে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারবে শিশুর ওপর এর মাধ্যমে কি অবাঞ্চিত পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সূক্ষ্ম বিচক্ষণতার সঙ্গে এটা তাকে উপলব্ধি করতে হবে এবং একটু কৌশলে তা তাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ফলে এর উৎস ও তা কোথা থেকে এসেছে তাও সে জানতে পারবে। এখন শিশুর মনন ও আচরণে বদ্ধমূল হওয়ার পূর্বে উপযুক্ত পদ্ধতিতে তার চিকিৎসা করা অভিভাবকের একান্ত কর্তব্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে ভবিষ্যতে তার প্রতিকার করা দুরূহ ও কঠিন হয়ে পড়বে।  
দায়িত্ব পালনে শিশুর অংশিদারিত্ব শিশুকে এই বয়সে কোন দায়িত্ব গ্রহণে অংশীদার করা উচিত। এই দিকে তাকাবে না যে, সে এখনো ছোট; বিশেষতঃ এই স্তরের শেষের দিকের সময়গুলোতে। পক্ষান্তরে যদি তাকে কোন দায়িত্বভার গ্রহণে অংশীদার না করা হয় অথচ সে এক পৈরুষের সমপর্যায় পৌঁছার প্রায় নিকটবর্তী হয়ে গেছে। তাহলে আর কবে সে এ দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারবে ? অতএব শিশুকে এ ব্যাপারে সচেতন করা অভিভাবকের কর্তব্য। যেমন : ক্স তাকে এক দিনের স্থলে একসঙ্গে এক সপ্তাহের খরচার টাকা দিয়ে দিবে। সেখান থেকে প্রয়োজন সাপেক্ষে সে ব্যয় করবে। এবং খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে। ক্স কোন কোন কাজে তার মতামত চাইবে ও তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তার মতের ব্যাখ্যা করবে। তার সকল কথা কাটবে না। একাধিক বিকল্পের মধ্যে যে কোন একটা নির্বাচনের সুযোগ দেবে। ক্স এবং তার কাছ থেকে কোন কর্ম সম্পাদনের প্রতিশ্র“তি নেবে। গৃহস্থালী ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কোন কাজের দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত করবে। কিন্তু এটা কি কল্পনা করা যায় যে, শিশু প্রথম বারেই কাংক্ষিত পদ্ধতিতে উক্ত কর্মটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে? নিঃসন্দেহে এমন আশা পূরণ সুদূর পরাহত। সুতরাং কোন ভুল-ত্র“টি হয়ে যেতেই পারে। এ ব্যাপারে অভিভাবককে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, কোন কর্মের সূচনা এমনই হয়। সে কারণে এ ধরনের পরিণতিতে অভিভাবককে ইমোশনাল হয়ে শিশুকে শাস্তি দেয়া অথবা তাকে অর্পিত কাজটি প্রত্যাহার করে নিলে চলবে না। বরং শিশুকে এক্ষেত্রে সঠিক পথটি দেখাতে হবে এমন পদ্ধতিতে যা তার জন্য অপমান ও তার ব্যয়িত শ্রমকে তাচ্ছিল্যের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এবং তার সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে তা সমাধানের জন্য কাজ করবে। তবে এ প্রেক্ষিতে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হলো তাকে কোন বড় বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ অথবা যে কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার দরুণ ভুল হয় সেই কাজের দায়িত্ব অথবা প্রতিনিধিত্ব তাকে দেবে না। বরং দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমে ছোট ছোট কর্ম দিয়ে সূচনা করবেন। এমনিভাবে এক পর্যায়ে যখন সেটা তার জন্য সহজ হয়ে যাবে ও সঠিকভাবে তা সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে তখন তার ওপর যে কোন বড় ও মহৎ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা যাবে। যে সকল কাজের দায়িত্ব শিশুর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে সে ব্যাপারে তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত করা উচিত। যাতে প্রতিটি ব্যাপারে তাকে অভিভাবকের দিকে ফিরে আসতে না হয়। এমনিভাবে অভিভাবকের জন্য শিশুর প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারিত করে দেয়া উচিত নয়। তার প্রতিশ্র“ত কর্ম সম্পাদনে স্বাধীনতা দেয়া উচিত। বরং ‘শিশু করতে সক্ষম নয়’ এমন কোন কর্ম সম্পর্কে যদি তার এ রকম প্রবল ধারণা হয় কেবলমাত্র সেক্ষেত্রে তাকে পথ দেখাতে হবে। তবে অবশিষ্ট কাজ-কর্মে তাকে শুধু সংক্ষিপ্ত দিক-নির্দেশনা দিলেই চলবে। ফলশ্র“তিতে শিশু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মসমূহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে শিশুর ছোট বড় প্রতিটি পদক্ষেপে অভিভাবকের দিকে প্রত্যাবর্তনের প্রতি তার অতিশয় আগ্রহ এ জাতীয় প্রতিটি ব্যাপারে দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে শিশুকে পরিপূর্ণরূপে আবদ্ধ করে রাখা ও পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রে তাকে কোন অধিকার না দেয়া, অচিরেই ব্যক্তিত্ব, সমর্থন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেবে। ফলে তখন দায়িত্বভার প্রদানটা হবে অনর্থক ও অকার্যকর।  
প্রতিপালন ও শিক্ষায় অভিভাবকের তৎপরতা অভিভাবকের কাজই হলো প্রতিপালন। সে একটি সুশৃঙ্খল নির্মাণ কাজের দায়িত্ব নিয়েছে যার প্রতিপালন করবে তার পরিচ্ছন্ন ও সঠিক বিকাশের জন্য। সুতরাং অভিভাবক সমাধানের জন্য ভুল-ত্র“টি অথবা সমস্যা সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকবেন না। অতএব যে সকল ত্র“টি-বিচ্যুতি শিশুর থেকে সংঘটিত হওয়া সম্ভব অথবা তার দৃষ্টিতে সংঘটিত হতে পারে সে ব্যাপারে শিশুকে প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ দেয়া অভিভাবকের কর্তব্য। তার বয়স উপযোগী কর্মই তার জন্য নির্বাচিত করা উচিত। বয়োঃসন্ধির চিহ্নসমূহ সম্পর্কে বয়োঃপ্রাপ্তির কিছুকাল পূর্বেই তার সঙ্গে আলোচনা করে নেবে। অর্থাৎ ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ বছরেই তার সঙ্গে আলোচনা করবে। এভাবে মা তার মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারবেন। আরো আলোচনা করবে অপবিত্রতা থেকে কিভাবে পবিত্র হওয়া যায়। উক্ত আলোচনাটা অবশ্যই শিশুর বয়স নবম বছর অতিক্রম হওয়ার পূর্বে হতে পারবে না। এই প্রত্যাশিত প্রক্রিয়ায় প্রতিপালন হলে তাকে ভীত্তিমূল প্রতিপালন আখ্যায়িত করা যায়। আর এরই অর্থ নিখাঁদ নির্মাণ। সে কারণেই তার জন্য প্রত্যেকটি বয়োঃস্তর অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ-প্রস্তুতি ও ধীর-স্থীরতা একান্ত প্রয়োজন। এটা ডাক্তারী পরিচর্যার সম্পূর্ণ বিপরীত। যা বাস্তবানুগ ত্র“টি বা রোগ ব্যাধির চিকিৎসার প্রয়াস পেয়ে থাকে। ত্র“টি সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রয়োগ করতে হবে। কখনোই নির্ধারিত বয়োঃস্তর পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলবে না।
 অপচয়হীন ব্যয় শিশুর প্রতিপালনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকে বিশ্বস্ততা, আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ প্রভৃতি নান্দনিক চরিত্রে অভ্যস্ত করা। ব্যয়ের ক্ষেত্রে শিশুর ওপর কার্পণ্য এগুলো সব ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। যখন শিশু লক্ষ করবে তার অনেক বন্ধু মিঠাই ও জুস ক্রয় করছে অথচ সে এর কোনটাই অর্জন করতে সক্ষম নয়। তার বাবার দারিদ্রতার জন্য নয়, বরং এটা শুধুমাত্র তার কার্পণ্যতার কারণে। তখন শিশু বিশেষ পদ্ধতিতে সেটা অর্জন করতে চাইবে। সে ঘর অথবা বন্ধুদের থেকে চুরির আশ্রয় নিয়ে থাকবে। যেমনিভাবে তার সহপাঠিদের নিকট ভিক্ষার হাত সম্প্রসারিত করার মাধ্যমেও এ সমস্যার সমাধান হতে পারে যা তার ব্যক্তিত্বকে একেবারে ম্লান করে দিতে পারে। ফলে অনেক সময় তাকে দাতার অপদস্ত অনুগামীতে রূপান্তরিত করে ফেলবে। ইবনে কাইয়্যূম রহ. বলেন, ‘অভিভাবকের উচিত হলো শিশুকে অপরের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ থেকে চূড়ান্তভাবে ফিরিয়ে রাখবে। কারণ যদি সে গ্রহণে একবার অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে এটা তার স্বভাবে পরিণত হয়ে যাবে। ‘গ্রহণ করবে কিন্তু দান করবে না’ এভাবেই তার বিকাশ হবে।’ এমনিভাবে অধিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমালংঘন উচিত নয়- যা যুক্তিসঙ্গত সীমার অতীত। কারণ তা শিশুকে ধ্বংস করে দেবে। একেবারে ব্যয় না করা যদিও নিন্দিত চরিত্র। কিন্তএর বিপরীতে আরেকটি চরিত্র আছে যা এর থেকে মন্দ নয়। তা হলো অপচয় ও অপব্যয়। আল্লাহ তাআ’লা পবিত্র কোরআনে এ উভয় চরিত্র থেকে দূরে থাকতে বলেছেন - وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا. (الإسرآء-২৯ ( ‘তুমি তোমার হাত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিত করেও দিও না। তা হলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’
 প্রতিপালন কর্মে অভিভাবকের হৃদয়ের বিশালতা এই বয়োঃস্তরের মাঝামাঝি ও তারপর শিশুর অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ ও মন্তব্য করণের উৎসাহ সৃষ্টি হয়। যেমনিভাবে তার নিকট সূচিত হয় প্রশ্নবান ও জিজ্ঞাসাবাদের আধিক্য। কোন কোন অভিভাবকের সময় থাকে খুবই ব্যস্ত, তারা শিশুদের জন্য এতটুকু সময় বের করতে পারেন না। এ প্রেক্ষিতে একেবারে সহজ সমাধান হলো : শিশুর সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় থেকে দূরে থাকবে এই যুক্তিতে যে, সে খুবই ব্যস্ত এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করার মত তার হাতে কোন সময় নেই অথবা এই মতামতগুলো নিরেট অসার অথবা অপূর্ণাঙ্গ ইত্যাদি। এটাই হলো সব চেয়ে বড় ভুল। কারণ একটি শিশু তার অভিভাবকের দিকে শ্রদ্ধামাখা দৃষ্টিতে তাকায়। অতএব সে-ই পারে তার এ সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে। আর যখনই তিনি তাকে বিমুখ করলেন তখন শিশুটি নিশ্চয় অন্য কারো শরণাপন্ন হবে ও অভিভাবকের নিকট যা পেলো না সেটা তার কাছে তালাশ করবে। ফলশ্র“তিতে একটা গবেষণাগত বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হবে অথবা শিশু ও তার অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকের কর্তব্য হল, তার বক্ষ প্রসস্ত রাখবেন ও নিজের কাজগুলো যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে তার সময়ের মধ্য থেকে একটি সময় বের করে নেবেন যেখানে শিশুর এই প্রয়োজনগুলোর সাড়া তিনি দিতে পারবেন। তার কল্পনা প্রসূত অসংখ্য বিষয়ের থেকে এটা উত্তম। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে বরং প্রথমে তার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনবেন তারপর তার বক্তব্যের অনুশীলনী ও ব্যাখ্যা করবেন। কারণ এটাই মানব বিনির্মাণের সঠিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে সে নিজের, সমাজের ও দ্বীনের প্রভূত কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হবে।
 ইসলামী পরিভাষাগুলোর ব্যবহার পূববর্তী বয়োঃস্তরে কখনো শিশুকে ‘এটা একটা ভালো ও সময় উপযোগী কাজ’ এ জাতীয় কথা বলা গ্রহণযোগ্য ছিল। কারণ সেটা মা-বাবার নিকট পছন্দনীয় কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেভাবে গ্রহণযোগ্য হতো ‘এটা দোষের অথবা এ জাতীয় কথা।’ কারণ সে কাজটি ছিলো অপছন্দনীয়। কিন্তু এই স্তরে এসে শরিয়তের পরিভাষাগুলো প্রয়োগ করা উচিত। কারণ এটাই তাকে পৌরুষ স্তরের যোগ্য করে তোলার মাধ্যম। তখন বলতে হবে এটা হালাল ও এটা হারাম, ওটা মুস্তাহাব ও ওটা মাকরুহ্ ইত্যাদি। এর প্রমাণ স্বরূপ একটি আয়াত ও একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে শিশুকে শরিয়তের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে। যাতে বিষয়গুলো অভ্যাস ও সামাজিক প্রচলনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারে। ফলে সে কাজগুলোর তাৎপর্য ও মর্যাদা অর্জিত হয়ে যাবে। ফলে আল্লাহর আইন ও তার দ্বীনের মহত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে ও প্রকারান্তরে বয়োঃসন্ধি স্তরের জন্য শিশুকে তৈরী করাও হয়ে যাবে। তবে অভিভাবকের পক্ষ থেকে আল্লাহ তাআ’লা ও তদ্বীয় রাসুলের প্রতি মিথ্যারোপ করা হতে সতর্কতা অবলম্বন একান্ত কর্তব্য। যেমন বলা : ‘এটা আল্লাহ বলেছেন’ অথচ তিনি বলেননি। ‘এটা রাসূল বলেছেন’ অথচ তিনি বলেননি। এ রকম অসত্য কথা না বলেও একটি শিশুকে কিছু গ্রহণ কিংবা পরিহার করতে উদ্যত করা যায়। আর এ বয়সের শিশুদের সাথে অবাস্তব কোন কথা বলা উচিত নয়। যখন শিশু দেখবে কথাটা অবাস্তব তখন সে অভিভাবককে মিথ্যাবাদী মনে করবে। কিংবা অবাস্তব কথা বলাকে কোন দোষের কাজ বলে মনে করবে না।

 চিন্তা, গবেষণা ও কারণ নির্ণয় শিশুর প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিন্তা ও গবেষণা পরিচিতির ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ। যা তাকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বিশুদ্ধ সুদৃঢ় জ্ঞানের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। ফলশ্র“তিতে শিশু তার চতুর্পার্শ্বস্থ প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা ও সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সম্পর্ক গড়ে তুলবে সূর্য ও পূর্ব দিগন্তে তার নিয়মিত উদয় ও দিনের শেষে তার অস্তগমনের সঙ্গে। কিন্তু সে কখনোই এই মহান ঘটনা সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারে না- কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে? কিভাবে সে ভ্রমণ করে? কোন শক্তি তাকে ভ্রমণ করতে বাধ্য করছে ও তার জন্য এ অদ্ভুত নিয়ম কে বেঁধে দিয়েছে?Ñ যার কারণে তার ভ্রমণে কখনোই ব্যত্যয় ঘটে না। কোত্থেকে আসলো তার এই তীর্যক জ্যোতি? প্রভৃতি বিষয় রয়েছে- যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বহু চিন্তা ও গবেষণা, বস্তু সমূহের পরিচিতি ও তার কারণ জানা প্রয়োজন। ভূ-পৃষ্ঠে এরকম অসংখ্য বস্তু রয়েছে। নদ-নদী, সাগর মহাসাগর ও চন্দ্র সবই তো এর অন্তর্ভুক্ত। আরো রয়েছে খুঁটিহীন স্-ুউচ্চ নভোমণ্ডল ইত্যাদি। অতএব এই বস্তু সামগ্রীর দিকে লক্ষ করতে, এ সম্পর্কে গবেষণা করতে, তার হেতু ও কারণ অনুসন্ধান করতে ও এগুলোর সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানতে শিশুকে অভ্যস্ত করা অভিভাবকরে দায়িত্ব। শিশুর ব্যক্তিত্ব বিনির্মাণে এর অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে, যা সঠিক পদ্ধতিতে শিশুকে বিষয়গুলো অনুধাবন করাতে সক্ষম। এর সিঁড়ি বেয়ে শিশু এমন এক চূড়ান্ত ফলাফলে গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হবে, যার মধ্যে ইহ-পারলৌকিক কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। দেখুন, সায়্যেদুনা ইব্রাহিম আ. যিনি এ পথে চলেছেন। আল্লাহ তাআ’লা এই ঘটনার বিবরণ তার জবানীতে দিয়েছেন- فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَبًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَا أُحِبُّ الْآَفِلِينَ ﴿৭৬﴾ فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِنْ لَمْ يَهْدِنِي رَبِّي لَأَكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ ﴿৭৭﴾ فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ . (الأنعام-৭৬-৭৮) ‘অতঃপর রাত যখন তাকে আচ্ছন্ন করল তখন সে নক্ষত্র দেখে বলল- ‘এটাই আমার প্রতিপালক।’ অতঃপর যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বলল, ‘যা অস্তমিত হয় তা আমি পছন্দ করি না।’ অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বল রূপে উদিত হতে দেখল তখন বলল, এটাই আমার প্রতিপালক।’ যখন তা অস্তমিত হল তখন বলল, ‘আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করলে আমি অবশ্যই পথ ভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ কখনো বা এই চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা গৃহস্থালী সামগ্রী সংক্রান্ত কোন কাজ অথবা সেই কর্ম যা শিশু প্রত্যক্ষ করে সে ক্ষেত্রেও হতে পারে। এর দ্বারা এটাই একমাত্র লক্ষ্য নয় যে, উক্ত বিষয়ের সত্যিকারের পরিচয় লাভ করতে পারবে। বরং উক্ত গৃহস্থালী সামগ্রী সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালিত করে কোন ফলাফলে পৌঁছতে সক্ষম হবে। অথবা যার মাধ্যমে তার অভিভাবককে সমৃদ্ধ করবে। বরং আসল উদ্দেশ্য হল ক্রমাগত মার্জিত গবেষণায় শিশুকে প্রশিক্ষণ দেয়া যাÑ প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তার চূড়ান্ত ফলাফলে পৌঁছতে সক্ষম হবে।
 বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধানুকরণ শিশুরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়, বিশেষতঃ এই স্তরের শেষের দিকে এসে যার মধ্যে অধিকাংশ শিশুরা আক্রান্ত হয়ে থাকে। যেমন ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা ও তার নড়বড়ে অবস্থান ও ইসলমী অবকাঠামোর প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ। সম্ভবতঃ এর কারণ হল, এই চিহ্নিত বয়সে যোগাযোগের অসংখ্য ও বিচিত্র মাধ্যম এসে শিশুদের নিকট উপস্থিত হয়ে থাকে। পঠন, শ্রবণ, প্রত্যক্ষ করণ ও বহিরাগত সমাজ সংশ্রব- যা তাদেরকে আকর্ষণীয় প্রভাবের কর্মক্ষেত্রে পরিণত করে। পরিশেষে তাদেরকে নাস্তিক, পাপাচারী ও মূল্যহীন ব্যক্তিদের আনুগত্য করতে প্ররোচিত করে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদে, পানাহার পদ্ধতিতে, তাদের চুল কাটার ফ্যাশনে এমনকি তাদের বাহ্যিক অভিব্যক্তি ও সকল চালচলনে। অভিভাবকের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য, তাকে সম্পূর্ণরূপে সতর্ক রাখতে হবে। কারণ কোন জাতির মৃত্যু হয় না যতক্ষণ না তার সন্তানদের ব্যক্তিত্ব দুর্বল হয় ও তাদের উত্তরসুরীদের নিয়ে আত্ম মর্যাদাবোধ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলশ্র“তিতে তারা বিজাতীয় কৃষ্টি কালচারের মধ্যে নিশ্চিত হারিয়ে যায়। সে কারণে আমাদের শত্র“রা আমাদের সন্তানদেরকে তাদের সন্তানদের অনুরূপ বানাতে বেশ তৎপর। সবচেয়ে দুঃখজনক ও পরিতাপের বিষয় হলো, যেই অভিভাবকের কাছে প্রত্যাশা ছিলো যে, তারাই নিজ সন্তানদেরকে রাজপথের ওপর উঠাবে; তারাই কি-না তাদের সন্তানদেরকে অন্ধানুগত্য ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শিশুকে সে দিকেই আহ্বান করে তার কথা ও কাজের মাধ্যমে। অথচ আমাদের ধর্ম ইসলাম বিজাতীদের সাদৃশ্য অবলম্বনে সম্পূর্ণরূপে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি কোন বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করলো সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ উমার রা. আতাবাহ বিন ফারক্বাদ রা. কে লিখে পাঠালেন- যখন তারা আজারবাইজানে যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলেন- ‘তোমরা আরম্বড়তা ও পৌত্তলিকদের পোশাক পরিচ্ছেদ বর্জন কর।’ সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিজাতীয় আনুগত্য হল, ছেলেকে মেয়ের অথবা মেয়েকে ছেলের সাজে সজ্জিত করা। এ ধরনের শিশুরা যখন শরিয়ত কর্তৃক আদিষ্ট হবে তখন তাদের ওপর অভিশাপ অনিবার্য হয়ে যাবে। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষদের ওপর ও পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিণী মহিলাদের ওপর অভিশম্পাত করেছে। মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষদের নপুংশক ও পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিণী মহিলাদেরকে মেকি পুরুষ বলা হয়। এ প্রেক্ষিতে শিশুর অন্তরে তার ব্যক্তি সত্ত্বার অনুভূতি প্রবলভাবে জাগ্রত করা অভিভাবকের একান্ত কর্তব্য। সে একজন পুরুষ, একজন মুসলমান, ইসলাম হলো অপরাজেয় ও সুমহান, তার উপরে কোন জীবন বিধান নেই। আর মুসলমানগণ বিশ্ব মানবতার জন্য অনুকরণীয় একটি আদর্শ। সে হলো সর্বকালের সমগ্র বিশ্বের অমুসলিমদের থেকে উৎকৃষ্ট। শিশুর মনে তার ধর্ম ইসলামের প্রতি মর্যাদাবোধ জাগ্রত করতে হবে। ঐ নাস্তিকদের আনুগত্য করে সে কিভাবে আবু বকর, উমার, উছমান, আলী, খালেদ, আবু ওবাইদাহ ও সা’দ বিন আবি ওক্কাস রা. প্রমূখদের উত্তরসুরী হতে পারবে? চূড়ান্তভাবে এর নিন্দনীয় ও কুৎসিত রূপ তার নিকট তুলে ধরতে হবে। এ সংক্রান্ত কোরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি ও বিজ্ঞজনদের বাণী তার নিকট উল্লেখ করতে হবে যা তাদেরকে এ শিক্ষাগুলো প্রদান করতে সক্ষম হবে। ‘যার সাথে যার মহব্বত তার সাথে তার কিয়ামত’ কথাটা তাদের নিকট স্পষ্ট করে দিতে হবে। যে ব্যক্তি যেই জাতির প্রতি ভালোবাসা রাখবে তার সঙ্গেই তার হাশর হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণে তাদের আনুগত্য করলো সে তো প্রকারান্তরে তাদের ঐ পথকে ভালোবাসলো যেখানে তাদের আনুগত্য করলো। এমনিভাবে অন্ধানুগত্য ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি ও গবেষণার দুর্বলতার পরিচায়ক।  

No comments:

Post a Comment