বিদআত (পর্ব ১)
বিদআতের সংজ্ঞা শাব্দিক অর্থে বেদআত البدع থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ হচ্ছে, الاختراع على غير مثال سابق. অর্থাৎ অতীত দৃষ্টান্ত ব্যতীত নতুন আবিষ্কার। এ থেকেই আল্লাহ তাআলার বাণী : بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ. البقرة:(১১৭) অর্থাৎ ‘অতীত দৃষ্টান্ত ব্যতীত আকাশ জমিনের সৃষ্টিকর্তা। এবং قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ (الأحقاف:৯) অর্থাৎ ‘আমিই প্রথম ব্যক্তি নই যে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের নিকট রিসালতের দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।’ বরং আমার পূর্বে বহু রাসূল অতীত হয়েছেন। প্রচলন আছে : ابتدع فلان بدعة অর্থাৎ এমন পদ্ধতি শুরু করেছে যা ইতিপূর্বে কেউ করেনি। শরয়ি পরিভাষায় বেদআত বলা হয়— ما أحدث فى الدين على خلاف ماكان عليه النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابه من عقيدة وعمل. ‘দ্বীনের মধ্যে রাসূল সা. ও সাহাবা কর্তৃক প্রবর্তিত আক্বিদা ও আমল পরিপন্থী নতুন আক্বিদা ও আমলের প্রচলন ঘটানো।’আবিস্কার দুই প্রকার : (১) অভ্যাস (ও জাগতিক প্রয়োজনের) ক্ষেত্রে আবিষ্কার—যথা বর্তমানে প্রচলিত ও নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ। এগুলো মুবাহ (অনুআেদিত)। কারণ আদত ও অভ্যাসের ক্ষেত্রে আসল হচ্ছে ইবাহাহ الإباحة বা বৈধ হওয়া। (২) দ্বীনের (ইসলাম ধর্মের) ক্ষেত্রে আবিষ্কার। এটি হারাম। কারণ দ্বীনের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে توقيف বা শরিয়তের সিদ্ধান্তের উপর অবস্থান করা। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:— من أحدث فى أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. ‘যে আমাদের দ্বীনে নতুন কিছু সংযোজন ও সৃষ্টি করবে যা মূলত তাতে নেই সেটি পরিত্যাজ্য।’ এ হাদিস প্রমাণ করছে যে, দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নতুন সৃষ্ট বিষয়ই বেদআত আর প্রত্যেক বেদআতই গোমরাহি ও পরিত্যাজ্য।
এর অর্থ হচ্ছে ইবাদত ও আক্বিদার ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার, যার নজির পূর্বে নেই—হারাম ও অবৈধ। তবে এ অবৈধতার প্রকৃতি ও ধরন বেদআতের ধরন অনুপাতে বিভিন্ন রূপের হয়। কিছু বিষয় আছে যা সরাসরি কুফুরী যেমন কবরবাসীদের নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কবর তাওয়াফ করা, কবরের উদ্দেশ্যে জবেহ করা, মান্নত প্রেরণ করা, কবরবাসীর নিকট দোয়া করা, ফরিয়াদ করা, সাহায্য প্রার্থনা করা, এমনি ভাবে গোড়া মু’তাযিলা ও জহমীদের আক্বিদা ও মাজহাব। আবার কিছু বিষয় আছে যা শিরকের মাধ্যম। যেমন কবরের উপর সৌধ বা এ জাতীয় কিছু নির্মাণ করা কবরের নিকট সালাত আদায় করা, দোয়া করা—ইত্যাদি। কিছু বিষয় আছে যা ফিসকে ইতেকাদী বা বিশ্বাসগত ফিসক। যেমন কবিরা গোনাহে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাফের বলে রায় দেয়া বা কবিরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াকে কুফরি জ্ঞান করা। আমলকে ঈমানের সংজ্ঞা থেকে বহিষ্কার করা অর্থাৎ আমলকে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত মনে না করা। আবার কিছু কিছু বেদআত আছে যা শুধুমাত্র গোনাহ ও নাফরমানি—যেমন বিবাহ শাদি পরিত্যাগ করা। রোদে দাঁড়িয়ে সিয়াম পালন করা। দ্বীনের ভিতর বেদআতে হাসানাহ বলে কিছু আছে কি ? উপরোক্ত আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে যে দ্বীনের ভিতর সকল বেদআতই হারাম। যারা বেদআতকে হাসানাহ ও সাইয়্যেআহ বলে বিভক্ত করে, তারা ভুল করে থাকেন। এবং রাসূল সা.-এর বাণী—فإن كل بدعة ضلالة নিশ্চয়ই প্রত্যেক বেদআত গোমরাহি—এর বিরোধিতাকারী। কেননা, রাসূলুল্লাহ সা. বেদআত প্রসঙ্গে রায় দিতে গিয়ে বলেছেন প্রত্যেক বেদআতই গোমরাহি আর এরা বলছে, না প্রত্যেক বেদআত গোমরাহি নয় বরং কিছু বেদআত আছে হাসানাহ (ভাল)। আল্লামা হফেয ইবনে রজব বলেন : নবী আকরাম সা.-এর বাণী كل بدعة ضلالة (প্রত্যেক বেদআত গোমরাহি) একটি جوامع الكلم তথা ব্যাপক অর্থ বোধক বাক্য। কোন কিছুই তার বহির্ভূত নয়। সকল প্রকারই তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এটি দ্বীনের একটি বিশেষ মূলনীতি। এটি রাসূলের নিুোক্ত বাণীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বক্তব্য। আল্লাহর রাসূল বলেন : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, সেটি পরিত্যাজ্য হবে)—সুতরাং যে কেউ নতুন কিছু উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করবে এবং তাকে দ্বীনের দিকে নিসবত (সম্বন্ধযুক্ত) করবে অথচ দ্বীনে তার কোন মূল ভিত্তি নেই যার দিকে সে ফিরতে পারে, সেটিই গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। দ্বীন এ সকল বস্তু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এ ক্ষেত্রে সকল বিষয়—যথা আকায়েদ, আমল জাহেরী ও বাতেনী আকওয়াল—সব সমান।
এরূপ বিভক্তকারীদের যুক্তি প্রমাণ ও তার খণ্ডন :— সাহাবি ওমর রা. একবার সালাতে তারাবীহ সম্পর্কে বলেছিলেন : نعمت البدعة هذه (কত না সুন্দর বেদআত এটি) বেদআতকে হাসানাহ ও সাইয়্যেআহ দ্বারা বিভক্তকারীদের নিকট ওমরের এ উক্তিটি ব্যতীত তাদের মতের স্বপক্ষে আর কোন দলিল নেই। তারা আরো বলে যে, এরূপ আরো অনেক নতুন নতুন বিষয়ের প্রবর্তন হয়েছিল কিন্তু সালাফের কেউ সে গুলোকে ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান করেননি, যেমন কোরআনুল কারীমকে এক মাসহাফে একত্রিত করা, (যা রাসূলের যুগে ছিল না) হাদিস লেখা ও সংকলন করা এটিও রাসূল সা. নিজে করে যাননি। উত্তর :—আপত্তি উত্থাপিত বিষয়গুলো বেদআত নয় বরং শরিয়তের এগুলোর একটি ভিত্তি আছে। আর ওমর রা. এর বক্তব্য نعمت البدعة তে শরয়ি بدعة নয়। সুতরাং যে সকল বিষয়ের একটি শরয়ি ভিত্তি থাকবে যার দিকে প্রত্যাবর্তন করা যায়, সে গুলো সম্পর্কে যখন بدعة বলে মন্তব্য করা হবে তখন শাব্দিক বেদআত বুঝতে হবে—শরয়ি নয়। আর সালাতে তারাবীহ তো রাসূলুল্লাহ সা. নিজেই সাহাবিদের নিয়ে পড়ে ছিলেন। শেষ দিকে এসে ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তিনি তাদের থেকে পিছিয়ে গেছেন। তবে সাহাবারা বিক্ষিপ্ত ভাবে রাসূলের জীবদ্দশায় এবং ওফাতের পর ধারাবাহিক ভাবে পড়েছেন। এক পর্যায়ে এসে ওমর রা. সকলকে এক ইমামের পিছনে একত্রিত করে দিয়েছেন যেমন তারা রাসূলের পিছনে পড়ে ছিলেন। সুতরাং এটি দ্বীনের মধ্যে কোন নতুন বেদআত ছিল না। এখনও নয়। আর এক মাসহাফে কোরআন শরীফ একত্রিত করাও শরিয়তের একটি ভিত্তি আছে। কারণ রাসূলুল্লাহ সা. নিজে কোরআন লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেগুলো বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তাকারে ছিল পরে সাহাবায়ে কেরাম সংরক্ষণের নিমিত্তে সবগুলোকে এক মাসহাফে জমা করেছেন। হাদিস লিপিবদ্ধ করারও একটি শরয়ি ভিত্তি আছে। রাসূল সা. কতিপয় সাহাবিকে অনুমতি প্রার্থনা করার পর কোন কোন হাদিস লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে তার জীবদ্দশায় কোরআনের সাথে গায়রে কোরআন মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যাপক হারে লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু তার ওফাতের পর উক্ত নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। কেননা তিনি জীবিত থাকা অবস্থায়ই কোরআন পূর্ণতা লাভ করে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা পাকাপাকি ভাবে সম্পূর্ণ হয়। এরপর মুসলমানগণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য হাদিস সংকলনে হাত দেন। এবং সম্পন্ন করেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। কারণ তারা স্বীয় প্রতিপালকের কিতাব এবং নিজ নবীর সুন্নাহ বৃথা যাওয়া ও ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষাকল্পে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যাবে যে ইলম ও ইবাদত সংশ্লিষ্ট সাধারণ বেদআতের প্রচলন উম্মতের মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদীনের শেষ যুগে শুরু হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. এ প্রসঙ্গে বলেছেন— من يعش منكم فسيرى اختلافا كثيرا، فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين. ‘তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু এখতেলাফ মতানৈক্য দেখতে পাবে। সেসময় তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নত, হেদায়াত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ আঁকড়ে ধরা।’ সাহাবায়ে কেরাম সে সকল আহলে বেদআতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিদআত উৎপত্তির কতিপয় কারণ : বেদআত ও গোমরাহিতে পতিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা। আল্লাহ তাআলা বলেন : وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ . (سورة الأنعام:১৫৩) ‘এবং এ পথই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ কর না। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে তার পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।’ সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন এভাবে, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ বলেন : خط رسول الله صلى الله عليه وسلم خطا، ثم قال: هذا سبيل الله ثم خط خطوطا عن يمينه و عن شماله، ثم قال : و هذه سبلথقال يزيد متفرقةথ على كل سبيل منها شيطان يدعو إليه. ‘রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের (দেখানোর) জন্য একটি রেখা টানলেন বা দাগ দিলেন অত:পর বললেন এটি আল্লাহর পথ। এর পর এ রেখার ডানে বামে আরো অনেকগুলো দাগ দিলেন এর পর বললেন : এগুলো হচ্ছে বিভিন্ন পথ। ইয়াযীদ নামক হাদিসের জনৈক বর্ণনাকারী বললেন বিচ্ছিন্নকারী (অর্থাৎ এগুলো হচ্ছে বিচ্ছিন্নকারী বিভিন্ন পথ) এরপর প্রত্যেকটি পথের উপর একটি করে শয়তান বসে আছে, সে পথের দিকে আহ্বান করে। অত:পর পড়েছেন:— وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ . (الأنعام:১৫৩) ‘এটিই আমার সরল পথ। তোমরা এর অনুসরণ কর। এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করো না। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।’ অতএব যে ব্যক্তি কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বিমুখ হবে, এড়িয়ে চলবে, বিভ্রান্তকারী রাস্তা এবং নব আবিষ্কৃত বেদআতসমূহ তাকে বিভ্রান্ত করে দেবে। বেদআত উৎপত্তির গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোকে নিুোক্ত বিষয় গুলোতে সংক্ষেপণ করা যায়:—
(১) দ্বীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা : রাসূলের যুগ থেকে সময় যত দীর্ঘ হচ্ছে এবং মানুষ রিসালাতের প্রভাব ও নিদর্শন থেকে দূরে সরে চলেছে ততই ইলম ও ধর্মীয় জ্ঞান কমে চলেছে এবং মূর্খতা ও অজ্ঞতা বেড়ে চলেছে ও সর্বত্র বিস্তার লাভ করছে। বরং এ প্রসঙ্গে নবী সা. নিজেই বলেছেন— من يعش منكم فسيرى اختلافا كثيرا. ‘তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে।’ তিনি আরও বলেন:— إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد، و لكن يقبض العلم بقبض العلماء ، حتى إذا لم يبق عالما اتخذ الناس رؤوسا جهالا، فسئلوا، فأفتوا بغير علم، فضلوا، و أضلوا. ‘আল্লাহ তাআলা ইলম বান্দাদের থেকে উপড়ে নেয়ার মত করে উঠিয়ে নিবেন না বরং ওলামাদের মৃত্যুর মাধ্যমে উঠিয়ে নেবেন। এক পর্যায়ে যখন আর কোন আলেম অবশিষ্ট রাখবেন না তখন লোকেরা অজ্ঞ মূর্খদেরকে নিজেদের নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে তখন তারা না জেনে ফতওয়া দেবে। ফলে নিজেরাও গোমরাহ হবে এবং অপরদেরকে গোমরাহ করবে।’ বেদআতকে একমাত্র ইলম ও ওলামারাই প্রতিরোধ করতে পারেন এবং করেও থাকেন। যখন এতদুভয়ের বিলুপ্তি ঘটে, তখন বেদআত প্রকাশ ও প্রসারের সুযোগ পেয়ে যায়, আর বেদআতপন্থীরা এ বিষয়ে নব উদ্যম খুঁজে পায় এবং কাজ করতে শুরু করে।
(২) প্রবৃত্তির অনুসরণ:— মানুষ যখন কোরআন ও সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন— فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنَ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ . (القصص:৫০) ‘অত:পর তারা যদি আপনার ডাকে সাড়া না দেয়, তবে জানবেন, তারা শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহর হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে ? নিশ্চয় আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।’ আল্লাহ তাআলা আরো বলেন: أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ . (الجاثية:২৩) ‘আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল খুশিকে নিজ ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন। এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পরদা। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তা ভাবনা কর না ?’ বেদআত অনুসৃত প্রবৃত্তির বুনন বৈ নয়।
(৩) ব্যক্তি ও মতের পক্ষাবলম্বন:— সত্যাসত্য যাচাই না করে কোন ব্যক্তি ও ব্যক্তি মতের পক্ষাবলম্বন করা অনেক সময় একজন ব্যক্তিকে সঠিক দলিলের অনুসরণ ও হক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে। ব্যক্তি ও দলিলের আনুগত্যের মাঝে সেই পক্ষাবলম্বন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:— وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آَبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ . (البقرة:১৭০) ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা সে হুকুমের অনুসরণ কর যা আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না বরং আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি, যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না: জানতো না সঠিক পথও।’ বর্তমান যুগেও এ প্রকৃতির অনেক লোক পাওয়া যায়, যারা সুফিবাদে বিশ্বাসী কবর পূজারি। আপনি দেখতে পাবেন যে, তারা যে মতাবলম্বী এবং যে ব্যক্তির দর্শন গ্রহণ করেছে যদি সে মত ও দর্শনের বিপরীত কোরআন ও হাদিসের সঠিক উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে তাদের বলা হয়, আপনি যে মত ও দর্শন গ্রহণ করেছেন সেগুলো তো কোরআনের এ আয়াত ও এ সকল হাদিস দ্বারা বাতিল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং উক্ত মত ও পথ ছাড়–ন এবং কোরআন সুন্নাহর অনুসরণ করুন। সঠিক পথে ফিরে আসুন। তখন তারা নিজ মাজহাব মাশায়েখ ও বাপ-দাদার মাধ্যমে দলিল দিয়ে বলে যে, এতকাল যাবৎ তারা কি ভুল করে এসেছে ? যুগ যুগ ধরেই তো এ আমল চলে আসছে। কই কেউ তো ভুল বলেনি ? আমাদের পীর-বযুর্গরা এত বড় আলেম, তারা কি ভুল করতে পারে?—ইত্যাদি যতসব অসার ও বাতিল কথা বলে হককে এড়িয়ে যায়।
(৪) বিধর্মী কাফেরদের সাদৃশ্যাবলম্বন:— বেদআত ও কুপ্রথায় পতিত করার ব্যাপারে কাফেরদের সাদৃশ্য অবলম্বন একটি বিরাট কারণ, যেমন আবু ওয়াক্বিদ লায়সী রা. এর হাদিসে একটি ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি বলেন : আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে হোনাইন অভিমুখে যাত্রা করলাম। সে সময় সবে মাত্র কিছুদিন হলো আমরা কুফর ছেড়ে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছি, এদিকে ‘যাতে আনওয়াত’ নামে মুশরিকদের একটি বড়ই বৃক্ষ ছিল, যার চার পাশে তারা অবস্থান করত এবং নিজেদের যুদ্ধাস্ত্র সে গাছে ঝুলিয়ে রাখত। পথিমধ্যে আমরা সে গাছের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমরা বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাদের যেমন ‘যাতে আনওয়াত’ আছে আপনি আমাদের জন্যও একটি ‘যাতে আনওয়াত’ স্থির করুন। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন : আল্লাহু আকবার إنها السنن এটি একটি রীতি, যে সত্তার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, তোমরা তেমন একটি কথাই কললে যেমনটি বলেছিল, বনী ইসরাইলরা নবী সা. মূসা আ. কে— قَالُوا يَا مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آَلِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ. (الأعراف:১৩৮) তারা বলতে লাগল, হে মুসা আপনি আমাদের উপাসনার জন্যও তাদের মূর্তির মতই একটি মূর্তি নির্মাণ করে দিন। তিনি বললেন তোমরা নিতান্তই একটি অজ্ঞতা প্রসূত সম্প্রদায়।
তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্বসূরিদের রীতি অনুসরণ করবে। এ হাদিস নবী আকরাম সা. সুস্পষ্টকরে বর্ণনা করছেন যে, কাফেরদের সাদৃশ্য অবলম্বনই বনী ইসরাইলকে ইবাদতের জন্য মূর্তি নির্মাণ করে দেয়ার মত কদর্য অনুরোধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর ঐ একই জিনিস রাসূলুল্লাহ সা. কতিপয় সাহাবিকে বরকত হাসিলের জন্য আল্লাহকে বাদ দিয়ে একটি গাছ নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য আবেদন করতে উৎসাহ করে তুলছিল। বর্তমান সময়েও এমনটি ঘটে চলেছে যে অধিকাংশ মুসলমান শিরকি ও বেদআতি কার্যকলাপের ক্ষেত্রে কাফেরদের অনুসরণ করে চলেছে। যেমন ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন, নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য সপ্তাহ বা দিনক্ষণ নির্ধারণ করে নেয়া। বিভিন্ন উপলক্ষ ও স্মরণিকা স্বরূপ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা। স্মৃতি সৌধ, স্তম্ভ, ভাস্কর্য ইত্যাদি নির্মাণ। কবরের উপর ঘর-গুম্বজ ইত্যাদি নির্মাণ করা।
সূরা : বাকারা-১১৭
সূরা: আহকাফ
তিরমিযি : ২৬০০
সূরা : আল আনআম - ১৫৩
সূরা : আল আনআম - ১৫৩ বুখারী : ৯৮
সূরা : কাসাস-৫০ সূরা :
জাছিয়া-২৩ সূরা: বাকারা-১৭০
সূরা : আরাফ-১৩৮
তিরমিজি, হাদিসটি সহি
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment