জিলহজের প্রথম দশ দিনঃ তৎপর্য ও ফজিলত-2
সংকলনে : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
যিলহজের প্রথম দশ দিনে যে সকল নেক আমল করা যেতে
পারে
খাঁটি মনে তওবা করা—
তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন বা ফিরে যাওয়া। যে সকল
কথা ও কাজ আল্লাহ রাববুল আলামিন অপছন্দ করেন তা থেকে যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ
পছন্দ করেন তাঁর দিকে ফিরে যাওয়ার নাম তওবা—হোক এ সকল কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে। সাথে সাথে
অতীতের এ ধরনের কাজ থেকে অনুতপ্ত হতে হবে, কাজগুলো ত্যাগ করতে হবে ও দৃঢ় সংকল্প
করতে হবে যে ঐ ধরনের কাজ আর কোন দিন করব না। আরো সংকল্প করতে হবে যে, আল্লাহ
তাআলার পছন্দনীয় কাজ যেমন আদায় করব তেমনি তার নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিহার করব।
যখনই কোন পাপ কাজ সংঘটিত হবে তখন সাথে সাথে তা
থেকে তওবা করা একজন মুসলিমের জন্য ওয়াজিব। কেননা, তার জানা নেই কখন তার মৃত্যু হবে
আর কতক্ষণ সে বেঁচে থাকবে। মনে রাখতে হবে, একটি পাপ বা গুনাহ অন্য আরেকটি গুনাহের
দ্বার খুলে দেয়। তওবা না করলে এমনিভাবে গুনাহের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর সময়ের
মর্যাদা হিসেবে গুনাহের শাস্তি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বা
ফজিলতপূর্ণ সময়ে গুনাহের কাজের শাস্তি বেশি হয়। প্রথমত গুনাহের শাস্তি দ্বিতীয়ত
ফজিলতপূর্ণ সময়ের অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করার শাস্তি।
ইমাম নবভী রহ. বলেন : ‘মুসলিম ব্যক্তির উপর
ওয়াজিব হল সকল ধরনের গুনাহ থেকে তওবা করা যা সে করেছে। যদি কোন এক ধরনের গুনাহ
থেকে তওবা করে তাহলেও তার তওবা সঠিক হবে। তবে অন্য গুনাহের তওবা তার দায়িত্বে থেকে
যাবে। কোরআনের বহু আয়াত, একাধিক হাদিস ও ইজমায়ে উম্মাহ তওবা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ
বহন করে।[i] আল্লাহ রাববুল আলামিন এরশাদ করেন :—
يَا
أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ
أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ
تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ
آَمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ
يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ
شَيْءٍ قَدِيرٌ . (التحريم : 8)
‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর—বিশুদ্ধ তওবা
; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের
জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না
নবীকে এবং তার মোমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে
ধাবিত হবে। তারা বলবে ‘হে আমাদের প্রতিপালক ! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং
আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’[ii]
ইবনে কায়্যিম রহ. বলেন : খাঁটি তওবা (তওবা নাছুহ)
হল তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম।
প্রথম : সকল প্রকার গুনাহ থেকে তওবা করা। এমন যেন না
হয় কয়েকটি গুনাহ থেকে তওবা করলাম, দু একটি রেখে দিলাম এ ভেবে যে এ থেকে আরো কয়েক
দিন পরে তওবা করব। এমন করলেও তওবা হবে, তবে তা তওবা নাছূহ হিসেবে গৃহীত হবে না—যে তওবা করতে
আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় নির্দেশ দিয়েছেন।
দ্বিতীয় : সম্পূর্ণভাবে পাপ পরিত্যাগ করার জন্য
সততার সাথে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। এমন যেন না হয় যে তওবা করলাম আর মনে মনে বললাম
জানি না, আমি এ তওবার উপর অটল থাকতে পারব কি-না।
তৃতীয় : তওবা খালেছভাবে আল্লাহকে ভয় করে ও তার
সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষেই করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য
থাকবে না।
অবশ্যই এ তওবার সাথে আল্লাহ তাআলার কাছে
অব্যাহতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা ও সকল গুনাহ বা পাপ নিজের থেকে মিটিয়ে দিতে হবে। তা
হলেই কামেল তওবা বলে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।[iii]
তওবা কবুলের শর্ত--
সাধারণভাবে তওবা কবুলের জন্য পাঁচটি শর্ত রয়েছে।
(১) তওবা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হতে
হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন নিয়তে করলে তওবা হবে না। মানুষকে দেখানোর
জন্য বা শোনানোর জন্য বা অন্য কোন স্বার্থ হাসিলের স্বার্থে তওবা করা হলে তা
গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেন :—
فَاعْبُدِ
اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ (الزمر : 2)
সুতরাং আল্লাহর এবাদত কর, তার আনুগত্যে
বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে।[iv]
তওবা করা যেহেতু একটি এবাদত তাই তা একমাত্র
আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যেই করতে হবে।
(২) যে পাপ বা গুনাহ করা হয়েছে তার জন্য অনুতপ্ত
হতে হবে, আফসোস করতে হবে। কেননা হাদিসে এসেছে:—
الندم
توبة (صحيح الجامع رقم 6820)
‘অনুতপ্ত হওয়ার নামই তওবা।’[v]
তাই যে গুনাহ হয়ে গেছে তার জন্য আন্তরিকভাবে
দু:খিত হতে হবে।
(৩) গুনাহ বা পাপকে পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা। যদি
পাপ থেকে তওবা করে আবার সে পাপ কাজে লিপ্ত থাকা হয় তবে তা আল্লাহ তাআলার সাথে
ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার শামিল।
যদি পাপ কাজটি আল্লাহ রাববুল আলামিনের অধিকার
(হুকুকুল্লাহ) খর্ব করা সংশ্লিষ্ট হয় তবে
সেটা ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি পাপ কাজটি মানুষের অধিকার (হকুকুল এবাদ) ক্ষুণ্ণকারী
হয় তবে তা তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি কোন মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা হয় তবে তা তার
মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি কারো সম্মানের হানি করা হয়—যেমন গিবত বা
দোষ-চর্চা করা হল বা গালি দেয়া হল অথবা মিথ্যা অপবাদ দেয়া হল তাহলে তার কাছে ক্ষমা
চেয়ে বা অন্য কোনভাবে মিটমাট করে দাবি ছাড়িয়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষের
অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এমন পাপ যা আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাইলেও তিনি ক্ষমা করবেন
না।
(৪) ‘ভবিষ্যতে কখনো এ পাপে লিপ্ত হব না’—এমন দৃঢ়
সংকল্প থাকতে হবে। যদি আবার উক্ত পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে আবার তওবা করতে হবে।
(৫) তওবা করতে হবে তওবার সময়ের মাঝে। যদি তওবার
সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তওবা করা হয় তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এখন প্রশ্ন হল তওবার সময় পার হয়ে যায় কখন ?
তওবার সময় পার হয়ে যাওয়ার দুটি অবস্থা আছে। একটি
সাধারণ অবস্থা অন্যটি বিশেষ অবস্থা।
(ক) সাধারণ অবস্থা : যখন কিয়ামতের আলামত হিসেবে
সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। তখন কোন মানুষের তওবা কবুল করা হবে না। আললাহ
রাববুল আলামিন বলেন :—
يَوْمَ
يَأْتِي بَعْضُ آَيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ
آَمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا (الأنعام : 158)
‘যে দিন তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে সেদিন তার ঈমান কোন
কাজে আসবে না, যে ব্যক্তি পূর্বে ঈমান আনে নাই কিংবা ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন
করে নাই।’[vi]
এ আয়াতে ‘প্রতিপালকের নিদর্শন’-এর ব্যাখ্যায়
রাসূলে কারীম স. যা বলেছেন তা হল সূর্য পশ্চিম দিক দিয়ে উদিত হওয়া। অর্থাৎ যখন
সূর্য পশ্চিম দিক দিয়ে উদিত হবে তখন কোন কাফেরের ইসলাম কবুল করা হবে না এবং পাপী
ব্যক্তির তওবা গ্রহণ করা হবে না।
(খ) বিশেষ অবস্থা : যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যায়।
যখন কোন মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয় তখন তওবা করলে তা আল্লাহ গ্রহণ করেন না। আল্লাহ
রাববুল আলামিন বলেন :—
إِنَّمَا
التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ
يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ
عَلِيمًا حَكِيمًا ﴿17﴾ وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ
السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ
الْآَنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ
عَذَابًا أَلِيمًا ﴿18﴾ (النساء : 17-18)
‘আল্লাহ অবশ্যই সে সব লোকের তওবা কবুল করবেন যারা ভুলবশত মন্দ কাজ
করে এবং সত্বর তওবা করে, এরাইতো তারা যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। তওবা তাদের
জন্য নয় যারা আজীবন মন্দ কাজ করে, অবশেষে তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে
‘আমি এখন তওবা করলাম’ এবং তাদের জন্যও নয় যাদের মৃত্যু হয় কাফের অবস্থায়। এরাই তো
তারা যাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।’[vii]
এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন
করতে হবে তা হল পাপ বা গুনাহ দু প্রকার। এক প্রকার যা আল্লাহর অধিকার সম্পর্কিত।
অন্য প্রকার যা মানুষের অধিকার সম্পর্কিত। মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণকারী কোন পাপে
যদি কেউ লিপ্ত হয় তবে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে যথাযথ পাওনা পরিশোধ করতে হবে
বা তার সাথে মিটমাট করে দাবি ছাড়িয়ে নিতে হবে। অন্যথায় তওবা হবে না। যেমন কেউ
অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করল। পরে সে খুব কান্নাকাটি করে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে
তওবা করল, এতে কাজ হবে না। যার সম্পদ আত্মসাৎ করা হল তাকে তার সম্পদ ফিরিয়ে দিয়ে
তওবা করতে হবে। এমনিভাবে কেউ কাউকে মারপিট করে বা গালি দিয়ে অথবা পরনিন্দা বা গিবত
করে কিংবা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তার সম্মান ক্ষুণ্ণ করল, তা হলে তাকে অবশ্যই
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে ও দাবি ছাড়িয়ে নিতে হবে। যদি তাকে
পাওয়া না যায় তবে তার জন্য দোয়া করতে হবে। এ বিষয়টির গুরুত্ব দিয়ে ইমাম নবভী রহ.
সহ অনেক উলামায়ে কেরাম এ বিষয়টিকে তওবার জন্য স্বতন্ত্র শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে
বলেছেন : তওবার শর্ত তিনটি :—এক. অনুতপ্ত হওয়া, দুই. গুনাহ পরিত্যাগ করা, তিন. ভবিষ্যতে আর করব না বলে
দৃঢ় সংকল্প করা। আর যদি গুনাহটি মানুষের অধিকারের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে উক্ত
গুনাহ থেকে তওবা করার শর্ত চারটি। চতুর্থ শর্ত হল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পাওনা আদায়
করে তার কাছ থেকে দাবি ছাড়িয়ে নেয়া বা অন্য কোন উপায়ে মিটমাট করে নেয়া।
হজ ও ওমরাহ আদায় করা-
হজ হল ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি।
আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেন :—
وَلِلَّهِ
عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ
فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ (آل عمران : 97)
‘মানুষের মাঝে যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর
উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে
রাখুক নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।’[viii]
হাদিসে এসেছে—
عن عبد الله بن عمر- رضى الله عنهما- أن النبي-
صلى الله عليه وسلم- قال: بني الإسلام على خمس : شهادة أن لا إله إلا الله، وأن
محمدا رسول الله ، وإقام الصلاة، وإيتاء الزكاة، والحج، وصوم رمضان. رواه البخارى
৮ ومسلم ১৬
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত যে নবী
কারীম স. বলেছেন : পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। এ কথার ঘোষণা দেয়া যে
আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ স. আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম
করা, জাকাত আদায় করা, হজ করা, রমজানে সিয়াম পালন করা।[ix]
অতএব হজ হল সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর ফরজ। তবে
ওমরাহ করার হুকুম কি? তা কি ওয়াজিব না সুন্নত ? এ বিষয়ে দুটি মত রয়েছে। বিশুদ্ধ মত
হল ওমরাহ করা ওয়াজিব। যেমন হাদিসে এসেছে :—
الإسلام: أن تشهد أن لا إله إلا الله، وأن محمدا
رسول الله، وأن تقيم الصلاة، وتؤتي الزكاة، وتحج، وتعتمر، وتغتسل من الجنابة، وأن
تتم الوضوء، وتصوم رمضان.) رواه ابن خزيمة، وإسناده قد أخرجه مسلم، لكن لم
يسق لفظه، كما قال ابن حجر في الفتح ৩/ ৬৯৮
(
‘ইসলাম হল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন মাবুদ
নেই ও মোহাম্মদ স. আল্লাহর রাসূল। সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, হজ ও ওমরাহ
আদায় করবে এবং জানাবাতের (সহবাস, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত ইত্যাদির) পর গোসল করবে,
পরিপূর্ণরূপে ওজু করবে ও সিয়াম পালন করবে।[x]
এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ওমরাহ পালন করা
ওয়াজিব। হাদিসে আরো এসেছে—
عن عائشة- رضى الله عنها- قالة: قلة يا رسول الله
: على النساء جهاد؟ قال : نعم عليهن جهاد لا قةال فيه : الحج والعمرة. رواه ابن ماجة
২৯০১ وصححه الألباني ২৩৪৫
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি
রাসূলুল্লাহ স.-কে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েদের জন্য কি জিহাদের নির্দেশ রয়েছে ? তিনি
বললেন হ্যাঁ, তাদের দায়িত্বে এমন জিহাদ রয়েছে যাতে লড়াই-যুদ্ধ নেই। তা হল হজ ও
ওমরাহ।[xi]
এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মেয়েদের জন্য
ওমরাহ ওয়াজিব। যখন মেয়েদের জন্য ওমরাহ ওয়াজিব হল তখন পুরুষদের জন্য তো অবশ্যই।
হজ জীবনে একবার করা ফরজ। হাদিসে এসেছে :—
عن ابن عباس: أن الأقرع بن حابس- رضى الله عنه-
سأل النبي صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول الله، الحج كل سنة أو مرة واحدة ؟ قال : بل مرة واحدة، فمن زاد فهو تطوع. ) رواه أبو داود
১৭২১و صححه الألباني ১৫১৪(
ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত সাহাবি আকরা ইবনে
হাবিছ রা. রাসূলে কারীম স.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল ! হজ কি প্রতি বছর না মাত্র
একবার ? তিনি বললেন : হজ মাত্র একবার করা ফরজ। সুতরাং যে একাধিক হজ করল তা নফল
হিসেবে গৃহীত।[xii]
নবী কারীম স. এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ এবাদতের জন্য
উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি এবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা,
যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাববুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। তাই
নবী কারীম স. বলেছেন :—
من حج فلم يرفث ولم يفسق رجع كيوم ولدته أمه) .رواه
البخاري১৪৪৯ ومسلم১৩৫০(
‘যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোন অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোন পাপে
লিপ্ত হয়নি সে যেন সেই দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব
করেছে।’[xiii]
হাদিসে আরো এসেছে—
عن أبي هريرة- رضى الله عنه- أن رسول الله صلى
الله عليه وسلم قال : العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما، والحج المبرور ليس له
جزاء إلا الجـنة .) رواه البخاري ১৬৮৩ ومسلم১৩৪৯(
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স.
বলেছেন :—
‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহকে তার মধ্যবর্তী
পাপসমূহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর কলুষমুক্ত হজের পুরস্কার হল জান্নাত।’[xiv]
হজ মাবরুর বা কলুষমুক্ত হজ বলা হয় এমন হজকে যার
আহকামসমূহ পূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে ও হজের সময় কোন পাপ ও অশ্লীল কাজ করা হয়নি এবং
হজের সময়টা ছিল নেক আমল, কল্যাণমূলক কাজে ভরপুর।[xv]
একজন মুসলিমের জন্য কর্তব্য হল অতি সত্বর পবিত্র
হজ আদায় করে নেয়া। কেননা রাসূলে কারীম স. বলেছেন :—
من
أراد الحج فليتعجل، فإنه قد يمرض المريض، وتضل الضالة، وتعرض الحاجة.
.رواه ابن ماجه 2883
وأحمد 355 وصححه الألباني 2331
‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করল সে যেন তা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়।
হতে পারে তাকে কোন রোগে আক্রান্ত করবে বা বাহন হারিয়ে যাবে অথবা কোন প্রয়োজন দেখা
দেবে যা তার হজ আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’[xvi]
যে একবার ফরজ হজ ও ওমরাহ আদায় করেছে তার জন্য বার
বার তা আদায় করা মোস্তাহাব। কেননা এ দুটি এবাদতে রয়েছে মহা পুরস্কার ও সওয়াব।
রাসূলে কারীম স. বলেছেন :—
تابعوا
بين الحج والعمرة فإنهما ينفيان الفقر، كما ينفي الكير خبث الحديد والذهب والفضة،
وليس للحج المبرور ثواب إلا الجنة.) رواه أحمد 323 والترمذي810
والنسائي 2467 وابن ماجه2883 . صححه الألباني في صحيح سنن النسائي(
‘তোমরা হজ ও ওমরাহ বার বার আদায়ের চেষ্টা কর। কেননা এ দুটো এবাদত
দরিদ্রতাকে দূর করে যেমন আগুন লোহা ও স্বর্ণ-রুপার মরিচা দূর করে দেয়।’[xvii]
নিয়মিত ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া--
অর্থাৎ ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ সময়-মত সুন্দর ও
পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী স.। সকল এবাদতসমূহ তার
সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। হাদিসে এসেছে—
عن أبي هريرة- رضى الله عنه- قال : قال رسول الله
صلى الله عليه وسلم : إن الله تعالى قال : من عاد لي وليا فقد آذنته بالحرب، وما
تقرب إلي عبدي بشيء أحب إلي مما افترضته عليه، وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل
حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش
بها، ورجله التي يمشي بها، وإن سألني لأعطينه، ولئن استعاذ بي لأعيذنه ، وما ترددت
عن شيء أنا فاعله ترددي عن نفس المؤمن ، يكره الموت وأنا أكره مساءته.) رواه البخاري
৬৫০২(
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোন অলির সঙ্গে
শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরজ এবাদতের চাইতে আমার
কাছে অধিক প্রিয় কোন এবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল
এবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার
এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ
হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা
হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোন কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান
করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ
করতে চাইলে তাতে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা-সংকোচ করি মোমিন
বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ
করি।’[xviii]
এ হাদিসে কুদসীতে অনেকগুলো বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর
একটি হল, ফরজ এবাদতসমূহ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর নফল (যা ফরজ নয়) এবাদত
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। যদি ফরজ ও নফল এবাদতসমূহ যত্ন সহকারে যথাযথ নিয়মে
আদায় করা যায় তবে আল্লাহ রাববুল আলামিনের এমন নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ
হাদিসে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার এবাদতে কীভাবে যত্নবান হতে পারি এ সম্পর্কে এ
হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন : ফরজসমূহ যত্নের সাথে আদায় করার
অর্থ হল : আল্লাহর নির্দেশ পালন করা, তার নির্দেশকে সম্মান করা, মর্যাদা দেয়া,
নির্দেশের সামনে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত
করা, আল্লাহর রবুবিয়্যতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার দাসত্বকে মনে প্রাণে মেনে
নেয়া। আমলগুলো এভাবে যত্ন সহকারে আদায় করতে পারলে আল্লাহর সেই নৈকট্য অর্জন করা
যাবে যা তিনি এ হাদিসে বলেছেন।
ফরজ-ওয়াজিবসমূহ যত্ন সহকারে নিয়ম মাফিক আদায় করা
এমন একটি গুণ যার প্রশংসা আল্লাহ তাআলা তার কালামে পাকে করেছেন। বলেছেন :—
وَالَّذِينَ
هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ (المعارج : 34)
‘এবং যারা নিজেদের সালাতে যত্নবান।’[xix]
তাই আসুন ! আমরা এ পবিত্র দিনগুলোতে আল্লাহর
ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের কর্মসূচী বাস্তবায়নের অনুশীলন করে অধিক সওয়াব ও প্রতিদান
লাভ করতে চেষ্টা করি।
বেশি করে নেক আমল করা--
নেক আমল সকল স্থানে ও সর্বদাই আল্লাহ রাববুল
আলামিনের নিকট প্রিয়। তবে এই বরকতময় দিনগুলোতে নেক আমলের মর্যাদা ও সওয়াব অনেক
বেশি।
যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেলেন তারা তো
ভাগ্যবান—সন্দেহ নেই। আর যারা হজে যেতে পারেনি তাদের উচিত হবে এ বরকতময় দিনগুলোকে
মর্যাদা দিয়ে বেশি বেশি করে সালাত আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার, দোয়া-প্রার্থনা,
দান-সদকা, মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা,
সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় ও অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ প্রভৃতি ভাল কাজ সম্পাদন করা।
যেমন ইতিপূর্বে হাদিসে আলোচিত হয়েছে যে বেশি বেশি করে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ
রাববুল আলামিনের বিশেষ মহববত অর্জন করা যায়। (আমার বান্দা নফল এবাদত দ্বারাই
সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে।)
আল্লাহ তাআলার জিকির করা--
এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে জিকিরের এক বিশেষ
মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদিসে এসেছে :—
عن عبد الله بن عمر- رضى الله عنهما- عن النبى-
صلى الله عليه وسلم- قال : ما من أيام أعظم عند الله ولا أحب إليه من العمل فيهن
من هذه العشر، فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد.) رواه أحمد ১৩২ وقال أحمد شاكر :إسناده صحيح (
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম
স. বলেছেন : এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাববুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও
মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু
আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর।[xx]
আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেন :—
لِيَشْهَدُوا
مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا
رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ (الحج : 28)
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি
তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিন
সমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’[xxi]
অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বলেছেন : এ আয়াতে
নির্দিষ্ট দিন বলতে যিলহজের প্রথম দশ দিনকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ সময়ে আল্লাহর
বান্দাগণ বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা করেন, তার পবিত্রতা বর্ণনা করেন, তার
নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন, কোরবানির পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম ও তাকবীর
উচ্চারণ করে থাকেন।........
www.facebook.com/pages/Al-Quran-Modern-Science/140069416050931
No comments:
Post a Comment