দর্শক সংখ্যা

Wednesday, March 20, 2013

রোজার আদব (১)

রোজার আদব (১)
সংকলন : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা : কাউসার বিন খালেদ

রোজার আদব (১)
আদব হল মানুষের জীবনের সৌন্দর্য। ইবাদত-বন্দেগির আদবসমূহ ইবাদতকে উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ করে দেয়। তাই প্রত্যেকটি ইবাদতের রয়েছে কিছু আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার। কিছু আদব হল অবশ্য পালনীয় যা বাস্তবায়ন না করলে ইবাদতটি গ্রহণযোগ্য হবে না, আর কিছু হল মোস্তাহাব অর্থাৎ যা পালন করলে ইবাদতটি পরিপূর্ণতার সহায়ক হয় এবং ইবাদতের মাঝে কোন ক্ষতি হয়ে গেলে তা কাটিয়ে উঠা যায় ও পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যায়। তাই আমরা এখানে সিয়ামের কতিপয় আদব আলোচনা করব। আমরা যদি এ আদবসমূহ মান্য করে সিয়াম আদায় করতে পারি তবে আল্লাহর ফজলে আমরা সিয়ামের পূর্ণ সওয়াব বা প্রতিদান লাভ করতে সক্ষম হব।

(১) ইসলামকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করা :
সিয়াম পালনকারী তো বটেই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হল আল্লাহ যা কিছু আদেশ করেছেন তা পালন করা। আর যা কিছু করতে তিনি নিষেধ করেছেন তার প্রত্যেকটি বর্জন করা। এর নামই হল ইসলাম বা স্রষ্টার কাছে মানুষের পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একজন মুসলিম যেমন কখনো নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে পারে না তেমনি অন্য মানুষের খেয়াল-খুশি বা তাদের রচিত বিধানের অনুগত হতে পারে না। যদি হয় তবে তা স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করা হল না। যদি এমনভাবে জীবনকে পরিচালিত করা যায় তবে তাকেই বলা হবে পরিপূর্ণ ইসলাম। আর পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করতে আল্লাহর রাব্বুল আলামিন আদেশ করেছেন মানুষকে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ. (البقرة : ২০৮)
‘হে মোমিনগণ ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“।’ সূরা বাকারা : ২০৮
ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করার নামই হল তাকওয়া। যে তাকওয়া অবলম্বন করতে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বার বার নির্দেশ দিয়েছেন। এ তাকওয়ার দাবি হল আল্লাহর আনুগত্য করা হবে, অবাধ্য হওয়া যাবে না, তাকে স্মরণ করা হবে ভুলে যাওয়া চলবে না, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে অকৃতজ্ঞ (কাফির) হওয়া যাবে না। ঈমানদারের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হল, শিরক ও রিয়া মুক্ত থেকে খালেস আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদতসমূহ সম্পাদন করা। এর মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। সালাত বাদ দিয়ে সিয়ামের কি মূল্য আছে ? দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে। জামাতের সাথে সালাত আদায়ের মাধ্যমে মুনাফেকি থেকে মুক্তির সনদ নিতে হবে। এরপর যথা সময় জাকাত আদায় করতে হবে। সত্যিকার হকদারকে জাকাত প্রদান করতে হবে। এমনিভাবে যে সামর্থ্য রাখে তার হজ ও ওমরাহ আদায় করতে হবে। সাথে সাথে উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে সকলের সাথে আচরণ করতে হবে। মাতা-পিতার সাথে ভাল আচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক সু-দৃঢ় রাখা, প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ, সাধ্য-মত সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এমনিভাবে জাদু-টোনা, সুদি কারবার, মিথ্যা কথা, ধোঁকাবাজি, ঘুসসহ সকল প্রকার দুর্নীতি, মাদক সেবন, ব্যভিচার, সৃষ্টি জীবকে কষ্ট দেয়া ও গান-বাদ্য পরিহার করতে হবে। মানুষের অধিকারগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে হবে।

(২) সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত থাকা :
রমজানে সকল প্রকার অন্যায় থাকতে বিরত না থাকলে সিয়াম কবুলের বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। অনেককে দেখা যায় সিয়াম পালন করে অযথা কথা-বার্তা, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে খবর রাখে না যে এ সকল অন্যায় কাজ-কর্ম সিয়ামের প্রতিদান লাভে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের ব্যাপারেই হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
كم من صائم ليس له من صيامه إلا الظمأ وكم من قائم ليس له من قيامه إلا السهر. (أخرجه الدارمي)
‘কত সিয়াম পালনকারী আছেন যারা উপোস থাকা ছাড়া আর কিছু পায় না। আর কত রাতজাগা সালাত আদায়কারী আছে যারা রাত্রি-জাগরণ ব্যতীত আর কিছু লাভ করে না।’ বর্ণনায় : দারামী
অতএব যার উদর সিয়াম পালন করছে তার উচিত তার মুখ, কর্ণ, চক্ষু, হাত ও পা সবকিছুই সিয়াম পালন করবে। সকল অন্যায়-অবৈধ কাজ হতে এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পবিত্র থাকবে। যেমন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
. . والصيام جنة فإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث يومئذ ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني امرء صائم . رواه مسلم
সিয়াম হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে সিয়াম পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায় তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী। বর্ণনায় : মুসলিম
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন :—
ليس الصائم من الأكل والشرب، إنما الصيام من اللغو والرفث، فإن سابك أحد أو جهل عليك، فقل إني صائم. رواه ابن خزيمة والحاكم
‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়। মূলত সিয়াম হল : অনর্থক-অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। যদি তোমার সাথে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, অথবা মূর্খতা সুলভ আচরণ করে তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী। বর্ণনায় : ইবনে খুযাইমা ও হাকেম
যদি সিয়াম পালনকারী নিষিদ্ধ কথা ও কাজ-কর্ম পরিত্যাগ না করেন তবে তার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে দুঃসংবাদ :—
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه. رواه البخاري
‘যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ বর্ণনায় : বোখারি

(৩) এখলাস অবলম্বন করা :
কোন কাজে এখলাস অবলম্বন করার অর্থ হল কাজটা করার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। শুধু সিয়াম নয়, এ এখলাস ব্যতীত কোন আমল কবুল হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :—
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ. ( البينة : ৫)
‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও জাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন।’ সূরা আল-বাইয়েনা : ৫
আর সিয়াম পালনে এখালাসের বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر لـه ما تقدم من ذنبه .رواه الشيخان
‘যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
এ হাদিসে ‘ইহতিসাব’ শব্দ এসেছে। এর অর্থ এখালাসের সাথে সিয়াম পালন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার কাছ থেকে প্রতিদানের আশা করার নাম হল ইহতিসাব।

(৪) সুন্নতে নববীর অনুসরণ :
কোন আমল—তা যতই এখালাসের সাথে সম্পাদন করা হোক না কেন, তা যদি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা না হয় তবে তা কবুল করা হবে না। বরং তা আল্লাহর দরবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে।
যেমন বলেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد . رواه مسلم
‘যে এমন আমল করবে যার প্রতি আমাদের দ্বীনের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।’
‘যার প্রতি আমাদের দ্বীনের নির্দেশ নেই’—কথাটির অর্থ হল যা আমাদের সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব এমন সকল আমল যতই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে করা হোক তা রাসূলুল্লাহ স.-এর পক্ষ থেকে অনুমোদিত না হওয়ার কারণে আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব কোন ধর্মীয় আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দুটো শর্ত। তা হলে : এক. কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। দুই. কাজটি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে হবে। কাজটি যদি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করা না হয় বা এ কাজে তার অনুমোদনের প্রমাণ না থাকে তাহলে কাজটি করে কোন সওয়াব অর্জিত হবে না। বরং গুনাহ হবে।
(৫) যা কিছু সিয়াম ভঙ্গের সহায়ক তা পরিহার করে চলা :
সিয়াম পালনকারীর এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যে, যে সকল আচার-আচরণ সিয়াম ভঙ্গ করার কারণ হয় অথবা সিয়াম নষ্ট করার সহায়ক হয় এমন সকল বিষয় থেকে দুরত্ব বজায় রাখা। বিশেষত: স্বামী স্ত্রীর আলিঙ্গন, চুম্বন বা এক কাঁথা কম্বলের নীচে শয়ন করা ইত্যাদি পরিহার করা উচিত। এ সকল কাজ যদিও সিয়াম অবস্থায় করার অনুমতি আছে কিন্তু দেখা গেছে এ সকল কাজ করতে যেয়ে অনেকে সমস্যায় পড়ে গেছে ফলে সিয়াম ভঙ্গ হয়ে গেছে। প্রত্যেক বিষয়ের একটি সীমানা আছে, এ সীমা যাতে অতিক্রম না হয়ে যায় এ লক্ষ্যে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য হাদিসে নির্দেশ এসেছে। যদিও সীমানা পর্যন্ত যাওয়া বৈধ কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন বিধেয়। মনে রাখতে হবে রমজানের দিনের বেলা সিয়াম ভেঙে ফেলা একটি কবিরা গুনাহ। ‘আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি’ বা ‘এমনটি হবে বুঝতে পারিনি’ বলে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এ ধরনের কথা কখনো অজুহাত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

(৬) ভয় ও আশা পোষণ করা :
প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হল সকল ইবাদত ও সিয়াম-সালাত সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা। কিন্তু সে জানে না তার এ সালাত ও সিয়াম আল্লাহ কবুল করেছেন না প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতএব তার সর্বদা এ ভয় থাকা উচিত যে, হয়তো আমি আমার ইবাদত-বন্দেগি এমনভাবে আদায় করতে পারিনি যেভাবে আদায় করলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। ফলে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান হয়তো পাব না। আবার এ আশাও পোষণ করা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে আমার ত্র“টিগুলো ক্ষমা করে আমার ইবাদত-বন্দেগি কবুল করে আমাকে প্রতিদান দেবেন। এ অবস্থার নাম হল ‘আল-খাওফ ওয়ার রজা’ অর্থাৎ ‘ভয় ও আশা।’ এটা ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ আকীদাগত পরিভাষা।
মনে রাখতে হবে আল্লাহ তাআলা সকলের নেক আমল কবুল করেন না। যেমন তিনি বলেন :—
إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.  (المائدة : ২৭)
‘অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজ কবুল করেন।’ সূরা মায়েদাহ : ২৭
হাদিসে এসেছে আয়েশা রা. এ আয়াতের অর্থ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ স.-কে জিজ্ঞেস করলেন :—
(والذين يؤتون ما آتوا وقلوبهم وجلة) أي خائفة. أهم الذين يشربون الخمر ويسرقون ؟ قال : لا يا بنت الصديق، ولكنهم الذين يصومون ويصلون ويتصدقون وهم يخافون أن لا تقبل منهم. أولئك يسارعون في الخيرات وهم لها سابقون. رواه الترمذي
‘যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে’—আল্লাহ এ কথা কাদের জন্য বলেছেন, যারা মদ্য পান করে, চুরি করে তাদের জন্য ? তিনি উত্তরে বললেন : না, হে সত্যবাদীর কন্যা ! তারা হল, যারা সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে, দান-সদকা করে সাথে সাথে এ ভয় রাখে যে হয়তো আমার এ আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী।’ বর্ণনায় : তিরমিজি
বর্ণিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, আল্লাহ ঐ সকল মুনিমদের প্রশংসা করেছেন যারা নেক আমল করে কবুল হবে কি হবে না এরকম একটা ভয় পোষণ করে। এবং কাজ আরো সুন্দর করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ ভয় যেন আবার মানুষকে নৈরাশ্যবাদী না করে। কোন অবস্থাতেই কোন মুসলিম আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত থেকে নিরাশ হতে পারে না। আল্লাহর সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদী হওয়া একটা কুফরি। নেক আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী হতে হবে কিন্তু এ আশাবাদী মনোভাব যেন অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তিতে ফেলে না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তি নেক আমলকে বাতিল করে দেয়। অনেক সময় অলসতা নিয়ে আসে। অপরদিকে ভয় মানুষকে তৎপর ও কর্মঠ হতে সাহায্য করে। তাই সকলের উচিত সকল প্রকার নেক আমল করতে হবে ভয় ও আশা নিয়ে। শুধুই ভয় অথবা শুধুই পাওয়ার আশায় নয়।


(৭) সেহরি খাওয়া :
সিয়াম পালনের জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
تسحروا فإن في السحور بركة.  (رواه البخاري ومسلم)
‘তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
সেহরি না খেয়ে সিয়াম পালন করলে যখন সিয়াম আদায় হবে। তবে সেহরি খাবেন কেন ?
(ক) সেহরি খাওয়া সুন্নত। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেহরি খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
(খ) ক্ষুধা-পিপাসা মোকাবিলা করার জন্য।
(গ) সেহরি খেলে সিয়াম পালনে কষ্ট কম হয় ও সিয়াম পালন সহজ হয়।
(ঘ) ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। কারণ তারা সিয়াম পালন করতে সেহরি খায় না। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحور.  (رواه مسلم)
‘আমাদের ও ইহুদি-খ্রিস্টানদের সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হল সেহরি খাওয়া।’ বর্ণনায় : মুসলিম
(ঙ) সেহরির মাধ্যমে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
(চ) ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করা নিশ্চিত হয়।
তাই সেহরি খাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবে সেহরির খাবার হালকা হওয়া ভাল। এমন বেশি খাওয়া উচিত নয় যাতে দিনের বেলা কাজ-কর্মে অলসতা দেখা দেয়। যে কোন হালাল খাবার সেহরিতে গ্রহণ করা যায়।
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
نعم سحور المؤمن التمر. (رواه أبو داود)
‘মোমিনের উত্তম সেহরি হল খেজুর।’ বর্ণনায় : আবু দাউদ। তিনি আরো বলেন :—
السحور أكلة بركة فلا تدعوه، ولو أن بجرع أحدكم جرعة من ماء، فإن الله وملائكته يصلون على المتسحرين. (رواه أحمد)
‘সেহরি হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সেহরি করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও ফেরেশ্তাগণ সেহরিতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন।’ বর্ণনায় : আহমদ
(৮) দেরি করে সেহরি খাওয়া :
সেহরির অর্থ হল যা কিছু রাতের শেষ ভাগে খাওয়া হয়। সুন্নত হল দেরি করে সেহরি খাওয়া। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা শেষ সময়ে সেহরি খেতেন। ফজরের ওয়াক্ত আসার পূর্বক্ষণে সেহরি খেলে সিয়াম পালন অধিকতর সহজ হয়, ফজরের সালাত আদায় করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কষ্ট করতে হয় না। সতর্কতা অবলম্বন করে ফজরের অনেক আগে সেহরি শেষ করা সুন্নত নয়। সেহরি সময় শেষ হলো কি-না তা জানবেন নিজের চোখে পূর্বাকাশের শুভ্রতা দেখে, অথবা ক্যালেন্ডার ও ঘড়ির মাধ্যমে সূক্ষ্ম হিসাব করে কিংবা নির্ভরযোগ্য মুয়াজ্জিনের ফজরের আজান শুনে।

(৯) সেহরির সময়কে সুযোগ মনে করে কাজে লাগানো :
সেহরির সময় অত্যন্ত মর্যাদা-পূর্ণ একটি সময়। এ সময় জাগ্রত হওয়ার কারণে আল্লাহ যা পছন্দ করেন এমন অনেক ভাল কাজ করা যায়। যেমন তিনি মোমিনদের প্রশংসায় বলেছেন :—
وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ. (الذاريات :১৮)
‘তারা শেষ রাতে (সেহরির সময়) ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ সূরা জারিয়াত : ১৮
তিনি এ আয়াতে ঐ সকল জান্নাতবাসী মানুষদের প্রশংসা করেছেন যারা শেষ রাতে দোয়া-প্রার্থনা করে ও ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছে। এর মাধ্যমে তারা যে জান্নাত লাভ করবে এর সুসংবাদও দেয়া হয়েছে। সেহরির সময়টা এমন একটি সময় যখন আল্লাহর রাব্বুল আলামিন দুনিয়ার নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন। যে সকল মানুষ তখন তার প্রতি আগ্রহী হয়ে সালাত ও দোয়া-প্রার্থনা করে তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
ينـزل ربنا تبارك وتعالى كل ليلة إلى السماء الدنيا حين بيقى ثلث الليل الآخر، فيقول: من يدعوني فأستجيب له، من يسألني فأعطيه، من يستغفرني فأغفرله. رواه البخاري ومسلم
‘আমাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। তখন মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলেন, যে আমার কাছে দোয়া করবে আমি তাতে সাড়া দেব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব ও যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম
অতএব সেহরির সময় হল আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি দান-প্রতিদানের সময়। এ সময় সে ব্যক্তিই তার সামনে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন যিনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করেছেন। অনেক মানুষ এমন আছেন যারা এ সময় জাগ্রত হয়ে খাওয়া-দাওয়াসহ অনেক কাজ সমাধা করেন কিন্তু দোয়া- প্রার্থনা. ইস্তিগফার, তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার সুযোগ করে নিতে পারেন না।
শেষ রাতের সালাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:—
يا أيها الناس أفشوا السلام، وأطعموا الطعام، وصلوا الأرحام، وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام. رواه الترمذي
‘হে মানবসকল ! তোমরা সালামের প্রচলন কর। অন্যকে খাবার দাও। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা সালাত আদায় কর তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে যেতে পারবে।’ বর্ণনায় : তিরমিজি

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment