ইসলামে সালাতের গুরুত্ব (পর্ব : ২)
জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব হওয়া প্রসঙ্গে: সালাত আল্লাহ তাআলার মহান আদেশ এবং ঈমানের পরই সালাতের গুরুত্ব। আর সালাত মহা মর্যাদার অধিকারী এবং সালাত ত্যাগকারীর উপর অনেক বিধানই কার্যকর হয়। এ কারণেই আল্ল¬াহ তার বান্দাদেরকে জামাতের সাথে মসজিদে সালাত আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। সুতরাং, আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে সালাত জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব। জামাতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব হওয়ার উপর একাধিক প্রমাণ বিদ্যমান আছে।
জামাত ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ :
১-আল্লাহ রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন:—
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ (سورة البقرة :৪৩)
“তোমরা সালাত কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।”
অর্থাৎ- সালাত আদায়কারীর সাথে সালাত আদায় কর।
২- আল্লা¬হ তাআলা ভীষণ ভয়ের সময় জামাতে সালাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্ল¬াহ তার নবীকে বলেন:—
وَإِذَا كُنْتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلَاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِنْ وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَى لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ . . . (النساء:১০২) .
এবং যখন তুমি তাদের মাঝে থাক, তখন তাদের জন্য নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর, যেন
তাদের একদল তোমার সাথে দণ্ডায়মান হয় এবং স্ব-স্ব অস্ত্র গ্রহণ করে: অতঃপর যখন সেজদা সম্পন্ন করে তখন যেন তারা তোমার পশ্চাদ্বর্তী হয় এবং অন্যদল, যারা নামাজ পড়েনি, তারা যেন অগ্রসর হয়ে তোমার সাথে নামাজ পড়ে এবং স্ব-স্ব সতর্কতা এবং অস্ত্র গ্রহণ করে। (সুরা নিসা:১০২)
উল্লে¬খিত আয়াতটি صلاة الخوفসম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এ বিষয়ে ইজমা বিদ্যমান আছে।
আর এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, ভয়ের সময় যদি জামাত ওয়াজিব হয়, তবে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময় ওয়াজিব হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত।
৩-নবী করিম সা: জামাতে সালাত আদয়ের নির্দেশ দেন তিনি বলেন—
إذا كانوا ثلاثة فليؤمهم أحدهم واحقهم بالإمامة أقرأهم) رواه مسلم : ১০৭৭)
“যখন তারা তিন জন হবে তখন তাদের একজন ইমামতি করবে আর তাদের মাঝে যিনি ভাল পড়তে পারবে সেই ইমাম হওয়ার জন্য অধিক বিবেচ্য।” (মুসলিম:১০৭৭ )
৪- অন্ধ সাহাবি আব্দুল¬হ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. জামাতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকার অনুমতি চাইলে রাসূল সা: তাকে অনুমতি দেননি। তিনি রাসূলের দরবারে এসে বলেন:—
يا رسول الله إني رجل ضرير البصر شاسع الدار ولي قائد لا يلائمني فهل لي رخصة أصلي في بيتي قال هل تسمع النداء قال نعم قال لا أجد لك رخصة. (رواه أبوداود:৪৬৫)
ইয়া রাসুলুল্ল¬াহ ! আমি একজন অন্ধ মানুষ, আমার বাড়িও অনেক দূরে এবং আমার একজন পথচালক আছে সে আমার পছন্দনীয় নয়। আমার জন্য ঘরে সালাত পড়ার অনুমতি আছে কি ? রাসূল সা: বললেন তুমি কি আজান শুন ? বললেন হ্যাঁ। তার পর রাসূল সা. বললেন, তাহলে আমি তোমার জন্য জামাতে অনুপস্থিত থাকার কোন অনুমতি দিচ্ছি না। (আবুদাউদ:৪৬৫)
অন্যান্য বর্ণনায় বর্ণিত আছে তার বাড়ি ও মসজিদের মাঝে খেজুরের বাগান ও অন্যান্য গাছের বাগান বিদ্যমান। শহরটিতে অধিক হারে হিংস্র পশু, কীট, পতঙ্গ বসবাস করত। তিবরানীর বর্ণনায় এসেছে—
إنه قال له (ما أجد لك رخصة ولو يعلم هذا المتخلف عن الصلاة في الجماعة ما لهذا الماشي إليهالأتوها ولو حبوا (الطبراني)
তিনি বলেন আমি তোমার জন্য অনুমতি দিতে পারছি না। জামাতে সালাত পড়া হতে বিরত ব্যক্তি যদি বুঝতে পারতো জামাতে সালাত পড়ার কি গুরুত্ব, তাহলে সে নিতম্ব, দুই হাত ও দুই পায়ে চড়ে হলেও সালাতে উপস্থিত হত। (তিবরাণী)
৫-কোন প্রকার অপারগতা ছাড়া জামাত হতে বিরত থাকলে তার সালাতই হয় না। রাসূল সা: বলেন-
من سمع النداء فلم يأته فلا صلاة له إلا من عذر )) رواه ابن ماجة:৭৮৫)
যে ব্যক্তি আজান শ্রবণ করার পর সালাতে উপস্থিত হয় না তার সালাতই হয় না। (ইবনে মাজাহ:৭৮৫ )
৬-জামাতে সালাত হতে বিরত থাকা মুনাফেকের নিদর্শন। রাসূল সা: বলেন—
ليس صلاة أثقل علي المنا فقين من الفجر والعشاء ولو يعلمون ما فيهما لأتوهما ولو حبوا ( رواه البخاري:৫৮০)
মুনাফেকের জন্য ফজর আর এশার সালাত যত কষ্টকর অন্য আর কোন সালাত অনুরূপ কষ্টকর নয়, তারা যদি এ দুটি সালাতের সওয়াব সম্পর্কে জানতো, তাহলে নিতম্বে ভর করে হলেও এ দুই সালাতে উপস্থিত হত। (বোখারি:৫৮০)
৭-জামাত বাদ দেয়া বান্দার উপর শয়তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণ। রাসূল সা: বলেন:
مامن ثلاثة في قرية ولابدو لا تقام فيهم الصلاة إلا قد استحوذ عليهم الشيطان فعليك بالجماعة فإنما يأكل الذئب من الغنم القاصية (رواه أبوداود:৮৩৮)
“কোন গ্রাম বা উপত্যকায় তিন জন লোক বিদ্যমান, অথচ সেখানে জামাতে সালাত হয় না তাদের উপর শয়তান প্রাধান্য বিস্তার করবে। সুতরাং, তুমি জামাতকে জরুরি মনে কর। কারণ, বাঘ সাধারণত পাল হতে বিচ্ছিন্ন বকরিটাকেই আক্রমণ করে।” (আবু দাউদ:৮৩৮)
৮-জামাত ত্যাগ করা আল্ল¬াহর ক্রোধের কারণ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لينتهين أقوام عن ودعهم الجماعة أو ليختمن الله على قلوبهم ثم ليكونن من الغافلين . (رواه ابن ماجة:৭৮২ )
সম্প্রদায়ের লোকেরা হয় জামাত ত্যাগ করা হতে বিরত থাকবে, অন্যথায় আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন অত:পর তারা গাফেল লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (ইবনে মাজাহ:৭৮৬)
৭- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামাতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেছেন। তিনি বলেন :—
لقد هممتت أن أمر المؤذن فيقيم ثم أمر رجلا يؤم الناس ثم أخذ شعلا من النار فأحرق على من لا يخرج إلى الصلاة بعد. (رواه البخاري:৬১৭ )
“আমার ইচ্ছা হয় মুয়াজ্জিনকে নির্দেশ দিই সে সালাতের একামত বলে আর একজনকে আদেশ করি সে সালাত পড়াবে অত:পর একটি অগ্নিকুণ্ড নিয়ে বের হই এবং যারা সালাতে উপস্থিত হয়নি তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিই।” (বোখারি:৬১৭)
হাদিসে রাসূল ঐ সকল লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেছেন, যারা মসজিদে আসেনি, তারা ঘরে সালাত পড়–ক, অথবা নাই পড়–ক।
জামাতে সালাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য এটাই সব চেয়ে বড় দলিল। আর যদি জামাত মোস্তাহাব হত তাহলে এ ধরনের পুড়িয়ে দেয়ার মত সংকল্প করা কোনভাবেই সম্ভব হত না। ছলফে ছালেহীন জামাতের সালাতকে সীমাহীন গুরুত্ব দেন। এমনকি জামাত তরক করাকে মুনাফেকের নিদর্শন হিসাবে গণ্য করেন।
আব্দুল্ল¬াহ বিন মাসঊদ (রা:) বলেন—
من سره أن يلقى الله غدا مسلما فليحافظ علي هؤلاء الصلوات حيث ينادي بهن فإن الله شرع لكم سنن الهدى ولو أنكم صليتم في بيوتكم كما يصلي هذا المتخلف في بيته لتركتم سنة نبيكم ولوتركتم سنة نبيكم لضللتم ....ثم يقول و لقدرأيتنا وما يتخلف عنها إلا منافق معلوم النفاق و لقد كان الرجل يؤتي به يهادي بين الرجلين حتي يقام في الصف . )رواه مسلم:১০৪৬)
যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে সে আগামী দিন আল্লাহর সাথে একজন মুসলমান হিসাবে সাক্ষাৎ করবে, সে যেন সালাত সংরক্ষণ করে, যখন তার প্রতি আহ্বান করা হয়। কারণ, আল্লাহ তোমাদের নবীর জন্য হেদায়াতের পদ্ধতি চালু করেছেন, আর সালাত তার অন্যতম, যদি তোমরা পশ্চাৎগামী লোকটির ন্যায় ঘরে সালাত আদায় কর, তবে তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শকে ত্যাগ করলে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শকে ছেড়ে দাও, তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে। অত:পর তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে দেখেছি নামাজে উপস্থিত হওয়া থেকে একমাত্র পরিচিত মুনাফেক ছাড়া আর কেউ বিরত থাকতো না, এমনকি কোন কোন লোককে দেখা যেত দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর করে তাকে নিয়ে আসা হত তারপর তাকে সালাতের কাতারে দাঁড় করানো হত। (মুসলিম:১০৪৬)
এবং ইবনে ওমর রা. বলেন :—
كنا إذا فقدنا الرجل في صلاة العشاء و صلاة الفجر أسأنا به الظن. رواه ابن أبي شيبة
আমরা যখন দেখতাম কোন লোক ফজর ও এশার নামাজে অনুপস্থিত তখন তার প্রতি আমরা খারাপ ধারণা করতাম। (ইবনু আবীশাইবা )
ইব্রাহীম তাইমী (রহ:) বলেন:—
যখন দেখবে কোন ব্যক্তি নামাজে প্রথম তাকবীরকে গুরুত্ব দেয় না তুমি তার থেকে হাত ধুয়ে নাও। অর্থাৎ তাকে এড়িয়ে যাও।
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ বলেন:—
সালাতের সুন্নত হল সালাতে ইকামত দেয়ার পূর্বেই উপস্থিত হওয়া।
আদি বিন হাতিম (রা:) বলেন:—
ইসলাম গ্রহণ করার পর যখনই সালাতের ইকামত হত, আমি ওজু অবস্থায় থাকতাম। ইব্রাহীম বিন মাইমুন—তিনি রঙের কাজ করতেন,—তার অভ্যাস ছিল, যদি তিনি তুলি উঠানো অবস্থায় আজান শুনতেন তুলিটি ফিরিয়ে নিতেন না বরং তা ঐ অবস্থায় নিক্ষেপ করে দিতেন এবং সালাতে দাঁড়াতেন।
বশার বিন হাসান, পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত প্রথম কাতার ছাড়েননি এমন কি তার নামও ছফ্ফী (কাতারবন্দী) হয়ে যায়।
সুলাইমান বিন মাহরান সত্তুর বৎসর জীবিত থাকেন কিন্তু একবার ও তার তাকবীরে উলা-প্রথম তাকবীর -ছুটেনি।
অনুরূপ আমাশ (র:) সাইদ বিন আব্দুল আজীজ (রহ:) যখন জামাতে সালাত ছুটে যেত কান্নাকাটি করতেন।
ইবনে ওমর রহ:-এর যখন এশার সালাতের জামাত ছুটে যেত, তিনি অবশিষ্ট রাত ঘুমাতেন না, সারা রাত এবাদত বন্দেগিতে কাটিয়ে দিতেন।
সাহাবিরা যে কোন ধরনের প্রতিকুল অবস্থা-অসুস্থতা, ভয়—ইত্যাদি সত্ত্বেও জামাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আকাংখা করতেন।
আবু আব্দুর রহমান আসসুলামী মসজিদে রওয়ানা দিলে পথ মাঝে তার মৃত্যু উপস্থিত হলে লোকেরা তাকে বাড়ি নিয়ে আসতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, যাতে তার রূহ ক্ববজ করার সময় তাকে নামাজের প্রতীক্ষা অবস্থায় পাওয়া যায়।
সাহাবিরা তাদের সন্তানদেরও নামাজের জামাতের জন্য উৎসাহ দিতেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন এবং অলসতার দরুন তাদের শাস্তি দিতেন।
খুলাফায়ে রাশেদীনও জামাতের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। যারা জামাতে উপস্থিত হতেন না তাদেরকে হুমকি দিতেন। তৎকালে অক্ষম প্রতিবন্দিদের জন্য একজন লোক নিয়োগ করা হত যিনি জামাতে উপস্থিত হতে তাদের সাহায্য করতেন। যেমন ওমর রা: হতে বর্ণিত, তিনি একজন অন্ধকে সালাতে নিয়ে আসার জন্য একজন গোলাম নিয়োগ করেন।
জামাতে সালাত আদায়ের ফজিলত
জামাতে সালাত আদায় কারীদের জন্য মহান আল্লাহ যে সব ফজিলতের ঘোষণা দিয়েছেন, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, যখন কোন কাজের লাভ ও উপকারিতা জানা থাকে, তখন সে কাজ করার প্রতি আগ্রহ জাগে এবং কাজটি করতে উৎসাহ পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, জামাতে সালাত আদায়ের অনেক ফজিলত ও লাভ রয়েছে, কিন্তু এসব লাভ শুধু জামাতে সালাত পড়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় বরং কোন ব্যক্তি যদি জামাতে সালাত আদায়ের প্রতিজ্ঞা করে, জামাতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে আগমন করে, (যদিও সে জামাত পায়নি) জামাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অপেক্ষা করতে থাকে, এমনকি সালাত আদায়কারী জামাতে নামাজ আদায় শেষে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে ছাওয়াব পেতে থাকবে।
নিম্নে এর বিশদ আলোচনা করা হল:
এক. -যে ব্যক্তি মসজিদে জামাতে সালাত আদায় করাকে বেশি বেশি ভালোবাসে আল্লাহ তাআলা কেয়ামত দিবসে আরশের নীচে তাকে ছায়াদান করবে, যেদিন আল্লাহর আশ্রয় ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
রাসূল সা. বলেন :
سبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله الإمام العادل وشاب نشأ في عبادة الله ورجل قلبه بالمساجد ورجلان تحابا في الله اجتمعا عليه وتفرقا عليه ورجل طلبته إمرأة ذات منصب وجمال فقال إني أخاف الله ورجل تصدق بصدقة أخفى حتى لا تعلم شماله ما تنفق يمينه ورجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه. رواه أبوداود)
“সাত ব্যক্তিকে কেয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া দেয়া হবে, যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া অবশিষ্ট থাকবে না—
১-ন্যায় পরায়ণ বাদশা।
২-ঐ যুবক যে তার যৌবন আল্লাহর এবাদতে কাটিয়েছেন।
৩-যে লোকের অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।
৪-দুই ব্যক্তি একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য পৃথক হয়।
৫-একজন ক্ষমতাবান সুন্দরী রমণী তাকে আহ্বান করলে, উত্তরে সে বলল নিশ্চয়ই আমি আল্লাহকে ভয় করি।
৬-এক ব্যক্তি এমন গোপনে দান খয়রাত করল, তার বাম হাত জানে না ডান হাতে কি দান করল।
৭-যে নির্জনে আল্লাহর স্মরণ করল, এবং তার চক্ষুদ্বয় হতে অশ্র“ প্রবাহিত হতে লাগল।
দুই. -মসজিদে আগমনের ফজিলত:
বর্ণিত সওয়াব একমাত্র ঐ ব্যক্তি পাবে যে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্যই ঘর হতে বের হয়। এ বিষয় বর্ণিত হাদিস :—
من خرج من بيته متطهرا إلي صلاة مكتوبة فأجره كأجر الحاج المحرم. (رواه أبوداود:৪৭১)
“যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় ফরজ সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে ঘর হতে বের হয়, তার সওয়াব এহরাম বেঁধে হজের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সমপরিমাণ। (আবুদাউদ:৪৭১)
রাসূল সা: বলেন—
بشر المشائين في الظلم إلي المساجد بالنور التام يوم القيامة . ( رواه أبوداود:৪৭৪)
গভীর অন্ধকারেও মসজিদে আগমনকারীদেরকে কেয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ নুরের সুসংবাদ প্রদান করুন। (আবুদাউদ:৪৭৪)
রাসূল সা: আরো বলেন:—
من غدا إلي المسجد أو راح أعدالله له نزله من الجنة كلما غدا أو راح. (رواه البخاري:৬২২ )
“যে ব্যক্তি সকাল ও বিকালে মসজিদে গমন করে আল্লাহ তাআলা প্রতিবারই তার জন্য জান্নাতে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেন।” (বোখারি:৬২২)
তিন. -সালাতের অপেক্ষায় বসে থাকা ব্যক্তি সালাতের সওয়াব পাবে। রাসূল সা: বলেন:—
أحدكم ما قعد ينتظر الصلاة في صلاة ما لم يحدث تدعوا له الملائكة اللهم اغفرله اللهم ارحمه . (رواه مسلم:১০৬৩)
তোমাদের কেউ সালাতের অপেক্ষা করতে থাকলে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওজু নষ্ট না হয়, সে সালাতের সওয়াব পেতে থাকবে। আর ফেরেশতারা তার জন্য এ বলে দোয়া করবে-
হে আল্লাহ তাকে মাফ কর; তাকে রহম কর; ও দয়া কর ; (মুসলিম:১০৬৩)
চার.Ñপ্রথম কাতারের ফজিলত :—
এ ফজিলত বিশেষ করে ঐ ব্যক্তি পাবে যে জামাতে সর্বাগ্রে উপস্থিত হয় এবং প্রথম কাতারে অংশগ্রহণ করে। প্রথম কাতারের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস :
لو يعلم الناس ما في النداء والصف الأول ثم لم يجدوا إلا أن يستهموا عليه لاستهموا. ( رواه البخارى:৫৮০ )
লোকেরা প্রথম কাতার ও আজানের ফজিলত কি তা যদি জানতো, আর তা লটারি ছাড়া লাভ করা সম্ভব না হত তবে তারা লটারিতেও অংশ গ্রহণ করত। (বোখারি:৫৮০ )
পাচÑগুনাহ মাফ হয় :—
من توضأ للصلاة فأسبغ الوضوء ثم مشى إلى الصلاة المكتوبة فصلاها مع الناس أو مع الجماعة أو فى المسجد غفر الله له ذنوبه. (رواه مسلم:৩৪১ )
যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সালাতের ওজু করে তারপর ফরজ নামাজের উদ্দেশ্যে পথ চলে এবং মসজিদে জামাতে সালাত আদায় করে আল্ল¬াহ তাআলা তার যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেন (মুসলিম:৩৪১)
ছয়.Ñদোজখের আগুন হতে নিষ্কৃতি ও নিফাক হতে পরিত্রাণ।
রাসূল সা: বলেন:—
من صلى أربعين يوما في جماعة يدرك التكبيرة الأولي كتب له براءتان: براءة من النار و براءة من النفاق. (رواه الترمذي:২২৪ )
যে ব্যক্তি চল্লি¬শ দিন যাবৎ প্রথম তাকবীরের সাথে জামাতে সালাত আদায় করে আল্ল¬াহ তাকে দুটি পুরস্কার প্রদান করেন—এক-দোজখের আগুন হতে মুক্তি। দুই-নেফাক হতে নিষ্কৃতি (তিরমিযি:২২৪)
সাত.-জামাতে সালাত আদায় একা একা আদায় হতে সাতাশ গুন বেশি মর্যাদা রাখে।
উল্লে¬খিত সকল ফজিলত ছাড়াও ইশা ও ফজরের নামাজ জামাতে আদায়কারীর জন্য বিশেষ ফজিলত হাদিসে বর্ণনা করা হয়। এর কারণ, এ দুই সালাতের সময় সাধারণত বিশ্রাম, গভীর অন্ধকার ও ভয়-ভীতির সম্ভাবনা থাকে। এ দুই সালাত মুনাফেকদের জন্য ঈমানের বিলুপ্তির কারণ হয় আর মোমিনদের জন্য কারণ হয় ঈমান বৃদ্ধি এবং অধিক সওয়াব লাভের। রাসূল সা: বলেন:—
ولو يعلمون ما في العتمة (أي العشاء) والصبح لأتوهما ولو حبوا. (رواه البخاري:৫৮০ )
“যদি এশা ও ফজরের সালাতের ফজিলত সম্পর্কে জানতে পারতো তাহলে তারা হাতে পায়ে ভর করে হলেও সালাতে অংশ গ্রহণ করতো।” (বোখারি:৫৮০)
এবং রাসূল সা: বলেন:—
من صلى الصبح فى جماعة فهو في ذمة الله فمن أخفر ذمة الله كبه الله فى النار لوجهه . )رواه الطبراني )
যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করে, সে আল্লাহর জিম্মায়-দায়িত্বেই থাকে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মা-দায়িত্ব বিনষ্ট করে আল্ল¬াহ তাকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (তিবরানী )
আল্লাহর জিম্মা বিনষ্টের মাঝে দুটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত—
এক—জামাতে ফজরের সালাত আদায়ে অলসতা করা। ফলে আল্লাহর মাঝে যে চুক্তি তা ভঙ্গ হয়ে যায়।
দুই—যে সব ব্যক্তি জামাতে সালাত আদায়ের ফলে আল্লাহর জিম্মার অন্তর্ভুক্ত হল, তাদের কোন ধরনের কষ্ট দেয়া।
এ ছাড়াও ফজর এবং এশার সালাত জামাতে আদায় সম্পর্কে যে সকল হাদিস বর্ণিত আছে তন্মধ্যে একটি হাদিসে বলা হয়, এশার সালাত জামাতে আদায় করা অর্ধেক রাত জাগ্রত থেকে এবাদত করার সমান, আর ফজরের সালাতও যদি জামাতে পড়া হয় তা হলে সারা রাত ক্বিয়ামুললাইল এর-সমতুল্য ছাওয়াব পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, ফজর ও আছরের সালাতে ফেরেশতাদের উভয় দল দুনিয়াতে একত্রিত হয়।
জামাতে সালাত আদায়ের লাভ ও উপকারিতা :
কোরআন ও হাদিস জামাতে সালাত পড়ার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করে এবং জামাতে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়, এছাড়া এও প্রমাণিত হয় যে, যারা জামাতে সালাত আদায় করবে না, তাদেরকে নি:সন্দেহে আজাবের সম্মুখীন হতেই হবে।
জামাতে সালাত আদায়ের বিশেষ কিছু লাভ ও উপকারিতা—
একÑজামাতে সালাত আদায়ের ফলে সালাতের পাবন্দী করা সহজ হয়। শয়তান মানুষকে সালাত আদায় হতে দুরে সরানোর হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় সহজ হয়। কারণ, শয়তানের ষড়যন্ত্র হল, সে প্রথমে মানুষকে জামাতে সালাত আদায় হতে বিরত রাখে। তারপর সে যে কোন সুন্নত ও নির্ধারিত সুন্নত গুলি আদায়ে বিঘœ ঘটায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে পার করায়, এমনকি অনেক সময় সালাতের ওয়াক্ত পার করে দেয়, ফলে সালাত আদায় করাই হয় না তারপর দেখা যায় সে একত্রে দুই ওয়াক্ত সালাত আদায় করে। এভাবে চলতে চলতে দেখা যাবে, এক সময় এরকম আসবে তখন সে একেবারেই সালাত আদায় করবে না। রাসূল সা: শয়তানের ষড়যন্ত্র ও তা হতে মুক্তির পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন :—
إن الشيطان ذئب الإنسان كذئب الغنم يأخذ من الشاة القاصية والناحية فإياكم والشعاب وعليكم بالجماعة والعامة والمسجد. ( رواه احمد:২১০২০)
নিশ্চয় ছাগলের জন্য যেমন বাঘ রয়েছে, তেমনিভাবে মানুষের জন্যও বাঘ রয়েছে। আর মানুষের বাঘ হল শয়তান। বাঘ বকরির পাল হতে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্নটিকেই আক্রমণ করে। সাবধান ! তোমরা বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বিরত থাক। তোমরা জামাতবদ্ব থাক, মুসলমানদের দলভুক্ত হও এবং মসজিদ মুখী হও। (আহমদ:২১০২০)
দুই-জামাত কল্যাণ, খোদাভীতি, নেক কাজের প্রতি আগ্রহ এবং কল্যাণকর আমলের দিকে ছুটে যাওয়ার একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র। এছাড়াও উত্তম আদর্শ অনুসরণের একটি অভিনব মিলন মেলা। কারণ, মসজিদে জ্ঞানীরাও আসে এবং মূর্খরাও আসে : শিক্ষক ও আসে আবার শিক্ষার্থীরাও আসে। সালাতের পর যে সব ওয়াজ নসিহত এবং শরিয়তের বিধান আলোচনা করা হয়, চরিত্র সংশোধন ও নৈতিকতা সস্পর্কিত সব বিষয় ভিত্তিক আলোচনা করা হয় অথবা বিষয় ভিত্তিক ভাষণ দেয়া হয়, বা দরস দেয়া হয়—যাবতীয় সব কিছুতেই রয়েছে কল্যাণ ও শিক্ষা। এ কারণেই বলা হয় জামাতে সালাত একটি দ্বীনি কেন্দ্র ও মাদরাসা। এছাড়াও একজন ভাই তার অপর ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে উপদেশ দিতে পারে। এবং ইমাম সাহেব মোক্তাদির সহযোগিতা করে। মোক্তাদিরাও একে অপরের সহযোগী হিসাবে এমন সব কাজ আঞ্জাম দিতে পারেন যা একজন মানুষ একা একা করতে সক্ষম হয় না।
তিন-জামাত মুসলমানদের স্বকীয়তা এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষার কারণ। মুসলমানদের—বিশেষ করে, অমুসলিম সমাজে মুসলমানদের দুর্বল হয়ে থাকা, তাদের ব্যক্তিত্ব খর্ব করা এবং ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করা হতে হেফাজত করে। এর বাস্তব নমুনা আমরা বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে স্বচক্ষে দেখতে পাই।
জামাতে নামাজ আদায়ের কারণে একজন মুসলমান তার দ্বীনি ভাই ও প্রতিবেশীর সাথে পরিচিত হয়, তাদের খোঁজ খবর নেয়, এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানে যথাসম্ভব ভূমিকা রাখতে পারে, তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়। তাদের পরস্পরের মাঝে লেনদেন ও মত-বিনিময় হয়। ফলে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভীত মজবুত। তাদের মাঝে ঈমানী বন্ধন সুদৃঢ় হয়, আপোশে মিল মহব্বত বৃদ্ধি পায়। এতে নেক ও কল্যাণের কাজে সহযোগিতা হয় এবং আল্লাহর আনুগত্যে প্রত্যয়ী হতে সহযোগিতা করে। ফলে মুসলমানদের পারস্পরিক একটি মহা ঐক্য গড়ে উঠে, তারা সমাজে একটি শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে সক্ষম হয়, এতে করে তাদের শক্ররা তাদের ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে বাধ্য হয়। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে তারা হাজারো হিসাব নিকাশ কষে থাকে।
৪-মুসলমানরা যখন জামাতে সালাত আদায়ের পরিপূর্ণ আনুগত্য করে তা মূলতঃ অমুসলিম ভাইদের প্রতি ইসলামের দাওয়াতেরই নামান্তর। কারণ, জামাতে সালাত আদায়ের কারণে মুসলমানদের যে সব বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলী ফুটে উঠে তা একজন অমুসলিম ভাইয়ের হৃদয়ংগম করা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। জামাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আজানের সুউচ্চ আওয়াজ, মুসলমানদের দলে দলে মসজিদে গমন, নামাজে সুশৃংখলভাবে কাতার বন্দি হওয়া, এক ইমামের পিছনে সকল মানুষ একই ধরনের কার্যাদি একই নিয়মে অত্যন্ত বিনয় ও একাগ্রতার সাথে সম্পাদন—ইত্যাদি ইসলামের দাওয়াত বৈ আর কিছুই নয়।
আল্লাহ মোমিনদের নির্দেশ দেন তারা যেন সালাতে খুব সুন্দর অবস্থায় হাজির হয়। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মোমিনদের ওজু করার নির্দেশ দেন।
No comments:
Post a Comment