সিয়াম
ও রমজান : শিক্ষা-তাৎপর্য-মাসায়েল-২
সিয়াম
পালন যাদের উপর ফরজ
কার জন্য
সিয়াম পালন ফরজ ?
প্রত্যেক
প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, মুকীম, সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য সিয়াম পালন
ফরজ।
যে ব্যক্তি
এ সকল শর্তাবলির অধিকারী তাকে অবশ্যই রমজান মাসে সিয়াম পালন করতে হবে।
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন বলেন :—
‘সুতরাং
তোমাদের মাঝে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে।’
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
:—
إذا رأيتم الهلال فصوموا. مسلم:১০৮১
‘যখন
তোমরা রমজানের চাঁদ দেখবে তখন সিয়াম পালন করবে।’
দশ প্রকার
মানুষের মাঝে সিয়াম পালনের এ সকল শর্তাবলি অনুপস্থিত। তারা হল :
প্রথম
: কাফের বা অমুসলিম
কারণ
তারা ইবাদত করার যোগ্যতা রাখে না। ইবাদত করলেও তাদের মধ্যে ইসলাম অনুপস্থিত থাকার কারণে
তা সহীহ হবে না, কবুলও হবে না। যদি কোন কাফের রমজানে ইসলাম গ্রহণ করে, তবে পিছনের সিয়ামের
কাজা আদায় করতে হবে না। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :—
‘যারা
কুফরী করে তাদেরকে বল, ‘যদি তারা বিরত হয় তবে যা অতীতে হয়েছে আল্লাহতা ক্ষমা করবেন।’
তবে রমজানের
দিনে ইসলাম গ্রহণ করলে ঐ দিনের বাকি অংশটা পানাহার থেকে বিরত থাকবে।
দ্বিতীয়
: অপ্রাপ্ত বয়স্ক
অপ্রাপ্ত
বয়স্ক ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
:—
رفع القلم عن ثلاثة : عن النائم حتى يستيقظ، وعن الصغير حتى يكبر، وعن المجنون حتى يفيق. السنن الكبرى للنسائي:৫৬২৬
‘তিন
ব্যক্তি থেকে কলমকে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। নিদ্রা মগ্ন ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়।
কম বয়সী ব্যক্তি যতক্ষণ না সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়। পাগল ব্যক্তি যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়।’
যদিও
অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকাদের উপর সিয়াম পালন ফরজ নয় তবে অভিভাবকরা অভ্যস্ত করার জন্য
তাদের সিয়াম পালন করতে বলবেন। সাহাবায়ে কেরাম তাদের বাচ্চাদের সিয়াম পালনে অভ্যস্ত
করেছেন। তাই আমাদের জন্য মুস্তাহাব হল আমরাও আমাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের সিয়াম
পালনে উদ্বুদ্ধ করব, যদি সিয়াম পালন তাদের কোন ক্ষতি না করে।
অপ্রাপ্ত
বয়স্ক ছেলে মেয়ে কখন বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হয় ?
যদি কোন
অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক বা বালিকাদের মাঝে তিনটি আলামতের কোন একটি পরিলক্ষিত হয় তখন তাদের
প্রাপ্তবয়স্ক বলে ধরা হবে। আলামত তিনটি হল:
(১) স্বপ্নদোষ
অথবা অন্য কোন কারণে বীর্যপাত হলে।
(২) যৌনাঙ্গে
কেশ দেখা দিতে শুরু করলে।
(৩) বয়স
পনেরো বছর পূর্ণ হলে।
ছেলেদের
মাঝে যখন এ তিনটি আলামতের কোন একটি পরিলক্ষিত হবে তখন তাদের পূর্ণবয়স্ক বলে ধরা হবে।
অবশ্য মেয়েদের জন্য চতুর্থ একটি আলামত রয়েছে, তা হল মাসিক দেখা দেয়া। যদি দশ বছর বয়সী
কিশোরীদেরও মাসিক দেখা দেয় তাহলে তাদের পূর্ণবয়স্ক বলে ধরতে হবে। এবং শরীয়তের সকল আদেশ-নিষেধ
তার জন্য অবশ্য পালনীয় বলে গণ্য হবে। কোন কিশোর বা কিশোরী রমজান মাসের দিনের বেলা যদি
বয়স প্রাপ্ত হয়, তাহলে তাকে দিনের অবশিষ্ট অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। এ দিনের
সওম তার কাজা করতে হবে না। পিতা-মাতার কর্তব্য হল, এ বিষয়ে সতর্ক থাকা ও সন্তানকে সচেতন
করা। সাথে সাথে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার উপর যে সকল ধর্মীয় দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা
পালনে দিক-নির্দেশনা দেয়া। পাক-পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম-নীতিগুলো সে জানে কি না বা মনে
রাখতে পেরেছে কিনা তার প্রতি খেয়াল রাখা।
তৃতীয়
: পাগল
পাগল
বলতে বুঝায় যার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যার কারণে ভাল-মন্দের মাঝে পার্থক্য করতে
পারে না। এর জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়। যেমন পূর্বের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। পাগল যখনই
সুস্থ হয়ে যাবে তখনই সে সিয়াম পালন শুরু করে দেবে। যদি এমন হয় যে দিনের কিছু অংশ সে
সুস্থ থাকে কিছু অংশ অসুস্থ তাহলে সুস্থ হওয়া মাত্রই সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। সিয়াম
পূর্ণ করবে। পাগলামি শুরু হলেই তার সিয়াম ভঙ্গ হবে না, যদি না সে সিয়াম ভঙ্গের কোন
কাজ করে।
চতুর্থ
: অশীতিপর বৃদ্ধ যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না : এমন ব্যক্তি, যার বয়সের কারণে
ভাল-মন্দ পার্থক্য করার অনুভূতি চলে গেছে সে শিশুর মতই। শিশু যেমন শরীয়তের নির্দেশমুক্ত
তেমনি সেও। তবে অনুভূতি ফিরে আসলে সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। যদি তার অবস্থা এমন
হয় যে কখনো অনুভূতি আসে আবার কখনো চলে যায়, তাহলে অনুভূতি থাকাকালীন সময়ে তার উপর সালাত,
সিয়াম ফরজ হবে।
পঞ্চম
: যে ব্যক্তি সিয়াম পালনের সামর্থ্য রাখে না : এমন সামর্থ্যহীন অক্ষম ব্যক্তি যার সিয়াম
পালনের সামর্থ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। যেমন অত্যধিক বৃদ্ধ অথবা এমন রোগী যার রোগ
মুক্তির সম্ভাবনা নেই—আল্লাহর কাছে আমরা এ ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই- এ ধরনের
লোকদের সিয়াম পালন জরুরি নয়। কারণ সে এ কাজের সামর্থ্য রাখে না।
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন বলেন :—
لاَ يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا . (البقرة : ২৮৬)
‘আল্লাহ
কারো উপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।’
কিন্তু
এমন ব্যক্তির উপর সিয়ামের ফিদিয়া প্রদান করা ওয়াজিব। সিয়ামের ফিদিয়া হল, প্রতিটি দিনের
পরিবর্তে একজন মিসকিন (অভাবী) লোককে খাদ্য প্রদান করবে।
কীভাবে
মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করবে ?
মিসকিনদের
দু ভাবে খাদ্য প্রদান করা যায় :
(১) খাদ্য
তৈরি করে সিয়ামের সংখ্যা অনুযায়ী সমসংখ্যক মিসকিনকে আপ্যায়ন করাবে। (২) মিসকিনদের প্রত্যেককে
এক মুদ পরিমাণ ভাল আটা দেবে। এক মুদ হল ৫১০ গ্রাম। (তবে হানাফি ফিকাহ অনুযায়ী দুই মুদ
বা এক কেজি বিশ গ্রাম আটা বা সমপরিমাণ টাকা দেয়া যেতে পারে।)
ষষ্ঠ
: মুসাফির
মুসাফিরের
জন্য সিয়াম পালন না করা জায়েয আছে। তবে সফরকে যেন সিয়াম পালন না করার কৌশল হিসেবে ব্যবহার
না করা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :—
ﮫ ﮬ ﮭ ﮮ ﮯ ﮰ ﮱ ﯓ ﯔ ﯕﯖ ﯗ ﯘ ﯙ ﯚ ﯛ ﯜ ﯝ ﯞ ﯨ ﭼ
البقرة: ١٨٥
‘যে কেউ
অসুস্থ থাকে বা সফরে থাকে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ
তা চান, যা কষ্টকর তা চান না।’
সুতরাং
যে ব্যক্তি সফরে থাকে, তার জন্য সিয়াম ভঙ্গের অনুমতি আছে এবং সফর শেষে সে সিয়াম আদায়
করবে। এমনিভাবে সে যদি সফরাবস্থায় সিয়াম পালন করে তবে তা আদায় হবে। তবে উত্তম কোনটি,
সফরকালীন সময়ে সিয়াম পালন করা, না সিয়াম ত্যাগ করা ? যেটা সহজ মুসাফির সেটাই করবেন।
যদি তিনি দেখেন সফরকালীন সময়ে তার সিয়াম পালন বাড়িতে থাকাকালীন সময়ের মতই মনে হয়, তাহলে
সফরে তার সিয়াম পালন করা উত্তম। আর যদি দেখেন সফরে সিয়াম পালন করলে অতিরিক্ত কষ্ট হয়
তবে সিয়াম ত্যাগ করা তার জন্য উত্তম। বরং বেশি কষ্ট হলে সিয়াম পালন মাকরূহ হবে। যেমন
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাথে একদল সাহাবী সফরে থাকাকালীন
সময়ে সিয়াম পালন করে খুব কষ্ট সহ্য করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তাদের লক্ষ্য করে বললেন :—
أولئك
العصاة، أولئك العصاة. مسلم:২৬৬৬
‘তারাইতো
অবাধ্য ! তারাইতো অবাধ্য !!’
সফরে
কেউ সিয়াম পালন শুরু করল পরে দেখা গেল সিয়াম অব্যাহত রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে, তখন সে
সিয়াম ভঙ্গ করে ফেলবে। এখন কথা হল এক ব্যক্তি সারা জীবনই সফরে থাকে এবং সফরাবস্থায়
সিয়াম পালন তার জন্য কষ্টকর সে কীভাবে সিয়াম পালন করবে? সে শীতকালে ছোট দিনগুলোতে সিয়াম
পালন করতে পারে।
সপ্তম
: যে রোগী সুস্থ হওয়ার আশা রাখে
যে রোগাক্রান্ত
ব্যক্তির সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তার অবস্থা তিনটির যে কোন একটি হয়ে থাকে :
প্রথম:
এমন রোগী যার পক্ষে সিয়াম পালন কষ্টসাধ্য নয় এবং সিয়াম তার কোন ক্ষতি করে না। এমন ব্যক্তির
সিয়াম পালন অপরিহার্য।
দ্বিতীয়:
এমন রোগী, সিয়াম পালন যার জন্য কষ্টকর। এমন ব্যক্তির সিয়াম পালন বিধেয় নয়-মাকরূহ। সিয়াম
পালন করলে আদায় হয়ে যাবে তবে মাকরূহ হবে। ইসলামী শরীয়তের উদ্দেশ্য মানুষকে কষ্ট দেয়া
নয় বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল মানুষের সমস্যাকে হালকা করা।
তৃতীয়:
এমন রোগী যে সিয়াম পালন করলে রোগ বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় তার সিয়াম ত্যাগ করাই হল ওয়াজিব
বা অপরিহার্য।
অষ্টম
: ঋতুস্রাবগ্রস্ত নারী
ঋতুকালীন
সময়ে নারীর জন্য সওম পালন জায়েয নয় বরং নিষেধ। যদি সওম পালন করা অবস্থায় মাসিক দেখা
দেয় তাহলে তার সওম ভেঙে যাবে। যদি সূর্যাস্তের এক মুহূর্ত পূর্বেও দেখা যায় তবুও তাকে
সওমের কাজা আদায় করতে হবে। মাসিক অবস্থায় রমজানের দিনের বেলা কোন মহিলার মাসিক বন্ধ
হয়ে গেল তাহলে তাকে ঐ দিনের বাকি সময়টা খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, পরে এটারও
কাজা করতে হবে। যদি সুবহে সাদিকের এক মুহূর্ত পূর্বে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ঐ দিনের
সওম পালন অপরিহার্য। এমন ভাবা ঠিক নয় যে, গোসল করা হয়নি তাই সওম পালন থেকে বিরত থাকতে
হবে। বরং তার কর্তব্য হল, রোজার নিয়ত করে নিবে। গোসল পরে করলে সমস্যা নেই। সিয়াম আদায়ের
ক্ষেত্রে সদ্য প্রসূতি নারীর বিধান ঋতুবতী নারীর অনুরূপ। ঋতুবতী ও সদ্য প্রসূতি নারীরা
সুস্থ হয়ে সিয়ামের কাজা আদায় করবে। তবে তাদের সালাতের কাজা আদায় করতে হবে না। আয়েশা
রা.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ঋতুবতী নারী সালাতের কাজা আদায় করবে না, কিন্তু তাদের
সিয়ামের কাজা আদায় করতে হবে কেন ? তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমাদের এ অবস্থায় শুধু সিয়ামের
কাজা আদায় করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, সালাতের কাজা আদায়ের নির্দেশ দেননি।’
এটা আল্লাহ
রাব্বুল আলামীনের এক বিরাট অনুগ্রহ যে তিনি মহিলাদের হায়েজ ও নিফাস চলাকালীন সময়ের
সালাত মাফ করে দিয়েছেন।
নবম
: গর্ভবতী ও দুগ্ধ দান কারী নারী
যদি গর্ভবতী
বা দুগ্ধ দান কারী নারী সিয়ামের কারণে তার নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে
সে সিয়াম ভঙ্গ করতে পারবে। পরে নিরাপদ সময়ে সে সিয়ামের কাজা আদায় করে নিবে। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
:—
إن
الله تبارك وتعالى وضع عن المسافر شطر الصلاة وعن الحامل والمرضع الصوم أو الصيام
. مسند أحمد:১৯৫৬৩
‘আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন মুসাফিরের অর্ধেক সালাত কমিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধ দান করী
নারীর সিয়াম না রেখে পরে আদায় করার অবকাশ দিয়েছেন।’
দশম
: যে অন্যকে বাঁচাতে যেয়ে সিয়াম ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয় : যেমন কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি
; পানিতে পড়ে যাওয়া মানুষকে অথবা আগুনে নিপতিত ব্যক্তিকে কিংবা বাড়িঘর ধসে তার মাঝে
আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে যেয়ে সিয়াম ভঙ্গ করল। এতে অসুবিধা নেই। যদি এমন হয় যে,
সিয়াম ভঙ্গ করা ব্যতীত এ সকল মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে সিয়াম ভঙ্গ
করে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে। কেননা জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি
হয়েছে এমন বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করা ফরজ। এমনিভাবে যে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্র“দের
বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে জিহাদে নিয়োজিত, সে সিয়াম ভঙ্গ করে শক্তি অর্জন করতে পারবে। এ
দশ প্রকার মানুষ যাদের জন্য সিয়াম ভঙ্গ করার অনুমতি দেয়া হল, তারা যেন প্রকাশ্যে পানাহার
না করে সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত। কারণ এতে অনেক অজানা লোকজন খারাপ ধারণা পোষণ করবে
যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সিয়ামের
কাজা আদায়ের বিধান :
উপরে
বর্ণিত যে সকল কারণে রমজানের সিয়াম ত্যাগ করা হয়, রমজানের পর তা আদায় করাকে ‘কাজা’
বলে। যেমন আল্লাহতা আলা বলেছেন :—
ﭼ ﭽ ﭾ ﭿﮀ ﮗ
البقرة: ١٨٤
‘অন্য
সময় এ সংখ্যা পূর্ণ করবে।’
বিলম্ব
না করে কাজা সিয়ামগুলো আদায় করা উত্তম। এমনিভাবে সকল মানুষের উচিত ভালো কাজে কোন বিলম্ব
না করা। ভালো কাজ তাড়াতাড়ি করা প্রমাণ করে যে, কাজের প্রতি তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা
রয়েছে। অপরদিকে দেরি করা হলে তার অলসতা ও ঈমানের দুর্বলতার পরিচয় বহন করে। পরবর্তী
রমজান আসার পূর্বে অবশ্যই কাজা সিয়ামগুলো আদায় করে নিতে হবে।
সিয়াম
ভঙ্গকারী বিষয়াবলী ও করণীয়
যা কিছু
সিয়াম ভঙ্গ করে তা থেকে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকার নাম হল সওম, বহু
বচনে সিয়াম। সিয়ামভঙ্গকারী সকল প্রকার বিষয় থেকে বিরত না থাকলে সিয়াম আদায় হবে না।
যে সকল কাজ সিয়াম ভঙ্গ করে তা সাধারণত সাত প্রকার।
প্রথম
: সহবাস
সিয়াম
অবস্থায় সহবাস করলে সিয়াম বাতিল হয়ে যায়। সিয়াম ফরজ হোক কিংবা নফল। সহবাসের মাধ্যমে
সিয়াম বাতিল করা হলে তার কাজা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করা জরুরি।
কীভাবে
সিয়ামের কাফফারা আদায় করা যায় ?
(১) মুসলিম
দাস বা দাসী মুক্ত করে দেয়া। বর্তমানে যেহেতু দাস প্রথা নেই। ইসলাম ধাপে ধাপে দাস প্রথাকে
উচ্ছেদ করেছে, তাই দাস-দাসী মুক্ত করে কাফফারা আদায় করার সুযোগ নেই।
(২) এক
একটি রোজার পরিবর্তে দু মাস বিরতিহীন সিয়াম পালন করা। এ বিরতিহীন সিয়াম পালন করতে গিয়ে
সংগত কারণ ব্যতীত যদি বিরতি দেয়া হয়, তবে আবার নতুন করে দু মাস সিয়াম পালন করতে হবে।
(৩) যদি
বিরতিহীন ভাবে দু মাস সিয়াম পালনের সামর্থ্য না রাখে তবে এক একটি রোজার পরিবর্তে ষাট
জন অভাবী মানুষকে খাদ্য দান করতে হবে। প্রত্যেকের খাদ্য হবে এক ফিতরার সম পরিমাণ।
দ্বিতীয়
: ইচ্ছাকরে বীর্যপাত করা
যেমন
কাউকে চুমো দেয়ার মাধ্যমে বা স্পর্শ করার কারণে কিংবা হস্ত মৈথুন ইত্যাদি কারণে বীর্যপাত
ঘটানো হলে সিয়াম বাতিল হয়ে যায়। তবে এ সকল কারণে কামভাব থাকা সত্ত্বেও যদি বীর্যপাত
না হয় তবে সিয়াম বাতিল হবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওম অবস্থায় স্ত্রীকে চুমো দিতেন ও স্পর্শ করতেন।
তবে তিনি নিজেকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ ছিলেন। যদি চুমো ও স্পর্শ দ্বারা বীর্যপাত
হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে এ সকল কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইসলামী শরীয়তের একটা
মূলনীতি হল, যা কিছু অন্যায় বা হারাম কাজের দিকে নিয়ে যায় বা তার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে
তা থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব। এ কারণে সিয়াম পালনকারীর জন্য কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার
সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সে কুলি করার সময় গড়গড়া করবে না। স্বপ্নদোষের কারণে
বীর্যপাত হলে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। কারণ এটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে গেছে। যা কিছু অনিচ্ছাকৃতভাবে
হয়ে যায় আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেন। এমনিভাবে নিদ্রামগ্ন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা
হয়। কাজেই নিদ্রাকালে যা কিছু ঘটে তার জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। এটা আমাদের প্রতি
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একটি রহমত। কেউ কোন বিষয় কল্পনা করার ফলে যদি বীর্যপাত হয়ে
যায়, এতে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
إن
الله تجاوز عن أمتي ما حدثت به أنفسها ما لم تعمل أو تتكلم. البخاري:৪৯৬৮
‘অবশ্যই
আল্লাহ তাআলা আমার উম্মত যা কল্পনা করে তা ক্ষমা করে দেন। যদি না সে কাজ বা কথার দ্বারা
তা বাস্তবায়ন করে।’
তৃতীয়
: পানাহার করা : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :—
ﭳ ﭴ ﭵ ﭶ ﭷ ﭸ ﭹ ﭺ ﭻ ﭼ ﭽ ﭾﭿ ﮀ ﮁ ﮂ ﮃ ﮄﮅ ﮚ البقرة: ١٨٧
‘আর তোমরা
পানাহার কর, যতক্ষণ রাতের কালো রেখা হতে উষার শুভ্র রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত
না হয়। অতঃপর রাতের আগমন পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর।’
নাক দিয়ে
ঔষধ সেবন করা পানাহার করার মতই সিয়াম বাতিল করে দেয়। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
وبالغ
في الاستنشاق إلا أن تكون صائما (أبو داود:১২৩)
‘তোমরা
ওজুর সময় নাকে পানি দিতে একটু অতিরিক্ত করবে, তবে সিয়াম অবস্থায় নয়।’
এ হাদীস
দ্বারা প্রমাণিত হল সিয়াম অবস্থায় নাকের ভিতরে এমনভাবে পানি দিতে নিষেধ করা হয়েছে,
যাতে পানি ভিতরে চলে যায়। অতএব নাক দিয়ে কিছু ভিতরে প্রবেশ করালে সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়।
চতুর্থ
: যা কিছু পানাহারের বিকল্প, তা সিয়াম ভঙ্গ করে এটা দুইভাবে হতে পারে:
(১) সিয়াম
পালনকারী শরীরে রক্ত গ্রহণ করলে সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পানাহার দ্বারা রক্ত তৈরি
হয়। তাই রক্ত গ্রহণ পানাহারের একটি বিকল্প।
(২) খাবারের
বিকল্প হিসেবে স্যালাইন বা ইনজেকশন গ্রহণ করা। তবে যে সকল ইনজেকশন ও স্যালাইন খাবারের
বিকল্প নয়, তা গ্রহণ করতে বাধা নেই।
পঞ্চম:
হাজামা বা শিঙা লাগানো। যে শিঙা লাগায় ও যাকে শিঙা লাগানো হয় উভয়ের সিয়াম নষ্ট হয়ে
যায়। যেমন হাদীসে এসেছে—
أفطر
الحاجم والمحجوم أب৬৯و داود:২০২৩
‘শিঙা
যে লাগাল ও যাকে লাগা৬ে৯না হলো উভয়ে সিয়াম ভঙ্গ করল।’
শিঙা
লাগালে শরীরে এর প্রভাব পড়ে। এটা রক্ত দানের মতই। তাই সিয়াম পালনকারীর জন্য শিঙা ব্যবহার
জায়েয নয়। তবে প্রয়োজন হলে সিয়াম ভঙ্গ করে শিঙা ব্যবহার করবে, পরে সিয়াম কাজা করবে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়লে কিংবা দাঁত ওঠালে অথবা আহত হয়ে রক্ত প্রবাহিত হলে সিয়ামের কোন ক্ষতি
হয় না।
ষষ্ঠ
: ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা। যদি কেউ ইচ্ছা করে বমি করে তবে তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন :—
من
ذرعه القيئ فليس عليه شيء ومن استقاء عمدا فليقض. الترمذي:৬৫৩
‘অনিচ্ছাকৃতভাবে
যার বমি হল তার কিছু করণীয় নেই। আর যে নিজের ইচ্ছায় বমি করল সে সিয়াম কাজা করবে।’
তবে বমি
আসলে তা আটকে রাখার চেষ্টা করবে না।
সপ্তম
: মহিলাদের মাসিক ও প্রসূতিবস্থা আরম্ভ হলে।
যদি সিয়াম
অবস্থায় মাসিকের রক্ত দেখা দেয় তাহলে সিয়াম ভেঙে যাবে। এমনিভাবে প্রসবজনিত রক্ত প্রবাহিত
হতে থাকলে সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়।
যে সকল
বিষয় সিয়াম ভঙ্গ করে না
সুরমা
ব্যবহার, চোখে বা কানে ঔষধ ব্যবহার করলে সিয়াম নষ্ট হয় না, যদিও তার স্বাদ অনুভূত হয়।
কোন কিছুর স্বাদ অনুভূত হলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না। সিয়াম ভঙ্গ হওয়ার সম্পর্ক হল পানাহারের
সাথে। কোন কিছুর স্বাদ পরীক্ষা করার কারণে সিয়াম ভঙ্গ হয় না, যদি না তা গিলে ফেলে।
কোন কিছুর ঘ্রাণ নিলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না। তবে ধুম জাতীয় ঘ্রাণ সিয়াম অবস্থায় গ্রহণ করবে
না। যেমন আগরবাতি বা চন্দন কাঠের ধুয়া কিংবা ধুপ গ্রহণ করবে না। কুলি করলে বা নাকে
পানি দিলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না, তবে গড়গড়া করবে না বা নাকের খুব ভিতরে পানি দেবে না, বা
নাকে পানি দিয়ে উপরে টান দেবে না। মিসওয়াক বা ব্রাশ করলে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না।
সিয়াম অবস্থায় দিনের যে কোন সময় মেস ওয়াক কিংবা ব্রাশ করতে দোষ নেই। এমনিভাবে দাঁতের
মাজন বা টুথপেস্ট ব্যবহার করলে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না তবে তা যেন গলার ভিতরে প্রবেশ
না করে তার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। ‘সিয়াম অবস্থায় দুপুরের পর মেস ওয়াক করা উচিত নয়’
বলে যে কথা প্রচলিত আছে তার কোন ভিত্তি নেই। গরম থেকে বাঁচতে পানি গায়ে দেয়া বা ভিজা
কাপড় গায়ে জড়াতে কোন দোষ নেই। এতে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না।
রমজানের
শেষ দশকের ফযীলত ও তাৎপর্য
রমজান
মাসের শেষ দশকের বিশেষ ফযীলত রয়েছে এবং আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য। এগুলো হল :
(১) এ
দশ দিনের মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত। যা হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ। যে
এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া
হবে।
(২) নবী
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে
ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন সহীহ মুসলিমে
আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, তিনি এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, সালাত ও দোয়ার
মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন এরপর সাহরী গ্রহণ করতেন।
(৩) রমজানের
শেষ দশক আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরনের লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন। রাত্রি জাগরণ
করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। যেমন বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসে
এসেছে। তিনি এ দশদিনের রাতে মোটেই নিদ্রা যেতেন না। পরিবারের সকলকে তিনি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী
করার জন্য জাগিয়ে দিতেন। ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন’ কথাটির অর্থ হল তিনি এ দিনগুলোতে
স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন।
(৪) এ
দশদিনের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ শেষ দশদিনে মসজিদে এতেকাফ করতেন। প্রয়োজন ব্যতীত
তিনি মসজিদ থেকে বের হতেন না।
লাইলাতুল
কদরের গুরুত্ব
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তার কালামে
এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে যেয়ে এরশাদ করেন
:—
ﭽﭖ ﭗ ﭘ ﭙ
ﭚﭛ ﭜ ﭝ
ﭞ ﭟ ﭠ ﭡ ﭢ ﭣ ﭤ ﭥ ﭼ الدخان: ٣ - ٤
‘আমি
তো ইহা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ
বিষয় স্থিরকৃত হয়।’
বরকতময়
রজনী হল লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা একে বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে
যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কুরআন নাযিল হয়েছে।
এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ
করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে
একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে।
ﭽﭑ ﭒ ﭓ ﭔ ﭕ ﭖ ﭗ ﭘ ﭙ ﭚ ﭛ ﭜ
ﭝ ﭞ ﭟ
ﭠ ﭡ ﭢ ﭣ ﭤ ﭥ ﭦ ﭧ ﭨ ﭩ ﭪ ﭫ ﭬ ﭭ ﭮ ﭯ ﭰ ﭱ ﭲ ﭳ
ﭼ القدر: ١ - ٥
‘নিশ্চয়
আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এক মহিমান্বিত রজনীতে। আর মহিমান্বিত রজনী সম্পর্কে তুমি কী
জান? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতেই ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ
হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রজনী উষার আবির্ভাব
পর্যন্ত।’
এ সূরাতে
যে সকল বিষয় জানা গেল তা হল:—
(১) এ
রাত এমন এক রজনী যাতে মানবজাতির হিদায়াতের আলোকবর্তিকা মহা গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ
হয়েছে।
(২) এ
রজনী হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিরাশি বছরের চেয়েও এর মূল্য বেশি।
(৩) এ
রাতে ফেরেশতাগণ রহমত, বরকত ও কল্যাণ নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে থাকে।
(৪) এ
রজনী শান্তির রজনী। আল্লাহর বান্দারা এ রাতে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে শান্তি
অর্জন করে থাকে।
(৫) সময়ের
প্রতি গুরুত্ব দেয়া। এ আয়াতগুলোতে অল্প সময়ে বেশি কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হল।
যত সময় তত বেশি কাজ করতে হবে। সময় নষ্ট করা চলবে না।
(৬) গুনাহ
ও পাপ থেকে ক্ষমা লাভ। এ রাতের এই ফযীলত সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীসে এসেছে—
إن
النبي صلى الله عليه وسلم قال : من قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم
من ذنبه. البخاري:১২৬৬ ومسلم:৩৪
নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
‘যে লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সালাত আদায় ও ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের
পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’
লাইলাতুল
কদর কখন ?
আল-কোরআনে
নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমজান
মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রমজানের শেষ
দশকে হবে বলে সহীহ হাদীসে এসেছে। এবং তা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা
বেশি বলে হাদীসে এসেছে।
تحروا
ليلة القدر في العشر الأواخر من رمضان. البخاري:১৮৭৪
‘তোমরা
রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।’
এবং রমজানের
শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদীসে এসেছে
...
فمن كان متحريا بها فليتحرها في السبع الأواخر. البخاري:১৮৭৪, مسلم:১৯৮
‘যে লাইলাতুল
কদর অন্বেষণ করতে চায় সে যেন শেষ সাত দিনে অন্বেষণ করে।’
অধিকতর
সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হল রমজান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয়
হল উনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন
এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযীলত লাভের জন্য
কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
লাইলাতুল
কদরে আমাদের করণীয় হল বেশি করে দোয়া করা। আয়েশা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলেন, লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি বললেন, বলবে—
اَللّهُم
إِنَّكَ عَفُوٌّ تٌحِبُّ العَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ . ابن ماجه:৩৯৮২
‘হে আল্লাহ!
আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।’
এতেকাফ
: তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও বিধানাবলী
এতেকাফের
সংজ্ঞা
বিশেষ
নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ
বলে।
এতেকাফের
ফযীলত
এতেকাফ
একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি বছরই এতেকাফ পালন করেছেন। দাওয়াত, তরবিয়ত,
শিক্ষা এবং জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে তিনি এতেকাফ ছাড়েননি। এতেকাফ ঈমানী
তরবিয়তের একটি পাঠশালা, এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিদায়াতি আলোর একটি প্রতীক। এতেকাফরত অবস্থায়
বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়।
ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। এতেকাফ ঈমান বৃদ্ধির
একটি মূখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ঈমানী চেতনাকে প্রাণিত করে
তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌছেঁ দেয়ার চেষ্টা করা।
আল-কুরআনুল
কারিমে বিভিন্নভাবে এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে, ইবরাহীম আ. ও ইসমাইল আ. এর কথা উল্লেখ
করে এরশাদ হয়েছে :
‘এবং
আমি ইবরাহীম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের
জন্য পবিত্র করো।’
এতেকাফ
অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
‘আর তোমরা
মসজিদে এতেকাফ কালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না।’
ইবরাহীম
আ. তাঁর পিতা এবং জাতিকে লক্ষ্য করে মূর্তির ভর্ৎসনা করতে যেয়ে যা বলেছিলেন, আল্লাহ
তা‘আলা তা উল্লেখ করে বলেন:
‘যখন
তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: ‘এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (এতেকাফকারী)
হয়ে তোমরা বসে আছ’?
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অসংখ্য
হাদীস এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্য হতে ফযীলত সম্পর্কিত কিছু হাদীস নিুে
উল্লেখ করা হল:
عن
عائشة رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر
حتى توفاه الله، ثم أزواجه من بعده. البخاري:১৮৮৬ و مسلم :২০০৬
আয়েশা
রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষের দশকে এতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত।
এরপর তাঁর স্ত্রী গণ এতেকাফ করেছেন।’
عن
عائشة رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان .
البخاري: ২০৪১
আয়েশা
রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমজানে এতেকাফ করতেন।’
অন্য
এক হাদীসে এসেছে—
إني
اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي
إنها في العشر الأواخر فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف، فاعتكف الناس معه، قال:
وإني أُريتها ليلة وتر وأني أسجد صبيحتها في طين وماء، فأصبح من ليلة إحدى وعشرين
وقد قام إلى الصبح، فمطرت السماء فوكف المسجد، فأبصرت الطين والماء، فخرج حين فرغ
من صلاة الصبح وجبينه وروثة أنفه فيهما الطين والماء، وإذا هي ليلة إحدى وعشرين.
مسلم:১৯৯৪
আমি
(প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে এতেকাফ পালন করি। অত:পর এতেকাফ পালন করি মাঝের
দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের
মাঝে যে (এ দশে) এতেকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে এতেকাফ
পালন করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেন, আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে
কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি
কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ ছেপে বৃষ্টি
নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত
শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের
রাত।
আবু হুরাইরা
রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان
النبي صلي الله عليه و سلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام، فلما كان العام الذي قبض
فيه اعتكف عشرين يوماً. البخاري: ১৯০৩
‘রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে
দশ দিন এতেকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফে কাটান।’
আবু হুরাইরা
রা. হতে বর্ণিত হাদীসে উভয়টির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন —
عن
أبي هريرة رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان عشرة
أيام فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوما. البخاري: ১৯০৩
আবু হুরাইরা
রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। তবে যে বছর
পরলোকগত হন তিনি বিশ দিন এতেকাফ করেছেন।’
عن
عائشة رضي الله عنها أن النبي صلى الله عليه وسلم اعتكف معه بعض نسائه وهي مستحاضة
ترى الدم فربما وضعت الطست تحتها من الدم) البخاري:২৯৮
আয়শা
রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তাঁর জনৈকা স্ত্রীও এতেকাফ করলেন। তখন তিনি
ছিলেন এস্তেহাজা অবস্থায়, রক্ত দেখছেন। রক্তের কারণে হয়তো তাঁর নীচে গামলা রাখা হচ্ছে। রাসূল বলেন—
إني
اعتكفت العشر الأُوَل ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل
لي: إنها في العشر الأواخر؛ فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف؛ فاعتكف الناس معه.
مسلم:১৯৯৪
‘আমি
কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিন।
অত:পর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হল যে তা শেষ দশদিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ
পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে।’ ফলে, মানুষ তার সাথে এতেকাফ যাপন করল।
এতেকাফের
উপকারিতা
১- এতেকাফকারী
এক নামাযের পর আর এক নামাযের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফযীলত রয়েছে।
আবু হুরাইরা
রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إن
الملائكة تصلي على أحدكم ما دام في مصلاه ما لم يحدث: اللهم اغفر له، اللهم ارحمه
لا يزال أحدكم في مصلاه ما دامت الصلاة تحبسه، لا يمنعه أن ينقلب إلي أهله إلا
الصلاة. مسلم:৬১১
‘নিশ্চয়
ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাযের স্থানে
অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন,
যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাযের স্থানে থাকবে, ও নামায তাকে আটকিয়ে রাখবে, তার পরিবারের
নিকট যেতে নামায ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।’
২- এতেকাফকারী
কদরের রাতের তালাশে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের
কারণে আল্লাহ তা‘আলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাস জুড়ে তাকে তালাশ
করতে থাকে।
৩- এতেকাফের
ফলে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য মস্তক অবনত করার
প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
অর্থাৎ:
আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।
আর এ
ইবাদতের বিবিধ প্রতিফলন ঘটে এতেকাফ অবস্থায়। কেননা এতেকাফ অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে
পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যাকুল
হয়ে পড়ে।
আল্লাহ
তা‘আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে
দিয়ে বলেছেন:
অর্থাৎ:
বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ
হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
আর আমার
বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে- বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। প্রার্থনাকারীর
প্রার্থনা কবুল করি যখন সে প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মান্য করে এবং
আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সম্ভবত তারা পথ প্রাপ্ত হবে।
৪- যখন
কেউ মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ করতে লাগে— যা সম্ভব প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত করানোর মাধ্যমে,
কেননা প্রবৃত্তিকে যে বিষয়ে অভ্যস্ত করানো হবে সে বিষয়েই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে— মসজিদে
অবস্থান করা পছন্দ হতে শুরু করলে মসজিদকে সে ভালোবাসবে, সেখানে নামায আদায়কে ভালোবাসবে।
আর এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। হৃদয়ে সৃষ্টি হবে নামাযের ভালোবাসা,
এবং নামায আদায়ের মাধ্যমেই অনুভব করতে শুরু করবে হৃদয়ের প্রশান্তি। যে প্রশান্তির কথা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এভাবে বলেছিলেন:
(أرحنا
بها يا بلال، أرحنا بها يا بلال) المعجم الكبير للطبراني:৬০৯০
‘নামাযের
মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল! নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল!’
৫- মসজিদে
এতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানের
অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয় দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায়
নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি
ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়।
মসজিদে
এতেকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, ফলে এতেকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার
নাগপাশ কাটিয়ে ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে
ওঠার প্রয়াস পায়। কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে
না। আর মানুষের প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত
হয়ে যায়।
৬- এতেকাফের
মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।
৭- বেশি
বেশি কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৮- ঐকান্তিকভাবে
তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।
৯- তাহাজ্জুদে
অভ্যস্ত হওয়া যায়।
১০-সময়কে
সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।
এতেকাফের
আহকাম
ইসলামী
শরিয়াতে এতেকাফের অবস্থান
এতেকাফ
করা সুন্নাত। এতেকাফের সবচেয়ে উপযোগী সময় রমজানের শেষ দশক, এতেকাফ কুরআন, হাদীস ও এজমা
দ্বারা প্রমাণিত।
ইমাম
আহমদ রহ. বলেন: কোন মুসলমান এতেকাফকে সুন্নাত বলে স্বীকার করেনি, এমনটি আমার জানা নেই।
এতেকাফের
উদ্দেশ্য
১- আল্লাহর
সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা
আল্লাহর
দিকে আকৃষ্ট হওয়া ও আল্লাহকেন্দ্রিক ব্যতিব্যস্ততা যখন অন্তর সংশোধিত ও ঈমানী দৃঢ়তা
অর্জনের পথ, কেয়ামতের দিন তার মুক্তিও বরং এ পথেই। তাহলে এতেকাফ হল এমন একটি ইবাদত,
যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি-জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে
আসে। বান্দার কাজ হল তাঁকে স্মরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা ও তাঁর ইবাদত করা। সর্বদা তার
সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ়
ও মজবুত হয়।
২-পাশবিক
প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকা
রোজার
মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অতিরিক্ত পানাহার ও যৌনাচারসহ
পশু প্রবৃত্তির বিবিধ প্রয়োগ থেকে, অনুরূপভাবে তিনি এতেকাফের বিধানের মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন
অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ, ও অধিক ঘুম হতে।
এতেকাফের
মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ অর্থে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। নামায, কুরআন তিলাওয়াত,
যিকির ও দোয়া ইত্যাদির নির্বাধ চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরান সুযোগের
আবহে সে নিজেকে পেয়ে যায়।
৩- শবে
কদর তালাশ করা
এতেকাফের
মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে
বর্ণিত হাদীস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إني
اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة ثم اعتكفت العشر الأوسط ثم أتيت فقيل لي إنها
في العشر الأواخر فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف فاعتكف الناس معه. مسلم : ১১৬৭
‘আমি
প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশে। অতঃপর এতেকাফ করেছি মাঝের
দশকে। অত:পর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম। তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের
মধ্যে যদি কেউ এতেকাফ করতে চায় সে যেন এতেকাফ করে।’ অত:পর লোকেরা তাঁর সাথে এতেকাফ
করল।
৪-মসজিদে
অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা
এতেকাফের
মাধ্যমে বান্দার অন্তর মসজিদের সাথে জুড়ে যায়, মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস
গড়ে উঠে। হাদীস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ছায়ার নীচে ছায়া
দান করবেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি মসজিদের সাথে যার হৃদয় ছিল বাঁধা :
(ورجل
قلبه معلق بالمساجد) البخاري:৬২০
‘ এবং
ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে বাঁধা।’
৫- দুনিয়া
ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকা
এতেকাফকারী
যেসব বিষয়ের সাথে জীবন যাপন করত, সেসব থেকে সরে এসে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে ফেলে।
এতেকাফ অবস্থায় দুনিয়া ও দুনিয়ার স্বাদ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ঠিক ঐ আরোহীর ন্যায় যে কোন গাছের ছায়ার
নীচে বসল, অতঃপর সেখান থেকে উঠে চলে গেল।
৬- ইচ্ছাশক্তি
প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে
তোলা
কেননা
এতেকাফ দ্বারা খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকার ট্রেন্ড গড়ে উঠে। এতেকাফ তার জন্য সুবর্ণ
সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় নিজেকে ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত করতে ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে শানিত
করতে। এতেকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ পায়। যা
পরকালে উপকারে আসবে না তা থেকে বিরত থাকার ফুরসত মেলে।
এতেকাফের
বিধানাবলী
১- এতেকাফের
সময়সীমা
সবচেয়ে
কম সময়ের এতেকাফ হল, শুদ্ধ মত অনুযায়ী, একদিন এক রাত। কেননা সাহাবায়ে কেরাম রাদি-আল্লাহু
আনহুম নামায অথবা উপদেশ শ্রবণ করার অপেক্ষায় বা জ্ঞান অর্জন ইত্যাদির জন্য মসজিদে বসতেন,
তবে তারা এ সবের জন্য এতেকাফের নিয়ত করেছেন বলে শোনা যায়নি।
সর্বোচ্চ
কতদিনের জন্য এতেকাফ করা যায় এ ব্যাপারে ওলামাদের মতামত হল, এ ব্যাপারে নির্ধারিত কোন
সীমা-রেখা নেই।
২- এতেকাফে
প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময়
এতেকাফকারী
যদি রমজানের শেষ দশকে এতেকাফের নিয়ত করে তা হলে একুশতম রাত্রির সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে
মসজিদে প্রবেশ করবে, কেননা তার উদ্দেশ্য কদরের রাত তালাশ করা, যা আশা করা হয়ে থাকে
বেজোড় রাত্রগুলোতে, যার মধ্যে একুশের রাতও রয়েছে। ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর সে এতেকাফ
থেকে বের হতে পারবে।
৩- এতেকাফের
শর্তাবলী
এতেকাফের
অনেকগুলো শর্ত রয়েছে । শর্ত গুলো নিম্নরূপ:
এতেকাফের
জন্য কেউ কেউ রোজার শর্ত করেছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ মত হল রোজা শর্ত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত
আছে যে তিনি কোন এক বছর শাওয়ালের প্রথম দশকে এতেকাফ করেছিলেন, আর এ দশকে ঈদের দিনও
আছে। আর ঈদের দিনে তো রোজা রাখা নিষিদ্ধ।
* এতেকাফের
জন্য মুসলমান হওয়া শর্ত। কেননা কাফেরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না।
* এতেকাফকারীকে
বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা নির্বোধ ব্যক্তির কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর
উদ্দেশ্য ব্যতীত কাজ শুদ্ধ হতে পারে না।
* ভালো-মন্দ
পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কম বয়সী, যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না,
তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না।
*এতেকাফের
নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো এতেকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়তে।
আর এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তো বলেছেন :
إنما
الأعمال بالنيات ، وإنما لكل إمري ما نوى . البخاري:০১
‘প্রত্যেক
কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে।’
* এতেকাফ
অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি, কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান
করা হারাম, অবশ্য এস্তেহাজা অবস্থায় এতেকাফ করা বৈধ। আয়েশা রা. আনহা বলেন :
اعتكفت
مع رسول الله صلي الله عليه وسلم امرأة من أزواجه مستحاضة فكانت ترى الحمرة
والصفرة فربما وضعنا الطست تحتها وهي تصلي.
البخاري : ২০৩৭
‘রসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তাঁর
স্ত্রী-গণের মধ্য হতে কেউ একজন এতেকাফ করেছিলেন এস্তেহাজা অবস্থায়। তিনি লাল ও হলুদ
রঙ্গের স্রাব দেখতে পাচ্ছিলেন, আমরা কখনো তার নীচে পাত্র রেখে দিয়েছি নামাযের সময়।’
এস্তেহাজাগ্রস্তদের
সাথে অন্যান্য ব্যাধি গ্রস্তদেরকে মেলানো যায়, যেমন যার বহুমূত্র রোগ আছে। তবে শর্ত
হল মসজিদ যেন অপবিত্র না হয়।
* গোসল
ফরজ হয় এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতে হবে। অপবিত্র লোকের মসজিদে অবস্থান করা
হারাম। যদিও কোন কোন আলেম ওজু করার শর্তে মসজিদে অবস্থান বৈধ বলেছেন। আর যদি অপবিত্রতা,
যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী -স্ত্রীর মিলনের ফলে হয়, তবে সকলের মতে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
আর যদি স্বপ্নদোষের কারণে হয়, তা হলে কারোর মতে এতেকাফ ভঙ্গ হবে না। যদি হস্ত মৈথুনের
কারণে হয় তা হলে সঠিক মত অনুসারে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
* এতেকাফ
মসজিদে হতে হবে : এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে এতেকাফ মসজিদে হতে হবে। তবে জামে মসজিদ
হলে উত্তম। কেননা এমতাবস্থায় জুমার নামাযের জন্য এতেকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে
না।
মসজিদ
থেকে বের হওয়ার বিধান
* এতেকাফকারী
যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
* আর
এতেকাফের স্থান থেকে যদি মানবীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয় তাহলে এতেকাফ ভঙ্গ হবে
না।
* মসজিদে
থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্ভব না হলে মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি আছে।
* বাহক
না থাকার কারণে এতেকাফকারীকে যদি পানাহারের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয় অথবা মসজিদে খাবার
গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ হয়, তবে এরূপ প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে।
* যে
মসজিদে এতেকাফে বসেছে সেখানে জুমার নামাযের ব্যবস্থা না থাকলে জুমার নামায আদায়ের প্রয়োজনে
মসজিদ থেকে বের হওয়া ওয়াজিব, এবং আগে ভাগেই রওয়ানা হওয়া তার জন্য মুস্তাহাব ।
* ওজরের
কারণে এতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারে। ছাফিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস এর প্রমাণ
:
أنها
جاءت إلى رسول الله صلي الله عليه وسلم تزوره في اعتكافه في المسجد في العشر
الأواخر من رمضان فتحدثت عنده ساعة ثم قامت تنقلب فقام النبي صلي الله عليه وسلم
معها يقلبها. البخاري :১৮৯৪
ছাফিয়্যা
রা. রমজানের শেষ দশকে এতেকাফস্থলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কতক্ষণ কথা বললেন,
অতঃপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিদায় দিতে উঠে দাঁড়ালেন।
* কোন
নেকির কাজ করার জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন রোগী দেখতে যাওয়া,
জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এ মর্মে আয়শা রা. বলেন:
السنة
علي المعتكف أن لا يعود مريضا ولا يشهد جنازة ولا يمس إمرأة ولا يباشرها ولا يخرج
لحاجة إلا لما لا بد منه أبو داود : ২১১৫
‘এতেকাফকারীর
জন্য সুন্নত হল, সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে
না ও তার সাথে কামাচার থেকে বিরত থাকবে এবং অতি প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে
না।’
* এতেকাফ-বিরুদ্ধ
কোন কাজের জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্বামী-স্ত্রীর
মিলন ইত্যাদি।
এতেকাফকারীর
জন্য যা কিছু বিধিবদ্ধ
* ইবাদত
আদায়, যেমন নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও দোয়া ইত্যাদি। কেননা এতেকাফের উদ্দেশ্য
হল আল্লাহ তা‘আলার সমীপে অন্তরের একাগ্রতা নিবেদন করা এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যা
উপরোক্ত ইবাদত আদায় ছাড়া সম্ভব নয়।
অনুরূপভাবে
যেসব ইবাদতের প্রভাব অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছায় যেমন সালামের উত্তর দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ
ও অসৎ কাজ থেকে বারণ, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, পথ দেখানো, ইলম শিক্ষা দেওয়া, কুরআন পড়ানো
ইত্যাদিও করতে পারবে। কিন্তু শর্ত হল এগুলো যেন এত বেশি না হয় যে এতেকাফের মূল উদ্দেশ্যই
ছুটে যায়।
* এতেকাফকারীর
জন্য মুস্তাহাব হল, তার এতেকাফের স্থানে কোন কিছু দ্বারা পর্দা করে নেয়া। কেননা রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুর্কি তাবুর
ভিতরে এতেকাফ করেছেন যার দরজায় ছিল চাটাই।
اعتكف
في قبة تركية على سدتها حصير ( مسلم :১৯৯৪)
* এতেকাফকারী
তার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র সঙ্গে নেবে যাতে নিজের প্রয়োজনে তাকে বার বার মসজিদের বাইরে
যেতে না হয়। আবু সাইদ খুদরি রা. এর হাদীসে এসেছে , তিনি বলেন:
اعتكفنا
مع رسول الله صلى الله عليه وسلم العشر الأوسط فلما كان صبيحة عشرين نقلنا متاعنا،
فأتانا رسول الله صلي الله عليه وسلم فقال: من اعتكف فليرجع إلى معتكفه البخاري :১৮৯৯
অর্থাৎ:
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে রমজানের মাঝের দশকে এতেকাফ করলাম, যখন বিশ
তারিখ সকাল হল আমরা আমাদের বিছানা-পত্র সরিয়ে নিলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে বললেন: ‘যে এতেকাফ
করেছে সে তার এতেকাফের স্থানে ফিরে যাবে।’
এতেকাফকারীর
জন্য যা অনুমোদিত
* এতেকাফকারীর
জন্য মসজিদে পানাহার ও ঘুমানোর অনুমতি আছে। এ ব্যাপারে সকল ইমামদের ঐক্যমত রয়েছে। তবে
এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্ত এবং একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশের
জন্য কম খাওয়া কম ঘুমানো সহায়ক বলে বিবেচিত।
* গোসল
করা, চুল আঁচড়ানো, তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, ভাল পোশাক পরা, এ সবের অনুমতি আছে। আয়েশা
রা. এর হাদীসে এসেছে :
أنها
كانت ترجل النبي صلي الله عليه وسلم وهي حائض وهو معتكف في المسجد وهي في حجرتها
يناولها رأسه ) البخاري : ২০৪৬)
অর্থাৎ:
তিনি মাসিক অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথার কেশ বিন্যাস করে দিতেন, যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে এতেকাফরত অবস্থায়
থাকতেন, আয়েশা রা. তার কক্ষে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথার নাগাল পেতেন।
* এতেকাফকারীর
পরিবার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে, কথা বলতে পারবে, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রীগণ এতেকাফকালীন তার সাথে
সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু সাক্ষাৎ দীর্ঘ না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এতেকাফকারী
যা থেকে বিরত থাকবে
* ওজর
ছাড়া এতেকাফকারী এমন কোন কাজ করবে না যা এতেকাফকে ভঙ্গ করে দেয়, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَا
تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
‘তোমরা
তোমাদের কাজ সমূহকে নষ্ট করো না।’
* ঐ সকল
কাজ যা এতেকাফের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে, যেমন বেশি কথা বলা, বেশি মেলামেশা করা, অধিক
ঘুমানো, ইবাদতের সময়কে কাজে না লাগানো ইত্যাদি।
* এতেকাফকারী
মসজিদে অবস্থানকালে ক্রয়-বিক্রয় করবে না, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।
نهى
عن البيع والاشتراء في المسجد. المسند
لأحمد : ৬৯৯১
এমনিভাবে
যা ক্রয় বিক্রয়ের কাজ বলে বিবেচিত, যেমন বিভিন্ন ধরনের চুক্তিপত্র, ভাড়া, মুদারাবা,
মুশারাকা, বন্ধক রাখা ইত্যাদি। কিন্তু যদি মসজিদের বাহিরে এমন ক্রয়-বিক্রয় হয়, যা ছাড়া
এতেকাফকারীর সংসার চলে না তবে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
আনাস রা. এর হাদীসে এসেছে, যখন বেদুইন লোকটি মসজিদে
প্রস্রাব করেছিল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন:
إن
هذه المساجد لا تصلح لشيئ من هذا البول ولا القذر إنما هي لذكر الله عز وجل
والصلاة وقراءة القرآن. مسلم : ৪২৯
অর্থাৎ:
মসজিদ প্রস্রাব, ময়লা-আবর্জনার উপযোগী নয়, বরং মসজিদ অবশ্যই আল্লাহর যিকির এবং নামায
ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য।
* এতেকাফ
অবস্থায় যৌন স্পর্শ নিষেধ, এ ব্যাপারে সকল ওলামাদের ঐকমত্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ ওলামাদের
মতে বীর্য স্খলনের দ্বারাই কেবল এতেকাফ ভঙ্গ হয়।
সদকাতুল
ফিতর
আমাদের
প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরেকটি অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের ইবাদত-বন্দেগীতে কোন
ত্র“টি হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। যেমন নফল নামায দ্বারা ফরজ নামাযের
ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এমনি সিয়াম পালনে যে সকল ত্র“টি-বিচ্যুতি হয়ে
থাকে তার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য সদকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান দিয়েছেন। সাথে সাথে দরিদ্র
ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষেরা যেন ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থাও দিয়েছেন। কেউ
যেন অর্থাভাবে ঈদের খুশি থেকে বঞ্চিত না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইসলামী সমাজকে
এ বিধান দিয়েছেন। এ ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে
থাকে। তিনিই তো সিয়াম পূর্ণ করা ও রমজানের রাতে কিয়াম সহ অন্যান্য নেক আমল এবং কল্যাণকর
কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন।
১-সদকাতুল
ফিতরের বিধান:
হাদীসে
এসেছে—
عن
ابن عباس رضي الله عنهما قال: فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر طهرة
للصائم من اللغو والرفث وطعمة للمساكين، فمن أداها قبل الصلاة فهي مقبولـة، ومن
أداها بعد الصلاة فهي صدقة من الصدقات. أبوداود:১৩৭১
‘ইবনে
আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়াম পালনকারীর জন্য সদকাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য
করে দিয়েছেন। যা সিয়াম পালনকারীর অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ পরিশুদ্ধকারী ও অভাবী মানুষের
জন্য আহারের ব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে এটা আদায় করবে
তা সদকাতুল ফিতর হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা অপরাপর
(নফল) সদকা হিসেবে গৃহিত।’
অতএব
সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু ওয়াজিব করেছেন তা পালন করা উম্মতের জন্য
অপরিহার্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:—
ﭽ ﭑ ﭒ ﭓ ﭔ ﭕ ﭖﭗ ﭘ ﭙ ﭚ ﭛ ﭜ ﭝ ﭞ ﭼ النساء: ٨٠اء:
‘যে রাসূলের
আনুগত্য করল সে তো আল্লাহর-ই আনুগত্য করল। এবং যে মুখ ফিরিয়ে নিল (জেনে রেখ) আমি তোমাকে
তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি।’
অতএব
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা
নির্দেশ দিয়েছেন তা মূলত আল্লাহর-ই নির্দেশ। আল্লাহ বলেন:—
‘তোমরা
আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের।’
২- সদকাতুল
ফিতর কার উপর ওয়াজিব ?
প্রত্যেক
এমন মুসলমান ব্যক্তির উপর ওয়াজিব যারা ঈদের দিনে তার পরিবারের এক দিন এক রাতের খাবারের
অতিরিক্ত যদি এক সা’ পরিমাণ খাদ্যের মালিক থাকে তবে তার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। তবে
ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর মতে ঐ ব্যক্তির উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব যে ঈদের দিন ভোরে প্রয়োজনের
অতিরিক্ত সম্পদ হিসেবে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সম-পরিমাণ
সম্পদের মালিক। যার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন
তেমনি নিজের পোষ্যদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন।
৩- সদকাতুল
ফিতর এর পরিমাণ :
প্রধান
খাদ্য হিসেবে যে সকল বস্তু স্বীকৃত যেমন গম, যব, ভুট্টা, চাউল, খেজুর ইত্যাদি থেকে
এক সা’ পরিমাণ দান করতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে—
عن
ابن عمر رضي الله عنهما قال : فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر من
رمضان، صاعا من تمر أو صاعا من شعير. مسلم:১৬৩৫
ইবনে
উমার রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের যাকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা’ খেজুর অথবা
এক সা’ গম আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন।।’
নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমলের সা’-র হিসেবে এক
সা’-তে ২ কেজি ৪০ গ্রাম হয়ে থাকে। এটা অধিকাংশ ইমামের মত। আর ইমাম আবু হানীফা রহ.-র
মতে অর্ধ সা’ পরিমাণ আটা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা জায়েয। তবে ‘এক সা’ পরিমাণ আদায়
করলে আদায় হবে না, অর্ধ সা’ দিতেই হবে’ এমন কথা কখনো কোন হানাফী ইমাম বলেননি। বরং যুক্তির
দিক দিয়েও এটাই উত্তম যাতে মানুষের বিশেষ করে দরিদ্র অসহায়দের উপকার বেশি হয়। তাই এক
সা’ পরিমাণ খাদ্য সদকাতুল ফিতর হিসেবে দান করা হানাফি মাজহাবের বিরোধী নয়, বরং উত্তম।
কেননা অধিকাংশ সহীহ হাদীসে এক সা’ পরিমাণ আদায় করতে বলা হয়েছে।
তা ছাড়া
হানাফী মাযহাবে যে অর্ধ সা’ এর কথা বরা হয়েছে, সেটি ইরাকী সা’ এর হিসাবে। ইরাকী সা’
এর হিসাবে অর্ধ সা’ তে এক কেজি সাত শত পঞ্চাশ গ্রাম হয়ে থাকে।
৪ কখন
আদায় করবেন সদকাতুল ফিতর ?
সদকাতুল
ফিতর আদায় করার দুটো সময় আছে। একটি হল উত্তম সময় অন্যটি হল বৈধ সময়। আদায় করার উত্তম
সময় হল ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করা।
যেমন
হাদীসে এসেছে—
عن
ابن عمر رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم أمر بزكاة الفطر قبل خروج
الناس إلى الصلاة. مسلم:১৬৪৬
‘ইবনে
উমার থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ
দিয়েছেন।’
সদকাতুল
ফিতর আদায় করার সুযোগ দেয়ার জন্যই ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্বে আদায় করা মুস্তাহাব।
সদকাতুল ফিতর আদায় করার বৈধ সময় হল: যদি কেউ ঈদের দু একদিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায়
করে তবে আদায় হয়ে যাবে। সহীহ বুখারীতে আছে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এভাবে আদায় করতেন।
তবে কোন সংগত কারণ ব্যতীত ঈদের সালাতের পরে আদায় করলে সদকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় হবে
না বরং একটি নফল সদকা হিসেবে আদায় হবে। ওজর বা বিশেষ অসুবিধায় কেউ যদি ঈদের সালাতের
পূর্বে আদায় করতে না পারে তবে সে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে।
৫- সদকাতুল
ফিতর কাকে দেবেন ?
নিজ শহরের
অভাবী ও দরিদ্র মানুষদের সদকাতুল ফিতর দান করবেন। যারা যাকাত গ্রহণের অধিকার রাখে এমন
অভাবী লোকদেরকে সদকাতুল ফিতর প্রদান করা হবে। একজন দরিদ্র মানুষকে একাধিক ফিতরা দেয়া
যেমন জায়েয আছে, তেমনি একটি ফিতরা বণ্টন করে একাধিক মানুষকে দেয়াও জায়েয।
ঈদের
তাৎপর্য ও করণীয়
ঈদের
সংজ্ঞা :
ঈদ আরবী
শব্দ। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বার বার ফিরে আসে। এটা আরবী
শব্দعاد يعود থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ ফিরে আসা। অনেকে বলেন এটা আরবী শব্দ
العادة আদত বা অভ্যাস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই
হোক, যেহেতু এ দিনটি বার বার ফিরে আসে তাই এর নাম ঈদ। এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার
তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দিবসে তার বান্দাদেরকে নেয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা
বার বার ধন্য করেন ও বার বার তার এহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রমজানে পানাহার নিষিদ্ধ
করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। ছদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানীর গোশত ইত্যাদি
নেয়ামত তিনি বার বার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নেয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগত
ভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।
ইসলামে
ঈদের প্রচলন
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদীসে এসেছে—
عن
أنس بن مالك رضي الله عنهما قال: قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم المدينة، ولهم
يومان يلعبون فيهما، قال: ما هذان اليومان؟ قالوا كنا نلعب فيهما في الجاهلية، قال
رسول الله صلى الله عليه وسلم: قد أبدلكم الله خيرا منهما : يوم الأضحى ويوم
الفطر. أبو داود:৯৫৯
‘রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনাতে
আগমন করলেন তখন মদিনা বাসীদের দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন
এ দু দিনের কি তাৎপর্য আছে? মদিনা বাসীগণ উত্তর দিলেন : আমরা মূর্খতার যুগে এ দু দিনে
খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দু দিনের পরিবর্তে
তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’
শুধু
খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দুটো দিন ছিল আল্লাহ তাআলা তা পরিবর্তন করে এমন দুটো
দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তার যিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে
সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে।
ঈদের
তাৎপর্য
ইতিপূর্বে
আলোচিত আনাস রা. বর্ণিত হাদীস থেকে ঈদের তাৎপর্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে।
তা হল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উম্মতে মুহাম্মদীকে সম্মানিত করে তাদের এ দুটো ঈদ দান
করেছেন। আর এ দুটো দিন বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ
দিন ও সেরা ঈদ।
ইসলামের
এ দু’টো উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়। বরং এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসব এর সাথে
সাথে জগৎসমূহের প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে। যিনি জীবন দান
করেছেন, দান করেছেন সুন্দর আকৃতি, সুস্থ শরীর, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন,
যার জন্য জীবন ও মরণ তাকে এ আনন্দের দিনে ভুলে থাকা হবে আর সব কিছু ঠিকঠাক মত চলবে
এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়? তাই ইসলাম আনন্দ-উৎসবের এ দিনটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের
ইবাদত-বন্দেগী, তার প্রতি শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা সু-সজ্জিত করেছে।
ঈদের
দিনের করণীয়
ঈদের
দিনে কিছু করণীয় আছে যা নীচে আলোচনা করা হল :
(১) গোসল
করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা। ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মুস্তাহাব। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য
মিলিত হয়। যে কারণে জুমআর দিন গোসল করা মুস্তাহাব সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের সালাতের
পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে—
صح
عن ابن عمر رضي الله عنهما أنه كان يغتسل يوم الفطر قبل أن يغدو إلى المصلى رواه
الإمام مالك في أول كتاب العيدين وقال سعيد بن المسيب سنة الفطر ثلاث: المشي إلى
المصلى والأكل قبل الخروج و الاغتسال. إرواء الغليل للألباني ২/১০৪
ইবনে
উমার রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে তিনি ঈদুল-ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে
গোসল করতেন। সায়ীদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. বলেন : ঈদুল ফিতরের সুন্নত তিনটি : ঈদগাহে পায়ে
হেঁটে যাওয়া, ঈদগাহের দিকে রওয়ানার পূর্বে কিছু খাওয়া, গোসল করা।
এমনিভাবে
সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে—
عن
عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال: أخذ عمر جبة من استبرق تباع في السوق، فأخذها
فآتى بها رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقال يا رسول الله ابتع هذه تجمل بها
للعيد والوفود، فقال له رسول الله صلى الله عليه وسلم: إنما هذه لباس من لا خلاق
له . البخاري: ৯৪৮
আব্দুল্লাহ
ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত যে, উমার রা. একবার বাজার থেকে একটি রেশমি কাপড়ের জুব্বা
আনলেন ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে দিয়ে বললেন : আপনি এটা কিনে
নিন। ঈদের সময় ও আগত গণ্যমান্য প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাতে পরিধান করবেন। রাসূলে করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :
‘এটা তার পোশাক যার আখেরাতে কোন অংশ নেই।’
এ হাদীস
দ্বারা প্রমাণিত হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিনে উত্তম পোশাক পরিধান করার প্রয়োজনীয়তার
প্রতি সম্মতি দিয়েছেন। আর উক্ত পোশাকটি রেশমি পোশাক হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কেননা, ইসলামী শরীয়তে পুরুষদের রেশমি পোশাক পরিধান জায়েয নয়।
عن
ابن عمر ، أنه كان ্র يلبس في العيدين أحسن ثيابه. معرفة السنن والآثار للبيهقي :১৯০১
ইবনে
উমার রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত যে তিনি দু ঈদের দিনে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন।
ইমাম
মালেক রহ. বলেন: ‘আমি ওলামাদের কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার
ও সাজ-সজ্জাকে মুস্তাহাব বলেছেন।’ (আল-মুগনি: ইবনে কুদামাহ)
ইবনুল
কায়্যিম রহ. বলেছেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সুন্দরতম পোশাক পরিধান
করতেন।
এ দিনে
সকল মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হল তার প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত
তা প্রকাশ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করনারথে নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। হাদীসে
এসেছে—
عن
عبد الله ابن عمرو قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن الله تعالى يحب أن
يرى أثر نعمته على عبده. حسنه الألباني في صحيح الجامع: ১৮৮৭
আব্দুল্লাহ
ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দার উপর
তার প্রদত্ত নেয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’
(২) ঈদের
দিনে খাবার গ্রহণ প্রসঙ্গে
সুন্নত
হল ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা। আর ঈদুল আজহার দিন
ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। হাদীসে
এসেছে—
عن
بريدة رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم لا يخرج يوم الفطر حتى
يأكل، ولا يأكل يوم الأضحى حتى يرجع فيأكل من أضحيته. أحمد: ১৪২২ وصححه الألباني
في صحيح ابن ماجه
বুরাইদা
রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল
আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন।
ঈদুল
ফিতরের দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে তিনটি, পাঁচটি অথবা সাতটি এভাবে বে-জোড় সংখ্যায় খেজুর
খাওয়া সুন্নত। যেমন হাদীসে এসেছে—
عن
أنس رضي الله عنه قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يغدو يوم الفطر حتى
يأكل تمرات، ويأكلهن وتراً. البخاري:৯০০
সাহাবী
আনাস রা. বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন
না, আর খেজুর খেতেন বে-জোড় সংখ্যায়।
সম্ভবত
আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের হুকুম অতি তাড়াতাড়ি আদায় করার ইচ্ছায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করতেন। কেননা দীর্ঘ
এক মাস সিয়াম আদায়ের পর আল্লাহর নির্দেশ হল পানাহার করা। এটা করতে যেন দেরি না হয়ে
যায় এজন্য তিনি উপস্থিতভাবে খেজুর হলেও খেয়ে নিতেন। যিনি কুরবানী দেবেন, তার জন্য সুন্নত
হল ঈদুল আজহার দিনে প্রথমে কুরবানী দিয়ে তার গোশত খাওয়া। আর যিনি কুরবানী দেবেন না
তিনি ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু খেতে পারেন।
(৩) পায়ে
হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া
ঈদগাহে
তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত। যাতে ইমাম সাহেবের নিকটবর্তী স্থানে বসা যায় ও ভালো-কাজ অতি তাড়াতাড়ি
করার সওয়াব অর্জন করা যায়, সাথে সাথে সালাতের অপেক্ষায় থাকার সওয়াব পাওয়া যায়। ঈদগাহে
পায়ে হেঁটে যাওয়া হল মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে—
عن
علي رضي الله عنه قال: من السنة أن تخرج إلى العيد ماشيا. الترمذي:৪৮৭ وحسنه وقال:
والعمل على هذا عند أكثر أهل العلم : يستحبون أن يخرج الرجل إلى العيد ماشيا، وأن
لا يركب إلا بعذر.
আলী রা.
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘সুন্নত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।’ ইমাম তিরমিযী হাদিসটি
বর্ণনা করে বলেন হাদিসটি হাসান। তিনি আরো বলেন : অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ অনুযায়ী আমল
করেন। এবং তাদের মত হল পুরুষ ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাবে, এটা মুস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য
কোন কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহণ করবে না।
আর একটি সুন্নত হল : যে পথে ঈদগাহে যাবে সে পথে না
ফিরে অন্য পথে ফিরে আসবে। যেমন হাদীসে এসেছে—
عن
جابر رضي الله عنه قال : كان النبي صلى الله عليه و سلم إذا كان يوم العيد خالف
الطريق . البخاري:৯৩৩
জাবের
রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’
অর্থাৎ
যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন।
তিনি
এটা কেন করতেন ? এর ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন হিকমত বর্ণনা করেছেন। অনেকে বলেছেন
: যেন ঈদের দিনে উভয় পথের লোকদেরকে সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায় এ কারণে
তিনি দুটো পথ ব্যবহার করতেন। আবার অনেকে বলেছেন ইসলাম ধর্মের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করার
জন্য তিনি সকল পথে আসা-যাওয়া করতেন যেন সকল পথের অধিবাসীরা মুসলমানদের শান-শওকত প্রত্যক্ষ
করতে পারে। আবার কেউ বলেছেন গাছ-পালা তরুলতা সহ মাটি যেন অধিক হারে মুসলমানদের পক্ষে
সাক্ষী হতে পারে সে জন্য তিনি একাধিক পথ ব্যবহার করতেন। আসল কথা হল, হিকমত ও উদ্দেশ্য
যাই হোক, আর তা বুঝে আসুক বা না আসুক, আমাদের কর্তব্য হল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সুন্নত অনুসরণ করা।
(৪) ঈদের
তাকবীর আদায়
হাদীস
দ্বারা প্রমাণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা
পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। যখন সালাত
শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না। আর কোন কোন বর্ণনায় ঈদুল আজহার ব্যাপারে একই
কথা পাওয়া যায়। আরো প্রমাণিত আছে যে ইবনে উমার রা. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে
আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদগাহে এসে ইমামের আগমন পর্যন্ত এভাবে তাকবীর
পাঠ করতেন। আগে আলোচিত হয়েছে যে, সুন্নত হল মসজিদ, বাজার, রাস্তা-ঘাট সহ সর্বত্র উচ্চস্বরে
তাকবীর পাঠ করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল মানুষ এ সুন্নতের প্রতি খুবই উদাসীন। আমাদের
সকলের কর্তব্য হবে এ সুন্নতটি সমাজে চালু করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। শেষ রমজানের সূর্যাস্তের
পর থেকে ঈদুল ফিতরের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করবে। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে
যখন বের হবে ও ঈদগাহে সালাতের অপেক্ষায় যখন থাকবে তখন গুরুত্ব সহকারে তাকবীর পাঠ করবে।
ঈদের
সালাত :
(১) ঈদের
সালাতের হুকুম :—
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন বলেন—
ﮊ ﮋ ﮌ ﮍ
الكوثر: ١
‘তোমার
প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কুরবানী কর।’
অধিকাংশ
মুফাসসিরে কেরামের মতে এ আয়াতে সালাত বলতে ঈদের সালাতকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা এ
সালাত আদায় করেছেন। কোন ঈদেই ঈদের সালাত পরিত্যাগ করেননি। ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেছেন
: ‘ঈদের সালাত প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। তবে ফরজ নয়।’
ইবনে
তাইমিয়া রহ. ও এ মত পোষণ করেন। আর ঈদের সালাত যে ওয়াজিব এর আরেকটা প্রমাণ হল, যদি কোন
সময় জুমআর দিনে (শুক্রবার) ঈদ হয় তখন সে দিন যারা ঈদের সালাত আদায় করেছে তারা জুমআর
সালাতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে। অর্থাৎ জুমআর সালাতে অংশ না নিলে কোন গুনাহ
নেই। তবে এলাকার ইমামের কর্তব্য হল, সে ঈদের দিনে জুমআর সালাতের ব্যবস্থা করবে, যাদের
আগ্রহ আছে তারা যাতে শরিক হতে পারে। মনে রাখতে হবে ঈদের দিন জুমআর সালাত পরিত্যাগ করার
অনুমতি আছে। আর এ অনুমতির ভিত্তিতে কেউ জুমআর সালাত ত্যাগ করলে তার অবশ্যই জোহরের সালাত
আদায় করতে হবে। তবে উত্তম আমল হবে জুমআর দিনে ঈদ হলে জুমআ ও ঈদের সালাত উভয়টাই আদায়
করা। কোন অবস্থাই কেউ যেন ঈদের সালাত আদায়ে অলসতা না করে। শিশু-সন্তানদের ঈদের সালাতে
নিয়ে যাবে ও ব্যবস্থা থাকলে মেয়েদের যেতে উৎসাহিত করবে। মনে রাখতে হবে ঈদের সালাত ইসলামের
একটি শিআ’র তথা মহান নিদর্শন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. বলেছেন : ‘প্রত্যেক জাতির
এমন কিছু উৎসব থাকে যাতে সকলে একত্র হয়ে নিজেদের শান-শওকত, সংখ্যাধিক্য প্রদর্শন করে।
ঈদ মুসলিম জাতির এমনি একটি উৎসব। এ কারণেই তো শিশু, নারী, এমন মহিলা যারা সাধারণত ঘরের
বাইরে বের হয় না ও ঋতুবতী মেয়ে লোক -যাদের সালাত আদায় করতে হয় না—এদের সহ সকলকেই এ
দিনে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মুস্তাহাব।
(২) ঈদের
জামাতে মহিলাদের অংশগ্রহণের নির্দেশ
পাঁচ
ওয়াক্ত সালাতের জামাতে ও জুমআর সালাতে মহিলাদের অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
মেয়েদেরকে ঈদের সালাতে অংশ গ্রহণ করার হুকুম (নির্দেশ) দিয়েছেন। যেমন হাদীসে
এসেছে—
عن
أم عطية رضي الله عنها قالت: أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نخرج في الفطر
والأضحى، العواتق والحيض وذوات الخدر، فأما الحيض فيعتزلن الصلاة ويشهدن الخير
ودعوة المسلمين، قالت : يا رسول الله إحدانا لا يكون لها جلباب، قال: لتلبسها
أختها من جلبابها. مسلم:১৪৭৫
‘উম্মে
আতিয়া রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা মেয়েরা যেন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে
সালাতের জন্য বের হয়ে যাই ; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবতী ও গৃহবাসিনী সকলেই বের হবে। কিন্তু
ঋতুবতী মেয়েরা (ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের
দোয়ায় অংশ নেবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না
নেই। (যা পরিধান করে সে ঈদের সালাতে যেতে পারে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বললেন : তার বোন তাকে নিজের ওড়নাগুলো
থেকে একটি ওড়না পরিধান করাবে।’
দুঃখের
বিষয় হল আজকে দেখা যায় অনেকে মেয়েদের ঈদের সালাতে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত করেন। অনেকে
বাধা দেন। আবার কোথাও মহিলাদের জন্য ঈদের সালাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলেও ব্যবস্থা
গ্রহণ করা হয় না বা এটাকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। বলা হয়, বর্তমান যুগ ফিতনার
যুগ, কোন নিরাপত্তা নেই ইত্যাদি বলে কত অজুহাত সৃষ্টি করা হয়—যাতে মেয়েরা ঈদের সালাতে
অংশ না নেয়। আসলে কোন অজুহাতই এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নির্দেশ ও তাঁর সুন্নাহর বিপরীতে যত অজুহাত ও যুক্তি দেয়া হোক
না কেন সবই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেমন আমরা এ হাদিসটিতে দেখি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন অজুহাত গ্রহণ করেননি।
কেউ বলেছিল অনেকের ওড়না নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তার বোন তাকে ওড়না ধার দেবে।’ এমনকি যারা
ঋতুবতী ছিল তাদেরকেও নির্দেশ দেয়া হল যে, তোমরা ঈদগাহে যাবে। তাদের সালাত আদায় বৈধ
না হওয়া সত্ত্বেও ঈদের জামাত ও সালাত প্রত্যক্ষ করবে। তাই আমাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মৃতপ্রায় এ সুন্নতকে বাস্তবায়ন করার জন্য
যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে যুগের ফিতনা ও মেয়েদের ফিতনা সম্পর্কে
আমাদের চেয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক বেশি সচেতন ছিলেন।
(৩) ঈদের
সালাত আদায়ের সময় :
সূর্যোদয়ের
পর যখন তা এক লেজা (অর্ধ হাত) পরিমাণ উপরে উঠে তখন থেকে শুরু করে সূর্য ঠিক মাথার উপরে
আসা পর্যন্ত সময়টা হল সালাতুল ঈদ আদায়ের ওয়াক্ত। এ সময়ের মাঝে যে কোন সময় ঈদের সালাত
আদায় করা যায়। ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের সালাত দেরি করে আদায় করতেন আর ঈদুল
আজহার সালাত প্রথম ওয়াক্তে তাড়াতাড়ি আদায় করতেন।
ঈদুল
ফিতরের সালাত একটু দেরিতে আদায় করতেন, যাতে মুসলমানগণ সদকাতুল ফিতর আদায় করার প্রয়োজনীয়
সময় পায়। আর ঈদুল আজহার সালাত তাড়াতাড়ি আদায় করতেন, যাতে মুসলমানগণ সালাত শেষ করে দুপুরের
পূর্বে কুরবানীর পশু জবেহ সম্পন্ন করতে পারে।
(৪) ঈদের
সালাত কোথায় আদায় করবেন ?
হাদীসে
এসেছে :—
عن
أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخرج يوم
الفطر والأضحى إلى المصلى . رواه البخاري:৯০৩
আবু সাইদ
খুদরি রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের
হতেন...।’
ইবনুল
কায়্যিম রহ. বলেন: ‘রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ হল তিনি সর্বদা ঈদের সালাত ঈদগাহে আদায়
করতেন।’
ইবনে
কুদামাহ রহ. বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো উত্তম কাজ পরিত্যাগ করেননি। কখনো পরিপূর্ণতা
বাদ দিয়ে অপূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। তার চেয়ে বড় কথা হল আমাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল
আলামীনের পক্ষ থেকে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর আনুগত্যের নির্দেশ
দেয়া হয়েছে। এসব দিকে লক্ষ্য করে আমাদের অবশ্যই ঈদের সালাত ঈদগাহে (উন্মুক্ত প্রান্তরে)
আদায় করা উচিত।’
আর রাসূলে
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো
ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করেছেন এমন কোন বর্ণনা নেই। অবশ্য আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ বর্ণিত
একটি হাদীসে জানা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার কোন এক অসুবিধা থাকায় মসজিদে ঈদের সালাত আদায়
করেছেন। তবে এ হাদিসটিকে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী দুর্বল বলে প্রমাণ
করেছেন। তাই আমাদের অলসতা পরিত্যাগ করে কিছুটা কষ্ট করে হলেও ঈদের সালাত ঈদগাহে আদায়
করার ব্যাপারে যতœবান হওয়া উচিত। এ দিনে মুসলিমগণ এক সম্মেলনে মিলিত হবেন। মসজিদ এ
কাজের জন্য যথাযথ প্রশস্ত স্থান হতে পারে না। মসজিদে সালাত আদায়ের ফযীলত থাকা সত্ত্বেও
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
সর্বদা ঈদগাহে ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এমনিভাবে মসজিদের ফযীলত থাকা সত্ত্বেও
নফল নামায ঘরে আদায় করা উত্তম।
(৫) ঈদের
সালাতের পূর্বে কোন সালাত নেই
হাদীসে
এসেছে :—
عن
ابن عباس رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم خرج يوم الفطر فصلى ركعتين
لم يصل قبلها ولا بعدها. البخاري:৯৩৫
ইবনে
আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল-ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাআত ঈদের সালাত
আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামায আদায় করেননি।’
সুন্নত
হল ঈদের সালাতের ওয়াক্তে শুধু ঈদের নামায আদায় করবে অন্য কোন নফল নামায আদায় করবে না।
তবে যদি কোন অসুবিধার কারণে ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করতে হয় তাহলে মসজিদে প্রবেশ করে
দু রাকাআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা যেতে পারে।
(৬) ঈদের
সালাতে আযান ও একামত নেই। হাদীসে এসেছে :—
عن
ابن عباس و جابر رضي الله عنهما قالا : لم يكن يؤذن يوم الفطر ولا يوم الأضحى.
رواه البخاري:৯০৭
ইবনে
আব্বাস ও জাবের রা. থেকে বর্ণিত তারা বলেন: ‘ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সালাতে আযান দেয়া
হতো না।’
وعن
جابر بن سمرة رضي الله عنه قال : صليت مع
رسول الله صلى الله عليه وسلم العيدين غير مرة ولا مرتين بغير أذان ولا إقامة.
مسلم:১৪৬৭
জাবের
ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘আমি একাধিকবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম -এর সাথে দু ঈদের সালাত আদায় করেছি কোন আযান ও ইকামাত ব্যতীত।’
(৭) ঈদের
সালাত আদায়ের পদ্ধতি
ঈদের
সালাত হল দু রাকাআত। হাদীসে এসেছে—
قال
عمر رضي الله عنه : صلاة الجمعة ركعتان وصلاة الفطر ركعتان وصلاة الأضحى ركعتان
وصلاة السفر ركعتان. النسائي:১৪০৩ وصححه الألباني
উমার
রা.বলেন: ‘জুমআর সালাত দু রাকাআত, ঈদুল ফিতরের সালাত দু রাকাআত, ঈদুল আজহার সালাত দু
রাকাআত ও সফর অবস্থায় সালাত হল দু রাকাআত।’
ঈদের
সালাত শুরু হবে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে।
ঈদের
সালাতে অতিরিক্ত প্রত্যেক তাকবীরের পর হাত উঠাতে হবে। তাকবীর সমূহ আদায় করার পর সুরা
ফাতেহা পড়বে, তারপর প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা’ পড়বে আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাশিয়াহ পড়বে।
অথবা প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফ পড়বে আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কামার পড়বে।
এভাবে
পড়া মুস্তাহাব। কেউ এভাবে না পড়ে অন্য সূরা দিয়ে পড়লে কোন ক্ষতি নেই। সালাত শেষ হওয়ার
পর ইমাম সাহেব খুতবা দেবেন। মনে রাখা দরকার, ঈদের খুতবা হবে সালাত আদায়ের পর। সালাত
আদায়ের পূর্বে কোন খুতবা নেই। হাদীসে এসেছে—
عن
أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخرج يوم
الفطر والأضحى إلى المصلى، فأول شيء يبدأ به الصلاة، ثم ينصرف فيقوم مقابل الناس
والناس جلوس على صفوفهم، فيعظهم ويوصيهم ويأمرهم. البخاري:৯০৩
আবু সায়ীদ
খুদরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল-আজহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা
হতেন। ঈদগাহে প্রথম সালাত শুরু করতেন। সালাত শেষে মানুষের দিকে ফিরে খুতবা দিতেন, এ
খুতবাতে তিনি তাদের ওয়াজ করতেন, উপদেশ দিতেন, বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। আর এ অবস্থায়
মানুষেরা তাদের কাতারে বসে থাকতো।’
এ হাদীস
দ্বারা যে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হল তার মাঝে: ঈদের সালাতের পূর্বে কোন ওয়াজ-নসিহত বা
খুতবা হবে না। ইমাম সাহেব ঈদগাহে এসে সালাত শুরু করে দেবেন।
(৮) ঈদের
খুতবা শ্রবণ
সালাতের
পর ইমাম দুটো খুতবা দেবেন। সে খুতবায় তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা, গুণ-গান
ও অধিক পরিমাণে তাকবীর পাঠ করবেন। তবে ঈদের সালাত আদায়কারীকে ঈদের খুতবা শুনতেই হবে
এমন কথা নেই। যেমন হাদীসে এসেছে—
عن
عبد الله بن السائب رضي الله عنه قال: شهدت العيد مع النبي صلى الله عليه وسلم
فلما قضى الصلاة قال: إنا نخطب فمن أحب أن يجلس فليجلس ومن أحب أن يذهب فليذهب أبو
داود:৯৭৫ وصححه الألباني
আব্দুল্লাহ
বিন সায়েব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ
করলেন, বললেন: ‘আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভাল লাগে সে যেন বসে, আর যে চলে যেতে চায়,
সে যেতে পারে।’
আমাদের
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে খুতবা শুনলে অনেক সওয়াব অর্জন করা যাবে। তাতে যেমন আল্লাহ রাব্বুল
আলামীনের যিকির আছে, দ্বীনি শিক্ষা বিষয়ক কথা-বার্তা রয়েছে তেমনি রয়েছে ফেরেশতাদের
আগমন ও আল্লাহ তা‘আলার সাকীনা ও রহমত। তাই এটা অবহেলা করে হারানো উচিত নয়।
(৯) ঈদের
সালাতের কাজা আদায় প্রসঙ্গে
কারো
যদি ঈদের সালাত ছুটে যায় তাহলে সে কি করবে। কাজা করা দরকার কিনা? এ বিষয়ে উলামাদের
একাধিক মত রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মত হল কাজা আদায় করবে। এরপর কথা থেকে যায় সে কাজা আদায়
করতে যেয়ে কত রাকাআত আদায় করবে। চার রাকাআত না দু রাকাআত? এ বিষয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন
মত। ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন : ‘যদি কেউ ঈদের সালাত ধরতে না পারে তবে দু রাকাআত কাজা
আদায় করবে।’ আতা রহ. বলেছেন: ‘যদি ঈদের সালাত ছুটে যায় তবে কাজা হিসেবে দু রাকাআত আদায়
করবে।’ হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেছেন: ‘যদি ঈদের সালাত ছুটে যায় তবে ইমামের সাথে দু
রাকাআত আদায় করবে।’ অর্থাৎ কাজা করবে জামাতের সাথে। মূলত দু রাকাআত কাজা আদায় করা যুক্তি
সংগত। ইমাম মুযনী সহ একদল ফিকাহবিদ বলেছেন, ‘ঈদের সালাত ছুটে গেলে তা কাজা করার প্রয়োজন
নেই।’ আর ইমাম সওরী ও ইমাম আহমদ বিন হান্বল রহ. বলেছেন, ‘যদি কেউ একা একা ঈদের সালাতের
কাজা আদায় করে তবে সে দু রাকাআত আদায় করবে। আর যদি জামাতের সাথে আদায় করে তবেও দু রাকাআত।’
ইমাম
আবু হানীফা রহ. বলেছেন : ‘যদি কেউ ঈদের সালাত কোন কারণে আদায় করতে না পারে তবে সে ইচ্ছা
করলে কাজা আদায় করতে পারে, আর না করলে কোন অসুবিধা নেই। যদি আদায় করে তবে চার রাকাআতও
আদায় করতে পারে আবার দু রাকাআতও।’
(১০)
ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা
একে অপরকে
শুভেচ্ছা জানানো, অভিবাদন করা মানুষের সুন্দর চরিত্রের একটি দিক। এতে খারাপ কিছু নেই।
বরং এর মাধ্যমে অপরের জন্য কল্যাণ কামনা ও দোয়া করা যায়। পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ও
আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরীয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়।
বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন :
(ক) হাফেজ
ইবনে হাজার রহ. বলেছেন: ‘জোবায়ের ইবনে নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত যে রাসূলে করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবায়ে
কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন:
تَقَبَّلَ
اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ. المعجم الكبير للطبراني:১৭৫৮৯
‘আল্লাহ
তাআলা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন।’
(খ) ঈদ
মুবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
(গ) প্রতি
বছরই আপনারা ভাল থাকুন: وَكُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ বলা যায়। এ ধরনের সকল মার্জিত
বাক্যের দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য (تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا
وَمِنْكَ) দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কেরাম রা. এ বাক্য ব্যবহার
করতেন ও এতে পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া রয়েছে।
আর যদি কেউ সব বাক্যগুলো দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চায় তাতে অসুবিধা নেই। যেমন ঈদের
দিন দেখা হলে বলবে—
تَقَبَّلَ
اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ، وَكُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ، عِيْدُكَ مُبَارَكٌ
‘আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন আমার ও আপনার সৎ-কর্ম সমূহ কবুল করুন। সারা বছরই আপনারা সুখে থাকুন।
আপনাকে বরকতময় ঈদের শুভেচ্ছা।’
(১১)
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া:
সদাচরণ
পাওয়ার ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে সবচেয়ে বেশি হকদার হল মাতা ও পিতা। তারপর পর্যায়ক্রমে
অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন
এবং সকল প্রকার মনোমালিন্য দূর করার জন্য ঈদ হল একটা বিরাট সুযোগ। কেননা হিংসা-বিদ্বেষ
ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে খারাপ সম্পর্ক এমন একটা বিষয় যা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে মানুষকে
দূরে সরিয়ে দেয়। হাদীসে এসেছে—
عن
أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : تفتح أبواب الجنة
يوم الاثنين والخميس، فيغفر لكل عبد لا يشرك بالله شيئا إلا رجلا كانت بينه وبين
أخيه شحناء، فيقال: أنظروا هذين حتى يصطلحا ! أنظروا هذين حتى يصطلحا ! أنظروا
هذين حتى يصطلحا !. رواه مسلم: ৪৬৫২
আবু হুরাইরা
রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো
খুলে দেয়া হয়। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে তাকে ব্যতীত সে দিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করে
দেয়া হয় কিন্তু ঐ দু ভাইকে ক্ষমা করা হয় না যাদের মাঝে হিংসা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তখন
(ফেরেশতাদেরকে) বলা হয় এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে
মিলে মিশে যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে
যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়!!
’ (তাহলে তাদেরও যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়)।
এ হাদীস
দ্বারা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় যে নিজেদের মাঝে হিংসা, বিবাদ, দ্বন্দ্ব রাখা এত
বড় অপরাধ যার কারণে আল্লাহর সাধারণ রহমত তো বটেই বিশেষ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। হাদীসে
আরো এসেছে—
عن
أبي أيوب الأنصاري رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : لا يحل
لمسلم أن يهجر أخاه فوق ثلاث ليال، يلتقيان فيعرض هذا ويعرض هذا، وخيرهما الذي
يبدأ بالسلام . مسلم:৪৬৪৩
আবু আইয়ুব
আনসারী রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে
তিন দিনের বেশি সময় বয়কট করবে বা সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ
হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’
এ সকল
হাদীসে ভাই বলতে শুধু আপন ভাইকে বুঝানো হয়নি বরং সকল মুসলমানকেই বুঝানো হয়েছে। হোক
সে ভাই অথবা প্রতিবেশী কিংবা চাচা বা বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, সহপাঠী বা অন্য কোন আত্মীয়।
তাই যার সাথে ইতিপূর্বে ভাল সম্পর্ক ছিল এমন কোন মুসলমানের সাথে সম্পর্ক খারাপ করা
শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায়। যদি কেউ এমন অন্যায়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে তার এ অন্যায়
থেকে ফিরে আসার এক মহা সুযোগ হল ঈদ।
No comments:
Post a Comment