দর্শক সংখ্যা

Thursday, March 21, 2013

আল-কোরআনুল কারীম : মর্যাদা, শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা : পর্ব-১



আল-কোরআনুল কারীম :
মর্যাদা, শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা : পর্ব-১
অনুবাদ : ইকবাল হুসাইন মাসুম
মানব অন্তর কালিমাযুক্ত হয়ে কঠিন হয়ে যায়দুনিয়ার প্রাচুর্যের মোহ ও প্রবৃত্তির চাহিদা নফ্‌সকে দুর্বল ও অসাড় করে ফেলেমানুষকে এ পৃথিবীতে নফস, প্রবৃত্তি, ও শয়তানের সাথে যুদ্ধ ও সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়একজন যোদ্ধাকে যদি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকার অস্ত্রের মুখাপেক্ষী হতে হয় তাহলে চিরন্তন সফলতা যে যুদ্ধে বিজয় লাভের উপর নির্ভরশীল এমন যুদ্ধের যোদ্ধাকে অবশ্যই সক্রিয় ও কার্যকর অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবেআর তা হচ্ছে স্বীয় নফ্‌সকে সংশোধন ও পবিত্রকরণএ ক্ষেত্রে কোরআন ও সুন্নাহ ভিন্ন অন্য কোন পথ ও পদ্ধতি নেইকোরআন সম্পর্কে বলতে গেলে রমজান প্রসঙ্গে দুটি কথা বলতে হয় কয়েক কারণেযেমন :—
১. রমজান মাসেই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোরআন অবতরণের সূচনা রমজান মাসেই হয়েছে, তখন সূরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত নাজিল হয়
৩. জিবরাইল আ. রমজানের প্রতি রাতে এসে রাসূলুল্লাহ সা.-কে কোরআন শিখাতেন আর তিনিও তাকে পূর্ণ কোরআন শুনিয়ে দিতেনএ ব্যাপারটি রমজান মাসে কোরআন খতমের বৈধতাকে প্রমাণ করেতাছাড়া কোরআন খতম সারা বছরেই গুরুত্বপূর্ণ মোস্তাহাবতবে, রমজানে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়
প্রথমত : কোরআনের মর্যাদা, ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য
কোরআনুল কারীমের মর্যাদা, ফজিলত, অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনেই অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে, যেমনি এ প্রসঙ্গে বহু হাদিস রয়েছেকতক এখানে তুলে ধরা হল
(১) কোরআন বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তাবারাকা ও তাআলার কালামতিনি তা স্বীয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর রূহুল আমীন জিবরাইল আ.-এর মাধ্যমে অবতীর্ণ করেছেনআল্লাহ তাআলা বলেন :-
وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ (التوبة :6)
মুশরিকদের কেউ যদি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, আপনি তাকে আশ্রয় দিয়ে দিন, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়
(২) কোরআন মানবতার জন্য দিক-নির্দেশনা ও আলোকবর্তিকা তাদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট পথ-পানে পথ-নির্দেশ করেআল্লাহ বলেন-
إِنَّ هَذَا الْقُرْآَنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ.(الإسراء:9)
নিশ্চয় এ কোরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক
কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি যত সমস্যার সম্মুখীন হবে, তাদের যা যা প্রয়োজন হবে সকল বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে এ কোরআনে, আল্লাহ বলেন -
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ.( النحل:89)
এবং আমি আপনার প্রতি এমন কিতাব নাজিল করেছি যা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনাহেদায়াত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ। (সূরা নাহল : ৮৯)
৩. মহান আল্লাহ তাআলা এর নাম দিয়েছেন ফোরকান, (পার্থক্যকারী) যা হালাল-হারাম, হেদায়াত-গোমরাহি এবং হক ও বাতেলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে
৪. কোরআনুল কারীম আমাদের পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলী, পরবর্তীদের সংবাদ, মোমিনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ এবং কফেরদের জন্য জাহান্নামের দু:সংবাদের বর্ণনায় পরিপূর্ণবর্ণিত সকল বিষয়ের বর্ণনায় এটি ততোধিক সত্য বক্তব্য প্রদানকারীআল্লাহ তাআলা বলেন -

وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا. (الأنعام : 115)
অর্থ: আপনার প্রতিপালকের বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুষম
৫. আল কোরআন বিশ্ববাসী সকলের জন্য রহমতসে গাফেল হৃদয়কে জাগ্রত ও সক্রিয় করে, অন্তরকে শিরক-নিফাক এবং শরীরকে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে সুস্থ করে তোলেযেমন এ কথা সূরা ফাতেহা ও সূরা নাস, ফালাক ইত্যাদির ক্ষেত্রে সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেআল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ. (يونس:57)
হে মানবকুল ! তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়াত ও রহমত মোমিনদের জন্যতাই দেখা যায় কোরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে অন্তর প্রশান্ত হয়দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়আল্লাহ বলেন -
الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ.( الرعد:28)
যারা ঈমান আনে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করেজেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়
কোরআনুল কারীম খুবই বরকতময়তার উপকারিতা সু-বিশাল, মানবকুল কোরআনের মাধ্যমে দুনিয়া আখেরাত-উভয় জগতের কল্যাণ ও উন্নতি লাভ করতে পারে, এরশাদ হচ্ছে :
فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى ﴿123﴾ وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى﴾ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا﴾ قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آَيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى﴾(طه-123-126)
এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হেদায়াত আসে, তখন যে আমার বর্ণিত পথ অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে নাএবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ করে উত্থিত করবসে বলবে, হে আমার পালন-কর্তা ! আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমিতো চক্ষুষ্মান ছিলামআল্লাহ বললেন-এমনিভাবে তোমার কাছ আমার আয়াত সমূহ এসেছিলঅত:পর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলেতেমনি করে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল (সূরা ত্বহা: ১২৩-১২৬)
৭. আলকোরআনুল এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিতাব যা আল্লাহ তাআলার সংরক্ষণে সংরক্ষিতআল্লাহ বলেন :
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ:(الحجر-9)
নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব
৮. কোরআনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, যে ব্যক্তি এটি বুঝার ও অনুধাবন করার চেষ্টা করে, সে তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে, হৃদয়ে নাড়া দেয় অন্তরকে মার্জিত ও পরিশীলিত করেআত্মাকে করে সংশোধিতমানুষকে নেক আমলের প্রতি উৎসাহী করে তোলেতার প্রভাব ও আছর শুধু মানবকুল পর্যন্তই সীমিত নয় ; বরং একে যদি খুব মজবুত ও শক্ত পাহাড়ে অবতীর্ণ করানো হত তাহলে অবশ্যই সেটি কেঁপে উঠতএ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :
َوْأَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآَنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُتَصَدِّعًا مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ﴾ (سورة الحشر:21 )
যদি আমি এ কোরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম তবে আপনি দেখতে পেতেন যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তাআলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে, আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা হাশর : ২১)
৯. কোরআন এ উম্মতের জন্য উপদেশ ও সম্মানের বস্তুএরশাদ হচ্ছে :
وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَكَ وَلِقَوْمِكَ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ. (الزخرف : 44)
কোরআন তো আপনার ও আপনার জাতির জন্য সম্মানের বস্তু অবশ্যই এ বিষয়ে সত্ত্বর জিজ্ঞাসিত হবেন। (সূরা যুখরুফ : ৪৪)
১০. সালাতের মত গুরুত্বপূর্ণ আমল কোরআনের সূরা ফাতেহা পড়া ব্যতীত সহীহ-শুদ্ধ হয় নারাসূলুল্লাহ সা. বলেন :
لاصلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب. (متفق عليه)
যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে না তার সালাতই হয় না। (বোখারি ও মুসলিম)
(১১) যারা হেদায়াত প্রত্যাশা করে এবং এর জন্য চেষ্টা করে, মহান আল্লাহ তাআলা তাদের উদ্দেশ্যে কোরআনের তিলাওয়াত, বুঝা, হিফয করা, এর বিষয় বস্তু গভীরভাবে চিন্তা করে হৃদয়ংগম করা ও তার নির্দেশ অনুযায়ী আমল করা খুব সহজ করে দিয়েছেনআল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (القمر:17)
এবং আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝা ও উপদেশ গ্রহণের জন্যকোন চিন্তাশীল উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? (সূরা কমর : ১৭)
সুতরাং, কোরআন আল্লাহ তাআলার একটি বিশাল নেয়ামত ও বিশেষ অনুগ্রহতাই আমাদের সকলের এ কোরআন পেয়ে আনন্দিত হওয়া এবং সদা আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিতআল্লাহ তাআলা বলেছেন-
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ. (يونس:58)
বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবাণীতেসুতরাং এরই প্রতি তাদের আনন্দিত ও সন্তুষ্ট হওয়া উচিততারা যা সঞ্চয় করছে তা অপেক্ষা এটিই অতি উত্তম। (সূরা ইউনুস : ৫৮)
দ্বিতীয়ত : কোরআনুল কারীমের মূল্যায়ন ও গুরুত্ব প্রদান :
পৃথিবীতে অনেক মুসলমান আছেন, যারা তার পক্ষে যতটুকু সহজ ততটুকু শুধুমাত্র তিলাওয়াতকেই কোরআনের যথাযথ হক আদায় ও মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করেনতাদের সম্পর্কে ইমাম হাসান বসরী রহ. চমৎকার বলেছেন -
نزل القرآن ليعمل به فاتخذوا تلاوته عملا.
কুরআন-তদনুযায়ী-আমল করার জন্য অবতীর্ণ হল আর লোকেরা শুধু তিলাওয়াতকেই আমল বানিয়ে বসে আছে
সুতরাং, শুধু তিলাওয়াতই কোরআনের হক আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং যথাযথ মূল্যায়নের জন্য তিলাওয়াতের পাশাপাশি একে বুঝতে হবে-বুঝার চেষ্টা করতে হবে, হিফয করতে হবে, বর্ণিত বিষয়াদিতে চিন্তা গবেষণা করতে হবে, তদনুযায়ী আমল করতে হবে, শাসন, বিচার ও বিরোধ-মীমাংসার জন্য তার শরণাপন্ন হতে হবেকিন্তু, দু:খজনক ব্যাপার হল লোকেরা এর তিলাওয়াতকেই যথাযথ মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করছে এর চেয়েও দু:খজনক হচ্ছে-যারা তিলাওয়াতকে যথেষ্ট মনে করছে তাদের অধিকাংশ এ তিলাওয়াতের ব্যাপারে অবহেলা-উপেক্ষা করছে :
و لا حول ولا قوة إلا بالله العلي العظيم.

বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে যায় অথচ পূর্ণ বৎসরে একবারও কোরআন খতম করতে পারে নাএকটিমাত্র সূরাও মুখস্থ করে নারমজান মাস, যখন সকল মুসলমান পূর্ণোদ্দমে কোরআন অধ্যয়নসহ সকল ইসলামি কর্মকাণ্ড সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করে, তখনও কিছু মুসলমানকে আপনি দেখতে পাবেন, যারা এর তিলাওয়াত থেকে দূরে, এ বরকতময় মাসেও এর খতম পূর্ণ করার জন্য চেষ্টা করে না
কোরআনুল কারীমের মূল্যায়নের দিক সমূহ :
১. তিলাওয়াত করা :
তিলাওয়াতের ফজিলত :—
(১) কোরআনুল কারীমের যথাযথ তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসাআল্লাহ তাআলা বলেন -
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ ﴿29﴾ لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ ﴿30﴾ (فاطر : 29)
যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসা আশা করে, যাতে কখনও লোকসান হবে নাপরিণামে তাদেরকে আল্লাহ তাদের সওয়াব পুরোপুরি দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি দেবেননিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল মূল্যায়নকারী (সুরা-ফাতির-২৯-৩০)
(২) কোরআন তিলাওয়াতকারী প্রত্যেক অক্ষরের পরিবর্তে একটি করে নেকি লাভ করেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন -
من قرأ حرفا من كتاب الله فله حسنة، والحسنة بعشر أمثالها، لا أقول : (الم) حرف، ولكن ألف حرف، ولام حرف، وميم حرف. (رواه الترمذي)
যে ব্যক্তি কোরআন শরীফ থেকে একটি অক্ষর তিলাওয়াত করবে তাকে একটি নেকি দেয়া হবেউক্ত এক নেকি হবে দশ নেকির সমতুল্যআমি একথা বলি না যে الم একটি অক্ষর বরং الف একটি অক্ষর لام একটি অক্ষর ميم একটি অক্ষর। (الم তিলাওয়াত করলে ন্যূনতম ত্রিশটি নেকি প্রাপ্ত হবে) (তিরমিজি)
(৩) কোরআন তিলাওয়াতকারী ভিতর বাহির উভয় দিক থেকে উত্তম-উৎকৃষ্টরাসূলুল্লাহ সা. বলেন -
مثل المؤمن الذي يقرأ القرآن مثل الأترجة: ريحها طيب، وطعمها طيب، ومثل المؤمن الذي لا يقرأ القرآن كمثل التمرة: لا ريح لها وطعمها حلو، ومثل المنافق الذي يقرأ القرآن كمثل الريحانة: ريحها طيب وطعمها مر، ومثل المنافق الذي لا يقرأ القرآن كمثل الحنظلة: ليس لها ريح، وطعمها مر.(متفق عليه)
যে মোমিন কোরআন তিলাওয়াত করে সে জামীর সদৃশ যার সুগন্ধি বড় চমৎকার এবং স্বাদও সুমিষ্টআর যে মোমিন কোরআন তিলাওয়াত করে না সে খেজুর সমতুল্যযার গন্ধ নেই, কিন্তু স্বাদ বড় মিষ্টআর যে মুনাফেক কোরআন পাঠ করে সে রাইহান ফলের মত যার সুগন্ধি চমৎকার কিন্তু স্বাদ বড়ই তিক্তআর যে মুনাফেক কোরআন পড়ে না সে হানযালা বা কেদাঁ ফলের সমতুল্য যার কোন ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত (বোখারি মুসলিম)
৪. কোরআন পাঠে সাকীনা (বিশেষ রহমত) অবতীর্ণ হয়
عن البراء بن عازب رضي الله عنه قال: كان رجل يقرأ سورة الكهف وعنده فرس مربوط بشطنين (بحبلين) فتغشته سحابة، فجعلت تدنو، وجعل فرسه ينفر منها، فلما أصبح أتى النبي صلى الله عليه وسلم فذكر ذلك له، فقال: (تلك السكينة تنـزلت للقرآن). (متفق عليه)
সাহাবি বারা ইবনে আযেব রা. বর্ণনা করেছেন-জনৈক সাহাবি সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিলেনতার নিকট রশি দিয়ে বাঁধা একটি ঘোড়া ছিলঅল্প সময়ের মধ্যেই একটি জলধর তাকে ঢেকে নিল এবং ক্রমেই সেটি কাছে আসছিল আর ঘোড়া ছোটাছুটি করছিলসকাল হলে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেনশুনে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন সেটি সাকীনা (এক প্রকার বিশেষ রহমত যা দ্বারা অন্তরের প্রশান্তি লাভ হয়) কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াতের কারণে অবতীর্ণ হয়েছে। (বুখারী, মুসলিম)
(৫) কোরআনের একটি আয়াত (পাঠ করা বা শিক্ষা দেয়া) উটের মালিক হওয়া অপেক্ষা উত্তম
قال صلى الله عليه وسلم: أفلا يغدو أحدكم إلى المسجد فيعلم أو يقرأ آيتين من كتاب الله عز وجل خير له من ناقتين، وثلاث خير له من ثلاث، وأربع خير له من أربع، ومن أعدادهن من الإبل). (رواه مسلم )
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন :-তোমাদের কেউ কেন সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কোরআন হতে দুটি আয়াত পড়ে না বা শিক্ষা দেয় না ? তাহলে সেটি তার জন্য দুটি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম হবেতিনটি আয়াত তিনটি উট অপেক্ষা উত্তমচারটি আয়ত চার উট অপেক্ষা উত্তমঅনুরূপ আয়াতের সংখ্যা অনুপাতে উটের সংখ্যা অপেক্ষা উত্তম (মুসলিম)
৬. কোরআনুল কারীম নিয়মিত তিলাওয়াতকারী ও তদনুযায়ী আমলকারীর পক্ষে কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে
قال صلى الله عليه وسلم : إقرؤوا القرآن، فإنه يأتي يوم القيامة شفيعا لأصحابه. (رواه مسلم)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-তোমরা কোরআন তিলাওয়াত কর, কেননা, কোরআন কিয়ামতের দিবসে তিলাওয়াত ও আমলকারীর জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে। (মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
يؤتى يوم القيمة بالقرآن وأهله الذين كانوا يعملون به في الدنيا، تقدمه سورة البقرة وآل عمران تحاجان عن صاحبهما. (رواه مسلم)
কেয়ামতের দিন কোরআন এবং পৃথিবীতে কোরআনের মর্মানুযায়ী আমলকারীদেরকে এমতাবস্থায় উপস্থিত করা হবে সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরান আগে আগে চলবে এবং এদের তিলাওয়াত ও আমলকারীদের জন্য সুপারিশ করতে থাকবে। (মুসলিম)
৭. কোরআনের পাঠক ও আমলকারী দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে-
قال صلى الله عليه وسلم: خيركم من تعلم القرآن وعلمه. (رواه البخاري)
যে কোরআন শিখে ও শিক্ষা দেয় সে তোমাদের শ্রেষ্ঠতর (বোখারী)
কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি সাহাবাদের আগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয় তিলাওয়াতের মর্যাদা জানার পর তাদের কেউ কেউ সব সময়ের জন্য সারারাত না ঘুমিয়ে কোরআন তিলাওয়াতে কাটিয়ে দেয়ার সংকল্প করেছিলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত সংকল্প সম্পর্কে জেনে এরূপ না করার পরামর্শ দিয়ে বললেন বরং প্রতি সাত দিনে একবার করে খতম করতে পারতাইতো দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই প্রতি সাত দিনে একবার করে খতম করতেন
তিলাওয়াতের প্রতি তাদের এরূপ যত্নশীল হওয়া সত্ত্বেও যদি কখনো কেউ অন্য কাজে ব্যস্ততা হেতু বা ঘুমের কারণে রাতে পড়তে না পারতেন তাহলে পরদিন সে অংশটুকু অবশ্যই পড়ে নিতেন
قال صلى الله عليه وسلم : من نام عن حزبه أو عن شيء منه ، فقرأه فيما بين صلاة الفجر وصلاة الظهر كتب له كأنما قرأه من الليل. (رواه مسلم)
যে ব্যক্তি স্বীয় নির্ধারিত অংশ বা তার অংশ বিশেষ রাতে না পড়েই ঘুমিয়ে যায় অত:পর পরদিন ফজর ও জোহরের মধ্যবর্তী সময়ে পড়ে নেয়তাহলে রাতে পড়া হয়েছে ধরেই আল্লাহর নিকট নির্বাচিত হবেমুসলিম
আবার তাদের কেউ কেউ প্রতি দিনে একবার করে খতম করতেন রমজান মাস আসলে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাদের চেষ্টা ও পরিশ্রম আরো বেড়ে যেত রমজানে সালাতের মধ্যে এবং অন্য সময় তিলাওয়াতের জন্য তারা কঠোর পরিশ্রম করতেন
ইমাম বোখারি রহ. বলতেন :
إذا دخل رمضان فإنما هو تلاوة القرآن وإطعام الطعام.
যখন রমজান আসবে তখন সেটি হবে একমাত্র কোরআন তিলাওয়াত ও অপরকে খাওয়ানোর মাস
ইমাম মালেক রহ. রমজান আসলে হাদিসের অধ্যয়ন, ইলম শিক্ষার আসরসহ যাবতীয় কাজ ছেড়ে দিয়ে (রাতদিন শুধু) মাসহাফ থেকে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি বেশি মনোযোগী হতেনএর অর্থ এই নয় যে, শুধু চিন্তা ও গবেষণার দিক ও তিলাওয়াতের হক প্রদানকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু তিলাওয়াতের প্রতিই গুরুত্ব দেয়া হবেবরং অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায় বা অক্ষর অস্পষ্ট থাকে এমন করে খুব দ্রুত বেগে তিলাওয়াত করার অনুমতি নেইকালামুল্লাহ শরীফ তিলাওয়াতের অনেক আদব আছে তিলাওয়াতকালে সে গুলোর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা খুবই জরুরি

No comments:

Post a Comment