শয়তানের প্রবেশপথ (পর্ব:২)
লেখক : নুমান বিন আবুল বাশার সময় ক্ষেপণ ও মিথ্যা আশ্বাস প্রদান- শয়তান মানুষকে এমনভাবে আশ্বস্ত করে যে, তার জীবন অনেক দীর্ঘ এবং তার কাছে সৎকর্ম ও তওবা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তাই সে যখন নামাজ পড়ার ইচ্ছা পোষণ করে শয়তান তাকে বলে, তুমি তো এখনও সেই ছোট রয়ে গেছ, যখন বড় হবে নামাজ পড়বে। এবং যখন আত্মশুদ্ধিকারী ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি করতে চায় শয়তান তাকে বলে এটাতো তোমার প্রথম মওসুম : আগামী বৎসরের জন্যে তুমি অপেক্ষা কর। আর যখন কোন মানুষ কোরআন পড়তে চায় শয়তান তাকে বলে তুমি সন্ধ্যায় পড়বে। এবং সন্ধ্যা হলে বলে তুমি আগামীকাল পড়বে। এবং আগামীকাল বলে তুমি পরশু পড়বে, এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত অপরাধকারী তার পাপের ওপর অবশিষ্ট থাকবে। আর এই প্রক্রিয়ায় শয়তান কিছু কাফেরকে ইসলাম থেকে নিবৃত্ত করে রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন— إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ. ﴿محمد : ২৫﴾ ‘যাদের কাছে হেদায়াতের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরও তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান এদের মন্দ কাজগুলো (ভালো লেবাস দিয়ে) শোভনীয় করে পেশ করে এবং তাদের জন্যে নানা মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে রাখে। তাই বলা হয়, এর অর্থ হচ্ছে শয়তান তাদের উদ্দেশ্যে আশাকে সম্প্রসারিত করেছে এবং তাদেরকে দীর্ঘায়ুর প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এছাড়া ভিন্ন অর্থের মতও রয়েছে। কতক ঊলামায়ে কেরাম বলেছেন— أنذركم سوف فإنها أكبر جنود إبليس. تلبيس إبليس لابن الجوزي ص (৩৯০). আমি তোমাদেরকে ‘সাওফা’ তথা ‘এই করছি’, ‘এখনও সময় আছে’, ‘ভবিষ্যতে করব’, ‘কিছুটা ঝামেলা মুক্ত হয়েই করা শুরু করব।’ এমন সব ভবিষ্যৎ অর্থবোধক শব্দ হতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এবং এই অভিন্ন আচরণ করে থাকে যখন তারা আনুগত্য প্রদর্শন করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল বলেন— يعقد الشيطان على قافية رأس أحدكم إذا هو نام ثلاث عقد، يضرب كل عقدة عليك ليل طويل فارقد، فإن استيقظ فذكر الله انحلت عقدة، فإن توضأ انحلت عقدة، فإن صلى انحلت عقدة فأصبح نشيطا طيب النفس، وإلا أصبح خبيث النفس كسلان. যখন তোমাদের কেউ ঘুমায়, শয়তান তার মাথায় তিনটি গিঁট দেয়। সারারাত ব্যাপী প্রতিটি গিঁট দিয়ে রাখে। অত:পর সে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অত:পর যখন মানুষ ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর স্মরণ করে একটি গিঁট খুলে যায়। তারপর যখন সে নামাজ পড়ে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। অত:পর সে উদ্যম ও প্রাণবন্ত মন নিয়ে সকাল কাটায়। আরযদি এমনটি না করে তবে সে নিরানন্দ, উদ্যমহীন অলস সকাল কাটায়। এ কারণেই উল্লিখিত হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী সা. আগে আগে ঘুম থেকে জাগা এবং জিকির ও নামাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। ঐ দুই ব্যক্তির অবস্থা কতইনা সুন্দর যাদের সম্পর্কে রাসূল এভাবে আলোচনা করেছেন— عجب ربنا عزوجل من رجلين : رجل ثار عن وطائه ولحافه، من بين أهله وحيه إلى صلاته، فيقول ربنا: أيا ملائكتي، انظروا إلى عبدي، ثار من فراشه ووطائه، ومن بين حيه وأهله إلى صلاته، رغبة فيما عندي، وشفقة مما عندي. ورجل غزا في سبيل الله عز وجل...(المسند:১/৪১৬، وابن حبان(الإحسان ৬/২৯৭) وحسن المحقق إسناده. আমাদের প্রভু দুই রকম ব্যক্তি দ্বারা আনন্দিত বোধ করেন। ঐ ব্যক্তি যে তার শয্যা-বাস ও চাদর ছেড়ে এবং পরিবার-পরিজন ও মহল্লা মধ্য থেকে নামাজের দিকে ধাবিত হয়েছে। অত:পর তা দেখে আমাদের প্রভু বলবেন, হে আমার ফেরেশতারা ! তোমরা আমার বান্দার দিকে তাকাও সে তোর বিছানা ও শয্যা ছেড়ে এবং তার মহল্লা ও পরিবার পরিজনদের মধ্য থেকে নামাজের দিকে ধাবিত হয়েছে আমার দয়া ও অনুগ্রহের প্রত্যাশায়। আরেক ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করেছেন...। আল্লাহর আদেশের প্রতি দ্রুত সাড়া দেওয়ায় এবং আনুগত্য স্বীকার করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ায় এই বাস্তব চিত্রই আল্লাহর বাণীতে ব্যক্ত হয়েছে— وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ. ﴿آل عمران : ১৩৩﴾ ‘তোমরা তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষমা পাওয়ার কাজে প্রতিযোগিতা করো, আর সেই জান্নাতের জন্যেও (প্রতিযোগিতা করো) যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবী সমান, আর এই (বিশাল) জান্নাত প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে সে সব (ভাগ্যবান) লোকদের জন্যে, যারা আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ. ﴿الحديد : ২১﴾ (অতএব, এসব অর্থহীন প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে) তোমরা তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে সেই (প্রতিশ্র“ত) ক্ষমা ও চিরন্তন জান্নাত পাওয়ার জন্যে এগিয়ে যাও, (এমন জান্নাত) যার আয়তন আসমান জমিনের সমান প্রশস্ত, তা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে সে সব মানুষদের জন্যে যারা আল্লাহ তাআলা ও তার (পাঠানো) রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে, (মূলত) এ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার এক অনুগ্রহ। যাকে তিনি চান তাকে তিনি এ অনুগ্রহ প্রদান করেন। আর আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন মহা অনুগ্রহশীল। নবী সা. তার কিছু সাহাবাকে উপদেশ দিয়েছেন— إذا قمت في صلاتك فصل صلاة مودع তুমি নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হলে বিদায়ীর নামাজ হিসেবে পড়বে।
(৩) প্ররোচনা ও সন্দেহ সৃষ্টি :
শয়তান চেষ্টা করে মানুষকে এবাদত-আনুগত্য থেকে বাধা দিতে। অত:পর যখন সে তার আগ্রহ ও লোভ প্রত্যক্ষ করে, তখন এই লোভের দরজা দিয়ে তার কাছে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়ায় যে, সে তাকে এবাদতের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কঠোর বানিয়ে দেয়। এবং কখনো কখনো তাকে গুনাহের মাঝে নিক্ষেপ করে। আবার কখনো ভালো কাজ ছুটে যাওয়ার মাধ্যমে গুনাহে লিপ্ত করে। যেমন কোন ব্যক্তি ইসতিনজা ও ওজুর ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সে অঙ্গ সমূহকে তিনবারের অধিক ধৌত করে এবং খুব ভালো ভাবে ঘষামাজা করে, ফলে কখনো এ কারণে নামাজে বিলম্ব হয়। অথবা নামাজে ফাতেহা পাঠ, তাকবীর ও তাসবীহ সমূহ বারবার পাঠ করে, ফলে ইমামের অনুসরণ থেকে সে পিছিয়ে পড়ে। অত:পর সে এর কারণে জামাত ত্যাগ করে। অথবা তাহারাত ও সালাতের নিয়তে সে সন্দেহে পোষণ করে, তারপর সে নামাজ বা ওজু পুনরায় আদায় করে ; এভাবে তার উপর নামাজ কঠিন ও বোঝা স্বরূপ হয়ে পড়ে, এমনকি সে নামাজ ছেড়ে দেয়। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। এভাবেই কঠোরতা অবলম্বনকারীরা ধ্বংস হয়। রাসূল সা. বলেছেন— هلك المتنطعون. قالها ثلاثا. رواه مسلم (২৬৭০) চরমপন্থীরা ধ্বংস হয়েছে—তিন বার বলেছেন।
মুক্তির পথ ও উপায় মুসলমানকে শয়তানের প্রবেশ পথ সম্পর্কে জানতে হবে, এবং এও জানতে হবে এই কাজগুলো শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নয়। যে ব্যক্তি ওজুতে তিন বারের অধিক ধৌত করে তার সম্পর্কে রাসূল সা. বলেন— فمن زاد فقد أساء وتعدى وظلم. যে অতিরিক্ত করল সে মন্দ কাজ করল এবং জুলুম করল। অতএব সওয়াব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সে তিরস্কার ও দুর্ভোগের শিকার হবে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের এবাদত পালনের ক্ষেত্রে ভুল ও ত্র“টি-বিচ্যুতি ঘটতে পারে। তবে তা নিয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জায়েজ নেই। যদি তা নিছক ধারণা হয়ে থাকে বা কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে, অথবা যদি এমনটি এবাদতের পরে হয়ে থাকে। তাবে যদি মজবুত ভাবে সন্দিহান হয়ে থাকে যে, সে দুই সেজদা আদায় করেছে না এক সেজদা—এক্ষেত্রে তার কাছে যে ধারণাটি প্রাধান্য পাবে সেটাকেই গ্রহণ করবে। আর যদি কোন ধারণা প্রাধান্য না পায় তবে নিশ্চিত বিষয় তথা এক সেজদা হিসেবে আমল করবে। অত:পর দ্বিতীয় সেজদা আদায় করবে। তার নামাজের পূর্ণতা ও শয়তানের শাস্তি স্বরূপ এতটুকুই যথেষ্ট। ওয়াসওসায় আক্রান্ত ব্যক্তির এতটুকু জানা যথেষ্ট যে, নবী সা. কীভাবে ওজু ও গোসল করতেন। এবং কীভাবে আপন প্রভুর এবাদত করতেন ? তিনি এক মুদ দিয়ে ওজু করতেন। মুদ হল মধ্যম গড়নের ব্যক্তির দুই তালুর সমপরিমাণ ; এবং এক সা’ দিয়ে গোসল সারতেন। এক সা’ হল চার মুদের সমপরিমাণ। ফকিহ আলেমগণ মানুষের জন্যে বেঁচে থাকা কঠিন বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সহজ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যেমন পথ-ঘাটের কাদা যা সাধারণত নাপাক থাকে তা থেকে কাপড় ধোয়া জরুরি নয়। এমনিভাবে ঘরের ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি—যদি সেখানে না-পাকি না থাকার সম্পর্কে জানা থেকে। ইসলামের বিধান হল সহজীকরণ ও অসুবিধা দূরীকরন— يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ. ﴿البقرة : ১৮৫﴾ ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের (জীবন) আসান করে দিতে চান, আল্লাহ তাআলা কখনোই তোমাদের জন্য কঠোর করে দিতে চান না। وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ. ﴿الحج : ৭৮﴾ এবং এ জীবন বিধানের ব্যাপারে তিনি তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি। আর সর্বাধিক ক্ষতিকর ওয়াসওয়াসা ও সন্দেহ হচ্ছে যা আক্বীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাই এ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা জরুরি। রাসূল সা. বলেছেন— يأتي الشيطان أحدكم فيقول: من خلق كذا؟ من خلق كذا؟ حتى يقول: من خلق ربك؟ فإذا بلغه فليستعذ بالله ولينته. رواه البخاري (৩২৭৬)، ومسلم (১৩৪). তোমাদের কারো নিকট শয়তান এসে বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছেন ? ওটা কে সৃষ্টি করেছেন ? এভাবে এক পর্যায়ে সে জিজ্ঞাসা করে তোমার রবকে কে সৃষ্টি করেছেন ? যখন কেউ এ পর্যন্ত পৌঁছে যায় সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে এবং নিজেকে বিরত রাখবে। এসব ভাব-কল্পনা থেকে কেউই তেমন নিরাপদ নয়। সাহাবায়ে কেরাম রা.-ও এ জাতীয় কল্পনায় নিমজ্জিত হতেন। তাই তারা খুব ভয় পেতেন এবং এ বিষয়ে কোন কথাই বলতেন না। এবং তারা রাসূলের সা.-এর কাছে এ বলে অভিযোগ করতেন— إنأ نجد في أنفسنا ما يتعاظم أحدنا أن يتكلم به، قال: وقد وجدتموه؟ قالوا: نعم، قال ذاك صريح الإيمان. أخرجه مسلم(১৩২)، وفي رواية قال: الله أكبر الحمد لله الذي رد أمره إلى الوسوسوة. ابن حبان (الإحسان১৪৭)، وصحح المحقق شعيب الأرناوط إسناده. আমরা আমাদের হৃদয়ে এমন ভাব-কল্পনা অনুভব করি যা বলা আমাদের কেউ কেউ সাংঘাতিক মনে করে। তিনি বললেন, তোমরা এমন পেয়েছ ? তারা বলল হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটাই হচ্ছে সুস্পষ্ট ঈমান। ভিন্ন আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, আল্লাহু আকবার ! সকল প্রশংসা ঐ সত্তার যিনি তার বিষয়কে ওয়াসওয়াসার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।’ এসব প্ররোচনা যখন মানুষের মনকে প্রভাবিত করা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সে কথা বলবে না এটাই প্রমাণ করবে যে শয়তান তার চক্রান্তে ব্যর্থ, অসফল হয়েছে। অত:পর মানুষ যখন এই ওয়াসওয়াসাকে প্রতিহত করবে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়ার মাধ্যমে, এবং জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ও সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় ও ঈমানকে নতুন করার মাধ্যমে অথবা আল্লাহর নিকট দোয়া ও শয়তানের চক্রান্ত থেকে হেফাজত করার আবেদনের মাধ্যমে, তখন শয়তান তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং তা তার ঈমান ও সওয়াব বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পরিগণিত হবে। অতএব সমস্ত প্রশংসা মহামহিম আল্লাহর জন্য। (৪) ভুলিয়ে দেওয়া : মানুষকে ভালো কাজ ভুলিয়ে দিয়ে এবং মন্দ-কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শয়তান মানুষকে পাপে লিপ্ত করে। অথবা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভুলিয়ে অর্থহীন কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেন তাতে গুরুত্ব দিয়ে তার ওপর আমল করে। কেবল ওইসব লোকেরা প্রায়শই তাতে লিপ্ত হয় যারা শয়তানের পদক্ষেপে সাড়া দেয় ও তার বেশি আনুগত্য করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنْسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ أُولَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ. ﴿المجادلة : ১৯﴾ ‘(আসলে) শয়তান এদের ওপর পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে, শয়তান এদের আল্লাহর স্মরণ (সম্পূর্ণ) ভুলিয়ে দিয়েছে, এরা হচ্ছে শয়তানের দল, হে রাসূল তুমি জেনে রাখো, শয়তানের দলের ধ্বংস অনিবার্য।’ এইসব ব্যাধির চিকিৎসা হচ্ছে মানুষ বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ করবে এবং পাপাচার থেকে দ্রুত তাওবা করবে। কল্যাণের দিকে এগিয়ে যাবে এবং মন্দ ও অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آَيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ. ﴿الأنعام : ৬৮﴾ ‘তুমি যখন এমন লোককে দেখতে পাও যারা আমার আয়াত সমূহকে নিয়ে হাসি বিদ্রƒপ করছে, তাহলে তুমি তাদের কাছ থেকে সরে এসো, যতক্ষণ না তারা অন্য কিছু বলতে শুরু করে, যদি কখনো, শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে সেখানে বসিয়ে) রাখে, তাহলে মনে পড়ার পর জালেম সম্প্রদায়ের সাথে আর বসে থেকো না।
(৫) ভীতি প্রদর্শন : শয়তান তার কাফের ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী দল ও বাহিনী থেকে মুমিনদের ভয় দেখায়। এবং তাদেরকে নিজেদের শক্তি ও কঠোরতা বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। যেন মানুষ শয়তানের বাহিনীর আনুগত্য করেও তাদের অপছন্দ এবাদত ও আনুগত্য ছেড়ে দেয়া। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তা থেকে সতর্ক করে দিয়েছেন। إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ. ﴿آل عمران : ১৭৫﴾ ‘এই হচ্ছে তোমাদের (প্ররোচনাদানকারী) শয়তান, তারা (শত্র“পক্ষের অতিরঞ্জিত শক্তির কথা বলে) তাদের আপন জনদের ভয় দেখাচ্ছিল, তোমরা কোন অবস্থায়ই তাদের (এ হুমকিকে) ভয় করবে না, বরং আমাকেই ভয় করো, যদি তোমরা (সত্যিকার অর্থে) ঈমানদার হও। বিভিন্ন ভীতিকর স্বপ্ন ও ক্লান্তিকর চিন্তা-ভাবনা উসকে দেওয়ার মাধ্যমে এই ভয় দেখানো হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الرؤيا الصالحة من الله والحلم من الشيطان، فإذا حلم أحدكم حلما يخافه فليبصق عن يساره وليتعوذ بالله من شرها فإنها لا تضره. (رواه البخاري(৩২৯২)، ومسلم (২২৬১) وفيه أن البصق يكون ثلاثا. ‘সুন্দর ও কল্যাণময় স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে আর স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। তোমাদের কেউ যখন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে সে যেন তার বাম পার্শ্বে থু-থু নিক্ষেপ করে এবং তার অকল্যাণ হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় ফলে তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
দুশ্চিন্তায় নিক্ষেপ: শয়তান সর্বাত্মক চেষ্টা করে আদম সন্তানকে ক্ষতি ও বিপদে নিক্ষেপ করতে এবং ঐ সময়টাতে সে ঐ কাজের পরিণতি সম্পর্কে তাকে অন্ধকরে রাখে ফলে বনী আদম ঐ কাজটি করে। অত:পর যখন সে ক্ষতি গ্রস্ত হয়ে শয়তান তার থেকো মুক্ত হেয় যায়। তার পর সে কাজের ফলাফল প্রকাশ পেলে বনী আদম একাই তার দায়ভার বহন কারে। শয়তান নিজেকে দোষমুক্ত করে রাখে। كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ. فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ. ﴿الحشر : ১৭﴾ এদের (আরেকটি) তুলনা হচ্ছে শয়তানের মতো, শয়তান এসে যখন মানুষদের বলে, (প্রথমে) আল্লাহকে অস্বীকার করো, অত:পর (সত্যিই) যখন সে (আল্লাহকে) অস্বীকার করে তখন (মুহূর্তেই) সে (বোল পালটে ফেলে এবং) বলে এখন আমার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি (নিজে) সৃষ্টি লোকের মালিক আল্লাহকে ভয় করি, অত:পর (শয়তান ও তার অনুসারী) এ দু’জনের পরিণাম হবে জাহান্নাম, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে, আর এটাই হচ্ছে জালেমদের শাস্তি। মানুষের অধিকাংশ আচার-আচরণের ক্ষেত্রে এ দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। একবার মেকদাদ রা. এর ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটেছিল। তিনি এই মনে করে সমস্ত দুধ পান করে ফেললেন, নবী সা. আনসারদের নিকট পানাহার করবেন। অত:পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত বোধ করেন। মুমিন ব্যক্তি মাত্রই ধীমান, দূরদর্শী ও বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, তাই সে শয়তানের চক্রান্ত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারে। যদিও শয়তান তাকে একবার চক্রান্ত জালে নিক্ষেপ কারে, তার পর থেকে সে সম্পূর্ণ সতর্ক ও সজাগ হয়ে পায়। এ কারণেই মুস্তফা সা. বলেছেন, لا يلدغ المؤمن من جحر واحد مرتين. رواه البخاري(৬১৩৩)، ومسلم(২৯৯৮). মুমিন এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না। শয়তান মানুষকে দুশ্চিন্তায় নিক্ষেপ করার ভয় থেকেই মানুষকে তার অপর ভাইয়ের সঙ্গে চুপিসারে কথা বলা থেকে নিষেধ করা হয়েছে, যেখানে তাদের উভয়ের সঙ্গে তৃতীয় আরেকজন উপস্থিত তাকে। إذاكانوا ثلاثة فلا يتناجى اثنان دون ثالث فإن ذلك يحزنه. যখন তারা তিনজন থাকবে, তৃতীয়জনকে বাদ রেখে দু’জন কানাকানি কথাবার্তা বলবেন না, কেননা তা অপরজনকে দুশ্চিন্তায় ফেলবে। যেমন শয়তান সব সময় অব্যাহত ভাবে চেষ্টা করে কাফের ও ফাসেক ব্যক্তিদেরকে মুমিনদের দু:খ কষ্ট দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে। যেমন তারা মুমিনদের ব্যাপারে কানাঘুসার মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করে। إِنَّمَا النَّجْوَى مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَيْسَ بِضَارِّهِمْ شَيْئًا إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ. ﴿المجادلة :১০﴾ ‘(আসলে) এদের গোপন সলাপরামর্শ তো হচ্ছে একটা শয়তানি প্ররোচনা, যার একমাত্র) উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈমানদার লোকদের কষ্ট দেয়া (অথচ এরা জানে না) আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা ব্যতিরেকে তার ঈমানদারদের বিন্দুমাত্রও কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না,(তাই) ঈমানদারদের উচিত (হামেশা) আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা।) তাই মানুষের জন্য উচিত হচ্ছে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকা। এবং এমন বস্তু থেকে বিরত থাকা যা তার মুসলমান ভাইদের কষ্টের কারণ হয়। আর যখন তার ওপর এমন দুশ্চিন্তা পতিত হবে সওয়াবের আশায় সে ধৈর্য ধারণ করবে। অত:পর সে পুরস্কৃত হবে। তবে এখানে বিশেষ গুরুত্বের কথা হচ্ছে, এই দু:খ বেদনা ও দুশ্চিন্তা যেন হতাশা ও দুনিয়া আখেরাতের কাজ ত্যাগের কারণ না হয়। এবং দুনিয়ার যে প্রাপ্তি খোয়া গেছে তাতে যেন অধিক আফসোস সৃষ্টি না হয়, এবং দ্বীন থেকে যা ছুটে গেছে তার জন্য তাওবা করবে এবং তার ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করবে। যাতে একই ভুল দ্বিতীয় বার পুনরাবৃত্তি না হয়। এ বিষয়ে নবী সা.-এর দিক নির্দেশনা কতইনা সুন্দর। المؤمن القوي خير وأحب إلى الله من المؤمن الضعيف، وفي كل خير. احرص على ما ينفعك، واستعن بالله ولا تعجز، وإن أصابك شيئ فلا تقل: لو أني فعلت كان كذا وكذا، ولكن قل: قدر الله وما شاء فعل، فإن لو تفتح عمل الشيطان. رواه مسلم(২৬৬৪). ‘আল্লাহর নিকট শক্তিমান মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা অধিক উত্তম এবং সকল ভাল কাজে যা তোমার উপকারে আসবে এমন বস্তুর প্রতি লালায়িত হও। এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করও অক্ষম হয়োনা। তবে যদি কোন মুসিবত এসে যায় তাহলে বলো না, আমি যদি এমন টি করতাম তাহলে এমন হতো, বরং বলো, আল্লাহ তাআলা তাকদীরে যা রেখেছেন ও চেয়েছেন তাই করেছেন, কেননা যদি শয়তানের কাজ উন্মুক্ত করে দেয়।
(৭) প্রবৃত্তর ফেতনা সমূহ : প্রবৃত্তির অনেক ফেতনা রয়েছে। তবে সর্বাধিক কঠিন ও বিপজ্জনক হচ্ছে বিত্ত, প্রতিপত্তি ও নারীর প্রতি লোভ লালসা। সম্পদ ও খ্যাতির মোহ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন, ما ذئبان جائعان أرسلا في غنم بأفسد لها من حرص المرء على الشرف والمال لدينه. رواه الترمذي (২৩৭৬)، وصححه الألباني في صحيح الجامع(১৯৩৫). দু’টি ক্ষুধার্ত বাঘকে একটি বকরির কাছে ছেড়ে দেওয়ার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর হচ্ছে সম্পদও খ্যাতির প্রতি মানুষের লোভ লালসা, তার দ্বীনের জন্য। সম্পদের লোভ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হচ্ছে, শরিয়ত সম্মত উপায়ে ধন-সম্পদ অর্জনের আকাক্সক্ষা তবে তা হবে অন্যান্য করণীয় দায়িত্বে অবহেলা ও অলসতা ছাড়া মধ্যম পন্থায়। পাশাপাশি অর্জিত সম্পদের জাকাতসহ বিভিন্ন হক আদায়ের মাধ্যমে। ধৈর্য উদ্দেশ্যও নিজের প্রয়োজনে কার্পণ্য ও অপচয় করবে না। নারী সম্পর্কে প্রিয় নবী সা. বলেছেন, إن الدنيا حلوة حضرة، وإن الله مستخلفكم فيها فينظر كيف تعلمون، فاتقوا الدنيا، واتقوا النساء، فإن أول فتنة بني إسرائيل كانت في النساء، رواه مسلم (২৭৪২). নি:সন্দেহে দুনিয়া হচ্ছে সজীবও ভোগ্য বস্তু, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি বানাবেন, অত:পর তিনি লক্ষ্য করবেন তোমরা কেমন কাজ কর। তোমরা দুনিয়াকে ভয় করো এবং নারীকে। কেননা বনী ইসরাইলের প্রথম ফেতনা নারীদের মধ্যে ছিল। একারণেই এই ফেতনা সমূলে বন্ধ করার জন্যে শরিয়তের অনেক সতর্ক মূলক বিধান আরোপিত হয়েছে। সেই আলোকে এবং নিুমুখী রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবং একাকিত্বও মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উপরন্তু মহিলাদের প্রকাশমান হওয়া ও সৌন্দর্য প্রকাশ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা.-এর বাণী, ألا لايخلون رجل بامرأة إلا أن كان ثالهما الشيطان، رواه الترمذي (১১৭৩). وقال: هذا حديث حسن صحيح غريب، وصححه الألباني في صحيح سنن الترمذي (৯৩৬). খবরদার! কোন পুরুষ যেন কোন নারীর সঙ্গে একাকিত্বে রাত না কাটায়। তাহলে তাদের তৃতীয় জন হবে শয়তান। আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, المرأة عورة فإذا خرجت استشرفها الشيطان، رواه الترمذي (১১৭৩) وقال: هذا حديث حسن صحيح غريب، وصححه الألباني في صحيح سنن الترمذي(৯৩৬). ‘মহিলা হচ্ছে আবৃত, অত:পর সে যখন বের হয় শয়তান তাকে উঁকিঝুকি দিয়ে দেখে। মুবারকপুরী এই শব্দের অর্থ করেছেন, পুরুষদের দৃষ্টিতে তাকে সুন্দর শোভন করে পেশ করা হয়। অথবা শয়তান তাকে দেখে তার মাধ্যমে অন্যকে অথবা তাকে বিভ্রান্ত করার জন্যে।
(৮) মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি এবং একে অপরের প্রতি মন্দ-ধারণা সৃষ্টি করা। রাসূল সা. বলেছেন, إن الشيطان قد أيس أن يعبده المصلون في جزيرة العرب، ولكن في التحريش بينهم، رواه مسلم(২৮১২). শয়তান এই বিষয়ে আশা হত হয়েছে আরব উপদ্বীপে মুসল্লিরা তার উপাসনা করবে তবে তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব, সংঘাত সৃষ্টিতে নয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আরব উপদ্বীপের অধিবাসীর তার এবাদত করবে এ বিষয়ে সে হতাশ। তবে সে তাদের মধ্যে বিবাদ বিসংবাদ কৃপণতা, হিংসা, যুদ্ধ ও ফেতনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে।
No comments:
Post a Comment