কেয়ামতের ভয়াবহতা ও তারপর কি হবে?----১
বরযখের শাস্তি ও সুখ-- হে আল্লাহর বান্দা! মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় বরযখ। আর আপনি অবশ্যই জানেন যে, আখেরাতের প্রথম মনযিল হল কবর। মৃত্যু বরণ করার পরপরই মৃত ব্যক্তির উপর ছোট কিয়ামত কায়েম হয়ে যায়। মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার পর প্রতি সকালে ও প্রতি বিকালে তাকে তার ঠিকানা দেখানো হয়। যদি সে জাহান্নামী হয় তবে জাহান্নাম দেখানো হয়। যদি জান্নাতী হয়, তাহলে জান্নাত দেখানো হয়। ঈমানদারের কবরকে প্রশস্ত করে দেয়া হয়। উত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে এভাবে তাকে সুখ-শান্তিতে রাখা হয়। আর যে কাফের তার কবরকে সংকুচিত করে দেয়া হয়। হাতুরী দিয়ে পিটানো হয়। কবর থেকে উত্থিত না হওয়া পর্যন্ত এ সময়টা হল বরযখী জীবন।
মৃত্যুকালীন অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা-- আল্লাহ তাআলা বলেন :
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ ﴿99﴾ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ﴿100﴾ অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, হে আমার রব, আমাকে ফেরত পাঠান, যেন আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ কখনো নয়, এটি একটি বাক্য যা সে বলবে। যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বরযখ।” সূরা আল মুমিনূন, আয়াত ৯৯-১০০
এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পেলাম :
১- যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে তখন মানুষের চোখ খুলে যাবে। সে তখন ভাল কাজ সম্পাদন করার জন্য আরো সময় কামনা করবে। কিন্তু তাকে আর সময় দেয়া হবে না।
২- মৃত্যুর সময় এ ধরনের প্রার্থনা অনর্থক। এতে কোন ফল বয়ে আনে না।
৩- বরযখ এর প্রমাণ পাওয়া গেল।
৪- বরযখী জীবন শুরু হয় মৃত্যু থেকে আর শেষ হবে পুনরুত্থান দিবসে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ ﴿45﴾ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ ﴿46﴾ অতঃপর তাদের ষড়যন্ত্রের অশুভ পরিণাম থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন আর ফিরআউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেলল কঠিন আযাব। আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়, আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ফিরআউনের অনুসারীদেরকে কঠোরতম আযাবে প্রবেশ করাও।”(সূরা আল গাফির, আয়াত ৪৫-৪৬)
এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পেলাম :
১- মুসা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফেরাউনের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করলেন।
২- ফেরআউনের অনুসারীদের পতন হল।
৩- প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় তাদের দোযখ দেখানো হয়। এ কথা দিয়ে বরযখ ও তার শাস্তির বিষয়টি আবারও প্রমাণিত হল।
৪- কেয়ামেতর পর অপরাধীদের যে শাস্তি হবে সেটা বরযখের শাস্তির চেয়ে কঠোরতম হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে :
عن البراء بن عازب قال خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم في جنازة رجل من الأنصار فانتهينا إلى القبر ولما يلحد فجلس رسول الله صلى الله عليه وسلم وجلسنا حوله كأن على رؤوسنا الطير وفي يده عود ينكت بها في الأرض طويلا فرفع رأسه فقال أعوذ بالله من عذاب القبر قالها مرتين أو ثلاثا ثم قال إن العبد المؤمن إذا كان في انقطاع من الدنيا وإقبال من الآخرة بعث الله إليه ملائكة من السماء بيض الوجوه كأن وجوههم الشمس حتى يقعدوا منه مد البصر معهم كفن من أكفان الجنة وحنوط من حنوط الجنة ويجيء ملك الموت حتى يقعد عند رأسه فيقول أيتها النفس الطيبة اخرجي إلى مغفرة من الله ورضوان فتخرج تسيل كما تسيل القطرة[من] في السقاء فيأخذها فإذا أخذها لم يدعوها في يده طرفة عين حتى يأخذوها فيحولوها في ذلك الحنوط ثم يصعدون بها ويخرج منها كأطيب نفحة مسك وجدت على الأرض فيصعدون بها إلى السماء الدنيا فيستفتح فيفتح لها فلا يمرون بأهل سماء إلا قالوا ما هذا الروح الطيب فيقولون فلان بن فلان بأحسن أسمائه الذي كان يسمى بها في الدنيا حتى ينتهي بها إلى السماء الدنيا فيستفتحون له فيفتح له فيشيعه من كل سماء مقربوها إلى السماء التي تليها حتى ينتهي بها إلى السماء السابعة فيقول الله تعالى ذكره اكتبوا كتابه في عليين وأعيدوه إلى الأرض فإنى منها خلقتهم وفيها أعيدهم ومنها أخرجهم تارة أخرى فتعاد روحه في جسده ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان من ربك فيقول ربي الله فيقولان ما دينك فيقول ديني الإسلام فيقولان ما هذا الرجل الذي بعث فيكم فيقول هو رسول الله صلى الله عليه وسلم فيقولان له وما يدريك فيقول قرأت في كتاب الله فآمنت به وصدقت فينادي مناد من السماء أن صدق عبدي قال فذلك قوله { يثبت الله الذين آمنوا بالقول الثابت في الحياة الدنيا وفي الآخرة } فينادي مناد من السماء أن صدق عبدي فأفرشوه من الجنة وألبسوه منها وافتحوا له بابا إلى الجنة فيأتيه من روحها ومن طيبها ويفسح له في قبره مد بصره ويأتيه رجل حسن الوجه حسن الثياب طيب الريح فيقول أبشر بالذي يسرك فهذا يومك الذي كنت توعد فيقول من أنت فوجهك الوجه يجيء بالخير فيقول أنا عملك الصالح فيقول رب أقم الساعة رب أقم الساعة حتى أرجع إلى أهلي ومالي وإن العبد الفاجر أو الآخر إذا كان في انقطاع من الدنيا وإقبال من الآخرة نزل عليه من السماء ملائكة سود الوجوه معهم أكفان المسوح حتى يجلسوا منه مد البصر ويجيء ملك الموت فيجلس عند رأسه فيقول أيتها النفس الخبيثة اخرجي إلى سخط من الله وغضب فتفرق في جسده تنقطع معها العروق والعصب كما ينزع السفود من الصوف المبلول فيأخذها فإذا وقعت في يده لم يدعوها في يده طرفة عين حتى يأخذوها فيضعوها في تلك المسوح ثم يصعدوا بها ويخرج منها كأنتن ريح جيفة وجدت على الأرض فيصعدون فلا يمرون على ملأ من الملائكة إلا قالوا ما هذا الروح الخبيث قال فيقولون فلان بأقبح أسمائه التي كان يسمى بها في الدنيا حتى ينتهوا بها إلى السماء الدنيا فيستفتحون له فلا يفتح له ثم قرأ رسول الله صلى الله عليه وسلم ( لا تفتح لهم أبواب السماء ولا يدخلون الجنة حتى يلج الجمل في سم الخياط) فيقول الله تعالى ذكره اكتبوا كتابه في أسفل أرض في سجين في الأرض السفلى وأعيدوه إلى الأرض قال فتطرح روحه ثم قرأ (ومن يشرك بالله فكأنما خر من السماء فتتخطفه الطير أو تهوي به الريح في مكان سحيق) فتعاد روحه في جسده ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان له من ربك فيقول: هاه هاه لا أدري فيقولان ما دينك فيقول هاه هاه لا أدري فيقولان ما هذا الرجل الذي بعث فيكم فيقول هاه هاه لا أدري فينادي مناد من السماء أن كذب فأفرشوه من النار وألبسوه من النار وافتحوا له بابا من النار فيأتيه من حرها وسمومها ويضيق عليه قبره حتى تختلف فيه أضلاعه ويأتيه رجل قبيح الوجه قبيح الثياب منتن الريح فيقول أبشر بالذي يسوؤك هذا يومك الذي كنت توعد فيقول من أنت فوجهك الوجه يجيء بالشر فيقول أنا عملك الخبيث فيقول رب لا تقم الساعة رب لا تقم الساعة. رواه أحمد وأبو داود والحاكم وصححه الألباني في أحكام الجنائز বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, এক আনসারী ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বের হলাম। আমরা কবরের কাছে পৌছে গেলাম তখনও কবর খোড়া শেষ হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে বসলেন। আমরা তাঁর চার পাশে এমনভাবে বসে গেলাম যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছে। আর তাঁর হাতে ছিল চন্দন কাঠ যা দিয়ে তিনি মাটির উপর মৃদু পিটাচ্ছিলেন। তিনি তখন মাথা জাগালেন আর বললেন, তোমরা কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। কথাটি তিনি দু বার কিংবা তিন বার বললেন। এরপর তিনি আরো বললেন, যখন কোন ঈমানদার বান্দা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আখেরাতের দিকে যাত্রা করে তখন আকাশ থেকে তার কাছে ফেরেশতা আসে। তাদের চেহারা থাকবে সূর্যের মত উজ্জল। তাদের সাথে থাকবে জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি। তারা তার চোখ বন্ধ করা পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকবে। মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তার মাথার কাছে বসবে। সে বলবে, হে সুন্দর আত্মা! তুমি আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও তার সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। আত্মা বেরিয়ে আসবে যেমন বেড়িয়ে আসে পান-পাত্র থেকে পানির ফোটা। সে আত্মাকে গ্রহণ করে এক মুহুর্তের জন্যেও ছাড়বে না। তাকে সেই জান্নাতের কাফন পরাবে ও সুগন্ধি লাগাবে। পৃথিবিতে যে মিশক আছে সে তার চেয়ে বেশী সুগন্ধি ছড়াবে। তাকে নিয়ে তারা আসমানের দিকে যেতে থাকবে। আর ফেরেশতাদের প্রতিটি দল বলবে, কে এই পবিত্র আত্মা? তাদের প্রশ্নের উত্তরে তারা তার সুন্দর নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক অমুকের ছেলে। এমনিভাবে প্রথম আসমানে চলে যাবে। তার জন্য প্রথম আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে। এমনি করে প্রতিটি আসমান অতিক্রম করে যখন সপ্তম আসমানে যাবে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলবেন, আমার বান্দা আমলনামাটা ইল্লিয়ীনে লিখে দাও। আর আত্মাটা দুনিয়াতে তার দেহের কাছে পাঠিয়ে দাও। এরপর কবরে প্রশ্নোত্তরের জন্য দুজন ফেরেশতা আসবে। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে আমার প্রভূ আল্লাহ। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার ধর্ম কি? সে উত্তর দেবে, আমার ধর্ম ইসলাম। তারা প্রশ্ন করবে এই ব্যক্তিকে চেন, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে? সে উত্তরে বলবে, সে আল্লাহর রাসূল। তারা বলবে, তুমি কিভাবে জানলে? সে উত্তরে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পাঠ করেছি। তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তাকে সত্য বলে স্বীকার করেছি। তখন আসমান থেকে একজন আহবানকারী বলবে, আমার বান্দা অবশ্যই সত্য বলেছে। তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তার কবর থেকে জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও। জান্নাতের সুঘ্রাণ ও বাতাস আসতে থাকবে। যতদূর চোখ যায় ততদূর কবর প্রশস্ত করে দেয়া হবে। তার কাছে সুন্দর চেহারার সুন্দর পোশাক পরিহিত সুগন্ধি ছড়িয়ে এক ব্যক্তি আসবে। সে তাকে বলবে, তুমি সুসংবাদ নাও। সূখে থাকো। দুনিয়াতে এ দিনের ওয়াদা দেয়া হচ্ছিল তোমাকে। মৃত ব্যক্তি সুসংবাদ দাতা এ ব্যক্তিকে সে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার নেক আমল (সৎকর্ম)। তখন সে বলবে, হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন! হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি। আর যখন কোন কাফের দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখেরাত পানে যাত্রা করে তখন তার কাছে কালো চেহারার ফেরেশতা আগমন করে। তার সাথে থাকে চুল দ্বারা তৈরী কষ্ট দায়ক কাপর। তারা চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকে। এরপর আসে মৃত্যুর ফেরেশতা। তার মাথার কাছে বসে বলে, হে দুর্বিত্ত পাপিষ্ট আত্মা বের হয়ে আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের দিকে চলো। তখন তার দেহে প্রচন্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেমন আদ্র রেশমের ভিতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়। যখন আত্মা বের করা হয় তখন এক মুহুর্তের জন্যও ফেরেশতা তাকে ছেড়ে দেয় না। সেই কষ্টদায়ক কাপড় দিয়ে তাকে পেচিয়ে ধরে। তার লাশটি পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আত্মাটি নিয়ে যখন উপরে উঠে তখন ফেরেশতারা বলতে থাকে কে এই পাপিষ্ট আত্মা? তাদের উত্তরে তার নাম উল্লেখ করে বলা হয় অমুক, অমুকের ছেলে। প্রথম আসমানে গেলে তার জন্য দরজা খোলার অনুরোধ করা হলে দরজা খোলা হয় না। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন: لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ অর্থাৎ : তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সূঁচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে। (সূরা আরাফ, আয়াত ৪০) অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, তার আমলনামা সিজ্জীনে লিখে দাও যা সর্ব নিম্ন স্তর। এরপর তার আত্মাকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা হবে। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করেন : وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ অর্থাৎ : আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোন জায়গায় নিক্ষেপ করল। (সূরা আল হজ, আয়াত : ৩১) এরপর তার দেহে তার আত্মা চলে আসবে। দু ফেরেশতা আসবে। তাকে বসাবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারা তাকে আবার জিজ্ঞেস করবে, তোমার ধর্ম কি? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারপর জিজ্ঞেস করবে, এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল? সে উত্তর দেবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তখন আসমান থেকে এক আহবানকারী বলবে, সে মিথ্যা বলেছে। তাকে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের একটি দরজা তার জন্য খুলে দাও। জাহান্নামের তাপ ও বিষাক্ততা তার কাছে আসতে থাকবে। তার জন্য কবরকে এমন সঙ্কুচিত করে দেয়া হবে যাতে তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। তার কাছে এক ব্যক্তি আসবে যার চেহার বিদঘুটে, পোশাক নিকৃষ্ট ও দুর্গন্ধময়। সে তাকে বলবে, যে দিনের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছিলো তা আজ উপভোগ করো। সে এই বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার অসৎকর্ম। এরপর সে বলবে, হে প্রভূ! আপনি যেন কেয়ামত সংঘটিত না করেন।
বর্ণনায়: আহমদ, আবু দাউদ, হাকেম। আলবানী রহ. আহকামুল জানায়িয কিতাবে এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম :
১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সঙ্গী সাথিদের নিয়ে অন্যের দাফন-কাফনে অংশ গ্রহণ করতেন।
২- কবরের শাস্তির বিষয়টি একটি সত্য বিষয়। এটি বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।
৩- কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাওয়া সুন্নত।
৪- ঈমানদার ও বেঈমানের মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য।
৫- কবরে যাওয়ার পর ঈমানদার তার পুরস্কার ও প্রতিদান পাওয়ার জন্য কেয়ামত তাড়াতাড়ি কামনা করবে। আর বেঈমান মনে করবে কেয়ামত কায়েম হলে তাদের জাহান্নামের আজাব শুরু হয়ে যাবে। তাই তারা কেয়ামত কামনা করবে না।
৬- ওয়াজ ও নসীহতের সময় কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেছেন ও কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে রাসূলুল্লাহ সা.।
৭- কবরে ফেরেশতাদের প্রশ্ন ও তার উত্তর দেয়া একটি সত্য বিষয়। এর প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংশ।
৮- ইল্লিয়্যীন ও সিজ্জিনের পরিচয় জানা গেল। এ দুটি জান্নাত ও জাহান্নামের অংশ বিশেষ।
৯- বরযখী জীবনের সত্যতা এ হাদীস দিয়েও প্রমাণিত হল।
১০- হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি। এ কথা দ্বারা ঈমানদার ব্যক্তি সম্পদ বলতে তার নেক আমলের সওয়াব ও পুরস্কার বুঝিয়েছেন। আর ঈমানদার ব্যক্তি জান্নাতে তার পরিবার পরিজনের সাথে মিলিত হবেন। যদি তার পরিবারবর্গ ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ আর যারা ঈমান আনে এবং তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করে, আমরা তাদের সাথে তাদের সন্তানদের মিলন ঘটাব এবং তাদের কর্মের কোন অংশই কমাব না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার কামাইয়ের ব্যাপারে দায়ী থাকবে। (সূরা আত তুর, আয়াত ২১)
১১- বরযখী জীবনের সুখ ও তার শাস্তির কিছু বর্ণনা এ হাদীসের মাধ্যমে জানা গেল।
১২- হাদীসে জান কবচকারী ফেরেশতাকে মালাকুল মউত বলা হয়েছে। এর অর্থ মৃত্যুর ফেরেশতা। তার নাম কি, তা কুরআনে বা কোন সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। আমরা যে এ ফেরেশতার নাম দিয়েছি আজরাঈল এটা কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সম্ভব এটা ইহুদীদের থেকে এসেছে। তাই এ নামটি ব্যবহার করা উচিত নয়।
দুই ফেরেশতার প্রশ্নপর্ব--
হাদীসে এসেছে : عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: قال نبي الله صلى الله عليه وسلم : إن العبد إذا وضع في قبره، وتولى عنه أصحابه ، وإنه ليسمع قرع نعالهم، أتاه ملكان، فيقعدانه فيقولان : ما كنت تقول في هذا الرجل، فأما المؤمن فيقول : أشهد أنه عبد الله ورسوله، فيقال له : انظر إلى مقعدك من النار، قد أبدلك الله به مقعدا من الجنة ، فيراهما جميعاً. وأما المنافق والكافر فيقال له : ما كنت تقول في هذا الرجل ؟ فيقول : لا أدري ، كنت أقول ما يقول الناس ، فيقال : لا دريت ولا تليت ، ويضرب بمطارق من حديد ضربة ، فيصيح صيحة ، يسمعها من يليه غير الثقلين . (متفق عليه) আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মানুষকে যখন তার কবরে রাখা হয় আর তার সাথিরা চলে যায়, তখন মৃত ব্যক্তি তাদের জুতার আওয়ায শুনতে পায়। এমন সময় দু জন ফেরেশ্তা এসে তাকে বসায়। তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী ধারনা রাখতে? তখন ব্যক্তি যদি ঈমানদার হয়, সে উত্তর দেবে, আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। তাকে বলা হবে জাহান্নামে তোমার যেখানে অবস্থান ছিল সে দিকে তাকাও। আল্লাহ জাহান্নামের এ অবস্থানকে তোমার জন্য জান্নাত দিয়ে পরিবর্তন করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনে, সে উভয় অবস্থানকেই দেখবে। আর ব্যক্তি যদি মুনাফেক বা কাফের হয়, যখন তাকে প্রশ্ন করা হবে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী ধারনা রাখতে? তখন উত্তরে সে বলবে, আমি জানি না। মানুষ যা বলত আমি তাই বলতাম। তাকে ফেরেশতাদ্বয় বলবে, তুমি জানলে না ও তাকে অনুসরণ করলে না। তখন তাকে লোহার হাতুরী দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করা হয়। ফলে এমন চিৎকার দেয় যা মানুষ ও জিন ব্যতীত সকল প্রাণী শুনতে পায়।” বর্ণনায়: বুখারী ও মুসলিম
এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম :
১- মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার সাথে সাথে তার আত্মাকে তার দেহে ফিরিয়ে আনা হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব সম্পন্ন করার জন্য।
২- কোন কোন হাদীসে একটি প্রশ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণনাকারী নিজ বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য এটা করেছেন। এটা তার অধিকারের মধ্যে গণ্য। আসলে প্রশ্ন করা হবে তিনটি বিষয় সম্পর্কে। একটি বিষয় উল্লেখ করার অর্থ বাকী দুটো বিষয় অস্বীকার করা নয়।
৩- তিনটি প্রশ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে চেনা ও তার অনুসরণ সম্পর্কে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বাক্ষ্য দিয়েছে, সে প্রভূ হিসাবে আল্লাহ ও ধর্ম হিসাবে ইসলামকে স্বীকার করে নিয়েছে। তাই যে এ একটি প্রশ্নের উত্তর দেবে এর মধ্যে বাকী দুটোর উত্তর এমনিতেই এসে যাবে। ৪- মৃত্যুর পর ঈমানদারকে জাহান্নাম দেখানো হবে। সে যে কত বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে এটি তাকে বুঝাবার জন্য। ৫- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে গভীরভাবে জানতে হবে। কাফের ও মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যথাযথভাবে জানে না ও জানতে চায় না।
মুনকার ও নাকীর প্রসঙ্গ--
হাদীসে এসেছে : عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا قبر الميت ( أو قال أحدكم ) أتاه ملكان أسودان أزرقان . يقال لأحدهما : المنكر والآخر النكير . فيقولان : ما كنت تقول في هذا الرجل ؟ فيقول ما كان يقول : هو عبد الله ورسوله . أشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبده ورسوله . فيقولان : قد كنا نعلم أنك تقول هذا . ثم يفسح له في قبره سبعون ذراعا في سبعين . ثم ينور له فيه . ثم يقال له : نم . فيقول أرجع إلى أهلي فأخبرهم ؟ فيقولان : نم كنومة العروس الذي لا يوقظه إلا أحب أهله إليه ، حتى يبعثه الله من مضجعه ذلك . وإن كان منافقا قال : سمعت الناس يقولون فقلت مثله . لا أدري . فيقولان : قد كنا نعلم أنك تقول ذلك . فيقال للأرض : التئمي عليه . فتلتئم عليه . فتختلف أضلاعه . فلا يزال فيها معذبا حتى يبعثه الله من مضجعه ذلك. رواه الترمذي وقال : حديث حسن غريب وقال الألباني سنده حسن وهو على شرط مسلم، صحيح الجامع 2/236 আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন তোমাদের মধ্য হতে কোন মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়া হয় তখন কালো ও নীল বর্ণের দু জন ফেরেশতা আগমন করে। একজনের নাম মুনকার অন্যজনের নাম হল নাকীর। তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা কী বলতে? সে বলবে, সে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তখন ফেরেশতাদ্বয় বলবে, আমরা আগেই জানতাম তুমি এ উত্তরই দেবে। এরপর তার কবরকে সত্তর হাত প্রশস্ত করে দেয়া হয়। সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তাকে বলা হয়, এখন তুমি নিদ্রা যাও। সে বলবে, আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবো, তাদেরকে (আমার অবস্থা সম্পর্কে) এ সংবাদ দেব। তখন ফেরেশতাদ্বয় তাকে বলে, তুমি ঘুমাও সেই নব বধুর মত যাকে তার প্রিয়জন ব্যতীত কেহ জাগ্রত করে না। এমনিভাবে একদিন আল্লাহ তাকে জাগ্রত করবেন। আর যদি সে ব্যক্তি মুনাফেক হয়, সে উত্তর দেবে আমি তাঁর (রাসূলুল্লাহ) সম্পর্কে মানুষকে যা বলতে শুনেছি তাই বলতাম। বাস্তব অবস্থা আমি জানি না। তাকে ফেরেশ্তাদ্বয় বলবে, আমরা জানতাম, তুমি এই উত্তরই দেবে। তখন মাটিকে বলা হবে তার উপর চাপ সৃষ্টি করো। মাটি এমন চাপ সৃষ্টি করবে যে, তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। কেয়ামত সংঘটনের সময় তার উত্থান পর্যন্ত এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে। বর্ণনায়: তিরমিজী, তিনি বলেছেন হাদীসটি হাসান গরীব। আলবানী রহ. বলেছেন হাদীসটির সুত্র হাসান। হাদীসটি ইমাম মুসলিমের বিশুদ্ধতার শর্তে উত্তীর্ণ।
হাদীসটি থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম :
১- কবরে প্রশ্নকারী ফেরেশতাদের নাম ও তাদের বর্ণ আলোচনা হল।
২- ঈমানদারদের জন্য কবর প্রশস্ত করা হবে। কবরের অন্ধকার দূর করতে আলোর ব্যবস্থা করা হবে।
৩- ঈমানদার কবরের প্রশ্নোত্তর পর্বের পর পরিবারের কাছে ফিরে আসতে চাবে তার নিজের সফলতার সুসংবাদ শুনানোর জন্য ও পরিবারের লোকেরা যেন এ সফলতা অর্জনের জন্য সৎকর্ম করে সে ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য।
৪- ঈমানদার ব্যক্তি বরযখের জীবনে সুখ-নিদ্রায় বিভোর থাকবে। যখন কেয়ামত সংঘটিত হবে তখন তার নিদ্রা ভেঙ্গে যাবে ফলে সে অনেকটা বিরক্তির স্বরে বলবে :
يَا وَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ (سورة يس : 52) হায়! কে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো? (তাদের বলা হবে) এটা তো তা যার ওয়াদা পরম করুণাময় করেছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন। (সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৫২)
৫- কাফের ও মুনাফেকরা কবরে শাস্তি ভোগ করবে।
বরযখে শাস্তির কিছু দৃশ্য
হাদীসে এসেছে عن سمرة بن جندب رضي الله عنه قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم - يعني - مما يكثر أن يقول لأصحابه : ( هل رأى أحد منكم من رؤيا ) . قال : فيقص عليه من شاء الله أن يقص، وإنه قال ذات غداة : (إنه أتاني الليلة آتيان، وإنهما ابتعثاني، وإنهما قالا لي انطلق، وإني انطلقت معهما، وإنا أتينا على رجل مضطجع، وإذا آخر قائم عليه بصخرة، وإذا هو يهوي بالصخرة لرأسه فيثلغ رأسه، فيتدهده الحجر ها هنا، فيتبع الحجر فيأخذه ، فلا يرجع إليه حتى يصح رأسه كما كان ، ثم يعود عليه فيفعل به مثل ما فعل به مرة الأولى ، قال : قلت لهما : سبحان الله ما هذان ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا ، فأتينا على رجل مستلق لقفاه، وإذا آخر قائم عليه بكلوب من حديد ، وإذا هو يأتي أحد شقي وجهه فيشرشر شدقه إلى قفاه ، ومنخره إلى قفاه ، وعينه إلى قفاه - قال : وربما قال أبو رجاء : فيشق - قال : ثم يتحول إلى الجانب الآخر فيفعل به مثل ما فعل بالجانب الأول، فما يفرغ من ذلك الجانب حتى يصح ذلك الجانب كما كان ، ثم يعود عليه فيفعل مثل ما فعل المرة الأولى ، قال : قلت : سبحان الله ما هذان ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، فانطلقنا ، فأتينا على مثل التنور - قال : وأحسب أنه كان يقول - فإذا فيه لغط وأصوات ، قال : فاطلعنا فيه ، فإذا فيه رجال ونساء عراة ، وإذا هم يأتيهم لهب من أسفل منهم ، فإذا أتاهم ذلك اللهب ضوضوا ، قال : قلت لهما : ما هؤلاء ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا ، فأتينا على نهر - حسبت أنه كان يقول - أحمر مثل الدم ، وإذا في النهر رجل سابح يسبح ، وإذا على شط النهر رجل قد جمع عنده حجارة كثيرة ، وإذا ذلك السابح يسبح ما يسبح ، ثم يأتي ذلك الذي قد جمع عنده الحجارة ، فيفغر له فاه فيلقمه حجرا فينطلق يسبح ، ثم يرجع إليه كلما رجع إليه فغر له فاه فألقمه حجرا ، قال : قلت لهما : ما هذان ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا ، فأتينا على رجل كريه المرآة، كأكره ما أنت راء رجلا مرآة، فإذا عنده نار يحشها ويسعى حولها، قال : قلت لهما : ما هذا ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، فانطلقنا ، فأتينا على روضة معتمة ، فيها من كل لون الربيع، وإذا بين ظهري الروضة رجل طويل ، لا أكاد أرى رأسه طولا في السماء ، وإذا حول الرجل من أكثر ولدان رأيتهم قط ، قال : قلت لهما : ما هذا ما هؤلاء ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا فانتهينا إلى روضة عظيمة ، لم أر روضة قط أعظم منها ولا أحسن، قال : قالا لي : ارق فيها ، قال : فارتقينا فيها ، فانتهينا إلى مدينة مبنية بلبن ذهب ولبن فضة، فأتينا باب المدينة فاستفتحنا ففتح لنا فدخلناها، فتلقانا فيها رجال شطر من خلقهم كأحسن ما أنت راء ، وشطر كأقبح ما أنت راء ، قال : قالا لهم : اذهبوا فقعوا في ذلك النهر ، قال : وإذا نهر معترض يجري كأن ماءه المحض في البياض ، فذهبوا فوقعوا فيه، ثم رجعوا إلينا قد ذهب ذلك السوء عنهم، فصاروا في أحسن صورة، قال: قالا لي : هذه جنة عدن وهذاك منزلك ، قال : فسما بصري صعدا ، فإذا قصر مثل الربابة البيضاء، قال: قالا لي: هذاك منزلك ، قال : قلت لهما : بارك الله فيكما ذراني فأدخله ، قالا: أما الآن فلا، وأنت داخله، قال : قلت لهما : فإني قد رأيت منذ الليلة عجبا ، فما هذا الذي رأيت ؟ قال : قالا لي : أما إنا سنخبرك ، أما الرجل الأول الذي أتيت عليه يثلغ رأسه بالحجر، فإنه الرجل يأخذ القرآن فيرفضه وينام عن الصلاة المكتوبة ، وأما الرجل الذي أتيت عليه، يشرشر شدقه إلى قفاه، ومنخره إلى قفاه ، وعينه إلى قفاه ، فإنه الرجل يغدو من بيته ، فيكذب الكذبة تبلغ الآفاق ، وأما الرجال والنساء العراة الذين في مثل بناء التنور ، فإنهم الزناة والزواني ، وأما الرجل الذي أتيت عليه يسبح في النهر ويلقم الحجارة ، فإنه آكل الربا ، وأما الرجل الكريه المرآة ، الذي عند النار يحشها ويسعى حولها، فإنه مالك خازن جهنم ، وأما الرجل الطويل الذي في الروضة فإنه إبراهيم صلى الله عليه وسلم، وأما الولدان الذين حوله فكل مولود مات على الفطرة). قال: فقال بعض المسلمين: يا رسول الله ، وأولاد المشركين ؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (وأولاد المشركين ، وأما القوم الذين كانوا شطرا منهم حسن وشطرا منهم قبيح ، فإنهم قوم خلطوا عملا صالحا وآخر سيئاً ، تجاوز الله عنهم ) . সামুরা ইবনে জুনদুব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহু সময়ে তার সাহাবীদের বলতেন, তোমাদের কেহ কি কোন সপ্ন দেখেছে? তখন কেহ কেহ তাদের দেখা সপ্নের বিবরণ দিতেন। একদিন সকালে তিনি আমাদের বললেন, গত রাতে আমার কাছে দু জন আগন্তুক আসলো। তারা আমাকে জাগালো আর বলল, চলেন। আমি তাদের সাথে চললাম। আমরা এক ব্যক্তির কাছে আসলাম, দেখলাম সে শুয়ে আছে আর তার কাছে এক ব্যক্তি পাথর নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে পাথর দিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে ফলে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একটু পর তার মাথা ভালো হয়ে যাচ্ছে। আবার সে পাথরটি নিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে। তার মাথা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে আবার আঘাত করছে। এভাবেই চলছে। আমি তাদের বললাম, ছুবহানাল্লাহ! এ দু ব্যক্তি কে? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন। আমরা চলতে থাকলাম। অত:পর এক ব্যক্তির কাছে আসলাম, দেখলাম সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আরেক ব্যক্তি তার মাথার কাছে কুঠার নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে উলট পালট করে তার শরীর চিরছে। একবার চিৎ করছে আরেকবার উপুর করছে। যখন পিঠের দিকটা এ রকম করছে তখন সামনের দিকটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। আবার যখন সামনের দিকটায় এমন করছে তখন পিঠের দিকটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখে বললাম, ছুবহানাল্লাহ! এ দু ব্যক্তি কে? তারা বলল, আপনি সামনে চলুন। আমি তাদের সাথে চলতে থাকলাম। এসে পৌছলাম বিশাল চুলার মত একটি গর্তের কাছে। তার মধ্যে শুনলাম চিৎকার। ভিতরের দিকে তাকালাম। দেখলাম তার মধ্যে কিছু উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। তাদের নীচ থেকে আগুনে শিখা তাদের উপর আছরে পড়ে। তারা চিৎকার দিয়ে উঠে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন!সামনে চলুন!! আমি চলতে থাকলাম। আমি একটি নদীর কাছে আসলাম। নদীটির পানি রক্তের মত লাল। দেখলাম এক ব্যক্তি নদীটির মধ্যে সাতার কাটছে। নদীর তীরে এক ব্যক্তি দাড়ানো আছে। তার কাছে অনেকগুলো পাথর জমানো। যখন সে তীরের দিক আসে তখন তার মুখ খুলে যায়। মুখে একটি পাথর নিক্ষেপ করা হয় আর সে তা গিলে ফেলে। আবার সাতার কাটতে শুরু করে। আবার তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা হয়। যখনই সে তীরে ফিরে আসে তখনই তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে আর সে তা গিলে ফেলে আবার সাতার কাটতে থাকে। আমি তাদের প্রশ্ন করলাম, কারা এ দু ব্যক্তি? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন। আমরা সামনে চললাম। এমন ব্যক্তির কাছে আসলাম যাকে দেখতে খূবই খারাপ। তার মত খারাপ চেহারা লোক তুমি কখনো দেখোনি। তার কাছে আগুন আছে আর সে তাতে অনবরত ফুক দিয়ে জালিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, কে এই ব্যক্তি? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন। আমরা সামনে চললাম। এরপর আমরা একটি একটি উদ্যানে আসলাম, যেখানে আছে বিশাল বিশাল গাছ। আর আছে প্রত্যেক প্রকারের বসন্তকালীন ফুল। দেখলাম সেই উদ্যানে একজন দীর্ঘকায় মানুষ। আমি তার মত দীর্ঘ মানুষ দেখিনি। তার চতুর্পাশে দেখলাম বহু সংখ্যক শিশু-কিশোর। আমি আমার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন! সামনে চলুন!! আমরা চলতে থাকলাম। এসে পৌছলাম এমন একটি সুন্দর উদ্যানে যার মত সুন্দর উদ্যান আমি কখনো দেখিনি। আমাকে বলল, উপরের দিকে উঠুন। আমি উঠলাম। এসে পৌছলাম এমন একটি শহরে যার বাড়ীঘরগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইট দ্বারা নির্মিত। আমরা শহরের গেটে এসে পৌছলাম। দরজা খোলার জন্য বললাম। দরজা খুলে দেয়া হল। দেখলাম সেখানে কিছু মানুষ আছে যাদের শরীর অর্ধেক অংশ অত্যন্ত সুন্দর আর অর্ধেক অতি কুৎসিত। আমার সঙ্গীদ্বয় তাদের বলল, তোমরা ঐ নদীতে যাও। নদীর পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। তারা নদীতে ঝাপ দিয়ে ফিরে আসল। দেখা গেল তাদের পুরো শরীর সুন্দর হয়ে গেছে। সঙ্গীদ্বয় আমাকে বলল, এটা হল জানাতে আদন। আর ঐগুলো হল আপনার বাসস্থান। আমার দৃষ্টি উপরে উঠে গেল। আমি দেখলাম সাদা মেঘের মত শুভ্র একটি প্রাসাদ। আমাকে বলল, এটা আপনার ঘর। এরপর আমি তাদের উভয়কে বললাম, আল্লাহ তোমাদের বরকত দিন, আমাকে একটু সুযোগ দাও আমি প্রবেশ করি। তারা আমাকে বলল, এখনতো সম্ভব নয়। তবে আপনি তো সেখানে প্রবেশ করবেন। এরপর আমি তাদের উভয়কে বললাম, রাত থেকে শুরু করে আমি আশ্চর্যজনক অনেক বিষয় দেখলাম। যা দেখলাম তা কী? তারা বলল, আমরা আপনাকে এখনই বলছি। তা হল: যার মাথায় আপনি পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করতে দেখেছেন সে হল এমন ব্যক্তি যে আল কুরআন গ্রহণ করেছিলো কিন্তু পরে তা ছেড়ে দিয়েছে ও ফরজ নামাজ রেখে ঘুমিয়ে থেকেছে। আর যার মাথায় কুঠার দিয়ে আঘাত করতে দেখেছেন, সে হল এমন ব্যক্তি যে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হত আর মিথ্যা ছড়িয়ে বেড়াতো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। আর যে চুলোর মধ্যে উলঙ্গ নারী ও পুরুষ দেখেছেন তারা হল ব্যভিচারী নর নারী। আর যাকে দেখেছেন রক্ত নদীতে সাতার কাটছে সে হল সুদখোর। আর যাকে আগুন ফুকতে দেখেছেন সে হল জাহান্নামের রক্ষী। আর উদ্যানে যে দীর্ঘকায় মানুষটিকে দেখেছেন, তিনি হলেন, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, আর তার চারিদিকের শিশু-কিশোররা হল, যারা স্বভাব ধর্মের উপর শিশু অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। এ কথা বলার সময় অনেকে প্রশ্ন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুশরিকদের শিশু সন্তাদেরও কি এ অবস্থা হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মুশরিকদের শিশু সন্তানদেরও এ অবস্থা হবে। আর যে সকল মানুষকে দেখেছেন যে, তাদের কিছু অংশ কুৎসিত আর কিছু অংশ সুন্দর, তারা হল এমন মানুষ যারা সৎকর্ম করেছে আবার পাপাচারেও লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিলেন। বর্ণনায়: বুখারী। বুখারীর অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যাকে কুঠার দিয়ে মাথায় আঘাত করা হচ্ছে সে হল এমন ব্যক্তি যে মিথ্যা রচনা করত আর তা বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিত। কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। আর যার মাথায় কুঠার দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে সে হল এমন ব্যক্তি যে আল কুরআন শিখেছে আর রাত নিদ্রায় কাটিয়েছে এবং দিনে কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি। কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। হাদীসটি থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম :
১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি স্বপ্নের বিবরণ হল এ হাদীস। আমরা জানি নবী ও রাসূলদের সপ্ন আমাদের সপ্নের মত নয়। তাদের স্বপ্ন এক ধরনের অহী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ।
২- কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে, হাদীসের এ বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট হল যে, এ শাস্তিটি বরযখ জীবনের শাস্তি। কেয়ামতের পর হিসাব নিকাশ ও বিচারের পর তার চুরান্ত গন্তব্য স্থির করা হবে।
৩- আল কুরআন ধারন করে আবার তা ত্যাগ করার শাস্তি জানা গেল। আল কুরআন অধ্যায়ন করে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা না করার পরিণাম জানতে পারলাম।
৪- যে ব্যক্তি মিথ্যা খবর প্রচার করে তার শাস্তির কথা জানতে পারলাম।
৫- ব্যাভিচারী নারী ও পুরুষের শাস্তির চিত্র আমরা অনুভব করলাম।
৬- সুদ খাওয়া ও সুদী লেনদেন করার শাস্তির একটি চিত্র আমরা অবগত হলাম। ৬- যে সকল শিশু -কিশোর বয়:প্রাপ্ত হওয়ার আগেই মুত্যুবরণ করে তারা জান্নাতে থাকবে। তারা কাফের পিতা-মাতা সন্তান হলেও। কারণ প্রতিটি শিশু স্বভাবধর্ম ইসলাম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানায়। খৃষ্টান বানায় বা পৌত্তলিক হতে পথ দেখায়।
৭- যে সকল মুসলিম পাপাচার করে ও সৎকর্ম করে তারা একদিন না একদিন অবশ্যই জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেহ আল্লাহ তাআলার ক্ষমা লাভ করে শাস্তি ভোগ ব্যতীত মুক্তি পাবে। কেহ শাস্তি ভোগ করে মুক্তি পাবে। হাদীসে এসেছে عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لما عرج بي مررت بقوم لهم أظفار من نحاس يخمشون وجوههم وصدورهم ! فقلت : من هؤلاء يا جبريل ؟ قال : هؤلاء الذين يأكلون لحوم الناس ، ويقعون في أعراضهم. رواه أحمد، أبو داود وصححه الألباني في صحيح الجامع الصغير 5/51 আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন আমার প্রভূ আমাকে উর্ধ্বে আরোহন (মিরাজে গমন) করালেন তখন আমি এমন একদল মানুষ দেখলাম যাদের হাতে তামার বড় বড় নখ। এ নখ দিয়ে তারা তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষ খামচাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? সে বলল, এরা হল ঐ সকল মানুষ যারা মানুষের গোশ্ত খেত, তাদের সম্মানহানী ঘটাতো। (বর্ণনায়: আহমাদ, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ আল জামে আস সগীর কিতাবে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন)
হাদীসটি থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম :
১- মিরাজের সময়ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বরযখ, জাহান্নামের শাস্তি ও জান্নাতের কিছু চিত্র দেখানো হয়েছে।
২- মানুষের গোশ্ত খাওয়ার অর্থ হল তাদের দোষ চর্চা করা, গীবত করা, তাদের দোষ প্রচার করে সমাজে তাদের কে হেয় প্রতিপন্ন বা মানহানী করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ. (سورة الحجرات : 12)
তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্য কেউ কি নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরাতো তা অপছন্দই করে থাকো। (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত ১২)
এ আয়াতে অপরের দোষ চর্চাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। যারা এটা করে তারা মূলতঃ নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার মত নিকৃষ্ট কাজ করে। এটা এমন একটি অপরাধ যা আল্লাহ নিজে ক্ষমা করবেন না। যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে তাকে ক্ষমা না করে। এটা ইসলামী বিধানে একটি মানবাধিকার। যারা গীবত করে, অপরের দোষ চর্চা করে সমাজে তাকে অপমান করে ততারা এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। যার গীবত করা হয়েছে, যাকে অপমান করা হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে অথবা তাকে যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিয়ে দায়মুক্ত হতে হবে।
৩- অপর মানুষের মান সম্মান রক্ষা করা মুমিনদের দায়িত্ব। অন্যের মান সম্মানে আঘাত করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। অপরের গোপন দোষ প্রচার করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি হারাম। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা আদালতের কাছে সংশোধনের উদ্দেশ্যে অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বা সত্য স্বাক্ষ্য প্রদান করা নিষেধ নয়। কবরের আজাব সম্পর্কে ইমামদের বক্তব্য : শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: সালাফে সালেহীন ইমামদের মতামত হল, যখন কোন ব্যক্তি মারা যায় তখন সে সূখে থাকে অথবা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। আর এ সূখ বা শাস্তি তার আত্মা ও দেহ উভয়ে ভোগ করে থাকে। কখনো আত্মা দেহে আসে। তখন দেহ ও আত্মা উভয়ে একসাথে সুখ বা শাস্তি ভোগ করে। অত:পর কেয়ামতের দিন আত্মা শরীরের সাথে একত্র হয়ে কবর থেকে উত্থিত হবে। (মজমু আল ফাতাওয়া) ইমাম নববী রহ. বলেন: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে কবরের শাস্তি একটি সত্য বিষয়। আর এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের বহু সংখ্যক প্রমাণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়। এ বিষয়ে যথেষ্ঠ পরিমাণে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর আকল-বুদ্ধি এটাকে অসম্ভব মনে করে না। যদি কারো আকল বা জ্ঞান এটাকে অসম্ভব মনে করে তবে তাকে বুঝতে হবে, এ বিষয়ে যখন কুরআন ও হাদীসের সিদ্ধান্ত এসে গেছে তখন এটা মান্য করা অবশ্য কর্তব্য। এটা আমাদের জ্ঞানের পরিধির ভিতরে হোক বা বাহিরে, তাতে কিছু আসে যায় না। আসল কথা হল, কবরের শাস্তির বিশ্বাসটি আহলে সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্গত। খারেজী, অধিকাংশ মুতাযিলা ও মুরজিয়াদের একটি দল কবরের শাস্তির বিষয়টি অস্বীকার করে। তিনি আরো বলেন: যদি মৃত ব্যক্তির শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিংবা কোন জীব-জন্তুর পেটে চলে যায় তাহলেও কবরের শাস্তি ভোগ করা সম্ভব। যদি বলা হয়, আমরা দেখি মৃত ব্যক্তিকে কবরে যেভাবে রাখা হয়েছে সেভাবেই আছে। কখন তাকে বসানো হল আর কিভাবে তাকে শাস্তি দেয়া হল? এর উত্তরে বলা যায়, আমরা অনুভব না করলেও এটা ঘটা সম্ভব। যেমন আমাদের পাশে কোন ব্যক্তি নিদ্রায় থাকে আর সে স্বপ্নে কত খারাপ অবস্থা ভোগ করতে থাকে বা কত সুখ ভোগ করতে থাকে। অথচ আমরা তার পাশে থেকেও তার কোন কষ্ট বা সুখ অনুভব করি না বা দেখি না। এমনিভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে জিবরীল অহী নিয়ে আসতো। আর রাসূল কষ্ট করে সে অহী ধারন করতেন কিন্তু পাশে উপস্থিত সাহাবীগণ তা টের পেতেন না। (শরহু মুসলিম)
বরযখের শাস্তি ও সুখ-- হে আল্লাহর বান্দা! মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় বরযখ। আর আপনি অবশ্যই জানেন যে, আখেরাতের প্রথম মনযিল হল কবর। মৃত্যু বরণ করার পরপরই মৃত ব্যক্তির উপর ছোট কিয়ামত কায়েম হয়ে যায়। মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার পর প্রতি সকালে ও প্রতি বিকালে তাকে তার ঠিকানা দেখানো হয়। যদি সে জাহান্নামী হয় তবে জাহান্নাম দেখানো হয়। যদি জান্নাতী হয়, তাহলে জান্নাত দেখানো হয়। ঈমানদারের কবরকে প্রশস্ত করে দেয়া হয়। উত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে এভাবে তাকে সুখ-শান্তিতে রাখা হয়। আর যে কাফের তার কবরকে সংকুচিত করে দেয়া হয়। হাতুরী দিয়ে পিটানো হয়। কবর থেকে উত্থিত না হওয়া পর্যন্ত এ সময়টা হল বরযখী জীবন।
মৃত্যুকালীন অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা-- আল্লাহ তাআলা বলেন :
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ ﴿99﴾ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ﴿100﴾ অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, হে আমার রব, আমাকে ফেরত পাঠান, যেন আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ কখনো নয়, এটি একটি বাক্য যা সে বলবে। যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বরযখ।” সূরা আল মুমিনূন, আয়াত ৯৯-১০০
এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পেলাম :
১- যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে তখন মানুষের চোখ খুলে যাবে। সে তখন ভাল কাজ সম্পাদন করার জন্য আরো সময় কামনা করবে। কিন্তু তাকে আর সময় দেয়া হবে না।
২- মৃত্যুর সময় এ ধরনের প্রার্থনা অনর্থক। এতে কোন ফল বয়ে আনে না।
৩- বরযখ এর প্রমাণ পাওয়া গেল।
৪- বরযখী জীবন শুরু হয় মৃত্যু থেকে আর শেষ হবে পুনরুত্থান দিবসে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ ﴿45﴾ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ ﴿46﴾ অতঃপর তাদের ষড়যন্ত্রের অশুভ পরিণাম থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন আর ফিরআউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেলল কঠিন আযাব। আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়, আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ফিরআউনের অনুসারীদেরকে কঠোরতম আযাবে প্রবেশ করাও।”(সূরা আল গাফির, আয়াত ৪৫-৪৬)
এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পেলাম :
১- মুসা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফেরাউনের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করলেন।
২- ফেরআউনের অনুসারীদের পতন হল।
৩- প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় তাদের দোযখ দেখানো হয়। এ কথা দিয়ে বরযখ ও তার শাস্তির বিষয়টি আবারও প্রমাণিত হল।
৪- কেয়ামেতর পর অপরাধীদের যে শাস্তি হবে সেটা বরযখের শাস্তির চেয়ে কঠোরতম হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে :
عن البراء بن عازب قال خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم في جنازة رجل من الأنصار فانتهينا إلى القبر ولما يلحد فجلس رسول الله صلى الله عليه وسلم وجلسنا حوله كأن على رؤوسنا الطير وفي يده عود ينكت بها في الأرض طويلا فرفع رأسه فقال أعوذ بالله من عذاب القبر قالها مرتين أو ثلاثا ثم قال إن العبد المؤمن إذا كان في انقطاع من الدنيا وإقبال من الآخرة بعث الله إليه ملائكة من السماء بيض الوجوه كأن وجوههم الشمس حتى يقعدوا منه مد البصر معهم كفن من أكفان الجنة وحنوط من حنوط الجنة ويجيء ملك الموت حتى يقعد عند رأسه فيقول أيتها النفس الطيبة اخرجي إلى مغفرة من الله ورضوان فتخرج تسيل كما تسيل القطرة[من] في السقاء فيأخذها فإذا أخذها لم يدعوها في يده طرفة عين حتى يأخذوها فيحولوها في ذلك الحنوط ثم يصعدون بها ويخرج منها كأطيب نفحة مسك وجدت على الأرض فيصعدون بها إلى السماء الدنيا فيستفتح فيفتح لها فلا يمرون بأهل سماء إلا قالوا ما هذا الروح الطيب فيقولون فلان بن فلان بأحسن أسمائه الذي كان يسمى بها في الدنيا حتى ينتهي بها إلى السماء الدنيا فيستفتحون له فيفتح له فيشيعه من كل سماء مقربوها إلى السماء التي تليها حتى ينتهي بها إلى السماء السابعة فيقول الله تعالى ذكره اكتبوا كتابه في عليين وأعيدوه إلى الأرض فإنى منها خلقتهم وفيها أعيدهم ومنها أخرجهم تارة أخرى فتعاد روحه في جسده ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان من ربك فيقول ربي الله فيقولان ما دينك فيقول ديني الإسلام فيقولان ما هذا الرجل الذي بعث فيكم فيقول هو رسول الله صلى الله عليه وسلم فيقولان له وما يدريك فيقول قرأت في كتاب الله فآمنت به وصدقت فينادي مناد من السماء أن صدق عبدي قال فذلك قوله { يثبت الله الذين آمنوا بالقول الثابت في الحياة الدنيا وفي الآخرة } فينادي مناد من السماء أن صدق عبدي فأفرشوه من الجنة وألبسوه منها وافتحوا له بابا إلى الجنة فيأتيه من روحها ومن طيبها ويفسح له في قبره مد بصره ويأتيه رجل حسن الوجه حسن الثياب طيب الريح فيقول أبشر بالذي يسرك فهذا يومك الذي كنت توعد فيقول من أنت فوجهك الوجه يجيء بالخير فيقول أنا عملك الصالح فيقول رب أقم الساعة رب أقم الساعة حتى أرجع إلى أهلي ومالي وإن العبد الفاجر أو الآخر إذا كان في انقطاع من الدنيا وإقبال من الآخرة نزل عليه من السماء ملائكة سود الوجوه معهم أكفان المسوح حتى يجلسوا منه مد البصر ويجيء ملك الموت فيجلس عند رأسه فيقول أيتها النفس الخبيثة اخرجي إلى سخط من الله وغضب فتفرق في جسده تنقطع معها العروق والعصب كما ينزع السفود من الصوف المبلول فيأخذها فإذا وقعت في يده لم يدعوها في يده طرفة عين حتى يأخذوها فيضعوها في تلك المسوح ثم يصعدوا بها ويخرج منها كأنتن ريح جيفة وجدت على الأرض فيصعدون فلا يمرون على ملأ من الملائكة إلا قالوا ما هذا الروح الخبيث قال فيقولون فلان بأقبح أسمائه التي كان يسمى بها في الدنيا حتى ينتهوا بها إلى السماء الدنيا فيستفتحون له فلا يفتح له ثم قرأ رسول الله صلى الله عليه وسلم ( لا تفتح لهم أبواب السماء ولا يدخلون الجنة حتى يلج الجمل في سم الخياط) فيقول الله تعالى ذكره اكتبوا كتابه في أسفل أرض في سجين في الأرض السفلى وأعيدوه إلى الأرض قال فتطرح روحه ثم قرأ (ومن يشرك بالله فكأنما خر من السماء فتتخطفه الطير أو تهوي به الريح في مكان سحيق) فتعاد روحه في جسده ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان له من ربك فيقول: هاه هاه لا أدري فيقولان ما دينك فيقول هاه هاه لا أدري فيقولان ما هذا الرجل الذي بعث فيكم فيقول هاه هاه لا أدري فينادي مناد من السماء أن كذب فأفرشوه من النار وألبسوه من النار وافتحوا له بابا من النار فيأتيه من حرها وسمومها ويضيق عليه قبره حتى تختلف فيه أضلاعه ويأتيه رجل قبيح الوجه قبيح الثياب منتن الريح فيقول أبشر بالذي يسوؤك هذا يومك الذي كنت توعد فيقول من أنت فوجهك الوجه يجيء بالشر فيقول أنا عملك الخبيث فيقول رب لا تقم الساعة رب لا تقم الساعة. رواه أحمد وأبو داود والحاكم وصححه الألباني في أحكام الجنائز বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, এক আনসারী ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বের হলাম। আমরা কবরের কাছে পৌছে গেলাম তখনও কবর খোড়া শেষ হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে বসলেন। আমরা তাঁর চার পাশে এমনভাবে বসে গেলাম যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছে। আর তাঁর হাতে ছিল চন্দন কাঠ যা দিয়ে তিনি মাটির উপর মৃদু পিটাচ্ছিলেন। তিনি তখন মাথা জাগালেন আর বললেন, তোমরা কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। কথাটি তিনি দু বার কিংবা তিন বার বললেন। এরপর তিনি আরো বললেন, যখন কোন ঈমানদার বান্দা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আখেরাতের দিকে যাত্রা করে তখন আকাশ থেকে তার কাছে ফেরেশতা আসে। তাদের চেহারা থাকবে সূর্যের মত উজ্জল। তাদের সাথে থাকবে জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি। তারা তার চোখ বন্ধ করা পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকবে। মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তার মাথার কাছে বসবে। সে বলবে, হে সুন্দর আত্মা! তুমি আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও তার সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। আত্মা বেরিয়ে আসবে যেমন বেড়িয়ে আসে পান-পাত্র থেকে পানির ফোটা। সে আত্মাকে গ্রহণ করে এক মুহুর্তের জন্যেও ছাড়বে না। তাকে সেই জান্নাতের কাফন পরাবে ও সুগন্ধি লাগাবে। পৃথিবিতে যে মিশক আছে সে তার চেয়ে বেশী সুগন্ধি ছড়াবে। তাকে নিয়ে তারা আসমানের দিকে যেতে থাকবে। আর ফেরেশতাদের প্রতিটি দল বলবে, কে এই পবিত্র আত্মা? তাদের প্রশ্নের উত্তরে তারা তার সুন্দর নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক অমুকের ছেলে। এমনিভাবে প্রথম আসমানে চলে যাবে। তার জন্য প্রথম আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে। এমনি করে প্রতিটি আসমান অতিক্রম করে যখন সপ্তম আসমানে যাবে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলবেন, আমার বান্দা আমলনামাটা ইল্লিয়ীনে লিখে দাও। আর আত্মাটা দুনিয়াতে তার দেহের কাছে পাঠিয়ে দাও। এরপর কবরে প্রশ্নোত্তরের জন্য দুজন ফেরেশতা আসবে। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে আমার প্রভূ আল্লাহ। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার ধর্ম কি? সে উত্তর দেবে, আমার ধর্ম ইসলাম। তারা প্রশ্ন করবে এই ব্যক্তিকে চেন, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে? সে উত্তরে বলবে, সে আল্লাহর রাসূল। তারা বলবে, তুমি কিভাবে জানলে? সে উত্তরে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পাঠ করেছি। তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তাকে সত্য বলে স্বীকার করেছি। তখন আসমান থেকে একজন আহবানকারী বলবে, আমার বান্দা অবশ্যই সত্য বলেছে। তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তার কবর থেকে জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও। জান্নাতের সুঘ্রাণ ও বাতাস আসতে থাকবে। যতদূর চোখ যায় ততদূর কবর প্রশস্ত করে দেয়া হবে। তার কাছে সুন্দর চেহারার সুন্দর পোশাক পরিহিত সুগন্ধি ছড়িয়ে এক ব্যক্তি আসবে। সে তাকে বলবে, তুমি সুসংবাদ নাও। সূখে থাকো। দুনিয়াতে এ দিনের ওয়াদা দেয়া হচ্ছিল তোমাকে। মৃত ব্যক্তি সুসংবাদ দাতা এ ব্যক্তিকে সে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার নেক আমল (সৎকর্ম)। তখন সে বলবে, হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন! হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি। আর যখন কোন কাফের দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখেরাত পানে যাত্রা করে তখন তার কাছে কালো চেহারার ফেরেশতা আগমন করে। তার সাথে থাকে চুল দ্বারা তৈরী কষ্ট দায়ক কাপর। তারা চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকে। এরপর আসে মৃত্যুর ফেরেশতা। তার মাথার কাছে বসে বলে, হে দুর্বিত্ত পাপিষ্ট আত্মা বের হয়ে আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের দিকে চলো। তখন তার দেহে প্রচন্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেমন আদ্র রেশমের ভিতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়। যখন আত্মা বের করা হয় তখন এক মুহুর্তের জন্যও ফেরেশতা তাকে ছেড়ে দেয় না। সেই কষ্টদায়ক কাপড় দিয়ে তাকে পেচিয়ে ধরে। তার লাশটি পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আত্মাটি নিয়ে যখন উপরে উঠে তখন ফেরেশতারা বলতে থাকে কে এই পাপিষ্ট আত্মা? তাদের উত্তরে তার নাম উল্লেখ করে বলা হয় অমুক, অমুকের ছেলে। প্রথম আসমানে গেলে তার জন্য দরজা খোলার অনুরোধ করা হলে দরজা খোলা হয় না। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন: لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ অর্থাৎ : তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সূঁচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে। (সূরা আরাফ, আয়াত ৪০) অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, তার আমলনামা সিজ্জীনে লিখে দাও যা সর্ব নিম্ন স্তর। এরপর তার আত্মাকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা হবে। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করেন : وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ অর্থাৎ : আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোন জায়গায় নিক্ষেপ করল। (সূরা আল হজ, আয়াত : ৩১) এরপর তার দেহে তার আত্মা চলে আসবে। দু ফেরেশতা আসবে। তাকে বসাবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারা তাকে আবার জিজ্ঞেস করবে, তোমার ধর্ম কি? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারপর জিজ্ঞেস করবে, এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল? সে উত্তর দেবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তখন আসমান থেকে এক আহবানকারী বলবে, সে মিথ্যা বলেছে। তাকে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের একটি দরজা তার জন্য খুলে দাও। জাহান্নামের তাপ ও বিষাক্ততা তার কাছে আসতে থাকবে। তার জন্য কবরকে এমন সঙ্কুচিত করে দেয়া হবে যাতে তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। তার কাছে এক ব্যক্তি আসবে যার চেহার বিদঘুটে, পোশাক নিকৃষ্ট ও দুর্গন্ধময়। সে তাকে বলবে, যে দিনের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছিলো তা আজ উপভোগ করো। সে এই বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার অসৎকর্ম। এরপর সে বলবে, হে প্রভূ! আপনি যেন কেয়ামত সংঘটিত না করেন।
বর্ণনায়: আহমদ, আবু দাউদ, হাকেম। আলবানী রহ. আহকামুল জানায়িয কিতাবে এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম :
১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সঙ্গী সাথিদের নিয়ে অন্যের দাফন-কাফনে অংশ গ্রহণ করতেন।
২- কবরের শাস্তির বিষয়টি একটি সত্য বিষয়। এটি বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।
৩- কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাওয়া সুন্নত।
৪- ঈমানদার ও বেঈমানের মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য।
৫- কবরে যাওয়ার পর ঈমানদার তার পুরস্কার ও প্রতিদান পাওয়ার জন্য কেয়ামত তাড়াতাড়ি কামনা করবে। আর বেঈমান মনে করবে কেয়ামত কায়েম হলে তাদের জাহান্নামের আজাব শুরু হয়ে যাবে। তাই তারা কেয়ামত কামনা করবে না।
৬- ওয়াজ ও নসীহতের সময় কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেছেন ও কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে রাসূলুল্লাহ সা.।
৭- কবরে ফেরেশতাদের প্রশ্ন ও তার উত্তর দেয়া একটি সত্য বিষয়। এর প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংশ।
৮- ইল্লিয়্যীন ও সিজ্জিনের পরিচয় জানা গেল। এ দুটি জান্নাত ও জাহান্নামের অংশ বিশেষ।
৯- বরযখী জীবনের সত্যতা এ হাদীস দিয়েও প্রমাণিত হল।
১০- হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি। এ কথা দ্বারা ঈমানদার ব্যক্তি সম্পদ বলতে তার নেক আমলের সওয়াব ও পুরস্কার বুঝিয়েছেন। আর ঈমানদার ব্যক্তি জান্নাতে তার পরিবার পরিজনের সাথে মিলিত হবেন। যদি তার পরিবারবর্গ ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ আর যারা ঈমান আনে এবং তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করে, আমরা তাদের সাথে তাদের সন্তানদের মিলন ঘটাব এবং তাদের কর্মের কোন অংশই কমাব না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার কামাইয়ের ব্যাপারে দায়ী থাকবে। (সূরা আত তুর, আয়াত ২১)
১১- বরযখী জীবনের সুখ ও তার শাস্তির কিছু বর্ণনা এ হাদীসের মাধ্যমে জানা গেল।
১২- হাদীসে জান কবচকারী ফেরেশতাকে মালাকুল মউত বলা হয়েছে। এর অর্থ মৃত্যুর ফেরেশতা। তার নাম কি, তা কুরআনে বা কোন সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। আমরা যে এ ফেরেশতার নাম দিয়েছি আজরাঈল এটা কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সম্ভব এটা ইহুদীদের থেকে এসেছে। তাই এ নামটি ব্যবহার করা উচিত নয়।
দুই ফেরেশতার প্রশ্নপর্ব--
হাদীসে এসেছে : عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: قال نبي الله صلى الله عليه وسلم : إن العبد إذا وضع في قبره، وتولى عنه أصحابه ، وإنه ليسمع قرع نعالهم، أتاه ملكان، فيقعدانه فيقولان : ما كنت تقول في هذا الرجل، فأما المؤمن فيقول : أشهد أنه عبد الله ورسوله، فيقال له : انظر إلى مقعدك من النار، قد أبدلك الله به مقعدا من الجنة ، فيراهما جميعاً. وأما المنافق والكافر فيقال له : ما كنت تقول في هذا الرجل ؟ فيقول : لا أدري ، كنت أقول ما يقول الناس ، فيقال : لا دريت ولا تليت ، ويضرب بمطارق من حديد ضربة ، فيصيح صيحة ، يسمعها من يليه غير الثقلين . (متفق عليه) আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মানুষকে যখন তার কবরে রাখা হয় আর তার সাথিরা চলে যায়, তখন মৃত ব্যক্তি তাদের জুতার আওয়ায শুনতে পায়। এমন সময় দু জন ফেরেশ্তা এসে তাকে বসায়। তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী ধারনা রাখতে? তখন ব্যক্তি যদি ঈমানদার হয়, সে উত্তর দেবে, আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। তাকে বলা হবে জাহান্নামে তোমার যেখানে অবস্থান ছিল সে দিকে তাকাও। আল্লাহ জাহান্নামের এ অবস্থানকে তোমার জন্য জান্নাত দিয়ে পরিবর্তন করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনে, সে উভয় অবস্থানকেই দেখবে। আর ব্যক্তি যদি মুনাফেক বা কাফের হয়, যখন তাকে প্রশ্ন করা হবে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী ধারনা রাখতে? তখন উত্তরে সে বলবে, আমি জানি না। মানুষ যা বলত আমি তাই বলতাম। তাকে ফেরেশতাদ্বয় বলবে, তুমি জানলে না ও তাকে অনুসরণ করলে না। তখন তাকে লোহার হাতুরী দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করা হয়। ফলে এমন চিৎকার দেয় যা মানুষ ও জিন ব্যতীত সকল প্রাণী শুনতে পায়।” বর্ণনায়: বুখারী ও মুসলিম
এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম :
১- মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার সাথে সাথে তার আত্মাকে তার দেহে ফিরিয়ে আনা হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব সম্পন্ন করার জন্য।
২- কোন কোন হাদীসে একটি প্রশ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণনাকারী নিজ বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য এটা করেছেন। এটা তার অধিকারের মধ্যে গণ্য। আসলে প্রশ্ন করা হবে তিনটি বিষয় সম্পর্কে। একটি বিষয় উল্লেখ করার অর্থ বাকী দুটো বিষয় অস্বীকার করা নয়।
৩- তিনটি প্রশ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে চেনা ও তার অনুসরণ সম্পর্কে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বাক্ষ্য দিয়েছে, সে প্রভূ হিসাবে আল্লাহ ও ধর্ম হিসাবে ইসলামকে স্বীকার করে নিয়েছে। তাই যে এ একটি প্রশ্নের উত্তর দেবে এর মধ্যে বাকী দুটোর উত্তর এমনিতেই এসে যাবে। ৪- মৃত্যুর পর ঈমানদারকে জাহান্নাম দেখানো হবে। সে যে কত বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে এটি তাকে বুঝাবার জন্য। ৫- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে গভীরভাবে জানতে হবে। কাফের ও মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যথাযথভাবে জানে না ও জানতে চায় না।
মুনকার ও নাকীর প্রসঙ্গ--
হাদীসে এসেছে : عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا قبر الميت ( أو قال أحدكم ) أتاه ملكان أسودان أزرقان . يقال لأحدهما : المنكر والآخر النكير . فيقولان : ما كنت تقول في هذا الرجل ؟ فيقول ما كان يقول : هو عبد الله ورسوله . أشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبده ورسوله . فيقولان : قد كنا نعلم أنك تقول هذا . ثم يفسح له في قبره سبعون ذراعا في سبعين . ثم ينور له فيه . ثم يقال له : نم . فيقول أرجع إلى أهلي فأخبرهم ؟ فيقولان : نم كنومة العروس الذي لا يوقظه إلا أحب أهله إليه ، حتى يبعثه الله من مضجعه ذلك . وإن كان منافقا قال : سمعت الناس يقولون فقلت مثله . لا أدري . فيقولان : قد كنا نعلم أنك تقول ذلك . فيقال للأرض : التئمي عليه . فتلتئم عليه . فتختلف أضلاعه . فلا يزال فيها معذبا حتى يبعثه الله من مضجعه ذلك. رواه الترمذي وقال : حديث حسن غريب وقال الألباني سنده حسن وهو على شرط مسلم، صحيح الجامع 2/236 আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন তোমাদের মধ্য হতে কোন মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়া হয় তখন কালো ও নীল বর্ণের দু জন ফেরেশতা আগমন করে। একজনের নাম মুনকার অন্যজনের নাম হল নাকীর। তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা কী বলতে? সে বলবে, সে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তখন ফেরেশতাদ্বয় বলবে, আমরা আগেই জানতাম তুমি এ উত্তরই দেবে। এরপর তার কবরকে সত্তর হাত প্রশস্ত করে দেয়া হয়। সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তাকে বলা হয়, এখন তুমি নিদ্রা যাও। সে বলবে, আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবো, তাদেরকে (আমার অবস্থা সম্পর্কে) এ সংবাদ দেব। তখন ফেরেশতাদ্বয় তাকে বলে, তুমি ঘুমাও সেই নব বধুর মত যাকে তার প্রিয়জন ব্যতীত কেহ জাগ্রত করে না। এমনিভাবে একদিন আল্লাহ তাকে জাগ্রত করবেন। আর যদি সে ব্যক্তি মুনাফেক হয়, সে উত্তর দেবে আমি তাঁর (রাসূলুল্লাহ) সম্পর্কে মানুষকে যা বলতে শুনেছি তাই বলতাম। বাস্তব অবস্থা আমি জানি না। তাকে ফেরেশ্তাদ্বয় বলবে, আমরা জানতাম, তুমি এই উত্তরই দেবে। তখন মাটিকে বলা হবে তার উপর চাপ সৃষ্টি করো। মাটি এমন চাপ সৃষ্টি করবে যে, তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। কেয়ামত সংঘটনের সময় তার উত্থান পর্যন্ত এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে। বর্ণনায়: তিরমিজী, তিনি বলেছেন হাদীসটি হাসান গরীব। আলবানী রহ. বলেছেন হাদীসটির সুত্র হাসান। হাদীসটি ইমাম মুসলিমের বিশুদ্ধতার শর্তে উত্তীর্ণ।
হাদীসটি থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম :
১- কবরে প্রশ্নকারী ফেরেশতাদের নাম ও তাদের বর্ণ আলোচনা হল।
২- ঈমানদারদের জন্য কবর প্রশস্ত করা হবে। কবরের অন্ধকার দূর করতে আলোর ব্যবস্থা করা হবে।
৩- ঈমানদার কবরের প্রশ্নোত্তর পর্বের পর পরিবারের কাছে ফিরে আসতে চাবে তার নিজের সফলতার সুসংবাদ শুনানোর জন্য ও পরিবারের লোকেরা যেন এ সফলতা অর্জনের জন্য সৎকর্ম করে সে ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য।
৪- ঈমানদার ব্যক্তি বরযখের জীবনে সুখ-নিদ্রায় বিভোর থাকবে। যখন কেয়ামত সংঘটিত হবে তখন তার নিদ্রা ভেঙ্গে যাবে ফলে সে অনেকটা বিরক্তির স্বরে বলবে :
يَا وَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ (سورة يس : 52) হায়! কে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো? (তাদের বলা হবে) এটা তো তা যার ওয়াদা পরম করুণাময় করেছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন। (সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৫২)
৫- কাফের ও মুনাফেকরা কবরে শাস্তি ভোগ করবে।
বরযখে শাস্তির কিছু দৃশ্য
হাদীসে এসেছে عن سمرة بن جندب رضي الله عنه قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم - يعني - مما يكثر أن يقول لأصحابه : ( هل رأى أحد منكم من رؤيا ) . قال : فيقص عليه من شاء الله أن يقص، وإنه قال ذات غداة : (إنه أتاني الليلة آتيان، وإنهما ابتعثاني، وإنهما قالا لي انطلق، وإني انطلقت معهما، وإنا أتينا على رجل مضطجع، وإذا آخر قائم عليه بصخرة، وإذا هو يهوي بالصخرة لرأسه فيثلغ رأسه، فيتدهده الحجر ها هنا، فيتبع الحجر فيأخذه ، فلا يرجع إليه حتى يصح رأسه كما كان ، ثم يعود عليه فيفعل به مثل ما فعل به مرة الأولى ، قال : قلت لهما : سبحان الله ما هذان ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا ، فأتينا على رجل مستلق لقفاه، وإذا آخر قائم عليه بكلوب من حديد ، وإذا هو يأتي أحد شقي وجهه فيشرشر شدقه إلى قفاه ، ومنخره إلى قفاه ، وعينه إلى قفاه - قال : وربما قال أبو رجاء : فيشق - قال : ثم يتحول إلى الجانب الآخر فيفعل به مثل ما فعل بالجانب الأول، فما يفرغ من ذلك الجانب حتى يصح ذلك الجانب كما كان ، ثم يعود عليه فيفعل مثل ما فعل المرة الأولى ، قال : قلت : سبحان الله ما هذان ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، فانطلقنا ، فأتينا على مثل التنور - قال : وأحسب أنه كان يقول - فإذا فيه لغط وأصوات ، قال : فاطلعنا فيه ، فإذا فيه رجال ونساء عراة ، وإذا هم يأتيهم لهب من أسفل منهم ، فإذا أتاهم ذلك اللهب ضوضوا ، قال : قلت لهما : ما هؤلاء ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا ، فأتينا على نهر - حسبت أنه كان يقول - أحمر مثل الدم ، وإذا في النهر رجل سابح يسبح ، وإذا على شط النهر رجل قد جمع عنده حجارة كثيرة ، وإذا ذلك السابح يسبح ما يسبح ، ثم يأتي ذلك الذي قد جمع عنده الحجارة ، فيفغر له فاه فيلقمه حجرا فينطلق يسبح ، ثم يرجع إليه كلما رجع إليه فغر له فاه فألقمه حجرا ، قال : قلت لهما : ما هذان ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا ، فأتينا على رجل كريه المرآة، كأكره ما أنت راء رجلا مرآة، فإذا عنده نار يحشها ويسعى حولها، قال : قلت لهما : ما هذا ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، فانطلقنا ، فأتينا على روضة معتمة ، فيها من كل لون الربيع، وإذا بين ظهري الروضة رجل طويل ، لا أكاد أرى رأسه طولا في السماء ، وإذا حول الرجل من أكثر ولدان رأيتهم قط ، قال : قلت لهما : ما هذا ما هؤلاء ؟ قال : قالا لي : انطلق انطلق ، قال : فانطلقنا فانتهينا إلى روضة عظيمة ، لم أر روضة قط أعظم منها ولا أحسن، قال : قالا لي : ارق فيها ، قال : فارتقينا فيها ، فانتهينا إلى مدينة مبنية بلبن ذهب ولبن فضة، فأتينا باب المدينة فاستفتحنا ففتح لنا فدخلناها، فتلقانا فيها رجال شطر من خلقهم كأحسن ما أنت راء ، وشطر كأقبح ما أنت راء ، قال : قالا لهم : اذهبوا فقعوا في ذلك النهر ، قال : وإذا نهر معترض يجري كأن ماءه المحض في البياض ، فذهبوا فوقعوا فيه، ثم رجعوا إلينا قد ذهب ذلك السوء عنهم، فصاروا في أحسن صورة، قال: قالا لي : هذه جنة عدن وهذاك منزلك ، قال : فسما بصري صعدا ، فإذا قصر مثل الربابة البيضاء، قال: قالا لي: هذاك منزلك ، قال : قلت لهما : بارك الله فيكما ذراني فأدخله ، قالا: أما الآن فلا، وأنت داخله، قال : قلت لهما : فإني قد رأيت منذ الليلة عجبا ، فما هذا الذي رأيت ؟ قال : قالا لي : أما إنا سنخبرك ، أما الرجل الأول الذي أتيت عليه يثلغ رأسه بالحجر، فإنه الرجل يأخذ القرآن فيرفضه وينام عن الصلاة المكتوبة ، وأما الرجل الذي أتيت عليه، يشرشر شدقه إلى قفاه، ومنخره إلى قفاه ، وعينه إلى قفاه ، فإنه الرجل يغدو من بيته ، فيكذب الكذبة تبلغ الآفاق ، وأما الرجال والنساء العراة الذين في مثل بناء التنور ، فإنهم الزناة والزواني ، وأما الرجل الذي أتيت عليه يسبح في النهر ويلقم الحجارة ، فإنه آكل الربا ، وأما الرجل الكريه المرآة ، الذي عند النار يحشها ويسعى حولها، فإنه مالك خازن جهنم ، وأما الرجل الطويل الذي في الروضة فإنه إبراهيم صلى الله عليه وسلم، وأما الولدان الذين حوله فكل مولود مات على الفطرة). قال: فقال بعض المسلمين: يا رسول الله ، وأولاد المشركين ؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (وأولاد المشركين ، وأما القوم الذين كانوا شطرا منهم حسن وشطرا منهم قبيح ، فإنهم قوم خلطوا عملا صالحا وآخر سيئاً ، تجاوز الله عنهم ) . সামুরা ইবনে জুনদুব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহু সময়ে তার সাহাবীদের বলতেন, তোমাদের কেহ কি কোন সপ্ন দেখেছে? তখন কেহ কেহ তাদের দেখা সপ্নের বিবরণ দিতেন। একদিন সকালে তিনি আমাদের বললেন, গত রাতে আমার কাছে দু জন আগন্তুক আসলো। তারা আমাকে জাগালো আর বলল, চলেন। আমি তাদের সাথে চললাম। আমরা এক ব্যক্তির কাছে আসলাম, দেখলাম সে শুয়ে আছে আর তার কাছে এক ব্যক্তি পাথর নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে পাথর দিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে ফলে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একটু পর তার মাথা ভালো হয়ে যাচ্ছে। আবার সে পাথরটি নিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে। তার মাথা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে আবার আঘাত করছে। এভাবেই চলছে। আমি তাদের বললাম, ছুবহানাল্লাহ! এ দু ব্যক্তি কে? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন। আমরা চলতে থাকলাম। অত:পর এক ব্যক্তির কাছে আসলাম, দেখলাম সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আরেক ব্যক্তি তার মাথার কাছে কুঠার নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে উলট পালট করে তার শরীর চিরছে। একবার চিৎ করছে আরেকবার উপুর করছে। যখন পিঠের দিকটা এ রকম করছে তখন সামনের দিকটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। আবার যখন সামনের দিকটায় এমন করছে তখন পিঠের দিকটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখে বললাম, ছুবহানাল্লাহ! এ দু ব্যক্তি কে? তারা বলল, আপনি সামনে চলুন। আমি তাদের সাথে চলতে থাকলাম। এসে পৌছলাম বিশাল চুলার মত একটি গর্তের কাছে। তার মধ্যে শুনলাম চিৎকার। ভিতরের দিকে তাকালাম। দেখলাম তার মধ্যে কিছু উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। তাদের নীচ থেকে আগুনে শিখা তাদের উপর আছরে পড়ে। তারা চিৎকার দিয়ে উঠে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন!সামনে চলুন!! আমি চলতে থাকলাম। আমি একটি নদীর কাছে আসলাম। নদীটির পানি রক্তের মত লাল। দেখলাম এক ব্যক্তি নদীটির মধ্যে সাতার কাটছে। নদীর তীরে এক ব্যক্তি দাড়ানো আছে। তার কাছে অনেকগুলো পাথর জমানো। যখন সে তীরের দিক আসে তখন তার মুখ খুলে যায়। মুখে একটি পাথর নিক্ষেপ করা হয় আর সে তা গিলে ফেলে। আবার সাতার কাটতে শুরু করে। আবার তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা হয়। যখনই সে তীরে ফিরে আসে তখনই তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে আর সে তা গিলে ফেলে আবার সাতার কাটতে থাকে। আমি তাদের প্রশ্ন করলাম, কারা এ দু ব্যক্তি? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন। আমরা সামনে চললাম। এমন ব্যক্তির কাছে আসলাম যাকে দেখতে খূবই খারাপ। তার মত খারাপ চেহারা লোক তুমি কখনো দেখোনি। তার কাছে আগুন আছে আর সে তাতে অনবরত ফুক দিয়ে জালিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, কে এই ব্যক্তি? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন। আমরা সামনে চললাম। এরপর আমরা একটি একটি উদ্যানে আসলাম, যেখানে আছে বিশাল বিশাল গাছ। আর আছে প্রত্যেক প্রকারের বসন্তকালীন ফুল। দেখলাম সেই উদ্যানে একজন দীর্ঘকায় মানুষ। আমি তার মত দীর্ঘ মানুষ দেখিনি। তার চতুর্পাশে দেখলাম বহু সংখ্যক শিশু-কিশোর। আমি আমার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, সামনে চলুন! সামনে চলুন!! আমরা চলতে থাকলাম। এসে পৌছলাম এমন একটি সুন্দর উদ্যানে যার মত সুন্দর উদ্যান আমি কখনো দেখিনি। আমাকে বলল, উপরের দিকে উঠুন। আমি উঠলাম। এসে পৌছলাম এমন একটি শহরে যার বাড়ীঘরগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইট দ্বারা নির্মিত। আমরা শহরের গেটে এসে পৌছলাম। দরজা খোলার জন্য বললাম। দরজা খুলে দেয়া হল। দেখলাম সেখানে কিছু মানুষ আছে যাদের শরীর অর্ধেক অংশ অত্যন্ত সুন্দর আর অর্ধেক অতি কুৎসিত। আমার সঙ্গীদ্বয় তাদের বলল, তোমরা ঐ নদীতে যাও। নদীর পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। তারা নদীতে ঝাপ দিয়ে ফিরে আসল। দেখা গেল তাদের পুরো শরীর সুন্দর হয়ে গেছে। সঙ্গীদ্বয় আমাকে বলল, এটা হল জানাতে আদন। আর ঐগুলো হল আপনার বাসস্থান। আমার দৃষ্টি উপরে উঠে গেল। আমি দেখলাম সাদা মেঘের মত শুভ্র একটি প্রাসাদ। আমাকে বলল, এটা আপনার ঘর। এরপর আমি তাদের উভয়কে বললাম, আল্লাহ তোমাদের বরকত দিন, আমাকে একটু সুযোগ দাও আমি প্রবেশ করি। তারা আমাকে বলল, এখনতো সম্ভব নয়। তবে আপনি তো সেখানে প্রবেশ করবেন। এরপর আমি তাদের উভয়কে বললাম, রাত থেকে শুরু করে আমি আশ্চর্যজনক অনেক বিষয় দেখলাম। যা দেখলাম তা কী? তারা বলল, আমরা আপনাকে এখনই বলছি। তা হল: যার মাথায় আপনি পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করতে দেখেছেন সে হল এমন ব্যক্তি যে আল কুরআন গ্রহণ করেছিলো কিন্তু পরে তা ছেড়ে দিয়েছে ও ফরজ নামাজ রেখে ঘুমিয়ে থেকেছে। আর যার মাথায় কুঠার দিয়ে আঘাত করতে দেখেছেন, সে হল এমন ব্যক্তি যে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হত আর মিথ্যা ছড়িয়ে বেড়াতো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। আর যে চুলোর মধ্যে উলঙ্গ নারী ও পুরুষ দেখেছেন তারা হল ব্যভিচারী নর নারী। আর যাকে দেখেছেন রক্ত নদীতে সাতার কাটছে সে হল সুদখোর। আর যাকে আগুন ফুকতে দেখেছেন সে হল জাহান্নামের রক্ষী। আর উদ্যানে যে দীর্ঘকায় মানুষটিকে দেখেছেন, তিনি হলেন, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, আর তার চারিদিকের শিশু-কিশোররা হল, যারা স্বভাব ধর্মের উপর শিশু অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। এ কথা বলার সময় অনেকে প্রশ্ন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুশরিকদের শিশু সন্তাদেরও কি এ অবস্থা হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মুশরিকদের শিশু সন্তানদেরও এ অবস্থা হবে। আর যে সকল মানুষকে দেখেছেন যে, তাদের কিছু অংশ কুৎসিত আর কিছু অংশ সুন্দর, তারা হল এমন মানুষ যারা সৎকর্ম করেছে আবার পাপাচারেও লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিলেন। বর্ণনায়: বুখারী। বুখারীর অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যাকে কুঠার দিয়ে মাথায় আঘাত করা হচ্ছে সে হল এমন ব্যক্তি যে মিথ্যা রচনা করত আর তা বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিত। কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। আর যার মাথায় কুঠার দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে সে হল এমন ব্যক্তি যে আল কুরআন শিখেছে আর রাত নিদ্রায় কাটিয়েছে এবং দিনে কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি। কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। হাদীসটি থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম :
১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি স্বপ্নের বিবরণ হল এ হাদীস। আমরা জানি নবী ও রাসূলদের সপ্ন আমাদের সপ্নের মত নয়। তাদের স্বপ্ন এক ধরনের অহী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ।
২- কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে, হাদীসের এ বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট হল যে, এ শাস্তিটি বরযখ জীবনের শাস্তি। কেয়ামতের পর হিসাব নিকাশ ও বিচারের পর তার চুরান্ত গন্তব্য স্থির করা হবে।
৩- আল কুরআন ধারন করে আবার তা ত্যাগ করার শাস্তি জানা গেল। আল কুরআন অধ্যায়ন করে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা না করার পরিণাম জানতে পারলাম।
৪- যে ব্যক্তি মিথ্যা খবর প্রচার করে তার শাস্তির কথা জানতে পারলাম।
৫- ব্যাভিচারী নারী ও পুরুষের শাস্তির চিত্র আমরা অনুভব করলাম।
৬- সুদ খাওয়া ও সুদী লেনদেন করার শাস্তির একটি চিত্র আমরা অবগত হলাম। ৬- যে সকল শিশু -কিশোর বয়:প্রাপ্ত হওয়ার আগেই মুত্যুবরণ করে তারা জান্নাতে থাকবে। তারা কাফের পিতা-মাতা সন্তান হলেও। কারণ প্রতিটি শিশু স্বভাবধর্ম ইসলাম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানায়। খৃষ্টান বানায় বা পৌত্তলিক হতে পথ দেখায়।
৭- যে সকল মুসলিম পাপাচার করে ও সৎকর্ম করে তারা একদিন না একদিন অবশ্যই জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেহ আল্লাহ তাআলার ক্ষমা লাভ করে শাস্তি ভোগ ব্যতীত মুক্তি পাবে। কেহ শাস্তি ভোগ করে মুক্তি পাবে। হাদীসে এসেছে عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لما عرج بي مررت بقوم لهم أظفار من نحاس يخمشون وجوههم وصدورهم ! فقلت : من هؤلاء يا جبريل ؟ قال : هؤلاء الذين يأكلون لحوم الناس ، ويقعون في أعراضهم. رواه أحمد، أبو داود وصححه الألباني في صحيح الجامع الصغير 5/51 আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন আমার প্রভূ আমাকে উর্ধ্বে আরোহন (মিরাজে গমন) করালেন তখন আমি এমন একদল মানুষ দেখলাম যাদের হাতে তামার বড় বড় নখ। এ নখ দিয়ে তারা তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষ খামচাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? সে বলল, এরা হল ঐ সকল মানুষ যারা মানুষের গোশ্ত খেত, তাদের সম্মানহানী ঘটাতো। (বর্ণনায়: আহমাদ, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ আল জামে আস সগীর কিতাবে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন)
হাদীসটি থেকে আমরা যা শিখতে পারলাম :
১- মিরাজের সময়ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বরযখ, জাহান্নামের শাস্তি ও জান্নাতের কিছু চিত্র দেখানো হয়েছে।
২- মানুষের গোশ্ত খাওয়ার অর্থ হল তাদের দোষ চর্চা করা, গীবত করা, তাদের দোষ প্রচার করে সমাজে তাদের কে হেয় প্রতিপন্ন বা মানহানী করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ. (سورة الحجرات : 12)
তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্য কেউ কি নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরাতো তা অপছন্দই করে থাকো। (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত ১২)
এ আয়াতে অপরের দোষ চর্চাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। যারা এটা করে তারা মূলতঃ নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার মত নিকৃষ্ট কাজ করে। এটা এমন একটি অপরাধ যা আল্লাহ নিজে ক্ষমা করবেন না। যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে তাকে ক্ষমা না করে। এটা ইসলামী বিধানে একটি মানবাধিকার। যারা গীবত করে, অপরের দোষ চর্চা করে সমাজে তাকে অপমান করে ততারা এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। যার গীবত করা হয়েছে, যাকে অপমান করা হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে অথবা তাকে যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিয়ে দায়মুক্ত হতে হবে।
৩- অপর মানুষের মান সম্মান রক্ষা করা মুমিনদের দায়িত্ব। অন্যের মান সম্মানে আঘাত করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। অপরের গোপন দোষ প্রচার করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি হারাম। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা আদালতের কাছে সংশোধনের উদ্দেশ্যে অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বা সত্য স্বাক্ষ্য প্রদান করা নিষেধ নয়। কবরের আজাব সম্পর্কে ইমামদের বক্তব্য : শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: সালাফে সালেহীন ইমামদের মতামত হল, যখন কোন ব্যক্তি মারা যায় তখন সে সূখে থাকে অথবা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। আর এ সূখ বা শাস্তি তার আত্মা ও দেহ উভয়ে ভোগ করে থাকে। কখনো আত্মা দেহে আসে। তখন দেহ ও আত্মা উভয়ে একসাথে সুখ বা শাস্তি ভোগ করে। অত:পর কেয়ামতের দিন আত্মা শরীরের সাথে একত্র হয়ে কবর থেকে উত্থিত হবে। (মজমু আল ফাতাওয়া) ইমাম নববী রহ. বলেন: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে কবরের শাস্তি একটি সত্য বিষয়। আর এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের বহু সংখ্যক প্রমাণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়। এ বিষয়ে যথেষ্ঠ পরিমাণে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর আকল-বুদ্ধি এটাকে অসম্ভব মনে করে না। যদি কারো আকল বা জ্ঞান এটাকে অসম্ভব মনে করে তবে তাকে বুঝতে হবে, এ বিষয়ে যখন কুরআন ও হাদীসের সিদ্ধান্ত এসে গেছে তখন এটা মান্য করা অবশ্য কর্তব্য। এটা আমাদের জ্ঞানের পরিধির ভিতরে হোক বা বাহিরে, তাতে কিছু আসে যায় না। আসল কথা হল, কবরের শাস্তির বিশ্বাসটি আহলে সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্গত। খারেজী, অধিকাংশ মুতাযিলা ও মুরজিয়াদের একটি দল কবরের শাস্তির বিষয়টি অস্বীকার করে। তিনি আরো বলেন: যদি মৃত ব্যক্তির শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিংবা কোন জীব-জন্তুর পেটে চলে যায় তাহলেও কবরের শাস্তি ভোগ করা সম্ভব। যদি বলা হয়, আমরা দেখি মৃত ব্যক্তিকে কবরে যেভাবে রাখা হয়েছে সেভাবেই আছে। কখন তাকে বসানো হল আর কিভাবে তাকে শাস্তি দেয়া হল? এর উত্তরে বলা যায়, আমরা অনুভব না করলেও এটা ঘটা সম্ভব। যেমন আমাদের পাশে কোন ব্যক্তি নিদ্রায় থাকে আর সে স্বপ্নে কত খারাপ অবস্থা ভোগ করতে থাকে বা কত সুখ ভোগ করতে থাকে। অথচ আমরা তার পাশে থেকেও তার কোন কষ্ট বা সুখ অনুভব করি না বা দেখি না। এমনিভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে জিবরীল অহী নিয়ে আসতো। আর রাসূল কষ্ট করে সে অহী ধারন করতেন কিন্তু পাশে উপস্থিত সাহাবীগণ তা টের পেতেন না। (শরহু মুসলিম)
No comments:
Post a Comment