দর্শক সংখ্যা

Wednesday, March 20, 2013

সিয়াম ও রমজান : শিক্ষা-তাৎপর্য-মাসায়েল-৩



ঈদে যা বর্জন করা উচিত :
ঈদ হল মুসলমানদের শান-শওকত প্রদর্শন, তাদের আত্মার পরিশুদ্ধতা, তাদের ঐক্য সংহতি ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। কিন্তু দুঃখজনক হল বহু মুসলিম এ দিনটাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে জানে না। তারা এ দিনে বিভিন্ন অইৈসলামীক কাজ-কর্মে মশগুল হয়ে পড়ে। এ ধরনের কিছু কাজ-কর্মের আলোচনা করা হল :
(১) কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন ধরনের কাজ বা আচরণ করা
মুসলিম সমাজে এ ব্যাধি ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে তারা যেমন সাংস্কৃতিক দৈন্যতার পরিচয় দিচ্ছে অপর দিকে নিজেদের তাহজীব-তামাদ্দুনের প্রতি অনীহা দেখাচ্ছে। এ ধরনের আচরণ ইসলামে শরীয়তে নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে—
عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من تشبه بقوم فهو منهم رواه أبو داود:৩৫১২ وصححه الألباني
সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ 
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হল, যে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি এ বাহ্যিক অর্থ (কুফরীর হুকুম) আমরা না-ও ধরি তবুও কমপক্ষে এ কাজটি যে হারাম তাতে সন্দেহ নেই।’
(২) পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ: পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলার পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদীসে এসেছে—
عن ابن عباس رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم : أنه لعن المتشبهات من النساء بالرجال والمتشبهين من الرجال بالنساء. أبو داود:৩৫৭৪
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ঐ সকল মহিলাকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা মহিলার বেশ ধারণ করে। 
(৩) ঈদের দিনে কবর যিয়ারত
কবর যিয়ারত করা শরীয়ত সমর্থিত একটা নেক আমল। যেমন হাদীসে এসেছে—
عن أنس رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : كنت نهيتكم عن زيارة القبور، ألا فزورها فإنها ترق القلب وتدمع العين وتذكر الآخرة، ولا تقولوا هجراً. صحيح الجامع: ৪৫৮৪
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, হ্যাঁ এখন তোমরা কবর যিয়ারত করবে। কারণ কবর যিয়ারত হৃদয়কে কোমল করে, নয়নকে অশ্র“সিক্ত করে ও পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তোমরা শোক ও বেদনা প্রকাশ করতে যেয়ে সেখানে কিছু বলবে না।’ 
কিন্তু ঈদের দিনে কবর যিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরীয়ত সম্মত নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন :—
لا تجعلوا قبري عيداً . . . أبو داود:১৭৪৬
‘তোমরা আমার কবরে ঈদ উদযাপন করবে না বা ঈদের স্থান বানাবে না...।’ 
যদি ঈদের দিনে কবর যিয়ারত করা হয়, তাহলে তা কবরে ঈদ উদযাপন বলে গণ্য হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে ‘ঈদ’ মানে যা বার বার আসে। প্রতি বছরে অথবা প্রতি মাসে বা প্রতি সপ্তাহে। যদি বছরের কোন একটি দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া হয় আর তা প্রতি বছরে করা হয় তা হলে এটার নামই হল কবরে ঈদ উদযাপন। আর সেটা যদি সত্যিকার ঈদের দিনে হয় তবে তা আরো মারাত্মক বলে ধরে নেয়া যায়। যখন আল্লাহর রাসূলের কবরে ঈদ পালন নিষিদ্ধ, তখন অন্যের কবরে ঈদ উদযাপন করার হুকুম কতখানি নিষিদ্ধের পর্যায়ে পড়ে তা একটু অনুমান করা যেতে পারে।
(৪) বেগানা মহিলা পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ:
(ক) মহিলাদের খোলা-মেলা অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া। মনে রাখা প্রয়োজন যে খোলামেলা ও অশালীন পোষাকে রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
ﭽﭶ               ﭽﭾ     الأحزاب: ٣٣
‘আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মত নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ 
হাদীসে এসেছে—
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : صنفان من أهل النار لم أرهما : قوم معهم سياط كأذناب البقر يضربون بها الناس، ونساء كاسيات عاريات، مميلات مائلات، رؤسهن كأسنمة البخت المائلة لا يدخلن الجنة ولا يجدن ريحها، وإن ريحها ليوجد من مسيرة كذا وكذا . مسلم :৩৯৭১
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘জাহান্নামবাসী দু’ ধরনের লোক আছে যাদের আমি এখনও দেখতে পাইনি। (আমার যুগের পরে দেখা যাবে) একদল লোক যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে প্রহার করবে। আর এক দল এমন মেয়ে-লোক যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ মানুষের মত হবে। অন্যদের আকৃষ্ট করবে ও তারা অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না। যদিও তার সুগন্ধি বহু দূর থেকে পাওয়া যাবে।’ 
(খ) মহিলাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ
অনেককে দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরীয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়। হাদীসে এসেছে—
عن عقبة بن عامر رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله قال : إياكم والدخول على النساء، فقال رجل من الأنصار: يا رسول الله أفرأيت الحمو؟ قال : الحمو : الموت. مسلم:৪০৩৭
সাহাবী উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘তোমরা মেয়েদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে।’ আনসারী সাহাবীদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল ! দেবর-ভাসুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি উত্তরে বললেন : ‘এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন তো মৃত্যু।’ 
এ হাদীসে আরবী ‘হামউ’ শব্দ নেয়া হয়েছে। এর অর্থ এমন সকল আত্মীয় যারা স্বামীর সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম। যেমন স্বামীর ভাই, তার মামা, খালু প্রমুখ। তাদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করার কারণ হল, এ সকল আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমেই বে-পর্দাজনিত বিপদ আপদ বেশি ঘটে থাকে। যেমনটি অপরিচিত পুরুষদের বেলায় কম ঘটে।
(৫) গান-বাদ্য
ঈদের দিনে এ গুনাহের কাজটাও বেশি হতে দেখা যায়। গান ও বাদ্যযন্ত্র যে শরীয়তে নিষিদ্ধ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আবার যদি হয় অশ্লীল গান তাহলে তো তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন ভিন্নমত নেই। হাদীসে এসেছে—
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ليكون أقواما من أمتي يستحلون الحر والحرير والخمر والمعازف. البخاري:ص২৯৮ باب:১৭
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে।’ 
এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় গান-বাদ্য নিষিদ্ধ। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে ‘তারা হালাল মনে করবে’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় মূলত এটা হারাম। ইসলামী শরীয়ত কিছু কিছু পর্বে বিনোদনের অনুমতি দিয়েছে। তাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম নিম্নোক্ত কয়েকটি সময়ে দফ (একদিকে খোলা ঢোল জাতীয় বাদ্য) বাজানোকে জায়েয বলেছেন :

(ক) বিবাহের অনুষ্ঠানে : হাদীসে এসেছে—
عن الربيع بنت معوذ بن عفراء قالت : جاء النبي صلى الله عليه وسلم حين بني علي فجلس على فراشي كمجلسك مني، فجعلت جويريات لنا يضربن بالدف، ويندبن من قتل من آبائي يوم بدر، إذ قالت إحداهن : وفينا نبي يعلم ما في غد. فقال : دعي هذه وقولي بالذي كنت تقولين. البخاري:৪৭৫০
রবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. বর্ণনা করেন : ‘যখন আমার বিবাহের অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  আমার কাছে এসে আমার বিছানায় এমনভাবে বসলেন যেমন তুমি বসেছ। তখন কয়েকজন বালিকা দফ বাজাচ্ছিল ও আমাদের পূর্ব-পুরুষদের মাঝে যারা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তাদের প্রশংসামূলক সংগীত পরিবেশন করছিল। এ সংগীতের মাঝে এক বালিকা বলে উঠল, ‘আমাদের মাঝে এমন এক নবী আছেন যিনি জানেন আগামী কাল কি হবে।’ তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন: ‘এ কথা বাদ দাও এবং যা বলছিলে তা বল।’ 
(খ) ঈদের সময়ে : যেমন হাদীসে এসেছে—
عن عائشة رضي الله عنها قالت : دخل أبو بكر وعندي جاريتان من جواري الأنصار تغنيان بما تقاولت الأنصار يوم بعاث، قالت وليستا بمغنيتين، فقال أبو بكر : أمزامير الشيطان في بيت رسول الله ؟ وذلك يوم عيد، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يا أبا بكر إن لكل قوم عيداً وهذا عيدنا . البخاري:৮৯৯
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন আবু বকর রা. আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন দু জন আনসারী বালিকা বুয়াছ যুদ্ধে তাদের বীরত্ব সম্পর্কিত গান গাচ্ছিল, কিন্তু তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। আবু বকর রা. বললেন : ‘আশ্চর্য, আল্লাহর রাসূলের ঘরে শয়তানের বাদ্য !’ এদিনটা ছিল ঈদের দিন। আবু বকর রা. এর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন : ‘হে আবু বকর ! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এদিন হল আমাদের ঈদ।’ 
অন্যান্য নফল সিয়াম
রমজান মাসের সিয়াম ফরজ। এ ছাড়া আরো কিছু সিয়াম বা রোজা আছে যা পালন করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে এক মাস ব্যাপী সিয়াম পালন করতেন না। হাদীসে এসেছে—
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصوم حتى نقول إنه لا يفطر، ويفطر حتى نقول أنه لا يصوم، ما رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم استكمل صيام شهر إلا رمضان، وما رأيته أكثر صياما منه في شعبان. البخاري:১৮৩৩
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এমনভাবে নফল সিয়াম পালন করতেন আমরা ধরে নিতাম তিনি সিয়ামে বিরতি দেবেন না। আবার এমন ভাবে সিয়াম পরিত্যাগ করতেন আমরা মনে করতাম তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে তাকে পূর্ণ মাস সিয়াম পালন করতে দেখিনি। আর শাবান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতে দেখিনি। 
এ হাদীস দ্বারা বুঝে আসে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতেন। তিনি কি কি ধরনের নফল সিয়াম পালন করতেন তা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১- শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা :
عن أبي أيوب الأنصاري رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من صام رمضان ثم أتبعه ستا من شوال كان كصيام الدهر. مسلم:১৯৮৪
আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়াম আদায় করল সে যেন সাড়া বছর সিয়াম পালন করল।’ 
উলামায়ে কেরাম সাড়া বছর সিয়াম পালনের সওয়াবের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব দশগুণ দেয়া হয় সে হিসেবে রমজানের এক মাস সিয়াম পালনে দশ মাস সিয়াম পালনের সওয়াব। শাওয়ালের ছয়টি সিয়ামে দু মাস সিয়াম পালনের সওয়াব। এভাবে পুরো বছর সিয়াম পালনের সওয়াব পাওয়া যেতে পারে শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম পালন করলে। যদি কারো দায়িত্বে রমজানের কাজা সিয়াম থাকে তবে সে প্রথমে কাজা আদায় করবে তারপরে শাওয়ালের সিয়াম পালন করবে। শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম একাধারে আদায় করা যায়, আবার বিরতি দিয়েও আদায় করা যায়। তবে শাওয়াল মাস চলে যাওয়ার পর ছয় রোজার কাজা হিসেবে সিয়াম পালনের বিধান নেই।
২- আরাফা দিবসের সওম : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে আরাফা দিবসের (জিলহজ মাসের নবম তারিখে) সওম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন :
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله والسنة التي بعده. مسلم:১৮৯৫
‘আরাফা দিবসের সওম সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তাকে বিগত ও আগত বছরে পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’ 
তবে যারা পবিত্র হজ পালনরত আছেন তারা এ দিনে রোজা রাখবেন না।
৩- মুহাররম মাসের সওম :
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم، وأفضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل . مسلم:১৯৮২
‘রমজান মাসের পর সর্বোত্তম সওম হল আল্লাহর মাস মুহাররমের সওম। আর ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত।’ 
৪- শাবান মাসে সিয়াম : হাদীসে এসেছে—
عن عائشة رضي الله عنها قالت : . . ما رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم استكمل صيام شهر إلا رمضان، وما رأيته أكثر صياما منه في شعبان. البخاري:১৮৩৩
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনে : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে শাবান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতে দেখিনি। 
তিনি শাবান মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম আদায় করতেন। এর কারণ সম্পর্কে উসামা বিন যায়েদ রা. বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে তিনি বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল ! নফল সিয়ামের ব্যাপারে আমি তো শাবান মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে আপনাকে এত বেশি সিয়াম পালন করতে দেখি না। তিনি বললেন: শাবান, রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এমন একটি মাস যাতে মানুষ সিয়াম সম্পর্কে উদাসীন থাকে।
৫-প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করা : হাদীসে এসেছে—
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : أوصاني خليلي صلى الله عليه وسلم بثلاث : صيام ثلاثة أيام من كل شهر، وركعتي الضحى، وأن أوتر قبل أن أنام. البخاري:১৮৪৫
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  সম্পর্কে বলেন, আমার বন্ধু আমাকে তিনটি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন : প্রত্যেক মাসে তিনটি সিয়াম পালন করা, দ্বি-প্রহরের পূর্বে দু রাকাআত সালাত আদায় করা ও নিদ্রার পূর্বে বিতির সালাত আদায় করা। 
এ তিনটি সিয়াম আদায় করলে পূর্ণ বছর নফল সিয়াম আদায়ের সওয়াব লাভের কথা এসেছে। একটি নেক আমলের সওয়াব কমপক্ষে দশগুণ দেয়া হয়। তিন দিনের সিয়ামের সওয়াব দশগুণ করলে ত্রিশ দিন হয়। যেমন আবু কাতাদা রা. বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে—
صوم ثلاثة أيام من كل شهر ورمضان إلى رمضان فهذا صيام الدهركله. مسلم:১৯৭৬
‘প্রত্যেক মাসে তিনটি সিয়াম ও এক রমজান থেকে আরেক রমজান সিয়াম পালন করলে পূর্ণ বছর সিয়াম আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব ধরা হয়।’ 
মাসের যে তিন দিন সিয়াম পালন করা হবে সে তিন দিনকে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় ‘আইয়ামুল বীয’। এ তিন দিন হল হিজরি মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখ। বীজ শব্দের অর্থ আলোকিত। এ তিন দিনের রাতগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাঁদের আলোতে আলোকিত থাকে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এ সিয়াম গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। যেমন হাদীসে এসেছে—
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يفطر أيام البيض في حضر ولا سفر. النسائي:২৩০৫
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  সফর ও দেশে থাকা অবস্থায় আইয়ামে বীযের সিয়াম ত্যাগ করতেন না।’ 
৬- সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম :
সপ্তাহে দু দিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করা সুন্নত। হাদীসে এসেছে—
عن أبي قتادة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل عن صوم يوم الاثنين، فقال ذلك يوم ولدت فيه ويوم بعثت فيه أو أنزل علي فيه . مسلم:১৯৭৭
সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে সোমবারে সিয়াম পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, ‘এ দিনে আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত দেয়া হয়েছে বা আমার উপর কুরআন নাযিল শুরু হয়েছে।’   হাদীসে এসেছে :—
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: تعرض الأعمال يوم الاثنين والخميس، فأحب أن يعرض عملي وأنا صائم .رواه الترمذي رواه مسلم بغير ذكر الصوم
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। কাজেই আমি পছন্দ করি, যখন আমার আমল পেশ করা হবে তখন আমি সিয়াম অবস্থায় থাকব।’ 
৭- একদিন পর একদিন সওম পালন :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন—
أحب الصيام إلى الله صيام داود، وكان يصوم يوما ويفطر يوما. مسلم:১৯৬৯
‘আল্লাহর কাছে (নফল সিয়ামের) সবচেয়ে প্রিয় সিয়াম হল দাউদ আ.-এর সিয়াম। তিনি একদিন সিয়াম পালন করতেন আর একদিন সিয়াম ত্যাগ করতেন।’ 
৮- আশুরার সিয়াম পালন : হাদীসে এসেছে—
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ. الترمذي: ৬৮৩
আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘আমি আল্লাহর নিকট আশা রাখি, আশুরা দিবসের রোজা আল্লাহ তাআলার কাছে বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।’ 
অন্য বর্ণনায় এসেছে—
عن أبي قتادة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : . . . . . صيام يوم عاشوراء احتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله. مسلم:১৯৭৬
‘আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ...আমি আশা রাখি আশুরার দিনের সওমকে আল্লাহ তাআলা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।’  হাদীসে আরো এসেছে—
عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه قال: حين صام رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم عاشوراء وأمر بصيامه، قالوا إنه يوم تعظمه اليهود والنصارى. فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم ( فإذا كان العام المقبل إن شاء الله صمنا اليوم التاسع) قال : فلم يأت العام المقبل حتى توفي رسول الله صلى الله عليه وسلم. مسلم:১৯১৬
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  আশুরার সওম পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন : ‘এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সম্মান করে থাকে।’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন : ‘আগামী বছর আসলে ইনশা আল্লাহ আমরা নবম তারিখে সওম পালন করব।’ ইবনে আব্বাস রা. বলেন : ‘পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ইন্তেকাল করলেন।’  হাদীসে এসেছে—
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : صوموا يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، وصوموا قبله يوما أو بعده يوما. أحمد:২০৪৭
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : ‘তোমরা আশুরা দিবসে সওম পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা কর। তাই তোমরা আশুরার একদিন পূর্বে অথবা একদিন পরে সওম পালন করবে।’ 
কীভাবে আশুরার সওম পালন করবেন ?
(ক) মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে সওম পালন করা। এ পদ্ধতি অতি উত্তম। কারণ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এভাবেই আশুরার সওম পালনের সংকল্প করেছিলেন। যেমন ইতিপূর্বে আলোচিত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীস এর প্রমাণ বহন করে।
(খ) মুহাররম মাসের দশম ও একাদশ দিবসে সওম পালন করা। এ পদ্ধতিও হাদীস দ্বারা সমর্থিত। যদি কেউ নবম তারিখে কোন কারণে সওম পালন করতে না পারেন তিনি এ পদ্ধতিতে সওম পালন করবেন।
(গ) শুধু মুহাররম মাসের দশম তারিখে সওম পালন করা। এ পদ্ধতি মাকরূহ। কারণ এটা ইহুদীদের আমলের সাথে সংগতিপূর্ণ। 
নিষিদ্ধ সিয়াম :
বছরের পাঁচটি দিন সিয়াম পালন নিষিদ্ধ । এগুলো হল
এক. ঈদুল ফিতরের দিন।
দুই . ঈদুল আজহার দিন (জিলহজ মাসের দশ তারিখ)
তিন. জিলহজ মাসের এগারো তারিখ।
চার. জিলহজ মাসের বার তারিখ।
পাঁচ. জিলহজ মাসের তেরো তারিখ।
রমজান মাসে আল-কুরআন কিভাবে তিলাওয়াত করা উচিত :
যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় এমন একটি গ্রন্থের নাম বলতে পারেন কি যেটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাঠ করা হয়? উত্তরে আপনি বলবেন : হা, পারি। সে গ্রন্থখানা হল পবিত্র আল-কুরআন আল-কারিম। বিগত কালে ও বর্তমানে ইনশা আল্লাহ ভবিষ্যতেও যে গ্রন্থখানা সবচেয়ে বেশি পঠিত, তা হল আল-কুরআন। ভাবতে আশ্চর্য লাগবে সাড়া বিশ্ব থেকে যদি এর সকল কপি নিঃশেষ করে দেয়া হয় -আল্লাহ না করুন - তা হলেও আল-কুরআন সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ হিসেবেই টিকে থাকবে। বরং এমতাবস্থায় আল-কুরআনের পঠন কয়েক হাজার গুন বেড়ে যাবে। কারণ সাড়া বিশ্বে যে লক্ষ লক্ষ হাফেজে কুরআন আছেন তারা তাদের কুরআন চর্চা কয়েকশত গুন বাড়িয়ে দেবেন। এবং মুসলমানদের মাঝে যারা এতদিন কুরআন হিফজ করাকে অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন, তারা তাদের সন্তানদেরকে কলেজ ভার্সিটি থেকে বের করে এনে তাহফীজুল কুরআন বিভাগে ভর্তি করে দেবেন। আর বলবেন, আল্লাহর কালামের এ সংকটময় সময়ে তার রক্ষার ফযীলত থেকে মাহরুম হতে পারি না। আর এভাবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার দ্বীনের দুশমনদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে তার কালামকে রক্ষা করবেন। এরপর যদি প্রশ্ন করা হয় এমন একটি গ্রন্থের নাম বলতে পারেন যেটা পাঠ করা হয় অথচ পাঠকরা এর অর্থ বোঝেন সবচেয়ে কম। এর উত্তরে আপনি বলবেন সে গ্রন্থটি হল আল-কুরআন। তারপর যদি প্রশ্ন করা হয় এমন একটি গ্রন্থের নাম বলতে পারেন, যার পাঠকেরা তার বাণী জীবনে বাস্তবায়ন করেন সবচেয়ে কম ? এর উত্তরেও আপনি বলবেন, তা হল পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন। মূলত আমাদের আলোচনার বিষয়, কীভাবে কুরআন অধ্যয়ন করা উচিত। এ বিষয়ে বলতে যেয়ে প্রথমে বলব যারা কুরআন পাঠ করেন তাদের নিয়ে। যারা আল-কুরআন পাঠ করেন তাদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত : যারা আরবীতে কুরআন তিলাওয়াত করেন সাথে সাথে তরজমা বোঝেন অথবা পাঠ করে বুঝে নেন।
দ্বিতীয়ত : যারা শুধু আল-কুরআনের অনুবাদ পাঠ করেন। আরবীতে পাঠ করতে পারেন না।
তৃতীয়ত : যারা আরবীতে কুরআন তিলাওয়াত করেন কিন্তু তরজমা বোঝেন না বা বুঝে পাঠ করার প্রয়োজন অনুভব করেন না। আমি এ প্রবন্ধে আল-কুরআন অধ্যয়নে এ তিন দলের ভূমিকা নিয়ে নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম প্রকারের যারা আরবী ভাষায় কুরআন তিলাওয়াত করেন ও অর্থ-তরজমা বোঝেন, তারাই সঠিক ভাবে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ও তার সাহাবায়ে কেরাম রা. তাদের পরবর্তী উম্মতের ইমাম ও আলেমগণ এভাবে অর্থ ও তরজমাসহ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। এবং আল্লাহ নিজেও চান বান্দা তার কালামের অর্থ বুঝে শুনে তিলাওয়াত করুক। তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাই চেয়েছেন ও তার সাহাবাগণও এরকম আমলই করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :—

‘আমি তো তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি কিতাব, যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ। তোমরা কি তা বুঝবে না ?’ 
‘তোমরা কি তা বুঝবে না’ প্রশ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা কুরআন বুঝার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন :—
‘এ হল এক কল্যাণময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি। যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধ শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।’ 
এখানে আল্লাহ তাআলা কুরআন অনুধাবন ও উপদেশ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ দুটোর কোনটাই অর্থ বুঝা ব্যতীত শুধু তিলাওয়াত দ্বারা সম্ভব নয়। এ ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে, যাতে আল্লাহতাআলা কুরআন অর্থ বুঝে তিলাওয়াত করা ও গভীর ভাবে অনুধাবন করার জন্য বলেছেন। শুধু এতটুকুই নয় বরং যারা আল-কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ অর্থ বুঝে না, আল্লাহ তাদের সমালোচনা করেছেন।
যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :—
‘আর তাদের মাঝে এমন কতক নিরক্ষর লোক আছে যাদের মিথ্যা আশা (আমানিয়্যা) ব্যতীত কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই, তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে।’ 
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী বলেন : ‘আমানিয়্যার অর্থ হল : তরজমা অনুধাবন ব্যতীত শুধু তিলাওয়াত করা অর্থাৎ তিলাওয়াত করা ছাড়া তাদের কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। অর্থ বুঝে না, গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না।’ 
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে দু ধরনের লোকদের তিরস্কার করেছেন। প্রথমত যারা আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করেছে, দ্বিতীয়ত যারা তিলাওয়াত ছাড়া আল্লাহর কিতাবের আর কোন খবর রাখে না। অর্থ অনুধাবন ব্যতীত তিলাওয়াতকেই বলে আমানিয়া।’ (বাদায়ে আত-তাফসীর)
তাই বলা যায়, যারা আল-কুরআন শুধু তিলাওয়াত করে, অর্থ অনুধাবনের কোন চেষ্টা করে না আল্লাহ তাদের তিরস্কার করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতকারীদের প্রশংসা করতে যেয়ে বহু আয়াতে বলেছেন, যারা তিলাওয়াত করে তাদের অন্তর বিগলিত হয়, ঈমান বৃদ্ধি পায়, অশ্র“ প্রবাহিত হয় ইত্যাদি। আর আমরা সকলেই জানি ও বুঝি ; অর্থ অনুধাবন ব্যতীত এগুলোর কোনটিই হয় না। অতএব নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় আল্লাহ যে সকল তিলাওয়াতকারীর প্রশংসা করেছেন, তারা হলেন, যারা অর্থ-তরজমা বুঝে বুঝে তিলাওয়াত করেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কোরআনে এরশাদ করেন :—
‘রাসূল বলবেন : হে আমার প্রতিপালক ! আমার সম্প্রদায় তো এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে।’ 
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  হাশরের ময়দানে যে সকল উম্মত কুরআন ত্যাগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে এভাবেই নালিশ করবেন। আচ্ছা তার উম্মতের মাঝে কারা কুরআন ত্যাগ করল? আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন : ‘যারা কুরআন তিলাওয়াত অগ্রাহ্য করল, তারা কুরআন ত্যাগের অভিযোগে অভিযুক্ত। যারা কুরআনের অর্থ অনুধাবন ও তা গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করল না, তারাও কুরআন ত্যাগের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। যারা কুরআনের বিধি-বিধান মানল না, তারাও কুরআন ত্যাগকারী বলে অভিযুক্ত হবে।’ 
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন: ‘কুরআন ত্যাগের বিভিন্ন প্রকার আছে তার মাঝে একটি হল কুরআনের তরজমা অনুধাবন পরিহার করা।’ (বাদায়ে আত-তাফসীর)
হাসান বসরী রহ. বলেছেন: আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এজন্য যে, তা মানুষ বুঝবে ও আমল করবে। কিন্তু আফসোস! মানুষ আজ শুধু তার তিলাওয়াতকেই আমল হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। 
বিখ্যাত সাহাবী ইবনে মাসঊদ রা. বলেন : ‘আমাদের যুগে কুরআন হিফজ করা কঠিন ছিল আর তা আমল করা সহজ ছিল। আমাদের পর এমন যুগ আসবে যখন কুরআন হিফজ করা সহজ হবে কিন্তু তার উপর আমল করা কঠিন হবে।’ 
পূর্ববর্তী আকাবিরে দ্বীন, সালাফে সালেহীন ও মুফাসসিরে কেরামগণ এভাবে আল-কুরআন বুঝার জন্য মুসলিম উম্মাহকে হিদায়াত দিয়েছেন। আল-কুরআন বুঝে-বুঝে তিলাওয়াত করার জন্য মানুষদের উৎসাহিত করার দায়িত্ব মূলত আলেম-ওলামা, দায়ী ও আইম্মায়ে মাসাজিদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের অধিকাংশের ভূমিকা নেতিবাচক। তাদের অনেকে মনে করেন সাধারণ মানুষ তরজমাসহ কুরআন তিলাওয়াত করলে গোমরাহ হয়ে যেতে পারে। হা হতে পারে ! তবে এ আশঙ্কায় মানুষকে কুরআন বুঝা থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব আপনার নয়, আপনার দায়িত্ব তাদের উৎসাহিত করা। আলেমদের অনেকে কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত বয়ান করতে যেয়ে এমন সব কথা বলেন যা শুনে মানুষ মনে করে কুরআনের অর্থ বুঝার দরকার নেই। তারা কুরআনের অর্থ-তরজমা বুঝতে নিরুৎসাহিত হন।
যেমন বলা হয়, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন: ‘... কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি হরফে ১০ টি করে সওয়াব পাওয়া যায়। আলিফ লাম মীম একটি হরফ নয়, তিনটি হরফ। এটা পড়লে তিনটি সওয়াব পাওয়া যায়। আলিফ লাম মীম এর অর্থ বুঝা যায় না তা পাঠ করলে যখন সওয়াব পাওয়া যায় তখন আল-কুরআন অর্থ না বুঝে পড়লেও সওয়াব পাওয়া যাবে।’ আমি বলব, আপনার এ দলীল পেশ করা বা যুক্তি মোটেই ঠিক নয়। কখনো সঠিক নয়। কয়েকটি কারণে:
এক. এ হাদীসে আল্লাহর রাসূলের এ বাণীর উদ্দেশ্য (নস) হল আলিফ লাম মীম একটি হরফ নয়, তিনটি হরফ এ কথা বুঝানো।
দুই. এ হাদীসের ইশারা ইঙ্গিতে (দালালাহ ও ইশারাহ দ্বারা) বুঝে আসে কেউ যদি আল-কুরআনের হুরূফে মুকাত্তায়াহ বা আয়াতে মুতাশাবিহা তিলাওয়াত করে যার অর্থ সাধারণত বুঝে আসে না তা হলেও সে সওয়াব পাবে।
তিন. এ হাদীসে আলিফ লাম মীম-এর কথা বলা হয়েছে যা আয়াতে মুতাশাবিহার অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে আয়াতে মুহকামাহ-র (যার অর্থ স্পষ্ট ভাবে বুঝে আসে) কিয়াস (তুলনা) করা ঠিক নয়। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
চার. এ হাদীস দ্বারা কখনো রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উদ্দেশ্য মানুষকে কুরআনের অর্থ অনুধাবনে নিরুৎসাহিত করা ছিল না। আমি কিন্তু এ কথা বলছি না যে অর্থ-তরজমা অনুধাবন ছাড়া আল-কুরআন তিলাওয়াতে সওয়াব নেই। সওয়াব হলে হতেও পারে। বরং আমি আমি বলতে চাচ্ছি, অর্থ অনুধাবন ব্যতীত আল-কুরআন পাঠে সওয়াব পাওয়ার যে দলীল ও যুক্তি দেয়া হয় তা মোটেই সঠিক নয়। এবং আল-কুরআন বুঝা, গবেষণা ও গভীর চিন্তা করতে যা মানুষকে অনুৎসাহিত করে এমন ধরনের কথা বলা মোটেই শুদ্ধ নয়। তাই আল-কুরআন নাযিলের এ মাসে অর্থ সহ আল-কুরআন তিলাওয়াতের জন্য আমরা কর্মসূচী গ্রহণ করব, অন্যকে উপদেশ দেব। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা.-এর একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন :
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَقْرَأَ الْقُرْآنَ غَضًّا كَمَا أُنْزِلَ فَلْيَقْرَأْهُ عَلَى قِرَاءَةِ ابْنِ أُمِّ عَبْدٍ. مسند أحمد:  ৩৫(ج ১ / ص ৩৮)
‘যে ব্যক্তি চায়, কুরআন যেভাবে নাযিল হয়েছে সেভাবেই পাঠ করবে, সে যেন ইবনে উম্মে আব্দ (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ)-এর মত পাঠ করে।’
কী তার পদ্ধতি? তিনি বলেছেন :—
كان الرجل منا إذا تعلم عشر آيات لم يجاوزهن حتى يعرف معانيهن والعمل بـهـن. جامع البيان للطبري: ص:৮০
‘আমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন দশটি আয়াতের তিলাওয়াত শিখত তখন সামনে আর অগ্রসর হতো না, যতক্ষণ না সে দশটি আয়াতের অর্থ অনুধাবন করত ও সে মোতাবেক আমল করত।’ 
অর্থাৎ দশটি আয়াত প্রথম তিলাওয়াত, তারপর অর্থ-তরজমা অনুধাবন, অতঃপর হিসাব নেয়া যে, এর বাস্তবায়ন আমার জীবনে কতটুকু। এ রকমই ছিল সাহাবায়ে কেরামের কুরআন তিলাওয়াত পদ্ধতি।
সম্মানিত পাঠক ! একটু চিন্তা করে দেখুন, যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের নিজ অনুগ্রহে হাজারও নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। নিজ মেহেরবানিতে আমাদের ইসলামের মত মহা-নেয়ামত দান করেছেন, তিনি আমাদের জন্য একটা কিতাব পাঠালেন যেটি আমাদের প্রতি তার একমাত্র পত্র হিসেবে গণ্য করা যায়। সে পত্রটি পাঠ করতে ও বুঝতে আমাদের কত অলসতা! কত উদাসীনতা! আপনার কি ইচ্ছে হয় না আমার প্রভু আমার উদ্দেশ্যে কী বলতে চাচ্ছেন, সাড়া জীবনে একটি বার হলেও জেনে নেই? আমাদের অনেকে বছরে কয়েক বার এমন কি শুধু রমজান মাসে কয়েক বার কুরআন পাঠ করে ‘খতম’ করি, অথচ একটি বারও তার অর্থ অনুধাবন ‘শুরু’ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি কি? এমনকি আরবী ভাষা জানে ও বুঝে এমন অনেক লোককে দেখেছি, তারা যখন কুরআন পাঠ করেন তখন অর্থ বা তরজমার দিকে খেয়াল করার সামান্য প্রয়োজন অনুভব করেন না। তাই সকলকে আহ্বান জানাই আর বেশি বেশি কুরআন ‘খতম’ করা নয়, বরং তিলাওয়াত ও বুঝার চেষ্টা ‘আরম্ভ ’করি। আমরা কি পারি না, প্রত্যেকে এ সিদ্ধান্ত নিতে জীবনে একবার হলেও আমি কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থ বুঝে বুঝে তিলাওয়াত করব। শুরু করেই দেখুন না ! আপনি অভিভূত হয়ে যাবেন। মনে হবে আপনি সত্যিই মহান আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলছেন আর আল্লাহ আপনার সামনে উপস্থিত। আপনি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছেন। মনে হবে তাঁকে প্রশ্ন করছেন, তিনি উত্তর দিচ্ছেন। মনে হবে, আপনি যেন নতুন করে ঈমান গ্রহণ করলেন। আপনার বিশ্বাস হতে চাইবে না যে, এ কুরআন চৌদ্দ শত বছর আগে অবতীর্ণ হয়েছে। মনে হবে মাত্র কিছুক্ষণ আগে নাযিল হয়েছে। আর তখনই প্রতিফলন দেখতে পাবেন আল্লাহর সে কথাগুলোর যা তিনি কুরআন তিলাওয়াত কারীদের প্রশংসায় বলেছেন। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা করছি আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকে ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভূত না করেন, যাদের সম্পর্কে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন :
وَيَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ . صحيح البخاري:৪৬৭০
‘তারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে, কণ্ঠ অতিক্রম করে অন্তর পর্যন্ত পৌঁছোবে না।’ 

সমাপ্ত


No comments:

Post a Comment