ফাঁসিই যদি একমাত্র গ্রহণযোগ্য রায় হয় তবে বিচারের দরকার কি : টবি ক্যাডম্যান
ক্যাডম্যান বলেন, ২০১০ সালের অক্টোবরে তিনি যখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন, তখন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে ভিআইপি লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে তিনি হোটেল সোনারগাঁও ছুটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত যুদ্ধাপরাধের নিরপেক্ষ বিচারবিষয়ক এক সভায় বক্তৃতা করতে। তিনি পুরনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি (তাদের দুজন পরে পদত্যাগ করেছিলেন), রেজিস্ট্রারের সাথে আলোচনা করেছিলেন।
কিন্তু এই রাজসিক সম্মান খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। এরপরপরই বাংলাদেশ সরকারের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন তিনি।
ব্রিটিশ এই আইনবিদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে ব্যাপকভাবে বিভক্ত। এমনকি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরাও যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এখানে ন্যায়বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের কোনো স্থান নেই। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠবে, তাদের সবাইকে অবশ্যই দোষী সাব্যস্ত করতে হবে এবং ফাঁসি দিতে হবে। এর চেয়ে কম কিছুই যথেষ্ট বিবেচিত হবে না।
শাহবাগের বিক্ষোভে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতিফলিত হচ্ছে। মৃত্যুর আহ্বান জানিয়ে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু সবাই জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি জানাচ্ছে। এর ফলে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে, ফাঁসিই যদি বিচারের একমাত্র গ্রহণযোগ্য রায় হয়, তবে বিচারের দরকার কি? নুরেমবার্গের ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বিচারপতি জ্যাকসনের কথা মনে রাখা দরকার। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি যেকোনো মামলায় কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বদ্ধপরিকর থাকেন, তবে বিচারের দরকার কী। যেসব আদালত কেবল দোষী সাব্যস্ত করে যায়, তাদের প্রতি কারো শ্রদ্ধা থাকে না।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সঙ্কটজনক। ট্রাইব্যুনালের প্রথম দুটি রায়ের পর শাহবাগের বিক্ষোভকে অনেকে কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের সাথে তুলনা করেছেন। আসলে দুটির মধ্যে তুলনা করা যায় সামান্যই। মিসরীয় বিপ্লবে এক স্বৈরাচারকে উৎখাত করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা প্রত্যাবর্তনের দাবি জানানো হয়েছিল। আর শাহবাগের বিক্ষোভে একটি ইসলামী দলের নেতাদের ফাঁসি দাবি করা হয়।
ক্যাডম্যান বলেন, ঢাকার রাজপথে আজ যা ঘটছে, তাতে আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে যে, উচ্ছৃঙ্খল লোকদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, দেশ নাটকীয়ভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সহিংসতা প্রতিরোধ করতে বর্তমান সরকার বলতে গেলে কিছুই করছে না। কেবল আগুনে ঘি ঢালছে। এমন একপর্যায়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, শাহবাগের বিক্ষোভকারীদের ভাবাবেগের আলোকে বিচারকেরা যাতে তাদের রায় দেন, তা নিশ্চিত করতে তিনি বিচারপতিদের সাথে কথা বলবেন। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে বলা হয়েছে, এতে ‘জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে।’
তিনি বলেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারপ্রক্রিয়া ছিল নানা অনিয়মে ভরপুর। কিন্তু শাহবাগের বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতিফলন ঘটে এই মামলার রায়েও। শাহবাগের বিক্ষোভকারীরা এখন ঘটনাপ্রবাহের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। এর ফলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে হাজির হতে ভয় পাচ্ছেন, বিচারকেরা জামায়াতবিরোধী ভাবাবেগে চালিত হচ্ছেন। জনগণের আহ্বানে সাড়া দিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের ওপর এত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়াও অবিশ্বাস্য নয় যে, তারা ভিন্ন রায় দিলে শাহবাগে তাদের রক্তও ছিটকে পড়তে পারে। যে রায়-ই দেয়া হোক না কেন সমস্যার সৃষ্টি হবে- এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যেভাবে বিচারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে, তাতে বলা যায় এর ফলে দেশটি যুদ্ধাপরাধের বিচার করার একটি সুযোগ নষ্ট করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিচারের নামে যে অবিচার হচ্ছে, সে ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকার কোনো উপায় নেই। এখন যা প্রয়োজন তা হলো ট্রাইব্যুালের বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখা, বিচারক ও প্রসিকিউটরসহ ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও অঘোষিত তৃতীয় পক্ষের সিনিয়র সদস্যদের অসদাচরণের মারাত্মক অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক তদন্ত করা।
http://www.dailynayadiganta.com/new/?p=132998
No comments:
Post a Comment