তৃতীয় পরিচ্ছেদ : বয়োঃসন্ধি স্তর
এ বয়সটা হল ইসলামী শরিয়ত কর্তৃক আদিষ্ট হওয়ার স্তর, যার পরিচয় পাওয়া যাবে কয়েকটি নিদর্শন ও পনেরতম বছরে পৌঁছার মাধ্যমে। সাধারণতঃ এটার সূচনা হয়ে থাকে মধ্যম স্তরের শেষ ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সন্ধিক্ষণে।
ইবনুল কাইয়্যূম রহ. বলেন, ‘যখন একটি শিশুর বয়স পনের বছর পূর্ণ হয়ে যায়, তখন ভিন্ন আরেকটি অবস্থার সৃষ্টি হয় : স্বপ্ন দোষ হয়, লজ্জাস্থানের চতুর্পাশে লোম গজায়, কণ্ঠস্বর মোটা হয়ে যায় ও তার নাসিকা রন্ধ্র পৃথক হয়ে যায়। এসবের মধ্য হতে শরিয়ত যে বিষয়টির বিবেচনা করেন তা হলো মাত্র দু’টো ঃ
ক্স স্বপ্ন দোষ
ক্স লোম গজানো।
যখন শিশুর বয়োঃপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে আদিষ্টের কলম তার জন্য সক্রিয় ও পুরুষের সামগ্রিক বিধানাবলি তার জন্য প্রযোজ্য হবে। অতঃপর সে বয়োঃপ্রাপ্তির পরিপক্কতা অর্জন করবে। ইমাম যুহুরী রহ. শব্দটির ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন- ‘পরিপক্কতা অর্জন হলো কোন মানুষের পৌরুষ স্তরে পৌঁছার পর থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘অতএব পরিপক্কতা অর্জন হলো সীমানার প্রথম ও শেষ। তবে এটি কোন সীমা নয়। চল্লিশ বছর বয়সকে আল-কুরআনে الأشد বলে অভিহিত করা হয়েছে। শব্দটির অর্থ হলো শক্তি ও বীরত্ব। এ শব্দ থেকে الشديد এর অর্থ হল শক্তিশালী ব্যক্তি। অতএব الأشد এর অর্থ হল, অসম শক্তির অধিকারী। আর তা হলো বুদ্ধির পরিপক্কতা অর্জনের বয়স, যে কারণে শরিয়তের বিধানাবলি বাধ্যতামূলক হয়, বুদ্ধি ও বিবেকই হলো তার অবলম্বন। কিন্তু যখন বুদ্ধি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত পৌঁছার পরÑযেখানে শরিয়তের বিধানাবলি বাধ্যতামূলক হয় তা অনুমান করে অবগত হওয়া অসম্ভব। এর সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানুষও তো বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সে কারণে ইসলাম এমন একটি সুস্পষ্ট নিদর্শনের মাধ্যমে তাকে সংজ্ঞায়িত করেছে যেখানে কেউ ভিন্নমত পোষণ করেননি। আর তা-ই হলো বয়োঃপ্রাপ্তি। এই বয়োঃপ্রাপ্তিই হলো পূর্ণতা প্রাপ্তির পরিচায়ক, যেখানে শরিয়তের বিধানাবলি বাধ্যতা মূলক হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক হলো এমন ব্যক্তি যার দৈহিক শক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সে কোন
শ্রমসাধ্য কর্ম সম্পাদন ও শরিয়তের বিধানাবলি পালনের ক্ষেত্রে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। যার বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও পরিপক্ক হয়েছে। ফলে সে দলিল প্রমাণাদি বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। যেভাবে তার আবেগ ও উচ্ছাসের পূর্ণতা সাধিত হয়েছে। ফলশ্র“তিতে সে সঠিকভাবে দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম হবে। এমনিভাবে সেটা সংরক্ষণ করতে ও তার ওপর আবর্তিত আবেগ ও অনুভূতির ফলাফলও সে বের করতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি তার প্রজনন ক্ষমতারও পূর্ণতা সাধিত হয়েছে যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানব প্রজাতিকে সংরক্ষণ করে থাকেন। অনেকের দৃষ্টিতে এই স্তরটা হলো প্রচলিতمراهقة (মুরাহাকা) এর সূচনা। مراهقة যদিও আরবী ভাষার ক্রিয়ামূল رهق থেকে সংগৃহীত। কিন্তু কোন কোন ভাষা বিশারদ مراهقة শব্দটিকে মূলতঃ ল্যাটিন শব্দ বলে মত প্রকাশ করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, অধিকাংশ ভাষাবিদ কিশোর অথবা কিশোরীদের বয়োঃসন্ধিতে পৌঁছে যাওয়াকে مراهقة এর সূচনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন।
বয়োঃসন্ধি ক্ষণ আরবী ভাষায় رهق শব্দটির একাধিক অর্থ এসছে। رهق অর্থ মিথ্যা, رهق অর্থ পাতলামী ও দুর্ব্যবহার, رهق অর্থ মানুষের মূর্খপণা ও তার বুদ্ধির অপরিপক্কতা। বলা হয়-وإنه لرهق نزل সে অনিষ্ট সাধনে দ্রুত ও দ্রুত ক্রুদ্ধ ব্যক্তি বা সে এমন ব্যক্তি যার মধ্যে ক্রোধ ও নির্বুদ্ধিতা বিদ্যমান অথবা সে এমন ব্যক্তি যার মধ্যে رهق রয়েছে যখন সে অনিষ্টতার দিকে ধাবিত হবে ও গোপন করবে। সর্বোপরি رهق হলো বোকামী ও সম্মানিত বস্তুকে ঢেকে ফেলা। এমনিভাবে এই শব্দটির অথের মর্ধ্যে নিকটবর্তী হওয়া ও নৈকট্য অর্জনও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে-راهق الغلام فهو مراهق অর্থাৎ সে স্বপ্ন দোষের নিকটবর্তী রয়েছে। বলা হয়ে থাকে- طلبت فلانا حتى رهقته অর্থ আমি অমুককে অনুসন্ধান করেছি তার নিকটবর্তী হওয়া পর্যন্ত। এক্ষেত্রে আনাস বিন মালেক রা. বর্ণিত হাদীসটি দ্রষ্টব্য। ওহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাত জন আনসার ও দু’কোরাইশীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে ছিলেন। ইতোমধ্যে তারা বয়োঃসন্ধি ক্ষণের নিকটে পৌঁছলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমাদের পক্ষে যে শত্র“দেরকে প্রতিহত করবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত অথবা সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।” আলোচ্য হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ رهقوه এর অর্থ : তার নিকটবর্তী হলো ও নিকটে পৌঁছলো। এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বয়সের দিক থেকে مراهق সেই ব্যক্তি যে স্বপ্ন দোষের নিকটবর্তী হয়েছে তবে এখনো পর্যন্ত স্বপ্ন দোষ হয়নি, অর্থাৎ সে এখনো প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি। তবে মূর্খপণা, ক্রোধ ও অনিষ্টের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অপরাপর গুণাগুণের দিক থেকে رهق যে কোন বয়োঃস্তরে মানুষের জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব। তার প্রথম, মধ্যম ও শেষ বয়সে। ওটা মানুষের জীবন প্রবাহের কোন নির্দিষ্ট কালের সঙ্গে নির্দিষ্ট নয়। আমি যতকুটু জানতে পেরেছি তার মধ্যে পাইনি যে, এই গুণাগুণ কালের কোন সীমাবদ্ধ সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আশা করি নোটটি মনোবিজ্ঞানের- অসংখ্য পাঠে যা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলো। مراهقة মানুষের জীবন প্রবাহের একটা নির্দিষ্ট কাল যার সূচনা বয়োঃসন্ধি ক্ষণ এবং একটা নির্ধারিত মেয়াদান্তে তার সমাপ্তি ঘটে’ তা হতে আশ্রয়হীনতা অর্জনের সহায়ক হবে যা এই পাঠের একান্ত দাবী। কখনো কখনো তা কয়েক বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে : চার থেকে ছয় বছর অথবা অনেকের মতে এর চেয়েও বেশি অথবা যুগের সঙ্গে যুগের ও এক সমাজের সঙ্গে অপর সমাজের পার্থক্যের কারণেও তা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এই অভিমতের আলোকে مراهقة এর সূচনা হবে বয়োঃসন্ধি ক্ষণে ও তার সমাপ্তি ঘটবে বুদ্ধিগত, সামাজিক ও ব্যক্তিগত আবেগের পরিপক্কতার মাধ্যমে। বয়োঃসন্ধি কালের দৈর্ঘ্য সমাজের ব্যক্তিবর্গের ওপর নির্ভর করে দশ বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। তবে অনেক গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি হলো এই সময়ে দুশ্চিন্তা, বিষণœœতা, অবমূল্যায়ন ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শৃঙ্খলহীনতা এ সবই সে বুঝতে পারে। এগুলোর জন্য তারা অসংখ্য সাক্ষী উল্লেখ করে থাকে যেগুলো তাদের অভিমতের স্বপক্ষের প্রমাণ বলে তারা জ্ঞান করে থাকে। অথচ এই মতের ওপর বিশেষজ্ঞদের কোন ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যা প্রমাণ করে এই বৈশিষ্ট্যাবলি ও কর্মকাণ্ড বয়স অথবা সাবালক হওয়ার আবশ্যকীয়তার অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সমাজ অথবা সংস্কৃতিকে বয়োঃসন্ধির সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অতঃপর এই বৈশিষ্ট্যাবলির সিংহভাগ সেই অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল যার অধিকাংশটাই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা নিজেদের সমাজের ওপর পরিচালিত করেছিলেন। তাদের গবেষণা প্রসূত এই ফলাফলগুলো সমগ্র মানবজাতির ওপর ব্যাপকভাবে চাপিয়ে দেয়া সমীচীন হবে না। কারণ এ গবেষণাটা শুধুমাত্র পাশ্চাত্য মানবগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত হয়েছিলো। আমরা যদি বিষন্নতা ও অবমূল্যায়নের ব্যাখ্যা করি এই বয়সে মানুষের বুদ্ধির পূর্ণতা প্রাপ্তি দ্বারা অথচ তখন সে বসবাস করছে এমন এক পৌত্তলিক সমাজে, যেখানে বিরাজ করছে বিশ্বাসগত ভ্রষ্টতা ও চারিত্রিক নষ্টামী। এতদসত্ত্বেও তার বিবেকের দাবী ও সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যে কোন সংঘর্ষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু বয়োঃসন্ধি ক্ষণে পৌঁছানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার চেয়েও এটা বেশি বিশুদ্ধ, উত্তম ও সূক্ষ্ম অভিমত। কথাটা আরো স্পষ্ট করে এভাবেও বলা যায় : নিশ্চয়ই মানুষ কোন জড় পদার্থের নাম নয় যে পরিবেশের প্রভাব ও সময়ের সকল বন্ধন উপেক্ষা করে কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা প্রসূত নিয়ম-কানুনগুলোই তার ওপর প্রয়োগ করা হবে। বরং সে একটি জীবন্ত ব্যক্তি সত্তা যার দেহ, বুদ্ধি, হৃদয় ও একটি প্রাণ রয়েছে। আরো রয়েছে আবেগ, উৎকণ্ঠা, বিশ্বাস, অসংখ্য ধ্যান-ধারণা ও পরিকল্পনা। যা একজন থেকে অপর জনের, এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশের চেয়ে ভিন্ন ও বিপরীত হয়ে থাকে। সে কারণে ঐ পরিবেশসমূহ থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা প্রসূত ফলাফল ও রীতি নীতিও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এখানে জ্ঞাতব্য যে, নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার বারংবার একই ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে যদি শর্ত করা হয় যে, গবেষণা ও ফলাফল শর্তানুযায়ী হতে হবে ও উদ্যোক্তাদের তত্ত্বাবধানে হতে হবে। মুসলিম ও পৌত্তলিক সমাজের নিশ্চিত পার্থক্যের কারণে এটা কখনো বস্তবায়িত হয়নি ও ভবিষ্যতেও বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞান কর্তৃক তাদের অনুসারীদের আচার-আচরণের জন্য পরিবেশিত গবেষণালব্ধ অধিকাংশ ব্যাখ্যা ও ফলাফল অবশ্যই আমাদের ইসলামী সমাজের বাহ্যিক ব্যাখ্যার উপযুক্ত নয় । বরং সম্ভবতঃ উল্লেখিত প্রকাশ্য ব্যাখ্যারও আমাদের সমাজে মূলত কোন অস্তিত্ব নেই। এক্ষেত্রে যতটুকু ঘটেছে তাও আমাদের কারো কারো ঐ সমাজের অন্ধ অনুকরণের কারণে। সম্ভবত ড. উমার মুফদা তার উপস্থাপিত শিক্ষা সেমিনারে এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন : ‘তরুণদের দৃষ্টির সম্মুখে বয়োঃসন্ধি ক্ষণে প্রবৃত্তির দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ’ শীর্ষক একটি সেমিনার পরিবেশন করেছিলেন। সেখানে বয়োঃসন্ধি ক্ষণে উপণীত তরুণদের অনুসৃত একটা সম্পর্ক তিনি দেখতে পেলেন অর্থাৎ যারা নিজেদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে বেড়ায়। কিন্তু এই সম্পর্কটা ছিলো ঘৃণিত ও মার্কিন সমাজ ঘেঁষা। কখনো নিশ্চয়ই ইসলাম এটা পরিবর্তন করে ব্যক্তির প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধ করতে সহায়তা করে। ফলে পরবর্তীতে গবেষণা ও প্রশ্নোত্তর কর্ম দীর্ঘায়িত হবে না। আমাদের নিকট মুসলিম তরুণ ও যুবকদের অসংখ্য উদাহরণ ও আদর্শ রয়েছে যারা সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বুদ্ধিমান সুপুরুষ ও মর্যাদাবান হতে সক্ষম হয়েছেন। বরং তারা মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এটা সমুদ্রের ওপাড় থেকে আমাদের নিকট আমগনকারী কোন আদর্শ নয়। বরং তা হলো একটা বিশুদ্ধ মডেল যা আমাদেরকে মুসলিম সমাজে নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আসহাবে কাহাফ (গুহাবাসী) সম্পর্কে বলেন, إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آَمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى. (الكهف-১৩ ( ‘তারা কতক তরুণ তাহাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান গ্রহণ করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম।’ আল্লাহ তাআলা সাইয়েদিনা ইসমাঈল আ. সম্পর্কে বলেন, ‘তার বাবার সঙ্গে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হওয়ার পর।’ তা হলো বুদ্ধির পরিপক্কতা যদ্বারা প্রমাণ উপস্থাপণ করা যায় অথবা স্বপ্ন দোষ হওয়া। প্রসিদ্ধ ঘটনা : فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ. (الصافات-১০২) ‘অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বলল, ‘বৎস ! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ্ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছাই আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ এ হলো ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যার সম্পর্কে তার সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছিল, যখন তিনি তাদের প্রতিমাগুলো ভেঙ্গে দিয়েছিলেন- قَالُوا سَمِعْنَا فَتًى يَذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ. (الأنبياء-৬০) ‘কেউ কেউ বলল, ‘এক তরুণকে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি। যাকে বলা হয় ইবরাহীম।’ এছাড়াও এ সময় সম্পর্কে কোরআন ও হাদীসে অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে। প্রশ্ন : যদি বলা হয়- مراهقة কে উল্লেখিত অর্থে সংজ্ঞায়ন হলো একটা পরিভাষা। আর পরিভাষায় কোন দ্বন্দ্ব নেই। উত্তর : তাকে বলা হবে নিঃসন্দেহে পরিভাষায় কোন দ্বন্দ্ব নেই ; তবে যে পরিভাষা বাস্তবতা ও সত্যের পরিপন্থী তার স্বীকৃতি অথবা গ্রহণ কোনটাই বৈধ নয়। যখন অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীগণ এ বিষয়ে একমত হন যে, مراهقة (তারুন্য) মানুষের বয়োঃপ্রাপ্তি থেকে সুচিত হয়। এ মতটি কোন ভাবেই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ শরিয়ত বয়োঃপ্রাপ্তিকে আদিষ্ট হওয়া ও ইসলামের বিধানাবলি বাধ্যতামূলক হওয়ার আলামত নির্ধারণ করেছে। দোদুল্যমানতা, অবমূল্যায়ন, বিষণœতা, নৈরাশ্য ও আবেগতাড়িত ক্রোধ প্রভৃতির সূচনার সঙ্গে কিভাবে তাকলীফ বা আদিষ্টযোগ্য প্রযোজ্য হতে পারে? مراهق শব্দের সঙ্গে অসংখ্য শরিয়তের বিধানাবলি সম্পৃক্ত। যেমন : ক্স مراهق মাহরাম হওয়ার যোগ্য কি না ? ক্স অপরিচিত মহিলার সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাতকার বৈধ কি না ? ক্স তার জন্য মেয়েদের সৌন্দর্য দর্শন বৈধ কি না ? ক্স সে যদি হজ্জব্রত পালন করে তাহলে ইসলামের ফরজ হজ্জ তার থেকে আদায় হয়ে যাবে কি না ? ক্স মদ্য পান করলে তার ওপর দণ্ডবিধি কার্যকর হবে কি না ? ক্স সে চুরি করলে তার হাত কর্তন করা হবে কি না ? ক্স কোন মহিলার সঙ্গে ব্যভিচার করলে তার ওপর দণ্ডবিধি কার্যকর হবে কি না ? ক্স এবং যে মহিলার সঙ্গে مراهق(বয়োঃসন্ধি ক্ষণে উপনীত তরুণ) ব্যভিচার করেছে তার ওপরও দণ্ডবিধি কার্যকর করা হবে কি না ? ক্স যদি উক্ত মহিলা বিবাহিত হয় তার ওপর (প্রস্তর নিক্ষেপে) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে কি না ? প্রভৃতি অসংখ্য ফিক্বহী মাসআলা রয়েছে যার সমাধান ফুকাহায়ে কেরাম আরবী ভাষার দাবীর আলোকে পেশ করেছেন। আর তা হলো مراهق যে এখনো প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি। অর্থাৎ সে হলো শিশু তবে শৈশবের শেষ স্তরে রয়েছে। পক্ষান্তরে মনোবিজ্ঞানে مراهق হলো যে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেছে। সে বয়োঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শরিয়ত কর্তৃক আদিষ্ট। এ দ্বৈত ব্যাখ্যা ফিক্বহী মাসআ’লার ক্ষেত্রে কঠিন দোদুল্যমান পরিস্থিতির মুখোমুখী করবে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাবালকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে যে, বয়োঃসন্ধি ক্ষণে উপনীত এক বালক যার দাবী সমাজের দৃষ্টিতে তরুণ-তরুণীদের পরিপক্কতার বয়স বিলম্ব করা। তার ভুল-ত্র“টিসমূহকে তুচ্ছ করে দেখা, বিরুদ্ধ আচরণে তাদের জন্য বাহানা তালাশ করা। অথচ প্রত্যেকটি সাবালক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জন্য যে আবেদন রেখেছে তাদের জন্যও একই আবেদন প্রযোজ্য। কিন্তু শরিয়ত যে দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন প্রাপ্ত বয়স্কের দিকে তাকায়- সে প্রাপ্ত বয়স্ক ও আদিষ্ট। তার সাথে আচার ব্যবহার এই ভিত্তিতেই পরিচালিত হবে। কারণ এটা তরুণ-তরুণীদের দ্রুত পরিপক্ক হতে সহায়ক হবে। ফলে সমাজও অবশ্য তাদের সঙ্গে এই ভিত্তিতেই আচার-ব্যবহার করতে পারে।
প্রথম অধ্যায় :
বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি বয়োঃপ্রাপ্তি কেউ কেউ মনে করে থাকেন এর উদ্দেশ্য হলো লিঙ্গগত পরিপক্ক অবস্থা অথবা লিঙ্গগত কার্যক্ষমতার পরিপূর্ণতা। এটা অবশ্যই আদিষ্ট হওয়ার (تكليف ( ভিত্তি নয়। বরং تكليف এর মূল ভিত্তি তার নিকট চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা ইন্দ্রিয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন, আর তা-ই হলো ‘আক্বল’ বা বুদ্ধিমত্তা। বয়োঃপ্রাপ্তি বুদ্ধির পূর্ণতা লাভের নিদর্শন যদ্বারা تكليف অনিবার্য হয়ে যায়। অতএব আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে, তাদের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ নিরসন কল্পে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে লোম গজানো, কণ্ঠস্বর ভারী হওয়া অথবা প্রজনন ইন্দ্রিয়সমূহের দায়িত্ব পালনের সামর্থ লাভ কেবলমাত্র ইত্যাকার আলামতসমূহ প্রকাশ পেলেই تكليف এর মত মহান দায়িত্বে কাউকে আদিষ্ট করেন না। বরং এগুলো হলো কতগুলো নিদর্শন মাত্র। এই স্তরে এসে তরুণ-তরুণীদের বিপরীত লিঙ্গে প্রতি অনুভূতি সক্রিয় হয়। তবে এটা সমস্যা নয়, কারণ এটা পৌরুষ ও নারীত্বের নিদর্শনের দাবী। কিন্তু মূল সমস্যা তখনই প্রকাশ পাবে যখন বিষয়টা শরিয়তের বিধানের আলোকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অথচ শরিয়তই প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে তার বিশুদ্ধ পথে পরিচালিত করতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তার মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত করেছেন। তিনিই আবার তাদের জীবন প্রবাহের জন্য জীবন বিধান দিয়েছেন যার মধ্যে শুধু কল্যাণ আর কল্যাণই নিহিত, তথায় কোন অকল্যাণের লেশমাত্র নেই। যা হবে সমাজ বিনির্মাণ ও তাদের পরস্পর যোগাযোগ স্থাপন এবং মানব প্রজাতির ধরাবাহিকতা সংরক্ষণের সোপান। অবশ্যই তা মানব জাতির বিপর্যয়, ধ্বংস ও বিলুপ্তির মাধ্যম নয়। অতএব মা-বাবা ও অভিভাবকদের কর্তব্য হলো এই বিধানাবলি তারা নিজেরা শক্তভাবে ধারণ করতে সচেষ্ট হবে ও এর সঙ্গে আবদ্ধ থাকতে তৎপর হবে। এ পর্যায় উল্লেখযোগ্য কতিপয় বিধান নিম্নে প্রদত্ত হলো ঃ ক্স উভয় লিঙ্গের মধ্যে সংশ্রব না হওয়া ক্স মেয়েদের প্রয়োজনে বাহিরে যেতে হলে শারঈ পোশাক বাধ্যতামূলকভাবে ধারণ করা ক্স অবিবাহিতদের সামর্থ হলে বিবাহ করা। ক্স দাম্পত্য জীবন পরিচালনার সামর্থ না থাকলে কামভাব দমনকারীর আশ্রয় নেয়া। এরজন্য উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বিষয় প্রত্যক্ষ করা ও পাঠ থেকে বিরত থাকাসহ রোজাব্রত পালনের অনুশীলন করা যেতে পারে। ক্স শক্তি সামর্থ্যকে কোন জনহিতকর ও ফলপ্রসূ কাজে নিয়োজিত রাখা। ক্স অবসর সময়গুলোকে ব্যস্ত রাখতে প্রচেষ্টা করা ও কোন বিশুদ্ধ ও মহৎ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। ফলে তরুণ-তরুণীরা চিন্তাগত দিক থেকে ঐ ধরনের অনুভূতি থেকে দূরে থাকতে পারবে। ক্স এর পূর্বে ও পরে নেক আমলকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা। ক্স অতি অবশ্যই আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা। অশালীন ও গর্হিত কর্মের নিকটবর্তী হওয়া থেকে মুক্তি ও হেফাজত থাকার প্রার্থনা খুব কাকুতি মিনতিসহ করা।
পরিপক্কতা ও পূর্ণাঙ্গতা একটি শিশুর এ স্তরে রূপান্তরিত হলেই তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় ; চাই সেটা তার দেহ, বুদ্ধি, গবেষণা অথবা অনুভূতিতেই হোক না কেন, যা অবশ্যই তাকে পূর্ববর্তী স্তর থেকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে। এখন আর তাকে শিশু অথবা বাচ্চা বলে নামকরণ করা শুদ্ধ হবে না। বরং সে এখন একজন পুরুষ। নব যৌবনের দিকে ইঙ্গিত করার জন্য তাকে বলা হবে: তরুণ অথবা বালক। তরুণের নিকট পরিপক্ক ও পূর্ণাঙ্গতার বিভিন্ন প্রকরণ হয়ে থাকে। সুতরাং শিশুর বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও গভীরতা তার অনিবার্য পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে অগ্রসর ও বিকাশ লাভ করতে থাকে। যদ্বারা প্রমাণ সাব্যস্ত হয়ে থাকে ও শরিয়তের বিধানাবলি কার্যকর হয়। ফলে বিরুদ্ধাচারণ ও শৈথিল্য প্রদর্শনে তাকে নিশ্চিত জবাবদিহী করা হবে। এ বয়সে শিশুর নিকট নিরেট চিন্তা ভাবনার (যা কোন অনুধাবনযোগ্য বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়) সামর্থ্য পরিলক্ষিত হয়। অনুরূপ পরোক্ষ বিষয়, একটি মোকদ্দমার অসংখ্য দূরত্ব ও বিভিন্নদিক সে উপলব্ধি করতে সক্ষম ও সামগ্রিক বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। ফলে সে আর এক কোণে আবদ্ধ হয়ে থাকবে না । উপরন্তু সে প্রবিষ্ট করণ, বিন্যাস, অবগঠন অথবা পরিক্ষণের মত উচ্চতর গবেষণার অভিজ্ঞতা চর্চায় সক্ষম। এমনিভাবে উপস্থিত বিষয় দ্বারা অনুপস্থিত বিষয়ের ওপর প্রমাণ উপস্থাপন, একাধিক প্রাথমিক তথ্য একত্রিত করে তা বাস্তবায়নের জন্য সে দিকে দৃষ্টিপাত করা ও এর ওপর আবর্তিত সম্ভাব্য ফলাফল পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হওয়া এসব কিছুই সে পারে। যেভাবে সে শিক্ষামূলক গবেষণা পরিচালনা করতে পারে। যেহেতু সে সমস্যা উপলব্ধি করতে ও আলোচ্য বিষয় সংজ্ঞায়িত করতে প্রয়াস পায়। ফলে এখান থেকেই এই সমস্যাটা ব্যাখ্যার উপযোগী তথ্যাবলি একত্রিত করে থাকে। অতঃপর একটি একটি করে তথ্যগুলো নিরীক্ষা করতে থাকে কাংক্ষিত তথ্যটি আবিস্কার করা পর্যন্ত যা উল্লেখিত সমস্যার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে। এই বুদ্ধিগত সামর্থ্যরে মাধ্যমে সেই তরুণ সত্যের সন্ধান, সত্য চর্চা করতে ও শৈশব অথবা শিশু বয়সে দীক্ষালব্ধ আনুগত্য নির্ভর ঈমানকে যুক্তিযুক্ত শ্র“তিনির্ভর প্রমাণাদি লব্ধ বিশ্বাসগত ঈমানে সুনিশ্চিত রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে। এটা নিঃসন্দেহে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বুদ্ধিগত সামর্থ লব্ধ ফলাফল নিশ্চিত করতে হলে তরুণ-তরুণীদেরকে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সার কথা হলো, এই যোগ্যতা ও তা অর্জনের পর্যাপ্ত সামর্থ্য আল্লাহর ইচ্ছাই তার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, এর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, সকল প্রাপ্ত বয়স্করাই কার্যতঃ এই অবস্থানে রয়েছে। এমন না হলে তো সকল মানুষই মর্যাদা ও সম্মানের দিক থেকে সমপর্যায়ের হতো। এমনিভাবে দেহটাও দ্রুত বিকাশ লাভ করে, কিন্তু সেটা হলো শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্তঙ্গের মধ্যে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ক্রমাগত বিকাশ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ. (التين-৪ ) ‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।’ আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ . فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ (الإنفطار-৭ -৮ ) ‘যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং সুসামঞ্জস্য করেছেন, যে আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।’ তা কোন অসামঞ্জস্য অথবা দোদুল্যমান বিকাশ নয়, যার ফলে মেজাজের দোদুল্যপনা, আবেগ, উত্তেজনা, কষ্টানুভূতি, অবাধ্যতা অথবা চলার পথে পদস্খলন সৃষ্টি হতে পারে। ফলশ্র“তিতে সে হয়ে পড়বে হতবিহ্বল ও নির্বোধের ন্যায়। যেমনিভাবে কোন কোন শিক্ষা তাকে এ দিকে ধাবিত করে থাকে বৈকি। এ সুগঠিত বর্ধনশীল দেহ দ্বারাই তো বান্দা শক্তি অর্জন করে নামাজ রোজা ও জিহাদ ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ শরিয়তের বিধানাবলি পালনে সামর্থ লাভ করে থাকে। এই সময়ই আবেগ ও উচ্ছাসগুলো পরিপক্ক হয়, যে ঘটনা ও অনুঘটনগুলো তরুণের সম্মুখে সংঘটিত হয় অথবা সে শুনতে পায় তাই তার আবেগকে উত্তেজিত করে। কিন্তু সেই আবেগ প্রবঞ্চিত হওয়া অথবা না হওয়া অথবা প্রশংসা ও ভর্ৎসনাকে অতিক্রম করে এমন এক অনুভূতির দিকে ধাবিত হয় যা কোন মহৎ কর্ম-তৎপরতার প্রেরণা যোগাতে সক্ষম হয়। যদি হয়, তাহলে এটা হবে ইতিবাচক আবেগ। এক্ষেত্রে একজন তরুণ প্রত্যক্ষ অথবা বাহ্যিক ভূমিকার ওপর তুষ্ট থাকতে পারবে না। বরং তার ভেতরে সৃষ্ট এ ইতিবাচক আবেগই এই সৎ তরুণকে সৎ কাজের নির্দেশ ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকবে। ফলে এমনকি যদি সেই কর্ম সম্পাদনে তাকে বিপদের সম্মুখীনও হতে হয় তুবও সে এ ব্যাপারে আপোষহীন থাকবে। কারণ তার রয়েছে উচ্চ আত্ম-বিশ্বাস। লক্ষ করুন, দুই আনসারী বালক যখন আবু জাহল কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়া সম্পর্কে জানতে পারল, তখন তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। যার পূর্ণ বিবরণ আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. এর যবানীতে : তিনি বলেন, ‘আমি বদরের দিন যুদ্ধের সাড়িতে দণ্ডায়মান অবস্থায় অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ডানে বামে তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমি আনসারদের দুই বালককে দেখতে পেলাম যাদের সবেমাত্র দাঁত উঠেছে। আমি উভয়ের মধ্যে কে বেশী শক্তিশালী তা প্রত্যক্ষ করছিলাম, তখন তাদের মধ্যে একজন আমাকে চেপে ধরে বললো : চাচাজান, আপনি কি আবু জাহলকে চেনেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে ভ্রাতুস্পুত্র, তার কাছে তোমার কি প্রয়োজন? তারা বলল, আমরা জানতে পেরেছি, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়। ঐ সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমাদের প্রাণ, আমরা যদি তাকে দেখতে পাই তাহলে আমাদের মধ্যে একজন নিহত না হয়ে একজনের ছায়া অন্য জন থেকে পৃথক হবে না। ফলে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। অতঃপর অপর জন আমার হাত ধরে অনুরূপ কথাই বললো। এরপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আমি আবু জাহলকে লোকের ভেতর ঘোরাফেরা করতে দেখে বললাম : এই হলো তোমাদের শিকার যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে। অতঃপর উভয়ে তাদের তরবারী কোষমুক্ত করে তাকে হত্যা করে ফেললো। এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমাদের দু’জনের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছে? উভয়ে বললো- ‘আমিই তাকে হত্যা করেছি।’ অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমরা কি তোমাদের তলোয়ার মুছে ফেলেছো? তারা উভয়ে বললো, না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় তলোয়ারের দিকে লক্ষ করে বললেন- ‘তোমরা দু’জনেই তাকে হত্যা করেছো।’ তবে তার পরিত্যক্ত সম্পদ পাবে মুয়ায বিন আমর বিন আল-জামুহ। এ তরুণ দুজনের নাম ছিল, মুআয বিন আফরা ও মুআয বিন আমর বিন আল-জামুহ।’ আরেকটি ঘটনা আমিরুল মু’মিনীন উমার বিন আব্দুল আজিজ রহ. এর ছেলে আব্দুল মালেকের। তখন তার বয়স ছিলো উনিশ বছর। যখন তিনি স্বীয় পিতাকে দেখলেন, তিনি জন সাধারণকে সুন্নতের অনুসরণের প্রতি অনুপ্রাণিত করছেন। তার বাবা তাদেরকে পুরোপুরি সুন্নাতের ওপর উঠাক এটা তারও একান্ত ইচ্ছা ছিল। তার নিকট এসে তিনি তার সম্মানিত পিতাকে বললেন : ‘হে আমিরুল মু’মিনীন, আপনি কি কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর আলোকে দেশ পরিচালনা করছেন না ? অতঃপর আল্লাহর শপথ! আমার ও আপনার চুলায় পাতিল জ্বলা না জ্বলার আমি কোন ভ্রুক্ষেপ করি না।’ এরপর তিনি তার ছেলেকে বললেন- ‘আমি জনগণকে কষ্টসাধ্য কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমি সুন্নাতের কোন অধ্যায় থেকে বেরিয়ে গেলে সেখানে প্রত্যাশার পর্ব রেখে দেই। তারা যদি সুন্নাতের জন্য বেরিয়ে পড়ে তাহলে প্রত্যাশার প্রশান্তি পাবে। আমি যদি পঞ্চাশ বছর বয়স পেতাম তাহলেও আমি মনে করতাম যে, আমার সকল প্রত্যাশা আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। কারণ আমি বেঁচে থাকলে আমার প্রয়োজনও বেড়ে যাবে; আর যদি মৃত্যু বরণ করি। তাহলে আল্লাহ তাআ’লাই আমার নিয়্যত সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ পরিপক্কতা ও পূর্ণতা তার বাহককে স্থিরতা ও ভারসাম্যতা, সত্যকে গ্রহণ ও মিথ্যা বর্জনের দিকে আহ্বান করে। কিন্তু যে পরিবেশে সে বসবাস করে সেখানে এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যা দ্ব্যর্থহীনভাবে বিবেক সম্মত প্রমাণাদির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অথবা যা সংঘটিত হয়েছে অথবা হওয়া উচিত। তখনই প্রকাশ পাবে, অস্থিরতা দোদুল্যপনা বিষণœতা নৈরাশ্য ও যুক্তি বিবর্জিত ক্রোধ তাড়িত আবেগ। এটা কিছু কাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যা কখনো দীর্ঘ আবার কখনো নাতিদীর্ঘও হতে পারে। অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্ববিরোধী বিষয়গুলো গ্রহণ করে তার সঙ্গে বসবাস করতে ও তাকে ভালোবাসতে হয়। ফলে সেগুলো সে ভালোবাসবে অথবা সেগুলোর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা পরিবর্তন করে ফেলবে। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী স্তরগুলোতে যদি একটি তরুণের বিশুদ্ধ পরিচর্যা ও প্রতিপালন না হয়, তাহলে এখন অনেক সমস্যা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। কারণ তরুণটি তখন তার মা-বাবা ও শিক্ষকবৃন্দ থেকে গবেষণাগত ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনুভব করতে শিখবে। আর এর অবশ্যম্ভাবলী ফসল হলো বন্ধু নির্বাচন, অবসর সময় কাটানোর পদ্ধতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা। এমনিভাবে অভিভাবক কর্তৃক প্রদত্ত দিক-নির্দেশনা ও উপদেশাবলি গ্রহণ না করলে অসংখ্য সমস্যা দেখা দেবে। একটি তরুণ চায় প্রত্যেকটি বিষয়ে তার একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক। এতে সে যদি প্রসিদ্ধ ও পরিচিত পথ থেকে বেরিয়েও যায় তবুও। تكليف
বা শরিয়তের নির্দেশ পালনে আদিষ্ট হওয়া একটি তরুণের এই স্তরে পৌঁছলে তার মধ্যে কয়েক প্রকারের বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে যেগুলো ইতিপূর্বে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কোন অহেতুক বিকাশ নয়, বরং এর পেছনে মহান উদ্দেশ্য লুক্কায়িত রয়েছে। তা হলো, আল্লাহপাক তার বান্দাদেরকে এই স্তরে পৌঁছার সাথে সাথে আদিষ্ট করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান আনয়ন করে সৎকাজ করবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। পক্ষান্তরে যে অস্বীকার করবে তার জন্য জাহান্নাম। (আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহে আমরা এর থেকে মুক্তি ও পরিত্রাণ চাই।) ফলে এর বিকাশ বান্দার বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপন করবে। তবে কখনোই তা বান্দার জন্য আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধে প্রমাণ হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ. (النساء-১৬৫ ) ‘যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর কাছে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে।’ অতএব দৈহিক বিকাশ বিধানাবলি পালনে সামর্থ্য লাভের জন্য অবশ্যম্ভাবী। বুদ্ধিগত বিকাশ, প্রমাণ অনুধাবনে সামর্থ অর্জন ভ্রষ্টতার পথগুলো ও হেদায়েতের প্রমাণাদি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারে। আবেগ ও উচ্ছাসের মধ্যে বিকাশ সাধন, জনসাধারণের জন্য সত্য গ্রহণ ও অসত্য অপনোদন সর্বোপরি আল্লাহর পথে সমূহ কষ্ট যথাসম্ভব সহ্য করতে সহায়ক হবে। অতএব দৈহিক বিকাশ বলতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসম ও শৃঙ্খলাহীন বিকাশ নয় ; যার কারণে তরুণ তার মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলবে। তার স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। অন্য দিকে বুদ্ধির বিকাশের অর্থ এই নয় যে, সে তার মা-বাবা ও শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিরোধ করবে ও তার বিরোধীদের মতামতকে নির্বুদ্ধিতা ঠাওরাবে। যেমনিভাবে লিঙ্গগত পরিপক্কতার অর্থ এই নয় যে, একটি তরুণ অদৃশ্য আহ্বানকারী যোগাযোগকারী ও বিপরীত লিঙ্গ নিয়ে সদা তৎপর থাকবে। আবেগের বিকাশ বলতে একগুয়েমী স্বভাব, ক্রুদ্ধ প্রভাবান্বিত, অপারগতা ও রাগান্বিত হওয়া নয়, যার ফলে সে অপরের সঙ্গে কোন দুর্ঘটনা ঘটায় ও মারামারি করতে উদ্যত হয়। সুতরাং একজন তরুণের সুষ্ঠ বিকাশ যা আল্লাহ তাআলা তাকে দান করেছেন তাহলো : আল্লাহ তাআলার অবশ্যপালনীয় বিধান পালনে সামর্থ্য অর্জনের জন্য। সেই বিকাশকে তার উদ্দেশ্যের বিপরীত খাতে প্রবাহিত করা হলে দেখা দেবে বহু রোগ ব্যাধি ও ত্র“টি বিচ্যুতি। অথচ এই ত্র“টি বিচ্যুতিগুলো এই বয়োঃস্তরের বৈশিষ্ট্যাবলির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কারণ, যে মহান সত্ত্বা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তো এর জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করেননি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ. (الذاريات-৫৬ ) ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এই জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ সে কারণেই অভিভাবককে প্রকাশিত লক্ষণগুলোর সাথে আচরণ করতে হবে এমনভাবে, যেন সেগুলো হলো কতগুলো রোগ- যার চিকিৎসা একান্ত প্রয়োজন। এগুলো ‘এই বয়সেরই অপ্রতিরোধ্য প্রতিক্রিয়া, ‘তরুণটি এ ব্যাপারে অনন্যোপায় এখানে তার কোন ইচ্ছাশক্তিই কাজ করে না’ ভেবে কখনোই তাদের সঙ্গে সে অনুযায়ী আচরণ করা যাবে না। অনন্তর মানুষ একটি অবসর জীবন পায়নি, বরং মানুষ জীবনকে জন্মগত অভ্যাসপূর্ণ অবস্থায় পেয়েছে- যে অভ্যাসের ওপর আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর মা-বাবা, অভিভাবকবৃন্দের তৎপরতা অথবা পরিবেশের কারণে তার পরিবর্তন ঘটে থাকে। পক্ষান্তরে সে যদি তার স্বভাবজাত প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে ও তার কোন কিছুরই পরিবর্তন সাধিত না হয়। তাহলে সে ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করবে, যা তাকে সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রতিটি সুন্দরতম নান্দনিক চরিত্রে নির্দেশ করবে। সকল অকল্যাণ ও নিন্দনীয় মন্দ চরিত্র থেকে তাকে বিরত রাখবে। অতএব একজন তরুণ যখন জন্মগত স্বভাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ও ইসলামী পরিবেশে প্রতিপালিত হবে, তখন উল্লেখিত কর্মকাণ্ডগুলো তাকে স্পর্শ করতে পারে এমন সাধ্য কি তার আছে? বরং তা আসে একটি স্বভাববিকৃত পরিবেশ থেকে। ‘অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহুদী, খৃষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়।’ অথবা তার প্রতিপালন আল্লাহ তাআলার বিধানের আলোকে করা হয় না। সর্বোপরি কথা হলো যার মধ্যে ত্র“টি রয়েছে সেখান থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হবে। তবে অবশ্যই তা ‘এ বয়সের বৈশিষ্ট্য নয়’ কথাটা সব সময় মাথায় রাখতে হবে।
সাহসিকতা, অগ্রগামিতা ও কষ্টসাধ্য কর্মসম্পাদন এই বয়োঃস্তরে তরুণের শরীরে যে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি সাধিত হয় ও তার নিকট গবেষণা করার যে ক্ষমতা অর্জিত হয়, তা-ই নিজের কাছেও ঐ শক্তি ও সামর্থের অনুভূতির জন্ম দেয়। আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন- اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً . (الروم:৫৪ ) ‘আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি ; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ শৈশবের দুর্বলতা থেকে ক্রমান্বয়ে তারুণ্য ও যৌবনের শক্তির দিকে সে রূপান্তরিত হয়। শক্তি ও সামর্থের অনুভূতি তাকে অগ্রগামিতা ও কষ্টসাধ্য কর্মসম্পাদনে অনুপ্রাণিত করে। সেহেতু অধিকাংশ সময় সে কোন প্রতিকূলতার প্রতি ভ্রুক্ষেপই করে না। এটা তার ভালো একটি দিক যদি তরুণটি সত্যাশ্রয়ী হয়। পক্ষান্তরে আবেগতাড়িত হয়ে যদি সঠিক দিক-নির্দেশনা থেকে দূরে সরে যায় তাহলে এটা হবে তরুণটির ধ্বংস ও মন্দ দিক। অতএব অভিভাবককে এক্ষেত্রে খুবই সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে যাতে তিনি তরুণটিকে কল্যাণের পথে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সর্বকালেই এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে : একাধিক সাহাবায়ে কেরাম জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন অথচ এরপর তারা তারুণ্যে গমন করেছেন। তারা এক্ষেত্রে যার পর নাই উদগ্রীবও ছিলেন বটে। এমনকি তারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য নিজেদের বয়স বেশী দেখানোর কৌশল অবলম্বন করতেন। সামুরাহ বিন যুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার মা বিধবা হওয়ার পর তিনি মদীনায় চলে আসলে লোকেরা তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। এরপর তিনি বলেন, ‘এই অনাথের দায়িত্বভার যে ব্যক্তি গ্রহণ করতে রাজি হবে আমি শুধুমাত্র তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি। অতঃপর তাকে এক আনসারী বিবাহ করলো। তিনি (হাদিসের বর্ণনাকারী) বলেন, ‘প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আনসারী বালকদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য পেশ করা হতো। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদের বয়স হয়েছে তাদেরকে মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীতে তালিকাভুক্ত করে নিতেন। তিনি (হাদীসের বর্ণনাকারী) বলেন, ‘আমাকে এক বছর পেশ করা হলো। তখন এক বালককে ভর্তি করা হলো আর আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি ওকে ভর্তি করে নিলেন আর আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। অথচ আমি তার সঙ্গে কুস্তি ধরে তাকে ধরাশায়ী করতে পারি। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তাহলে দেরি করছো কেন? কুস্তি ধরেই দেখাও না।’ অতঃপর আমি কুস্তি ধরে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলি। ফলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন।’ আব্দুল্লাহ বিন উমার রা.থেকে বর্ণিত, ‘অহুদের দিন তাকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপস্থাপিত করা হলো, অথচ সে তখন চৌদ্দ বছরের কঁচি বালক। তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। অতঃপর দ্বিতীয় বার আমাকে খন্দকের দিন পেশ করা হলো, অবশ্য তখন আমার বয়স পনের বছর পূর্ণ হয়েছিলো। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলো।’ (হাদীস বর্ণনাকারী) নাফে’ বলেন, ‘আমি উমার বিন আব্দুল আজিজের দরবারে গেলাম, যখন তিনি মুসলিম জাহানের সম্রাট। অতঃপর এই হাদীসটি তার নিকট বর্ণনা করলে তিনি সকল প্রাদেশিক গভর্নরদের নিকট শাহী ফরমান লিখে পাঠালেন- ‘পনের বছর পূর্ণ হয়েছে এমন বালকদের জন্য সেনাবাহিনীর তহবিল থেকে ভাতা নির্ধারণ করে দেয়া হোক।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসামা বিন যায়েদ রা. এর হাতে আঠারো অথবা বিশ বছর বয়সে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই অসংখ্য অপরাধ যা এমন লোকদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে যারা জীবনের এই ঈর্ষণীয় ও প্রসন্ন বয়সে উপনীত। এই প্রেক্ষাপটে এই বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত বয়সকে যথাযথ ব্যবহার করে শ্রমসাধ্য কল্যাণকর কর্ম সম্পাদনের জন্য তরুণকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে এখান থেকে উপকৃত হওয়া অভিভাবকের কর্তব্য। সাথে সাথে না দেখে না বুঝে কোন কাজে আসক্ত হওয়া ও নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হতে তাকে সতর্ক করতে হবে ।
দ্বিতীয় অধ্যায় :
অন্তরায় ও সমস্যাবলী পূর্ববর্তী স্তরগুলোয় যখন উত্তম রূপে একজন যুবকের প্রতিপালন ও পরিচর্যা সাধিত হবে। তখন পূর্ববর্তী অন্তরায় ও সমস্যাগুলোও দূরীভূত বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই স্তর সংশ্লিষ্ট প্রকট একটি সমস্যা প্রকাশিত হতে পারে। তা হলো তরুণ তরুণীদের বয়োঃসন্ধি সংশ্লিষ্ট সমস্যা। আর এটা শুধুমাত্র উত্তম পরিচর্যা ও প্রতিপালনের অভাবেই দেখা দিতে পারে। অথবা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেই নষ্ট পরিবেশের কারণে যেখানে সেই তরুণ-তরুণীরা বসবাস করছে। আল্লাহ তাআলা তো এই সুন্দর বসুন্ধরাটাকে আবাদ ও মানব প্রজন্মকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে কামোত্তেজনা ও সঙ্গমের সামর্থ প্রোথিত করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে এটা যদি নিরেট একটা কর্ম হতো যেখানে কোন কামভাব থাকবে না, উপভোগ করা যাবে না তা সম্পাদনে কোন স্বাদ তাহলে কেউ বিবাহ করতে কিংবা এর ব্যয় ভার বহন করতে অগ্রসর হতো না। ফলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে মানব প্রজাতি বিলুপ্তির মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস ডেকে আনতো। অনন্তর আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বকে এই জন্য সৃষ্টি করেননি। কিন্তু এই কামভাবকে যদি শরিয়তের বিধানাবলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না করা হয়, তখনই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর তা হলো তরুণ-তরুণীদের অবৈধ পথে কামক্ষুধা চরিতার্থ করা। ইসলাম এই সম্ভাব্য সমস্যার অসংখ্য উপকারী ও ফলপ্রসূ সমাধান দিয়েছে। অভিভাবকদের এই সমাধানগুলো থেকে উপকৃত হওয়া ও তা প্রয়োগ করা কর্তব্য। কারণ এইগুলোই আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে। তা হতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হলো ঃ ১- মহিলাদের গৃহ অভ্যন্তরে অবস্থান করা ও শরিয়ত সম্মত প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া। ২- শরিয়ত সম্মত প্রয়োজনে বের হওয়ার সময় মহিলাদের পোশাকের ব্যাপারে সমাজকে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করা। বের হওয়ার সময় বাঞ্ছনীয় কর্ম : আবৃত হওয়া ও সৌন্দর্য প্রকাশ না করার প্রতি যতœবান হওয়া। ৩- দৃষ্টি অবনত রাখা। আল্লাহ তাআলা যে দিকে তাকাতে নিষিদ্ধ করেছেন সে দিকে না তাকানো। ৪- উম্মোচিত হওয়া, দ্রষ্টব্য হওয়া অথবা স্পর্শকৃত হওয়া থেকে লজ্জা স্থানকে সংরক্ষণ করা। ৫- তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সংশ্রব না ঘটা। চাই তা পথে, ঘরে অথবা কর্মক্ষেত্র যেখানেই হোক না কেন। ৬- নির্জনতা পরিহার করা, অর্থাৎ কোন তরুণ তরুণীর সঙ্গে একান্তে মিলিত হবে না। কারণ শয়তান হয় তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি। ফলে সে তাদেরকে অবৈধ কাজের জন্য কুমন্ত্রণা দেবে ও তাদেরকে অপকর্মের দিকে ভালো করে ঠেলে দিতে সক্ষম হবে। ৭- সময় হলে বিবাহ কর্ম দ্রুত সম্পন্ন করা ও এতে বিলম্ব না করা। ৮- যার বিবাহ করার আর্থিক সামর্থ নেই তার জন্য রোজাব্রত পালন করা। ৯- উত্তেজনাবর্ধনকারী বিষয় থেকে দূরে থাকা। যেমন : উপন্যাস, সিনেমা ও গান-বাজনা ইত্যাদি। ১০- একাকীত্ব ও সমাজ বিমুখতা পরিহার করা। কারণ তখন মানুষের ওপর শয়তানের প্রভাব বিস্তার সহজ হয়। ১১- শক্তি সঞ্চয়ের জন্য বৈধ শরীর চর্চার প্রতি যতœবান হওয়া। ১২- গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান ও তাকে কর্মের মধ্যে ব্যস্ত রাখা। ১৩- সৎ সঙ্গ অবলম্বন করা। যা তাকে পুণ্য ও সংযমের কাজে সহায়তা করবে এবং পাপাচার ও সীমা লংঘনের কাজে বাধা দেবে। ১৪- ইবাদতের প্রতি যতœবান হওয়া। যা মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের অনুভূতি জাগ্রত করে। যেমন : তাহাজ্জুদ নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াত। ১৫- আল্লাহ থেকে লজ্জার দিকটাকে বেশি শক্তিশালী করা। আল্লাহ তাআলা বান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফলে বান্দার কোন কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকতে পারে না। ১৬- আল্লাহর নিকট দোয়া করার ক্ষেত্রে কাকুতি-মিনতি করা ও সন্তানাদি তথা ছেলে- মেয়েদের সার্বিক হেফাজতের জন্য তার কাছে প্রার্থনা করা। সুতরাং কিভাবে এই সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে তার পদ্ধতিসমূহ খুঁজে বের করা একজন দায়িত্বশীল অভিভাবদের কর্তব্য। আর তা হলো এমন তৎপরতা যা তরুণ- তরুণীদের মনের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করতে সক্ষম। যেহেতু তা জন্মগত স্বভাবের অনুকূল যার ওপর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে কারণেই এর প্রভাব যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা পছন্দ করে তাদের প্রভাবের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। পক্ষান্তরে উল্লেখিত উপকরণের মাধ্যমেও যদি অভিভাবক এই সমস্যাটির সমাধান করতে না পারেন। তাহলে এক্ষেত্রে শিথিলতার পরিণাম তিন দিকে আবর্তিত হবে। সমাজ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী। প্রত্যেকেই তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বহন করবে। সে কারণে এ প্রেক্ষিতে সফলতার কার্যকর রূপ তখনই প্রতিফলিত হবে, যখন এই মৌলিক উপাদানত্রয় একই দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করবে। এই তিনটি মৌলিক উপাদানের যে কোন একটির মধ্যে যদি কোন দুর্বলতা অথবা বিচ্ছিন্নতা সংঘটিত হয়, তাহলে অবশিষ্ট দুটি উপাদানকে আল্লাহর ইচ্ছায় জাহাজের পাল তুলে মুক্তি তীরে নিয়ে নোঙ্গর করতে হবে (যদি এক্ষেত্রে কোন দুর্বলতা থাকে)। কিন্তু বিপদ প্রকট আকার ধারণ করবে যখন দুটি উপাদানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও দুর্বলতা সংঘটিত হয়ে যাবে। কারণ অচিরেই এটা তৃতীয় উপাদানকেও সংক্রমিত করে ফেলবে। আল্লাহ ভাল কাজের সহায়ক।
তৃতীয় অধ্যায় :
উপকরণ ও পদ্ধতিসমূহ একটি তরুণ এই বয়োঃস্তরে পৌঁছেই আদিষ্ট হয়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের ওপর দৃঢ়তা অবলম্বনই হবে তার একমাত্র কাজ ও এটাই তার কাছ থেকে কাম্য। প্রথম পদক্ষেপেই সংঘটিত শিথীলতার জন্য তাকে জবাবদিহী করতে হবে। এর অর্থ হলো তার ওপর বাঞ্চনীয় কর্ম সম্পাদনে প্রচেষ্টা চালানো তার কর্তব্য। যেমন : ইল্ম, আমল ও আদব। সুতরাং তখন তরুণের প্রতিপালনের মহৎ কর্মটি তরুণ ও তার অভিভাবকের মধ্যে যৌথভাবে শিক্ষা দিতে হবে উপদেশ ও উদাহরণ উপস্থাপনের মাধ্যমে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার মাধ্যমেÑ যা কোরআনে কারীম বিরুদ্ধাচারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য অসংখ্যবার প্রয়োগ করেছে। আল্লাহ তাআলা এই উদাহরণ প্রসঙ্গে বলেন, وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ. (العنكبوت-৪৩ ) ‘এই সকল দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য দেই ; কিন্তু কেবল জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এটা বুঝে।’ যেমনিভাবে একটি তরুণের অনুসন্ধিৎসা ও রহস্য উদ্ঘাটনের আগ্রহ থেকে তার প্রতিপালন ও জ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে উপকৃত হওয়া সম্ভব। চাই তা অভিজ্ঞতা, পঠন, অধ্যয়ন অথবা শিক্ষা সফর ইত্যাদি প্রয়োগ করেই হোক না কেন। আল্লাহ তাআলা মিথ্যাবাদীদেরকে ভ্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে তারা জানতে পারে তিনি কিভাবে সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআ’লা বলেন, قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ (العنكبوت-২০ ) ‘বল, ‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর কিভাবে তিনি সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন ?’ এবং তিনি তাদের মৃত্যু সংবাদ দিলেন যারা তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণতি থেকেও কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ كَانُوا مِنْ قَبْلِهِمْ (غافر-২১ ) ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? তাহলে দেখতে পেতো তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিলো।’ জ্ঞান অন্বেষনের জন্য ভ্রমণ আলেম-উলামাদের নিকট প্রসিদ্ধ। তাদের লেখনীতে এ বিষয়ের ওপর ‘অধ্যায় : জ্ঞান অন্বেষণে ভ্রমণ’ নামে স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই ভ্রমণকাহিণীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মুসা আ. এর শিক্ষা সফর। যখন তিনি খিযির আ.-এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করলেন। তার সাক্ষাতের আবেদন করলেন, যাতে তার নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করতে পারেন। কারণ মুসা আ. জানতে পেরেছেন, তার নিকট এমন জ্ঞান রয়েছে যা তিনি জানেন না।
চতুর্থ অধ্যায় :
পুরস্কার ও শাস্তি পুরস্কার তরুণ যদিও সে এখন পুরুষের স্তরে উপনীত হয়েছে তথাপি পুরস্কারের প্রয়োজনীয়তা থেকে সে উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কোরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াত রয়েছে যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলার নেক আমলের বিনিময় পুরস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সুতরাং তরুণ ও তরুণীদের ব্যাপারে এটাকে গুরুত্বহীন ভাবা কোন অবস্থাতেই ঠিক হবে না। বিশেষ করে কষ্টসাধ্য কর্ম সম্পাদনে এবং যে কাজের জন্য বিরাট সাহসিকতার প্রয়োজন হয়। খন্দক যুদ্ধের ঘটনা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম সৈন্যদের মধ্য হতে এমন কাউকে চাচ্ছিলেন, যে শত্র“ সৈন্যদের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে পারবে। সে জন্য তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে হুজায়ফাহ রা. হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আহযাব যুদ্ধের রজনী, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথে দেখতে পেলেন। (প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া) তীব্র ও শীতল বায়ু আমাদেরকে স্পর্শ করে গেলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বললেন- ‘এমন কেউ আছো কি? যে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর এনে আমাকে দিতে সক্ষম, তাহলে আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গী করে উঠাবেন। তখন আমরা সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কোন উত্তর দিলো না। অতঃপর (দ্বিতীয় বার) তিনি সাল্লাল্লাহু আমাদেরকে বললেন- ‘এমন কেউ কি নেই? যে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর এনে আমাকে দিতে পারবে তাহলে আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গী করে উঠাবেন। তখন আমরা সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কোন উত্তর দিলো না। অতঃপর (তৃতীয় বার) তিনি আমাদেরকে বললেন- ‘এমন কেউ কি নেই? যে আমাকে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর এনে দিতে পারবে তাহলে আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গী করে উঠাবেন। তখন আমরা সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কোন উত্তর দিলো না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বললেন- ‘হুজাইফা, তুমি দাঁড়াও, যাও তুমি গিয়ে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর নিয়ে এসো।’ আমার নাম ধরে আহ্বান করার পর আমি কোন উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন- ‘যাও শত্র“বাহিনীর খবর নিয়ে এসো! তাদেরকে তোমার পরিচয় বুঝতে দিও না।’ সেই রাতে প্রচণ্ড ও তীব্র শীতল ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিলো। সে কারণে উক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য দুর্দান্ত সাহসিকতা ও শক্তির প্রয়োজন ছিলো। এই কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দুঃসাহসিক কর্ম সম্পাদনের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। কাজেই যে তার ইচ্ছা পূরণ করবে তার সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন আমার সঙ্গী করবেন।’ তিনি কাউকে শুরুতেই এ ব্যাপারে নির্দেশ করেননি। কল্যাণকর কাজে সাহাবীদের আগ্রহ ও তা বাস্তবায়নে তাদের চূড়ান্ত প্রয়াস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে এই মহান মর্যাদার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি তা তিনবার পুনরাবৃত্তি করা পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায়নি। যা সেই দিনের তীব্র শীত ও প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার দরুণ সৃষ্ট দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে দুঃসাহসিক দায়িত্ব পালনের দিকেই ইঙ্গিত করে। সে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়োজন হয়েছে, তিনি নিজেই সেনাপ্রধান হিসেবে নির্দেশ করেন। সকল দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে যার আনুগত্য অপরিহার্য কর্তব্য। তিনি এই দুঃসাহসিক কাজের দায়িত্ব হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. কে অর্পণ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ ভূমিকা অহুদের যুদ্ধেও নিয়েছিলেন যখন তাঁকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কতিপয় সাহাবীকে মুশরিকরা অবরোধ করে ফেলেছিলো। আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহুদের দিন সাত জন আনসারী ও দুই কোরাইশকে নিয়ে একাকী হয়ে পড়লেন। অতঃপর তারা যখন সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হলো, তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘কে আছে যে আমাদের পক্ষ হয়ে শত্র“দের প্রতিহত করবে, ফলে বিনিময়ে তার জন্য রয়েছে জান্নাত অথবা সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’ এমনিভাবে অভিভাবকের কর্তব্য হলো প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। আর যে কাজটি আল্লাহ তাআলা আবশ্যক করেছেন তার প্রতিদান তো সেটাই যার প্রতিশ্র“তি আল্লাহ তাআলা তার সংযমী বান্দাদের সঙ্গে করেছেন ।
শাস্তি তরুণের এই বয়োঃস্তরে পৌঁছার সাথে সাথে সকল বিরুদ্ধাচরণ ও পাপাচার লিপিবদ্ধ হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা পরকালে এর জন্য তাকে পাকড়াও করবেন যদি মৃত্যুর পূর্বে তা হতে তওবা না হয়ে থাকে অথবা পাপ মোচনকারী কোন নেক আমল তার না থাকে। কোন কোন পাপাচার তো পৃথিবীতে দণ্ডবিধি কার্যকর করণকে অবধারিত করে। এ শাস্তি প্রয়োগের জন্য কেবল অভিভাবকই যথেষ্ট নয়। অতএব এই বয়োঃস্তরে অভিভাবকের উক্ত অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া প্রতিপালনের কোন উপকরণ নয়। বরং তখন প্রতিপালন হবে দণ্ডবিধি কার্যকর করণের মাধ্যমে। কিন্তু অসংখ্য বিরুদ্ধাচরণ রয়েছে যার ইয়ত্তা নেই। এই সকল অপরাধের ক্ষেত্রে অভিভাবকের কর্তব্য হলো, অভিভবক যখন জানতে পারবে তখন তা হতে তাকে বারণ করবে যদিও তা শাস্তির মাধ্যমেই হোক না কেন। উল্লেখ্য যে, শাস্তির উদ্দেশ্য এখানে অবশ্যই প্রহার নয়। বরং কখনো তা হতে পারে ধমক দিয়ে, কখনো ক্রোধ প্রকাশ ও ভীতি প্রদর্শন করে, কখনো ত্যাগ করে অথবা এক দুই দিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে। খেয়াল রাখতে হবে, বয়কট করাটা তার অবাধ্যতা বাড়িয়ে না দেয়। বিদাআ’তী ও পাপাচারীদের বয়কট করার বিধানাবলি সংক্রান্ত জ্ঞানের একটা বিশাল অধ্যায় রয়েছে। অবহেলা না করে প্রয়োজন হলে অভিভাবক তা প্রয়োগ করতে পারেন । আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘মহিলাগণ মসজিদে আসার জন্য অনুমতি চাইলে তোমরা তাদেরকে বারণ করো না!’ (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, ‘এ কথা শুনে তার ছেলে বিলাল বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমরা অবশ্যই তাদেরকে বাধা দেব।’ (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, অতঃপর তার পিতা ইবনে উমার তার দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে খুব করে বকা দিলেন। অনুরূপ আর কাউকে কখনো তাকে বকা দিতে দেখিনি। ইবনে উমার রা. তাকে বললেন-‘আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস বর্ণনা করছি। অথচ তুমি বলছো : ‘আমরা অবশ্যই তাদেরকে বাধা দেব।’ লক্ষ করুন! সন্তান যখন সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক মত প্রকাশ করলো, তাকে সে জন্য শাস্তি দিলেন ও তার থেকে এটা শ্রবণ করার পর তাকে ছেড়ে দেননি। অপরাধ ও ত্র“টি বড় হওয়ার দরুণ তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। অনেক অভিভাবক আছেন যারা তরুণ-তরুণীদেরকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে এমন আচরণ করে থাকেন যা আদৌ ঠিক নয়। সে কারণে তাদের এ ক্ষেত্রে যে সকল ভুল-ত্র“টি সংঘটিত হয়ে থাকে তার মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হলো :
শাস্তি-শাস্তি প্রদানে ত্র“টিসমূহ বহিস্কার করণ কোন কোন কাজ থেকে অভিভাবক যখন তাকে বারণ করতে সক্ষম হবে না অথবা তার তরুণ সন্তানটি তার দিকনির্দেশনায় সাড়া দেবে না। সে কারণে তার ভরণ-পোষণ স্থগিত করে দেবেন অথবা তার ঘরে প্রবেশ করাতে নিষেধাজ্ঞা জারী করবেন। কিন্তু কখনো এটা সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এটা বরং তখন সমস্যার প্রকট আকার ধারণ ও বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর শাস্তির আশঙ্কায় অবশ্য এতে তরুণটি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার এর যে কোন সমাধান নিজের থেকে খুঁজতে আরম্ভ করে দিতে পারে। অবশ্য তখন সর্বাপেক্ষা দ্রুত ও সহজ সমাধান হতে পারে বিপথে ভ্রমণের সূচনা। পরিচিত ভ্রমণটি হতে পারে তাদের পথে যাদেরকে বলা হয় মন্দ বন্ধুমহল। ফলতঃ তারাই হবে এ পথের মূল শিকার, যেখানে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়বে। চূড়ান্ত পর্যায় বাবা তাকে ফিরিয়ে আনার কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার আর কোন উপায়ই খুঁজে পাবে না। কিন্তু এরপর কি হবে ?
সন্তানকে অভিশাপ বা বদ-দোয়া করা মা-বাবা কর্র্তৃক সন্তানের জন্য সামগ্রিক কল্যাণের দোয়া করা যা নবী রাসূলগণের আমলে ঈমানদারদের সুন্নত ছিলো। দেখুন ইবরাহীম আ. যিনি বলতেন- رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي.(إبراهيم-৪০ ) ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে সালাত কায়েমকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও।’ যাকারিয়া আ. বলতেন- رَبِّ هَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً. (آل عمران-৩৮ ) ‘আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর।’ একজন ঈমানদারের প্রার্থনা - وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي. (الأحقاف-১৫ ) ‘আমার জন্য আমার সন্তান-সন্ততিদিগকে সৎকর্মপরায়ণ কর।’ ঈমানদারগণের প্রার্থনা- هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ. (الفرقان-৭৪ ) ‘আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর।’ সন্তানের সৌভাগ্যের অন্যতম সোপান মা-বাবার দোয়া। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী- ‘তিনটি দোয়া আল্লাহর নিকট নিশ্চিত কবুল যোগ্য।’ সেখানে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তানের জন্য বাবার দোয়াকেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক মানুষ এই দোয়াকে সন্তানের উপকারের জন্য ব্যবহার করার পরিবর্তে তারা বিষয়টাকে সম্পূর্ণরূপে উল্টিয়ে দিতে অভ্যস্ত। যখন তারা ওদের ওপর ক্রোধান্বিত হয় অথবা সন্তানরা এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে যা তাদের অসন্তুষ্টির কারণ হয়, তখন তারা ওদেরকে অভিশাপ দেয়, বদ-দোয়া করে থাকে। বলে থাকে - ‘আল্লাহ, ওকে ধ্বংস করে ফেল, ওকে শাস্তি দাও অথবা ওর ওপর অভিসম্পাত কর! কেন মৃত্যু তোকে চোখে দেখে না। কত মানুষকে আল্লাহ নিয়ে নেয়, তোকে নিতে পারে না?’ এগুলো বলার স্থলে তারা বলতে পারেন : হে আল্লাহ, ওকে হেদায়েত দাও, ওকে সংশোধন করে দাও, ওকে পরিপাটি করে দাও এবং ওর তাওবা কবুল কর ইত্যাদি। কারণ এটা হলো উত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। এর মধ্যে কারো জন্য কোন ক্ষতি নেই, বরং এতে সন্তান ও বাবা উভয়ের জন্য কেবল কল্যাণ আর কল্যাণই নিহিত রয়েছে। এমন দোয়া করা উচিত নয়, যদি তা বাস্তবায়িত হয়ে যায়, তাহলে মা-বাবা দুঃখ ও অনুতাপে তার হাতের আঙ্গুল কাটবে। ফলে সে হবে নিতান্ত লজ্জিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তানদেরকে অভিশাপ দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ এর মধ্যে এমন বিপদ নিহিত যেখানে কোন ধরনের উপকারিতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের, তোমাদের সন্তানদের ও তোমাদের সম্পদের ওপর অভিশম্পাত কর না। তোমরা ঐ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহর সঙ্গে ঐক্যমত্যে যেওনা যখন আল্লাহর নিকট কোন দান প্রার্থনা করলে তিনি তা তোমাদের জন্য কবুল করে থাকেন।’
জরিমানা অথবা ছোট ভাই-বোনদের সামনে তাকে লজ্জিত করা তরুণ-তরুণীদের এ বয়সে আত্মমর্যাদাবোধ প্রবলভাবে ঊজ্জীবিত হয়ে থাকে। এই পথ অথবা পদ্ধতি তাদের উভয়কেই ভীষণভাবে আঘাত করে। যার ফলে অনেক সময় অভিভাবকদের সাথে তাদের শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। উপরন্তু এই পদ্ধতির বারংবার প্রয়োগ তাকে অবাধ্যতা ও তার কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতার স্বপক্ষে যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন ও অভিভাবকের ভুলত্র“টিগুলো খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হতে উদ্যত করবে। অথচ অন্য দিকে অভিভাবকগণ কেবলমাত্র এতটুকু করেই ক্ষ্যন্ত থাকেন না। বরং তাদেরকে অপরিচিত ব্যক্তি অথবা সহপাঠি ও বন্ধুদের মত নিকটতম লোকদের সম্মুখে লজ্জা দেন ও তিরস্কার করে থাকেন। অথচ এর অবশ্যম্ভাবী অশুভ পরিণতি সম্পর্কে তার কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই।
অবমূল্যায়ন ও তুচ্ছ জ্ঞান করা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত উভয় প্রকারের ভুল-ত্র“টি থেকে কেউই মুক্ত নয়। কোন কোন অভিভাবক রয়েছেন যারা চান যে, তার সন্তান হবে একেবারে নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ। ফলে কোন পদস্খলনকেই তারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারেন না। বরং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও কঠিন হিসাব নিয়ে থাকেন। এ কারণে অনেক সময় তরুণ সন্তানটি অভিভাবককে তুচ্ছজ্ঞান ও অবমূল্যায়ন করতে পারে। যার বহিঃপ্রকাশ কয়েকভাবে ঘটতে পারে। যেমন : কথাবার্তা অথবা কোন সময় কর্মের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ। যথা, ছোটদেরকে তার ওপর প্রাধান্য দেয়া, তার উর্ধ্বতনের স্থানে তাকে স্থাপন করা, বড়কে উপেক্ষা ও তার দিকে কোনরূপ ভ্রক্ষেপ না করে ছোটদের সঙ্গে পরামর্শ করা ও তার মত অনুযায়ী কর্ম প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেন সে অনুপস্থিত প্রভৃতি।
কোন অপরাধ বা বিরোধিতাকে হালকা করে দেখা একদিকে যেমন এমন অভিভাবক রয়েছেন যারা সামান্য অপরাধে কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকেন। অপর দিকে বড় বড় অপরাধের ক্ষেত্রেও শাস্তি দানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে থাকেন এমন অভিভাবকের সংখ্যাও একেবারে কম নয় অথচ উভয় কাজই নিন্দনীয়। তরুণ- তরুণীদের থেকে কোন ত্র“টি সংঘটিত হয়ে গেলে তা হালকা করে দেখা অথবা এক্ষেত্রে এমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা যে, ‘এ বয়সে এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার’ উচিত নয়। যদি সে স্বীয় অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ওখান থেকে মুক্তির পথ অনুসন্ধানরত অবস্থায় তাওবা করে ফিরে আসে তবুও। কারণ, এ অবস্থায় তাকে যদি কোন ভর্ৎসনা তিরস্কার ও লজ্জা দেয়া না হয় ‘সে অপরাধ স্বীকার করে তাওবা করে ফিরে এসেছে’ শুধূমাত্র এ কারণে, তাহলে সে বিষয়টিকে হাল্কা মনে করে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। ঐ লোকটির দিকে লক্ষ করুন, যে, পবিত্র রমজান মাসে স্ত্রী সম্ভোগ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট ফতওয়া জিজ্ঞাসা করার জন্য এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন- ‘পবিত্র রমাদান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাতে এক লোক মসজিদে নববীতে এসে বলে- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি দগ্ধ হয়ে গেছি, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন- ‘তোমার কি হয়েছে ?’ উত্তরে সে বললো- ‘আমি স্ত্রীর সাথে মিলন করে ফেলেছি।’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘সদকা কর।’ এরপর সে বললো- ‘হে আল্লাহর নবী, আমার তো কোন সম্পদই নেই। সুতরাং আমি সদকা করতে সক্ষম নই।’ তিনি বললেন- ‘তুমি বসো!’ তখন লোকটি বসে রইল। ইতিমধ্যে খাদ্য সামগ্রী বোঝাই গাধা হাঁকিয়ে এক ব্যক্তি আগমন করলো। এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘একটু আগে যে দগ্ধলোকটি এসেছিল সে কোথায়?’ তখন লোকটি দাঁড়িয়ে গেলে পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘যাও এটা নিয়ে সদকা করা গিয়ে।’ অতঃপর সে বললো, ‘আমাদের ছাড়া অন্য কাউকে?’ আল্লাহর শপথ! আমরা ক্ষুধার্ত ও কপর্দকশূন্য।’ এরপর তিনি বললেন- ‘তাহলে তোমরাই তা আহার করো!’ ভদ্রলোক তার অপরাধ স্বীকার ও তাওবা করে সমাধান জানার জন্য এসেছে। এর প্রমাণ তার কথা ‘আমি দগ্ধ হয়ে গেছি, আমি পুড়ে গেছি’ যার অর্থ তার কৃত অপরাধ বোধ ও তার অবগতি। যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার তাওবার দিকে তাকিয়ে তাকে কোন শাস্তি দেননি। আর তা ছাড়া তার কর্মটি দণ্ডবিধির আওতায় পড়ে এমন অপরাধও নয়। এতদসত্ত্বেও তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অপরাধটিকে খাটো করে না দেখে বললেন- ‘একটু আগে যে দগ্ধ লোকটি এসছিলো সে কোথায়?’ যা থেকে প্রতিভাত হয় যে, তার সে অপরাধকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যাবে না। অনন্তর পাপের বৈশিষ্ট্য হলো তা আগুনের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় যা মানুষকে ভষ্মীভূত করে দেয়। এই হলো পদ্ধতি, তরুণ-তরুণীদের এ জাতীয় দণ্ডবিধিমুক্ত অপরাধে নিমজ্জিত হওয়ার পর যা অভিভাবকের প্রয়োগ করা একান্ত কর্তব্য। ইমাম বুখারী রহ. এ বিষয়ের ওপর একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। ‘পর্ব : যে ব্যক্তি দণ্ডবিধির আওতাধীন নয় এমন কোন অপরাধ করলো, অতঃপর তা রাষ্টপ্রধান বা বিচারপতিকে অবহিত করা হলো। যদি অপরাধী তাওবা বা আত্মসমর্পণ করে সমাধান জানার জন্য আসে তাহলে তার ওপর শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। তরুণ ও তরুণীদের থেকে অপরাধ সংঘটিত হলে তা তুচ্ছ করে না দেখার অর্থ এ নয় যে, অভিভাবক তাকে অব্যাহতভাবে লজ্জা দিতেই থাকবে। যখন সে আলোচনা করবে, কোন কথা অথবা কোন কাজ করবে তখনই তাকে বলা হবে : তুমি হলে এই, এই। কারণ, এই পদ্ধতি সংশোধন নয় তাকে কেবল ধ্বংস করতে পারবে। সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে :التعيير হলো বর্তমানকালে কারো পূর্ব সংঘটিত অপরাধের জন্য তিরস্কার ও দোষারোপ করা, চাই তার তাওবা জ্ঞাত হোক বা অজ্ঞাত। তবে অন্যায়ে লিপ্ত হওয়ার সময় বা তার পরক্ষণে লজ্জা দেয়ার যার সামর্থ আছে তার ওপর এটা কর্তব্য। আবার কখনো বা দণ্ডবিধি অথবা শাস্তি বিধান করা অবশ্যক হয়ে যায়। এসবই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের পর্যায়ভুক্ত। দোষ-ত্র“টি অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করা ও অজুহাত পেশ অগ্রাহ্য কিংবা অবিশ্বাস করার ফলে কখনো কখনো তরুণ-তরুণীদের থেকে এমন অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে যা কেউ দেখেনি অথবা কেউ টের পায়নি। সে কারণে অভিভাবক অনুসন্ধান ও ছিদ্রান্বেষণ করতে থাকে তার কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে যেতে পারে এ আশংকায়। অতঃপর সেটা নিয়ে তার মুখোমুখি হয়। অথচ কেবলমাত্র কিছু অলীক কল্পনা ও নিছক আশঙ্কা ছাড়া তার কাছে কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। এতে সম্পর্ক ছিন্ন করা, সন্দেহের বীজ বপণ ও আস্থা হীনতা ব্যতীত অন্য কোন উপকারিতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘রাষ্টপ্রধান যদি প্রজা সাধারণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেন, তাহলে তিনি যেন তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন। কখনো কখনো তরুণ-তরুণীদের থেকে এমন কিছু কর্মও সংঘটিত হয়ে থাকে যাকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় যদি এ ব্যপারে সে কোন ওজর পেশ করে তবুও। বাস্তবেও যদি সেটা যুক্তিসঙ্গত অপারগতার উপযুক্ত হয় তবুও অভিভাবকের এই কথা বলে তাকে দিকনির্দেশনা উচিত হবে না - তুমি মিথ্যাবাদী ইত্যাদি। এমনকি এ মর্মে একাধিক আলামত তার নিকট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঐ বাহানা প্রকাশ তার জন্য বিশুদ্ধ নয়। কারণ এভাবে পরিত্রাণের প্রচেষ্টাই প্রমাণ করে যে, তার কর্মকাণ্ডের মন্দানুভূতি তার হয়েছে। কেবল এই অনুভূতিই তাকে সে কর্ম থেকে দূরে রাখতে সক্ষম। ‘সে বলেছে অথবা করেছে’ অভিভাবক কর্তৃক এ মর্মে চাপ প্রয়োগ অভিভাবকের অন্তরের রুক্ষতা ও কাঠিন্য প্রমাণ ভিন্ন অন্য কোন ফল দেবে না। কারণ, সে যতক্ষণ বিশ্বাস করবে যে, তার এ কর্ম সম্পর্কে কেউ অবহিত নয়, তা গোপন রাখতে ও কারো নিকট প্রকাশ না করতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এটাই তার কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়ার সঠিক পথ। পক্ষান্তরে যখন জানতে পারবে যে, জনসাধারণ তার ঐ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনে গেছে তখন এ ধারণাটাই তাকে উক্ত অপরাধ লুক্কায়িত না রাখতে ও জন সম্মুখে তা প্রকাশ করে দিতে উস্কানি দেবে। সাধারণত এটা অকল্যাণ ও মন্দের পথ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আমার প্রত্যেক উম্মতকে ক্ষমা করা হবে তবে যারা নিজেদের অপরাধ প্রকাশ করে দেয় তাদের নয়।’ এ প্রেক্ষিতে অভিভাবককে অতি সূক্ষ্ম পদ্ধতিসমূহ অবলম্বন করতে হবে যা তরুণ তরুণীদের মধ্যে ‘অভিভাবকের নিকট তাদের কোন কৌশল প্রকাশিত হয়নি’ এ উপলব্ধি জন্ম দিতে সক্ষম হবে। যদিও তিনি ঐ মুহূর্তে তাদেরকে কোন দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন না। অভিভাবকের বিচক্ষণতা সম্পর্কে তার অবগতির কারণে এ পদ্ধতি উক্ত অপরাধের মূলোৎপাটন ও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে ও দ্বিতীয় বার ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে সহায়ক হবে । পক্ষান্তরে তরুণের অজুহাত যদি একেবারে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ কখনো কৌশলটি তার নিকট প্রকাশিত হয়ে গেছে মর্মে ইঙ্গিত করে থাকে তাহলে তা তাকে আরো ঔদ্ধ্যত্যপনা ও অপরাধ করতে উস্কানি দিয়ে থাকবে। আবার কখনো কখনো অস্বীকৃতি ও মিথ্যা প্রতিপন্নতার দ্বারা তাদেরকে সম্মোধন করলে বিষয়টা দুঃখজনক পরিস্থিতির অথবা মিথ্যা শপথের দিকে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। অবশ্য এরূপ ঘটনা খুব স্বল্প সংখ্যক লোকের বেলায় ঘটে থাকে। এমনটি হতেই পারে। আমরা সেই ঘটনার দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাবো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে তার সমাধান দিয়েছেন। যায়েদ বিন আসলাম রা. থেকে বর্ণিত, খাওয়াত বিন যুবাইর রা. বলেন, ‘আমরা র্মারায-যাহরান নামক স্থানে অবতরণ করি। (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, ‘আমি আমার তাবু থেকে বের হলাম। দেখলাম কয়েকজন মহিলাকে পরস্পর কথাবার্তা বলছে। আমার ভাল লাগল। অতঃপর আমি আমার সফরের ব্যাগটা বের করি। এরপর সেখান থেকে একজোড়া কাপড় বের করে পরিধান করি। অতঃপর আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে বসে পড়ি। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর তাবু থেকে বের হয়ে এসে বলেন, ‘হে আব্দুল্লাহর বাপ, তুমি মহিলাদের আসরে বসলে কি কারণে? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে তাঁর ব্যক্তিত্বে অভিভূত ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছি। আমি বললাম- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার একটি উট ছুটে গেছে, আমি তাকে বাঁধতে চাই। অতঃপর তিনি সামনে চললেন। আমি তাঁর অনুসরণ করলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমার নিকট তার চাদর নিক্ষেপ করলেন ও বৃক্ষরাজির আড়ালে চলে গেলেন। আমি বৃক্ষের শষ্য শ্যামলিমার মধ্যে যেন তাঁর মেরুদণ্ডের শুভ্রতা প্রত্যক্ষ করছিলাম। অতঃপর তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন সম্পন্ন করলেন ও অজু করে সামনে আসলেন। তখনো অজুর পানি তার দাড়িগুচ্ছ থেকে গড়িয়ে বক্ষদেশ স্পর্শ করছিলো। অতঃপর তিনি বললেন- ‘হে আব্দুল্লাহর পিতা, তোমার ছুটে যাওয়া উট সম্পর্কে কী করলে?’ অতঃপর আমরা পথ চলা শুরু করলাম, এরপর পথিমধ্যে কেবল বলতেন ‘হে আব্দুল্লাহর পিতা, তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, সেই পলাতক উটটির কি হলো?’ যখন ‘আমি ধরা খেয়েছি’ অনুভব করলাম তখন দ্রুত মদীনায় ফিরে গেলাম। মসজিদ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মজলিস থেকে দূরে থাকলাম। যখন এ অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকল, এক সময় আমি মসজিদে না যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করলাম। এরপর আমি মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর একটি কক্ষ থেকে হঠাৎ বের হয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে দুই রাকাআত সালাত আদায় করে নিলেন। তবে আমি সালাত দীর্ঘ করি এই আশায় যে, তিনি আমাকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তিনি বললেন- ‘আব্দুল্লাহর বাপ, তোমার যতক্ষণ মন চায় সালাত দীর্ঘ কর। তবে আমি তোমার সালাত শেষ না করা পর্যন্ত দাঁড়াচ্ছি না। তখন আমি মনে মনে সংকল্প করলাম- ‘অবশ্যই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গিয়ে আমার ভুল স্বীকার করব ও আমার ব্যাপারে তাঁর পবিত্র অন্তরকে সংশয়মুক্ত করবই। এরপর যখন তিনি বললেন- ‘হে আব্দুল্লাহর বাপ, তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমার সেই ছুটে যাওয়া উঁটটি সম্পর্কে কী করলে? অতঃপর আমি বললাম- ‘সেই সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যের আহ্বান নিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে ঐ উটটি আর কখনো হারিয়ে যায়নি। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি রহম করুন।’ কথাটি তিনবার বলেছেন। এরপর কখনো তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পেছনের কোন বিষয় পুনরাবৃত্তি করেননি। এখানে বাহ্যিক অবস্থা দৃষ্টেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তার অজুহাত পেশ শুদ্ধ নয়। তা সত্ত্বেও তিনি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাননি। কিন্তু যখনই তার সঙ্গে সাক্ষাত হতো প্রশ্নের পুনরাবৃত্তির করার মাধ্যমে ঐ কর্মটি উল্লেখ করতেন। ফলে অনন্যোপায় হয়ে কৃতকর্ম স্বীকার করতে বাধ্য হতো। যখন তার পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় হয়ে যাবে তখন তাকে ডাকবে ও দ্বিতীয় বার সেই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করবে না। কারণ স্বীকারোক্তির পর লজ্জা দেয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শের পরিপন্থী।
পঞ্চম অধ্যায় :
দিকনির্দেশনা ও উপদেশাবলি (পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে আলোচিত দিকনির্দেশনা ও উপদেশবালির সঙ্গে পার্থক্য নির্ণয়সহ একটি সংযোজন।)
তরুণের অন্তরের সংরক্ষণ তরুণের বিভিন্ন দিকের পরিপূর্ণতা অর্জনের সাথে সাথে পরিবার, মসজিদ ও বিদ্যালয়ের মত পরিচিত গণ্ডির বাহির থেকেও জ্ঞান আহরণ ও গ্রহণ করার সামর্থ্য অর্জিত হয়ে থাকে। অতএব দুষ্ট লোকের দুষ্টামী যেন কল্যাণকামী লোকের কল্যাণের ওপর কার্যত দ্রুতগামী হতে না পারে। সমগ্র দেহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ড সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকলে গোটা দেহই সুস্থ থাকবে। পক্ষান্তরে তা অসুস্থ্য হয়ে পড়লে গোটা শরীরটাই অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ সুতরাং এই হৃদপিণ্ডের সযতœ পরিচর্যার জন্য যার মাধ্যমে হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকতে পারবে ঐ বিষয়গুলোর দিকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো : কিয়ামুল লাইলের প্রতি অনুপ্রাণিত করা। সাহাবায়ে কেরামের প্রাথমিক প্রজন্মগুলো কিয়ামুল লাইলের ওপর প্রশিক্ষিত ও প্রতিপালিত হয়েছিলেন- যাদের সৌজন্যে সেকালে ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আল্লাহ তাআলা কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে ইরশাদ করেন- إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا. (المزمل-৬ ) ‘নিশ্চয় এবাদতের জন্য রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল।’ ইবনে কাছির রহ. বলেন, ‘উদ্দেশ্য হলো কিয়ামূল লাইল রসনা ও হৃদপিন্ডের মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন স্থাপনকারী এবং কোরআন তেলাওয়াতে একাগ্রতা সৃষ্টিকারী। সেকারণে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا’ অর্থাৎ তা কিয়ামুন্নাহারে কোরআন তেলাওয়াত ও তা অনুধাবন করার চেয়ে অন্তরে বেশি একাগ্রতা সৃষ্টিকারী। কারণ দিবস হলো মানুষের কাজের জন্য বেরিয়ে পড়া শব্দদুষণ ও জীবিকা নির্বাহের সময়।’ কতই না উত্তম সেই অভিভাবক যে নিজে কিয়ামুল লাইল আদায় করে ও তার তরুণ ছেলে মেয়েদেরকেও নামাজের জন্য জাগ্রত করে তাদেরকে নিয়ে যতটুকু সম্ভব এক সঙ্গে জামাত সহকারে সালাত আদায় করার চেষ্টা করে থাকেন। তাদের নিদ্রা ভঙ্গের জন্য যৎ কিঞ্চিত পানি ছিটানোর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইঙ্গিতও রয়েছে। যেভাবে তরুণ- তরুণীদের সামনে পরকালের তথা জান্নাতের আলোচনারও পুনরাবৃত্তি করতে পারে। জান্নাতে প্রবেশ করার করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে পারেন। এমনিভাবে জাহান্নামের বিবরণ দিবেন। তাদের সামনে নবী ও রাসূলদের ইতিহাস, জীবনী ও আল্লাহর পথে তারা যে অবর্নণীয় দুঃখ কষ্ট ও অসহনীয় নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিভাবে তারা এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করেছেন। নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য কি কি সাহায্য এসেছে তা পর্যালোচনা করতে পারেন।
কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঁকড়ে ধরা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে রাসূলের বিশুদ্ধতা এবং এতদুভয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী সকল কিছুর অসারতা মুসলিম উম্মাহর নিকট একটি জাজ্জ্বল্যমান ও দিবালোকের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। অধিকাংশ মুসলমান এমনকি তাদের শিশুরা পর্যন্ত বিষয়টা সংক্ষিপ্তভাবে অনুধাবন করে থাকে। কিন্তু অনৈসলামী সমাজগুলো থেকে অসংখ্য দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণা আমাদের সমাজের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। যার কোনোটা লেখনী আবার কোনোটা প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কোনোটা আবার কোন কোন মুসলিম দেশের শিক্ষাকারিকুলামকেও দংশন করতে সক্ষম হয়েছে। এ দৃশ্যপটে একজন অভিভাবকের কর্তব্য হলো, ঐ দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণাগুলো সম্পর্কে সতর্ক হওয়া যা তার চতুর্পাশের পরিবেশের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সেগুলোর কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী হওয়ার বিবরণ দেয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ের ওপর রচিত ছোট ছোট পুস্তিকার সহায়তা নেয়া যেতে পারে। যার মধ্যে অত্যন্ত সহজ সাবলীলভাবে উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও তরুণকে পরিতুষ্ট করা এই বয়সে তরুণ-তরুণীদের বুদ্ধিমত্তা শরিয়তের বিধানাবলির ক্ষেত্রে সে নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়ার প্রমাণে পরিপূর্ণতা অর্জন করে থাকে। এই অবস্থায় অভিভাবকের গবেষণাসমূহ, দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা চর্চার প্রয়াস যদি অতৃপ্তিদায়ক হয়, তাহলে সেটা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। তরুণ-তরুণীদের নিকট তার কোন গ্রহণযোগ্যতা অথবা আহ্বান না থাকলে তা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। কাজেই আলোচনা, পরিতুষ্ট করা ও প্রমাণসহ দাবী উত্থাপণ ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। কারণ, তরুণ-তরুণীরা এ বয়সে পৌঁছলে আলোচনা হৃদয়ঙ্গম করা ও অপরাপর বিষয়গুলো বোঝার মত আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা তাদের অর্জিত হয়ে থাকে। এমনকি তারা ভুল ও শুদ্ধ এবং এতদুভয়ের প্রমাণাদিও উপলব্ধি করতে পারে। কথোপকথন ও পরিতুষ্ট করণের দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, অভিভাবক যা বলবে সবকিছুই সে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে। কারণ দৃষ্টিভঙ্গি গবেষণা ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত গবেষণামূলক বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক ও নিক্ষেপযোগ্য। কোন প্রকারের চাপ অথবা বল প্রয়োগ না করে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করে যাবেন। তবে নিশ্চিত প্রমাণিত বিষয়, অধিকাংশ ওলামার বক্তব্য অথবা পার্থিব বিষয়ে অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতামত কেবলমাত্র বাধ্যমূলক করা যাবে। কিন্তু তা নিরেট অভিভাবকের মত হতে পারবে না। এ সবই হলো জ্ঞানগত অথবা তথ্যগত বিষয়ে। যেমন : বিশ্বাস পরিকল্পনা ও গবেষণা। পক্ষান্তরে অভিভাবকের জন্য কার্যগত বিষয়সমূহ সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক করা বৈধ, যেখানেই কর্ম সম্পাদনই হলো মূখ্য কাম্য। তবে অবশ্যই তা তরুণ-তরুণী সন্তানদের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্তভর্ূুক্ত হতে হবে। উদাহরন স্বরূপ, বাবা যদি এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায় অথবা এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে স্থানান্তরিত হতে সংকল্প করে থাকেন, তাহলে বিষয়টা তিনি সন্তানদের সামনে উপস্থাপন করবেন এবং এ ব্যাপারে তাদের মতামত নেবেন। কিন্তু আলোচনার পরও যদি তারা কোনরূপ পরিতুষ্টি অর্জন করতে না পারে তাহলেও এক্ষেত্রে অভিভাবকের উক্ত কর্ম সম্পন্ন করা বৈধ হবে।
প্রজ্ঞা অথবা কারণ বর্ণনাসহ উপদেশ দান আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন তরুণদের উপদেশ দানের ক্ষেত্রে খুব সংক্ষিপ্ত করে থাকেন। অথচ উপদেশ হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ অনিবার্য বিষয়। কিন্তু তা এককভাবে যথেষ্ট নয় ; বিশেষতঃ এমন বিষয়ে যার পরিণতি সম্পর্কে সে অবগত। যেমনিভাবে শরিয়তের একটি বিধান এককভাবে আলোচনা করা এ অবস্থায় যথেষ্ট নয়। বরং এজাতীয় পরিস্থিতিতে উপদেশ ও বিধান বর্ণনার সাথে যদি কারণ নির্ণয় অথবা রহস্য উদ্ঘাটন করা হয় ; তাহলেই আল্লাহর ইচ্ছায় কেবল তা উপকারী হতে পারে। নিম্নের ঘটনা থেকে আমরা তার উদাহরণ পেশ করতে পারি। ইমাম আহমদ রহ. তার মুসনাদে আবু উমামা রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘জনৈক উদীয়মান তরুণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন! উপস্থিত জনসাধারণ তাকে তিরস্কার করতে লাগলো। তারা বললো, থামো। চুপ করো। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তুমি আমার কাছে এসো! এরপর সে তাঁর একেবারে নিকটে চলে গেল। (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, ‘এরপর সে বসে পড়লে তিনি বলেন, ‘এটা কি তুমি তোমার মায়ের জন্য পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার মায়ের সঙ্গে এটা পছন্দ করতে পারে না।’ আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার কন্যার জন্য তা পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার কন্যার জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।’ আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার বোনের জন্য তা পছন্দ করবে? সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার বোনের জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।’ তিনি আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার ফুফির জন্য তা তুমি পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার ফুফির জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।’ তিনি আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার খালার জন্য তা তুমি পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন।’ তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার খালার জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।” (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, অতঃপর তিনি তাঁর হাত মুবারক তার গায়ে সস্নেহে বুলাতে বুলাতে বললেন- ‘হে আল্লাহ, তুমি ওর পাপরাশি ক্ষমা করে দাও। ওর অন্তরকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে দাও। এবং ওর লজ্জাস্থানকে তুমি সুসংহত কর।’ এরপর সেই উদীয়মান তরুণটি আর কোন দিকে তাকায়নি।’ লক্ষ্য করুন, এখানে তরুণটির নিকট ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টা গোপন ছিলো না। এ কারণেই সে অনুমতি প্রার্থনা করতে এসেছিল। ‘আল্লাহকে ভয় কর! এটা হারাম অথবা বৈধ নয়’ এখানে এই কথা বললে হয়তো বা তরুণটির কোন উপকারে নাও হতে পারতো। তা ছাড়া এ বিধান তারও গোচরীভূত হওয়ার ফলে তার অন্য কোন বিষয়ের প্রয়োজন ছিল। সে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সঙ্গে বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তা হলো ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন। রহস্যটা হলো ভিকটিম নিশ্চয় কারো মা, কন্যা, বোন, ফুফি অথবা খালা হয়ে থাকবে। এছাড়া অন্য কিছূ হওয়া সম্ভব নয়। তরুণ যখন নিজের জন্য তা অনুমোদন করতে পারল না, তাহলে অন্যেরা নিজেদের জন্য তা পছন্দ করবে কিভাবে। কীভাবে এর বৈধতা দেবে? অতএব এই আত্মিক প্রমাণ ঐ উদীয়মান তরুণের অন্তর থেকে উক্ত কুকর্মের বাসনা চিরতরে দমন করে দিয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে সত্য ও সংযমের ওপর দৃঢ়পদ থাকার জন্য দোয়া করা হল। অতএব এজাতীয় পরিস্থিতিতে আমরাও এরকম পদক্ষেপ নিতে পারি। মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারি। এ ধরনের কর্মের ক্ষেত্রে এরূপ বলা যেতে পারে : ‘তুমি তার স্থানে যাও, এবং আমাকে বল তুমি কি করছ?’ মানুষ যদি অসংখ্য ব্যাপারে এরূপ কর্ম করতে পারতো, তাহলে মানুষের মধ্যে অনেক সমস্যার সৃষ্টিই হত না। কোন মানুষ যদি নিজেকে তার স্থানে উপস্থান করে যে তার আচরণ ও কর্ম তৎপরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাহলে কখনো কখনো সে ঐ পথটি অথবা তার নিকটবর্তী কোন পথ অবলম্বন করে থাকবে। সুতরাং কর্তব্য হলো তাকে এই পথের দিশা দেয়া।
নৈকট্য অর্জন ও পরস্পর বন্ধুত্ব স্থাপন এই বয়সে তরুণ অথবা তরুণীরা গবেষণা ও পরিকল্পনায় অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। অবশ্য এটা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। বরং তারা মনে করে গভীর গবেষণা করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে যার মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য থেকে ফলাফল চয়ন করা যায় ও গবেষণার উক্ত বিষয়কে তার অংশসমূহের মধ্যে বিভক্ত করা যায়- যার দ্বারা বিষয়টা গঠিত হয়েছে। ফলে তার অন্তর্নিহিত তথ্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে। ফলশ্র“তিতে সে যখন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকবে তখন তার চেয়ে যে অভিজ্ঞ ও বড় তার মত দ্বারা আলোকিত অথবা কোন পরামর্শ ব্যতিরেকে অথবা যে কোন পরামর্শের উপযুক্ত নয় এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে সমাধানের প্রচেষ্টা চালাবে। তবে তরুণ, অভিভাবক, মা-বাবা ও শিক্ষকের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে। যেখানে থাকবে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মূল্যায়ন। থাকবে না কোন তাচ্ছিল্য ও অবমূল্যায়ন। সেখানে শুধু থাকবে তরুণ সন্তানদের প্রতি উৎসাহ, স্নেহ ও মমতা। তাহলে সে এজাতীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অবশ্যই অভিভাবকের নিকট বিষয়টা উপস্থাপন করবে নিশ্চয়। তার পরামর্শ নেবে, তিনি যে দিকনির্দেশনা ও উপদেশ দেবেন তা সাদরে গ্রহণ করবে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে তরুণের নৈকট্য অর্জন ও তার মধ্যে সুসম্পর্কের বীজ বপণ করা এবং যে সমস্যা তার ভেতরে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে খুব কাছ থেকে জানতে সচেষ্ট থাকা মা-বাবা ও শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য।
পবিত্রতা বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ তরুণ-তরুণীরা বয়োঃসন্ধিক্ষণে উপস্থিত হলে প্রত্যেকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পবিত্রতা অর্জনের বিধানাবলি সংক্রান্ত বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। কারণ এ স্তরে নতুন এমন অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয় যা ইতোপূর্বে ছিলো না। যে কোন মসজিদে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তাহারাতের বিধানাবলি বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা উচিত। সেখানে একজন বিজ্ঞ শিক্ষক দরস পরিবেশন করবেন। অপর দিকে একই সাথে তরুণীদের জন্য কোন মহিলা শিক্ষক ক্লাশ নেবেন। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্যার প্রকৃত সমাধান। বিশেষ করে আলোচনাটা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয় বরং দলকে সম্মোধন করে হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোন সমস্যা নেই। বরং মসজিদে এজাতীয় প্রশিক্ষণের অনুষ্ঠান আলোচ্য বিষয়ের ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদাটাকে একটু বৃদ্ধি করে বৈকি। সুতরাং এ বিষয়ে কোন অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য অথবা অযৌক্তিক মন্তব্য করার আর কোন অবকাশ থাকল না। বরং সকলেই অনুভব করতে পারবেন যে, এই হলো প্রকৃত দ্বীন। কারণ এখানে তো একজন বিজ্ঞ আলেমের পক্ষ থেকে দ্বীন অথবা তালেবে ইলম সম্পর্কে আলোচনা হয়ে থাকে। তা আবার এমন স্থানে বসে যেটা কোরআন তেলাওয়াত ও সালাতের মত সৎ কর্ম সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত।
নম্রতা, অনুগ্রহ প্রদর্শন ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ না করা ছাত্রের উচ্চ স্থান অর্জনের আগ্রহ কখনো কখনো অভিভাবককে তার করণীয় পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়ে থাকে। ফলে তা শিক্ষার্থীর জন্য দুঃসাধ্য হয়ে যায়। এমনকি শিক্ষার্থী এতে বেশ বিরক্ত হয়েও উঠে। কিন্তু তাদের ধারণ ক্ষমতার দিকে সযতœ দৃষ্টি রাখলে তবে প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালন ফলপ্রসূ হতে পারে। আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট সমবয়স্ক একদল যুবক আসল। তারা তাঁর নিকট বিশটি রাত অবস্থান করল। অতঃপর যখন তিনি অনুধাবন করলেন যে, তাদের নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়টা তাদের নিকট একটু কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, তখন তাদেরকে অন্তিম উপদেশ দিলেন। এ প্রসঙ্গে আমাদের নিকট হযরত মালেক বিন হুওয়াইরিছ রা. হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট আগমন করলাম, তখন আমরা সমবয়স্ক টগবগে যুবক ছিলাম। আমরা তাঁর নিকট বিশ দিন বিশ রাত অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কোমলহৃদয় ও বিনম্্র প্রকৃতির মানুষ। এরপর যখন তিনি বুঝতে পারলেন আমরা নিজেদের পরিবারের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছি এবং আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমরা যাদের পেছনে রেখে এসেছি তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। তখন আমরা তার নিকট সবকিছূ খুলে বললাম। তিনি বললেন- ‘তোমরা তোমাদের পরিবারের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মধ্যে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষা দাও। তাদেরকে আদেশ করো।’ আরো কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন যা আমি মনে রাখতে পেরেছি অথবা আমার মনে নেই। ‘তোমরা সালাত আদায় করো যেভাবে তোমরা আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ। অতএব যখন নামাজের সময় উপস্থিত হবে তখন তোমাদের মধ্যে একজন আযান দেবে ও তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞজন নামাজে তোমাদের ইমামতি করবে।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের পরিবারের দিকে আগ্রহ লক্ষ্য করলেন তখন তাদেরকে সেদিকে ফিরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিলেন। এই হাদীস থেকে এ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হওয়া ও তার প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত হওয়া তাদের প্রতি বিনম্র হওয়া ও মানবিক দুর্বলতাকে অবজ্ঞা না করা শিক্ষক ও অভিভাবকবৃন্দের একান্ত কর্তব্য। সুতরাং তাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করবেন না যাতে তাদের কষ্ট হয়। তারা ফেরেশ্তা নয়, বরং তারাও অন্য মানুষের মতই মানুষ।
তাকে পুরুষদের সমাজে নিয়ে যাওয়া যার বয়োঃসন্ধির নিদর্শনগুলো ফুটে উঠেছে সেই তো একজন পুরুষ। এই ভিত্তিতে সে পূরুষদের সমাজে যেতে পারে। তার সঙ্গে এই দৃষ্টিতে আচরণ করতে হবে। তারা এখনো শিশু অথবা বাচ্চা এই ভিত্তিতে আচরণ করা কখনোই সমীচীন হবে না। অনুরূপ তরুণীরাও। ফলে এই আচরণই তাদের কর্ম তৎপরতাকে পুরুষ অথবা মহিলাদের মত বড় ও তাৎপর্য মণ্ডিত করে দেবে। বড়দের সমাজে তাদের অংশগ্রহণকে সহজ করে দেবে। অন্য দিকে তাদের প্রাক্তন শৈশব সমাজকে খুব দ্রুত অতিক্রম করতে সহায়ক হবে।
দায়িত্বভার গ্রহণে কার্যকর অংশগ্রহণ এই স্তরে এসে সেই ছোট্র শিশুটি একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণে পরিণত হয়ে গেল। ফলশ্র“তিতে শরিয়তের বিধানাবলি তার ওপর বাধ্যতামূলক হল। অর্থাৎ দায়িত্বভার বহণের পরিপূর্ণতা ও তার কৃত সকল কর্মতৎপরতার ফলাফল বের করতে সে সক্ষম হয়ে গেছে। সে কারণে তার দায়িত্বভার গ্রহণে সদা তৎপর থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। যদি এ ক্ষেত্রে শিশু কোন ভুল করে বসে তারপরও অভিভাবক তাকে এ বিষয়ে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করবে। অভিভাবক অসংখ্য বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ ও আলোচনা করে নিতে পারেন। তিনি তার কথা অনুযায়ী কাজ করবেন যদি তা শুদ্ধ প্রমাণিত হয়। তরুণ সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের পরামর্শ তার এই অনুভূতি জাগ্রত করবে যে, তার মতামতের একটা মূল্য আছে এবং সেও নির্ভরশীল হওয়ার যোগ্য। তার দায়িত্বানুভূতি ও সম্পাদনের আগ্রহ এবং তা বহনে কষ্টসহিষ্ণুতাকে বেশ শক্তিশালী করবে। ফলে তার মত ও চিন্তাকে অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ পর্যায় নিয়ে পৌঁছাতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকবে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত ফল হবে যদি তাকে অবজ্ঞা ও তার মতামতের দিকে ভ্রুক্ষেপ করা না হয়। প্রকাশ থাকে যে, পরামর্শের পুনরাবৃত্তি তাদেরকে অনুগত নয় বরং যারা অপরের পেছনে চলে তাদেরকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। ফলে তারা শ্রমসাধ্য কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। তরুণীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তরুণদের মতই। অভিভাবকের কর্তব্য হলো এগুলো শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে সে আহরণ করবে। নিশ্চয়ই মানুষের অনেক প্রয়োজন থাকতে পারে। তার একজন সাহায্যকারীরও প্রয়োজন আছে। এখন থেকেই যদি তরুণের দায়িত্বভার গ্রহণে তাকে অংশগ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে তৎপর না হওয়া যায়, তাহলে সে নিজেকে ঐ প্রয়োজনগুলোর আয়োজন সাধনে কষ্টের সম্মুখীন হবে। অথবা অন্য লোকদের সাহায্য নিতে প্রয়াস পাবে যারা তাকে সহায়তা করতে পারে। এর মধ্যে যদিও সাহায্য প্রার্থনার দিক থেকে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায় তা কখনো কখনো সন্তানদেরকে নিষ্কর্মা ও ব্যর্থ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে ফেলবে। ফলে তাদের ভূমিকা হবে অন্যের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ানো। যার অশুভ পরিণতি হতে অভিভাবকগণও মুক্ত থাকতে পারবেন না। যে সকল কাজ এই বয়সে তরুণদের সম্পন্ন করা কর্তব্য তার মধ্যে অন্যতম হলো, পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন কাজ যা গাড়ী ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। সে একই সঙ্গে তখন ড্রাইভ করার আগ্রহ দেখাতে পারে। কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদারক করা কর্তব্য। কারণ, অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য এটাই একমাত্র কারণ হয়ে থাকে। প্রথমেই তাকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়া কর্তব্য। তাকে গাড়ি ড্রাইভ করার অনুমতি দেয়া যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার নিজের ও অপরের জীবন কার্যতঃ সংরক্ষণে সক্ষম না হবে। তেমনিভাবে তাকে স্থায়ীভাবে গাড়ির চাবি দেয়া যাবে না। বরং তা ঘরে মা-বাবার সাথে থাকবে। কেবল প্রয়োজনের সময় তাকে তা দিতে হবে। তাও আবার বের হওয়া ও প্রত্যাবর্তনের সময় তদারকি করতে হবে। তরুণের কর্মতৎপরতা, কর্মের স্থীরতা ও গাড়ীটি যেন রীতি বহির্ভূতভাবে বের হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে সে ব্যপারে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত।
শ্রমসাধ্য কর্ম জ্ঞান ও তথ্য ভাণ্ডারের দিকে তরুণ সন্তানের অগ্রগতি ও অনুরাগ মূল্যায়ন মুসলিম বিশ্বের অনেক বরং সিংহভাগ দেশের শিক্ষাগত পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করলে যা প্রতিভাত হয় তা হল : কোন বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের সূচনা সাধারণত এই বয়োঃস্তরেই হয়ে থাকে। অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানের আগ্রহ সামর্থ্য ও তার প্রস্তুতির দিকে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ না করেই তাদের সন্তানদেরকে এমন অধ্যয়ন অথবা উচ্চ পর্যায়ের প্রবাস চাকুরীর দিকে দিকনির্দেশনা দিতে প্রয়াস পানÑ যাকে তারা অপেক্ষাকৃত উচ্চ মানের বলে জ্ঞান করে থাকেন। অতঃপর তারা এ বিষয়ে তরুণের ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে থাকেনÑযা অনেক সময় প্রত্যাশিত ফলাফল প্রাপ্তি থেকে তাদেরকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেবে। বহু বাবা অথবা অভিভাবক রয়েছেন (যে বিষয়ে তার সন্তান ভালো অথবা সক্ষম নয় সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে নিজ সন্তানের জীবন থেকে অনেকগুলো বছর নষ্ট করার কারণে) যারা অনুতাপ ও লজ্জায় আঙ্গুল কাঁটছেন। এখানে আমাদের একথা বলে রাখা উচিত : প্রত্যেকটি উপকারী জ্ঞান অথবা কারিগরি বিদ্যা -চাই তা যে মানেরই হোক না কেন- মুসলিম উম্মাহর তা নিতান্ত প্রয়োজন। সন্তান যখন সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে। সে ওখান থেকে যে ফল লাভ করতে পারবে তা পার্থক্যবোধহীন ভোগবাদী সমাজের দৃষ্টিতে এর চেয়ে কোন উৎকৃষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে প্রভুত অর্জনের চেয়ে অনেক মহৎ ও বড়। (উদাহরণ স্বরূপ) একজন অভিজ্ঞ মেকানিক্স অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের চেয়ে অনেক বেশি সমাজের উপকার করে থাকেন। সম্পদও তার চেয়ে বেশি উপার্জন করেন। সন্তানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও ভর্তি করা অথবা মেধার দুর্বলতার দরুণ যা অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তার জন্য চাপ প্রয়োগ অভিভাবকদের উচিত নয়। কারণ এর দ্বারা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বরং যে বিষয়ে উৎকর্ষ সাধন ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সামর্থ্য কিংবা তাদের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় সেই দিকেই তাদেরকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। কিন্তু সন্তানের আগ্রহশূন্যতা নিরসনকল্পে অভিভাবককে সজাগ ও সচেষ্ট থাকতে হবে। এটা তার দুর্বলতা, সামর্থ্যহীনতা নাকি কর্মটা তার জন্য দুঃসাধ্য সেটা বুঝতে হবে। ইবনে কাইউম রহ. এর এ সংক্রান্ত একটি উৎকৃষ্ট বাণী রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সন্তানের অবস্থা দেখে তার শিক্ষার বিষয়টি নির্ধারণ করা উচিত। এটা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিলে অন্যটা করতে সে উদ্যত হবে না।। সে যদি তার জন্য নির্ধারিত কর্মের বিপরীতটা করতে উদ্যত হয়, তাহলে কখনো সফলকাম হতে পারবে না। তার জন্য যা প্রস্তুত ছিল তাও হারিয়ে যাবে। যদি দেখা যায় পড়াশুনা না করে সে অশ্বারোহণ, তীর নিক্ষেপ ও তীর নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করে। তাহলে তাকে আপনি অশ্বারোহণের উপকরণ ও এর ওপর অনুশীলন গ্রহণের সুযোগ দিন। কারণ এটা তার নিজের ব্যক্তি ও গোটা মুসলিম জাতির জন্য উপকারী। যদি দেখে তার নয়ন যুগল কোন কারিগরি পেশার দিকে উম্মোচিত, প্রস্তুত ও গ্রহণকারী হিসেবে দেখতে পায়। যা হবে বৈধ জনহিতকর কারিগরি পেশা, তাহলে তাকে এর জন্য সুযোগ দেয়া উচিত। এ সকল বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ভর্তি করাতে হবে ধর্ম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদানের পর। কারণ তা বান্দার ওপর আল্লাহ তাআলার প্রমাণ উপস্থাপন সহজ করে দেয়। যেহেতু বান্দার বিরুদ্ধে পেশ করার মত তাঁর রয়েছে অকাট্য প্রমাণ। যেমনিভাবে বান্দার ওপর তার রয়েছে অফুরন্ত নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী রহ. এর রয়েছে মূল্যবান বক্তব্য, যা তিনি সবিস্তারে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সমগ্র সৃষ্টিকুলকে যখন সৃজন করেছেন তখন তারা নিজেদের পার্থিব ও পারলৌকিক প্রয়োজন ও কল্যাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর ছিল। আপনি কি আল্লাহ তাআ’লার এই বাণীর দিকে লক্ষ করেননি ? وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا.(النحل-৭৮ ) ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না।’ অতঃপর তাদেরকে প্রতিপালনের প্রয়োজন সাপেক্ষে আস্তে আস্তে এ সম্পর্কিত জ্ঞান দান করেছেন। একবার নবজাতকের অন্তরে প্রত্যাদেশ করেন। যেমন : জননীর স্তন্য স্পর্শ করা ও তা চোষার প্রত্যাদেশ। দ্বিতীয় বার শিক্ষার মাধ্যমে। অতএব মানুষের জন্য সকল কল্যাণকর বিষয় গ্রহণ ও ক্ষতিকর বস্তু নিরসন করার জন্য তার শিক্ষাগ্রহণ ও জ্ঞান অন্বেষণ করা কর্তব্য। ঐ স্বভাবগত এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভাগুলো তার মধ্যে বিকশিত হওয়ার পর যা প্রতিফলিত হবে। কারণ, বিস্তারিত ও সামগ্রিক কল্যাণ আহরণের জন্য এটা হল যেন ভিত্তিমূল। তা হতে পারে কতগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিশ্বাস গত বিষয় অথবা ইসলামী ও অভ্যাসগত শিষ্টাচারসমূহ। এসবের প্রতি যতœবান হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে তার জন্মগত স্বভাব ও তার প্রতি যে বিস্তারিত অবস্থা ও কর্মসমূহ প্রত্যাদেশ করা হয়েছে তা আরো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হতে থাকবে। ফলে এটা প্রকাশিত হয়ে যাবে তার মধ্যে প্রতিফলিত হবার সাথে সাথে তার ঐ সকল বন্ধুদের মধ্যেও প্রতিফলিত হবে যারা এ প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। সুতরাং বোধ ও বুদ্ধির এমন সমন্বয় আর কখনোই সূচিত হতে পারবে না। প্রাথমিক বয়সে যা তার জন্মগত স্বভাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তার বিপরীত কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া তার পৃষ্ঠে পরিস্ফুট হবে। যার ফলে আপনি লক্ষ করে থাকবেন : একজন প্রস্তুতি নিচ্ছে জ্ঞান অন্বেষণের ও অন্যজন করছেন নেতৃত্বের অন্বেষণ। আর একজন প্রয়োজনীয় কারিগরি বিদ্যা ও অপর ব্যক্তি প্রস্তুতি নিচ্ছেন সকল বিষয়ে লড়াই ও তর্ক করার জন্য। প্রত্যেকের মধ্যে যদি সামগ্রিক কর্ম তৎপরতা প্রোথিত করা হয়ে থাকে তাহলে এক অভ্যাসকে অপর অভ্যাসের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। ফলে তার আদিষ্ট হওয়াটা শিক্ষাপ্রাপ্ত ও শিষ্টাচার সমৃদ্ধ অবস্থায় হবে যার ওপর বর্তমানে সে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এমতাবস্থায় সেই আবেদনটি প্রত্যেক আদিষ্ট ব্যক্তির ওপর তাৎক্ষণিকভাবে প্রযোজ্য হবে সেই কর্মকাণ্ডসমূহে সে তৎপর। ফলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সেই দিকে দৃষ্টিপাত নির্ধারিত হয়ে গেল। অতঃপর সামর্থ অনুযায়ী তার পরিচর্যা করবে। সুতরাং তাদেরকে এমনভাবে যতœ নিতে হবে যেন অভিভাবকের হাতেই ওরা সঠিক পথের ওপর উঠতে পারে। এটা বাস্তবায়নে তাদের সহায়তা করবে। এরও অনেক পর স্থায়ীত্ব অর্জনের জন্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। যাতে প্রত্যেকের মধ্যে তার বিজিত চরিত্র প্রতিফলিত হয় এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, সে দিকে তার ঝোঁক রয়েছে। এরপর তারা পরিবারের মাঝে থাকলে তাদের সাথে সুসামঞ্জস্য আচরণ করা যেতে পারে। ফলশ্র“তিতে তারা তার অধিকারী হয়ে যাবে যদি তা তাদের জন্যই হয়ে থাকে। যেমন জন্মগত গুণাবলি ও প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলো। ফলে সাধিত হবে প্রভুত কল্যাণ ও প্রকাশিত হবে উক্ত প্রতিপালনের ফলাফল। উদাহরন স্বরূপ : ধরুন, কোন শিশুর মধ্যে উত্তম অনুভূতি, উৎকৃষ্ট বোধ ও শ্র“ত বিষয়ের পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ইত্যাদি গুণাবলি প্রকাশিত হয়, যদিও এসব ছাড়া অপর গুণাবলিও তার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে তা সত্ত্বেও তাকে উক্ত মহৎ লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করতে হবে। সার কথা হলো : তার মধ্যে এ নিশ্চিত গুণাবলি তার মধ্যে শিক্ষার কল্যাণ সংক্রান্ত যে তৎপরতা প্রত্যাশা করছেন তার মূল্যায়ন করা নিতান্ত কর্তব্য। অতএব শিক্ষা গ্রহণ ও সকল বিদ্যা সম্পর্কে সমন্বিত শিষ্টাচারে সমৃদ্ধি অর্জন তার কাছ থেকে কাম্য। সেখান থেকে অন্য দিকেও দৃষ্টি ফেরানো কর্তব্য। ফলে তার থেকে গ্রহণ ও তার সহায়তা নেয়া যাবে। কিন্তু তা একটা নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে হতে হবে। যে সম্পর্কে বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরাম নির্দেশ করেছেন। যখন উক্ত ‘অন্য’ এর মধ্যে প্রবেশ করবে তার স্বভাব বিশেষতঃ সে দিকেই ঝুঁকে পড়বে। ফলে তাকে অপরের থেকে বেশি ভালোবাসবে। তাকে এ ব্যাপারে সচেতন করা পরিবারের ওপর কর্তব্য। যাতে তাকে কোনরূপ অবজ্ঞা অথবা অবমূল্যায়ন ব্যতিরেকে তার কাছ থেকে সে পরিমিতভাবে গ্রহণ করতে পারে। এরপর সে যদি এখানেই অবস্থান করে তাহলে ভালো। যদি অভিভাবক অথবা অপরের থেকে আরো গ্রহণ কাম্য হয়। তাহলে সেক্ষেত্রে তার সাথে তেমন আচরণ করবে যা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। অনুরূপ এটার সমাপ্তি ও এ কথা বলা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখবে :‘অনুরূপ ক্রমবিন্যাস প্রযোজ্য হবে তার ক্ষেত্রেও যার পদক্ষেপ গ্রহণ, সাহসিকতা ও কর্ম পরিচালনার গুণাবলি ইতিমধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং তাকেও ঐ দিকে ধাবিত করবে ও সামগ্রিক বিদ্যা সংক্রান্ত সমন্বিত শিষ্টাচার শিক্ষা দেবে। এরপর তাকে উন্নত থেকে উন্নততর ব্যবস্থাপনার পেশাগত দক্ষতার দিকে নিয়ে যাবে। যেমন : চিকিসা, সংগঠন, সমর, পথ প্রদর্শন অথবা নেতৃত্ব প্রভৃতি থেকে সে যেটার যোগ্য, তার ইচ্ছা, সেটা সে গ্রহণ করবে। সে কারণে প্রতিটি কর্মের ব্যাপারে তাকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে, যেন তা সমগ্র জাতির দায়িত্ব। কারণ, সেই প্রথম এই সমন্বিত পথের অগ্রপথিক। অতএব অগ্রপথিক যদি দাঁড়িয়ে যায় এবং ভ্রমণে অপারগতা প্রকাশ করে, তাহলে তো প্রকারান্তরে তার জন্য অপেক্ষমান সমগ্র জাতিই দাঁড়িয়ে থাকবে। পক্ষান্তরে তার নিকট যদি এমন শক্তি থাকে যা সার্বজনীন কর্তব্যসমূহ পালন ও যে কর্মসমূহ সম্পাদনের জন্য ব্যক্তির দু®প্রাপ্র্যতা রয়েছে সে ক্ষেত্রে তার ভ্রমণকে গতিশীল করতে সক্ষম। যেমন : শরিয়তের বিধনাবলির বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রপরিচালনার প্রচেষ্টা- যার মাধ্যমে পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও পারলৌকিক আমলসমূহ সুস্থির ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। এ সকল ক্ষেত্রে তাকে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাতে সক্ষম। এখানেই এই সংকলনের সমাপ্তি। আমি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছি। তিনি যেন এর দ্বারা লেখক, পাঠক ও সকল মুসলিম সন্তানকে উপকৃত করেন। আমীন! وصلى الله تعالى وسلم على نبينامحمد بن عبدالله النبى الخاتم وآله وصحبه ومن تبعهم بإحسان. গ্রন্থপঞ্জি ১- আহমামূল কোরআন- আবু বকর আল-জাস্সাস ২- আত্ তাহরীর ওয়াত্ তানভীর- তাহের বিন আশুর ৩- তাফসীরে ইবনে কাছীর- হাফেজ ইবনে কাছীর ৪- তাফসীরে ইবনে সাউ’দ- ইবনে সাউ’দ ৫- তাফসীরে বাগভী- বাগভী ৬- তাফসীরে বায়দাভী- বায়দাভী ৭- তাফসীরে কুরতুবী- ইমাম কুরতুবী ৮- জামেউ’ল বয়ান- ইমাম তাবারী ৯- সহিহ্ আল-বুখারী- ইমাম মুহম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী ১০- সহিহ মুসলিম- ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জায আন্-নিশাপুরী ১১- ফাত্হুল বারী- ইবনে হাজার ১২- উমদাতুল কারী- বদরুদ্দীন আইনী ১৩- সুনানে আবি দাউদ- আবু দাউদ ১৪- সুনানে তিরমিযি- ইমাম তিরমিযি ১৫- আল-মুসনাদ- ইমাম আহমদ ১৬- সহিহ ইবনে খুযাইমা- ইবনে খুযাইমা ১৭- সহিহ ইবনে হিব্বান- ইবনে হিব্বান ১৮- সুনানে বায়হাক্বী- বায়হাক্বী ১৯- আল-মুস্তাদরেক- আল-হাকেম ২০- আল-মু’জামূল কবীর- তাবরানী ২১- আল-মুসান্নাফ- আব্দুর রাজ্জাক সানআনী ২২- মুসনাদুশ্ শামিয়্যীন- আবুল কাসেম তাবারানী ২৩- মুসনাদে আবি ইয়া’লা- আবু ইয়া’লা ২৪- মুসান্নাফে আবি শাইবা- আবু শাইবা ২৫- শারহে মাআ’নিল আছার- ইমাম তাহাবী ২৬- তাহজিবুল কামাল- হাফেজ মুযাই ২৭- আউনুল মা’বুদ শারহে সুনানে আবি দাউদ- শামসুল হক আজীমাবাদী ২৮- আল-মুহায্যআব-শিরাজী ২৯- তুহফাতুল মাওদুদ ফি আহকামিল মাওলুদ- ইবনে কাইয়্যূম যাওজিয়া ৩০- আত্ তাম্হীদ- ইবনে আব্দুল র্বার ৩১- এহ্য়ায়ে উলুমুদ্দীন- আবু হামেদ গাযালী ৩২- লিসানুল আরব- ইবনে মানযুর ৩৩- ইলমু নাফসিল মারাহিলিল উমরিয়্যাহ- আ. ড. উমার বিন আঃ রহমান মুফ্দা ৩৪- ইলমু নাফসিন নামুব্বি আত-তাফুলাতি ওয়াল মুরাহিক্বাহ- ড. হিশাম মুহম্মদ মুখাইমার ৩৫- আল-মুরাহিকুন দিরাসা নাফসিয়্যা ইসলামিয়া- ড. আব্দুল আযীয বিন মুহম্মদ নুগাইমিশী
শ্রমসাধ্য কর্ম সম্পাদন ও শরিয়তের বিধানাবলি পালনের ক্ষেত্রে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। যার বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও পরিপক্ক হয়েছে। ফলে সে দলিল প্রমাণাদি বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। যেভাবে তার আবেগ ও উচ্ছাসের পূর্ণতা সাধিত হয়েছে। ফলশ্র“তিতে সে সঠিকভাবে দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম হবে। এমনিভাবে সেটা সংরক্ষণ করতে ও তার ওপর আবর্তিত আবেগ ও অনুভূতির ফলাফলও সে বের করতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি তার প্রজনন ক্ষমতারও পূর্ণতা সাধিত হয়েছে যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানব প্রজাতিকে সংরক্ষণ করে থাকেন। অনেকের দৃষ্টিতে এই স্তরটা হলো প্রচলিতمراهقة (মুরাহাকা) এর সূচনা। مراهقة যদিও আরবী ভাষার ক্রিয়ামূল رهق থেকে সংগৃহীত। কিন্তু কোন কোন ভাষা বিশারদ مراهقة শব্দটিকে মূলতঃ ল্যাটিন শব্দ বলে মত প্রকাশ করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, অধিকাংশ ভাষাবিদ কিশোর অথবা কিশোরীদের বয়োঃসন্ধিতে পৌঁছে যাওয়াকে مراهقة এর সূচনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন।
বয়োঃসন্ধি ক্ষণ আরবী ভাষায় رهق শব্দটির একাধিক অর্থ এসছে। رهق অর্থ মিথ্যা, رهق অর্থ পাতলামী ও দুর্ব্যবহার, رهق অর্থ মানুষের মূর্খপণা ও তার বুদ্ধির অপরিপক্কতা। বলা হয়-وإنه لرهق نزل সে অনিষ্ট সাধনে দ্রুত ও দ্রুত ক্রুদ্ধ ব্যক্তি বা সে এমন ব্যক্তি যার মধ্যে ক্রোধ ও নির্বুদ্ধিতা বিদ্যমান অথবা সে এমন ব্যক্তি যার মধ্যে رهق রয়েছে যখন সে অনিষ্টতার দিকে ধাবিত হবে ও গোপন করবে। সর্বোপরি رهق হলো বোকামী ও সম্মানিত বস্তুকে ঢেকে ফেলা। এমনিভাবে এই শব্দটির অথের মর্ধ্যে নিকটবর্তী হওয়া ও নৈকট্য অর্জনও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে-راهق الغلام فهو مراهق অর্থাৎ সে স্বপ্ন দোষের নিকটবর্তী রয়েছে। বলা হয়ে থাকে- طلبت فلانا حتى رهقته অর্থ আমি অমুককে অনুসন্ধান করেছি তার নিকটবর্তী হওয়া পর্যন্ত। এক্ষেত্রে আনাস বিন মালেক রা. বর্ণিত হাদীসটি দ্রষ্টব্য। ওহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাত জন আনসার ও দু’কোরাইশীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে ছিলেন। ইতোমধ্যে তারা বয়োঃসন্ধি ক্ষণের নিকটে পৌঁছলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমাদের পক্ষে যে শত্র“দেরকে প্রতিহত করবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত অথবা সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।” আলোচ্য হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ رهقوه এর অর্থ : তার নিকটবর্তী হলো ও নিকটে পৌঁছলো। এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বয়সের দিক থেকে مراهق সেই ব্যক্তি যে স্বপ্ন দোষের নিকটবর্তী হয়েছে তবে এখনো পর্যন্ত স্বপ্ন দোষ হয়নি, অর্থাৎ সে এখনো প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি। তবে মূর্খপণা, ক্রোধ ও অনিষ্টের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অপরাপর গুণাগুণের দিক থেকে رهق যে কোন বয়োঃস্তরে মানুষের জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব। তার প্রথম, মধ্যম ও শেষ বয়সে। ওটা মানুষের জীবন প্রবাহের কোন নির্দিষ্ট কালের সঙ্গে নির্দিষ্ট নয়। আমি যতকুটু জানতে পেরেছি তার মধ্যে পাইনি যে, এই গুণাগুণ কালের কোন সীমাবদ্ধ সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আশা করি নোটটি মনোবিজ্ঞানের- অসংখ্য পাঠে যা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলো। مراهقة মানুষের জীবন প্রবাহের একটা নির্দিষ্ট কাল যার সূচনা বয়োঃসন্ধি ক্ষণ এবং একটা নির্ধারিত মেয়াদান্তে তার সমাপ্তি ঘটে’ তা হতে আশ্রয়হীনতা অর্জনের সহায়ক হবে যা এই পাঠের একান্ত দাবী। কখনো কখনো তা কয়েক বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে : চার থেকে ছয় বছর অথবা অনেকের মতে এর চেয়েও বেশি অথবা যুগের সঙ্গে যুগের ও এক সমাজের সঙ্গে অপর সমাজের পার্থক্যের কারণেও তা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এই অভিমতের আলোকে مراهقة এর সূচনা হবে বয়োঃসন্ধি ক্ষণে ও তার সমাপ্তি ঘটবে বুদ্ধিগত, সামাজিক ও ব্যক্তিগত আবেগের পরিপক্কতার মাধ্যমে। বয়োঃসন্ধি কালের দৈর্ঘ্য সমাজের ব্যক্তিবর্গের ওপর নির্ভর করে দশ বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। তবে অনেক গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি হলো এই সময়ে দুশ্চিন্তা, বিষণœœতা, অবমূল্যায়ন ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শৃঙ্খলহীনতা এ সবই সে বুঝতে পারে। এগুলোর জন্য তারা অসংখ্য সাক্ষী উল্লেখ করে থাকে যেগুলো তাদের অভিমতের স্বপক্ষের প্রমাণ বলে তারা জ্ঞান করে থাকে। অথচ এই মতের ওপর বিশেষজ্ঞদের কোন ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যা প্রমাণ করে এই বৈশিষ্ট্যাবলি ও কর্মকাণ্ড বয়স অথবা সাবালক হওয়ার আবশ্যকীয়তার অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সমাজ অথবা সংস্কৃতিকে বয়োঃসন্ধির সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অতঃপর এই বৈশিষ্ট্যাবলির সিংহভাগ সেই অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল যার অধিকাংশটাই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা নিজেদের সমাজের ওপর পরিচালিত করেছিলেন। তাদের গবেষণা প্রসূত এই ফলাফলগুলো সমগ্র মানবজাতির ওপর ব্যাপকভাবে চাপিয়ে দেয়া সমীচীন হবে না। কারণ এ গবেষণাটা শুধুমাত্র পাশ্চাত্য মানবগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত হয়েছিলো। আমরা যদি বিষন্নতা ও অবমূল্যায়নের ব্যাখ্যা করি এই বয়সে মানুষের বুদ্ধির পূর্ণতা প্রাপ্তি দ্বারা অথচ তখন সে বসবাস করছে এমন এক পৌত্তলিক সমাজে, যেখানে বিরাজ করছে বিশ্বাসগত ভ্রষ্টতা ও চারিত্রিক নষ্টামী। এতদসত্ত্বেও তার বিবেকের দাবী ও সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যে কোন সংঘর্ষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু বয়োঃসন্ধি ক্ষণে পৌঁছানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার চেয়েও এটা বেশি বিশুদ্ধ, উত্তম ও সূক্ষ্ম অভিমত। কথাটা আরো স্পষ্ট করে এভাবেও বলা যায় : নিশ্চয়ই মানুষ কোন জড় পদার্থের নাম নয় যে পরিবেশের প্রভাব ও সময়ের সকল বন্ধন উপেক্ষা করে কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা প্রসূত নিয়ম-কানুনগুলোই তার ওপর প্রয়োগ করা হবে। বরং সে একটি জীবন্ত ব্যক্তি সত্তা যার দেহ, বুদ্ধি, হৃদয় ও একটি প্রাণ রয়েছে। আরো রয়েছে আবেগ, উৎকণ্ঠা, বিশ্বাস, অসংখ্য ধ্যান-ধারণা ও পরিকল্পনা। যা একজন থেকে অপর জনের, এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশের চেয়ে ভিন্ন ও বিপরীত হয়ে থাকে। সে কারণে ঐ পরিবেশসমূহ থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা প্রসূত ফলাফল ও রীতি নীতিও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এখানে জ্ঞাতব্য যে, নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার বারংবার একই ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে যদি শর্ত করা হয় যে, গবেষণা ও ফলাফল শর্তানুযায়ী হতে হবে ও উদ্যোক্তাদের তত্ত্বাবধানে হতে হবে। মুসলিম ও পৌত্তলিক সমাজের নিশ্চিত পার্থক্যের কারণে এটা কখনো বস্তবায়িত হয়নি ও ভবিষ্যতেও বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞান কর্তৃক তাদের অনুসারীদের আচার-আচরণের জন্য পরিবেশিত গবেষণালব্ধ অধিকাংশ ব্যাখ্যা ও ফলাফল অবশ্যই আমাদের ইসলামী সমাজের বাহ্যিক ব্যাখ্যার উপযুক্ত নয় । বরং সম্ভবতঃ উল্লেখিত প্রকাশ্য ব্যাখ্যারও আমাদের সমাজে মূলত কোন অস্তিত্ব নেই। এক্ষেত্রে যতটুকু ঘটেছে তাও আমাদের কারো কারো ঐ সমাজের অন্ধ অনুকরণের কারণে। সম্ভবত ড. উমার মুফদা তার উপস্থাপিত শিক্ষা সেমিনারে এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন : ‘তরুণদের দৃষ্টির সম্মুখে বয়োঃসন্ধি ক্ষণে প্রবৃত্তির দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ’ শীর্ষক একটি সেমিনার পরিবেশন করেছিলেন। সেখানে বয়োঃসন্ধি ক্ষণে উপণীত তরুণদের অনুসৃত একটা সম্পর্ক তিনি দেখতে পেলেন অর্থাৎ যারা নিজেদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে বেড়ায়। কিন্তু এই সম্পর্কটা ছিলো ঘৃণিত ও মার্কিন সমাজ ঘেঁষা। কখনো নিশ্চয়ই ইসলাম এটা পরিবর্তন করে ব্যক্তির প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধ করতে সহায়তা করে। ফলে পরবর্তীতে গবেষণা ও প্রশ্নোত্তর কর্ম দীর্ঘায়িত হবে না। আমাদের নিকট মুসলিম তরুণ ও যুবকদের অসংখ্য উদাহরণ ও আদর্শ রয়েছে যারা সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বুদ্ধিমান সুপুরুষ ও মর্যাদাবান হতে সক্ষম হয়েছেন। বরং তারা মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এটা সমুদ্রের ওপাড় থেকে আমাদের নিকট আমগনকারী কোন আদর্শ নয়। বরং তা হলো একটা বিশুদ্ধ মডেল যা আমাদেরকে মুসলিম সমাজে নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আসহাবে কাহাফ (গুহাবাসী) সম্পর্কে বলেন, إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آَمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى. (الكهف-১৩ ( ‘তারা কতক তরুণ তাহাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান গ্রহণ করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম।’ আল্লাহ তাআলা সাইয়েদিনা ইসমাঈল আ. সম্পর্কে বলেন, ‘তার বাবার সঙ্গে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হওয়ার পর।’ তা হলো বুদ্ধির পরিপক্কতা যদ্বারা প্রমাণ উপস্থাপণ করা যায় অথবা স্বপ্ন দোষ হওয়া। প্রসিদ্ধ ঘটনা : فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ. (الصافات-১০২) ‘অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বলল, ‘বৎস ! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ্ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছাই আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ এ হলো ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যার সম্পর্কে তার সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছিল, যখন তিনি তাদের প্রতিমাগুলো ভেঙ্গে দিয়েছিলেন- قَالُوا سَمِعْنَا فَتًى يَذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ. (الأنبياء-৬০) ‘কেউ কেউ বলল, ‘এক তরুণকে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি। যাকে বলা হয় ইবরাহীম।’ এছাড়াও এ সময় সম্পর্কে কোরআন ও হাদীসে অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে। প্রশ্ন : যদি বলা হয়- مراهقة কে উল্লেখিত অর্থে সংজ্ঞায়ন হলো একটা পরিভাষা। আর পরিভাষায় কোন দ্বন্দ্ব নেই। উত্তর : তাকে বলা হবে নিঃসন্দেহে পরিভাষায় কোন দ্বন্দ্ব নেই ; তবে যে পরিভাষা বাস্তবতা ও সত্যের পরিপন্থী তার স্বীকৃতি অথবা গ্রহণ কোনটাই বৈধ নয়। যখন অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীগণ এ বিষয়ে একমত হন যে, مراهقة (তারুন্য) মানুষের বয়োঃপ্রাপ্তি থেকে সুচিত হয়। এ মতটি কোন ভাবেই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ শরিয়ত বয়োঃপ্রাপ্তিকে আদিষ্ট হওয়া ও ইসলামের বিধানাবলি বাধ্যতামূলক হওয়ার আলামত নির্ধারণ করেছে। দোদুল্যমানতা, অবমূল্যায়ন, বিষণœতা, নৈরাশ্য ও আবেগতাড়িত ক্রোধ প্রভৃতির সূচনার সঙ্গে কিভাবে তাকলীফ বা আদিষ্টযোগ্য প্রযোজ্য হতে পারে? مراهق শব্দের সঙ্গে অসংখ্য শরিয়তের বিধানাবলি সম্পৃক্ত। যেমন : ক্স مراهق মাহরাম হওয়ার যোগ্য কি না ? ক্স অপরিচিত মহিলার সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাতকার বৈধ কি না ? ক্স তার জন্য মেয়েদের সৌন্দর্য দর্শন বৈধ কি না ? ক্স সে যদি হজ্জব্রত পালন করে তাহলে ইসলামের ফরজ হজ্জ তার থেকে আদায় হয়ে যাবে কি না ? ক্স মদ্য পান করলে তার ওপর দণ্ডবিধি কার্যকর হবে কি না ? ক্স সে চুরি করলে তার হাত কর্তন করা হবে কি না ? ক্স কোন মহিলার সঙ্গে ব্যভিচার করলে তার ওপর দণ্ডবিধি কার্যকর হবে কি না ? ক্স এবং যে মহিলার সঙ্গে مراهق(বয়োঃসন্ধি ক্ষণে উপনীত তরুণ) ব্যভিচার করেছে তার ওপরও দণ্ডবিধি কার্যকর করা হবে কি না ? ক্স যদি উক্ত মহিলা বিবাহিত হয় তার ওপর (প্রস্তর নিক্ষেপে) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে কি না ? প্রভৃতি অসংখ্য ফিক্বহী মাসআলা রয়েছে যার সমাধান ফুকাহায়ে কেরাম আরবী ভাষার দাবীর আলোকে পেশ করেছেন। আর তা হলো مراهق যে এখনো প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি। অর্থাৎ সে হলো শিশু তবে শৈশবের শেষ স্তরে রয়েছে। পক্ষান্তরে মনোবিজ্ঞানে مراهق হলো যে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেছে। সে বয়োঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শরিয়ত কর্তৃক আদিষ্ট। এ দ্বৈত ব্যাখ্যা ফিক্বহী মাসআ’লার ক্ষেত্রে কঠিন দোদুল্যমান পরিস্থিতির মুখোমুখী করবে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাবালকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে যে, বয়োঃসন্ধি ক্ষণে উপনীত এক বালক যার দাবী সমাজের দৃষ্টিতে তরুণ-তরুণীদের পরিপক্কতার বয়স বিলম্ব করা। তার ভুল-ত্র“টিসমূহকে তুচ্ছ করে দেখা, বিরুদ্ধ আচরণে তাদের জন্য বাহানা তালাশ করা। অথচ প্রত্যেকটি সাবালক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জন্য যে আবেদন রেখেছে তাদের জন্যও একই আবেদন প্রযোজ্য। কিন্তু শরিয়ত যে দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন প্রাপ্ত বয়স্কের দিকে তাকায়- সে প্রাপ্ত বয়স্ক ও আদিষ্ট। তার সাথে আচার ব্যবহার এই ভিত্তিতেই পরিচালিত হবে। কারণ এটা তরুণ-তরুণীদের দ্রুত পরিপক্ক হতে সহায়ক হবে। ফলে সমাজও অবশ্য তাদের সঙ্গে এই ভিত্তিতেই আচার-ব্যবহার করতে পারে।
প্রথম অধ্যায় :
বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি বয়োঃপ্রাপ্তি কেউ কেউ মনে করে থাকেন এর উদ্দেশ্য হলো লিঙ্গগত পরিপক্ক অবস্থা অথবা লিঙ্গগত কার্যক্ষমতার পরিপূর্ণতা। এটা অবশ্যই আদিষ্ট হওয়ার (تكليف ( ভিত্তি নয়। বরং تكليف এর মূল ভিত্তি তার নিকট চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা ইন্দ্রিয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন, আর তা-ই হলো ‘আক্বল’ বা বুদ্ধিমত্তা। বয়োঃপ্রাপ্তি বুদ্ধির পূর্ণতা লাভের নিদর্শন যদ্বারা تكليف অনিবার্য হয়ে যায়। অতএব আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে, তাদের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ নিরসন কল্পে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে লোম গজানো, কণ্ঠস্বর ভারী হওয়া অথবা প্রজনন ইন্দ্রিয়সমূহের দায়িত্ব পালনের সামর্থ লাভ কেবলমাত্র ইত্যাকার আলামতসমূহ প্রকাশ পেলেই تكليف এর মত মহান দায়িত্বে কাউকে আদিষ্ট করেন না। বরং এগুলো হলো কতগুলো নিদর্শন মাত্র। এই স্তরে এসে তরুণ-তরুণীদের বিপরীত লিঙ্গে প্রতি অনুভূতি সক্রিয় হয়। তবে এটা সমস্যা নয়, কারণ এটা পৌরুষ ও নারীত্বের নিদর্শনের দাবী। কিন্তু মূল সমস্যা তখনই প্রকাশ পাবে যখন বিষয়টা শরিয়তের বিধানের আলোকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অথচ শরিয়তই প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে তার বিশুদ্ধ পথে পরিচালিত করতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তার মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত করেছেন। তিনিই আবার তাদের জীবন প্রবাহের জন্য জীবন বিধান দিয়েছেন যার মধ্যে শুধু কল্যাণ আর কল্যাণই নিহিত, তথায় কোন অকল্যাণের লেশমাত্র নেই। যা হবে সমাজ বিনির্মাণ ও তাদের পরস্পর যোগাযোগ স্থাপন এবং মানব প্রজাতির ধরাবাহিকতা সংরক্ষণের সোপান। অবশ্যই তা মানব জাতির বিপর্যয়, ধ্বংস ও বিলুপ্তির মাধ্যম নয়। অতএব মা-বাবা ও অভিভাবকদের কর্তব্য হলো এই বিধানাবলি তারা নিজেরা শক্তভাবে ধারণ করতে সচেষ্ট হবে ও এর সঙ্গে আবদ্ধ থাকতে তৎপর হবে। এ পর্যায় উল্লেখযোগ্য কতিপয় বিধান নিম্নে প্রদত্ত হলো ঃ ক্স উভয় লিঙ্গের মধ্যে সংশ্রব না হওয়া ক্স মেয়েদের প্রয়োজনে বাহিরে যেতে হলে শারঈ পোশাক বাধ্যতামূলকভাবে ধারণ করা ক্স অবিবাহিতদের সামর্থ হলে বিবাহ করা। ক্স দাম্পত্য জীবন পরিচালনার সামর্থ না থাকলে কামভাব দমনকারীর আশ্রয় নেয়া। এরজন্য উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বিষয় প্রত্যক্ষ করা ও পাঠ থেকে বিরত থাকাসহ রোজাব্রত পালনের অনুশীলন করা যেতে পারে। ক্স শক্তি সামর্থ্যকে কোন জনহিতকর ও ফলপ্রসূ কাজে নিয়োজিত রাখা। ক্স অবসর সময়গুলোকে ব্যস্ত রাখতে প্রচেষ্টা করা ও কোন বিশুদ্ধ ও মহৎ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। ফলে তরুণ-তরুণীরা চিন্তাগত দিক থেকে ঐ ধরনের অনুভূতি থেকে দূরে থাকতে পারবে। ক্স এর পূর্বে ও পরে নেক আমলকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা। ক্স অতি অবশ্যই আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা। অশালীন ও গর্হিত কর্মের নিকটবর্তী হওয়া থেকে মুক্তি ও হেফাজত থাকার প্রার্থনা খুব কাকুতি মিনতিসহ করা।
পরিপক্কতা ও পূর্ণাঙ্গতা একটি শিশুর এ স্তরে রূপান্তরিত হলেই তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় ; চাই সেটা তার দেহ, বুদ্ধি, গবেষণা অথবা অনুভূতিতেই হোক না কেন, যা অবশ্যই তাকে পূর্ববর্তী স্তর থেকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে। এখন আর তাকে শিশু অথবা বাচ্চা বলে নামকরণ করা শুদ্ধ হবে না। বরং সে এখন একজন পুরুষ। নব যৌবনের দিকে ইঙ্গিত করার জন্য তাকে বলা হবে: তরুণ অথবা বালক। তরুণের নিকট পরিপক্ক ও পূর্ণাঙ্গতার বিভিন্ন প্রকরণ হয়ে থাকে। সুতরাং শিশুর বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও গভীরতা তার অনিবার্য পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে অগ্রসর ও বিকাশ লাভ করতে থাকে। যদ্বারা প্রমাণ সাব্যস্ত হয়ে থাকে ও শরিয়তের বিধানাবলি কার্যকর হয়। ফলে বিরুদ্ধাচারণ ও শৈথিল্য প্রদর্শনে তাকে নিশ্চিত জবাবদিহী করা হবে। এ বয়সে শিশুর নিকট নিরেট চিন্তা ভাবনার (যা কোন অনুধাবনযোগ্য বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়) সামর্থ্য পরিলক্ষিত হয়। অনুরূপ পরোক্ষ বিষয়, একটি মোকদ্দমার অসংখ্য দূরত্ব ও বিভিন্নদিক সে উপলব্ধি করতে সক্ষম ও সামগ্রিক বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। ফলে সে আর এক কোণে আবদ্ধ হয়ে থাকবে না । উপরন্তু সে প্রবিষ্ট করণ, বিন্যাস, অবগঠন অথবা পরিক্ষণের মত উচ্চতর গবেষণার অভিজ্ঞতা চর্চায় সক্ষম। এমনিভাবে উপস্থিত বিষয় দ্বারা অনুপস্থিত বিষয়ের ওপর প্রমাণ উপস্থাপন, একাধিক প্রাথমিক তথ্য একত্রিত করে তা বাস্তবায়নের জন্য সে দিকে দৃষ্টিপাত করা ও এর ওপর আবর্তিত সম্ভাব্য ফলাফল পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হওয়া এসব কিছুই সে পারে। যেভাবে সে শিক্ষামূলক গবেষণা পরিচালনা করতে পারে। যেহেতু সে সমস্যা উপলব্ধি করতে ও আলোচ্য বিষয় সংজ্ঞায়িত করতে প্রয়াস পায়। ফলে এখান থেকেই এই সমস্যাটা ব্যাখ্যার উপযোগী তথ্যাবলি একত্রিত করে থাকে। অতঃপর একটি একটি করে তথ্যগুলো নিরীক্ষা করতে থাকে কাংক্ষিত তথ্যটি আবিস্কার করা পর্যন্ত যা উল্লেখিত সমস্যার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে। এই বুদ্ধিগত সামর্থ্যরে মাধ্যমে সেই তরুণ সত্যের সন্ধান, সত্য চর্চা করতে ও শৈশব অথবা শিশু বয়সে দীক্ষালব্ধ আনুগত্য নির্ভর ঈমানকে যুক্তিযুক্ত শ্র“তিনির্ভর প্রমাণাদি লব্ধ বিশ্বাসগত ঈমানে সুনিশ্চিত রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে। এটা নিঃসন্দেহে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বুদ্ধিগত সামর্থ লব্ধ ফলাফল নিশ্চিত করতে হলে তরুণ-তরুণীদেরকে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সার কথা হলো, এই যোগ্যতা ও তা অর্জনের পর্যাপ্ত সামর্থ্য আল্লাহর ইচ্ছাই তার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, এর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, সকল প্রাপ্ত বয়স্করাই কার্যতঃ এই অবস্থানে রয়েছে। এমন না হলে তো সকল মানুষই মর্যাদা ও সম্মানের দিক থেকে সমপর্যায়ের হতো। এমনিভাবে দেহটাও দ্রুত বিকাশ লাভ করে, কিন্তু সেটা হলো শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্তঙ্গের মধ্যে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ক্রমাগত বিকাশ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ. (التين-৪ ) ‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।’ আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ . فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ (الإنفطار-৭ -৮ ) ‘যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং সুসামঞ্জস্য করেছেন, যে আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।’ তা কোন অসামঞ্জস্য অথবা দোদুল্যমান বিকাশ নয়, যার ফলে মেজাজের দোদুল্যপনা, আবেগ, উত্তেজনা, কষ্টানুভূতি, অবাধ্যতা অথবা চলার পথে পদস্খলন সৃষ্টি হতে পারে। ফলশ্র“তিতে সে হয়ে পড়বে হতবিহ্বল ও নির্বোধের ন্যায়। যেমনিভাবে কোন কোন শিক্ষা তাকে এ দিকে ধাবিত করে থাকে বৈকি। এ সুগঠিত বর্ধনশীল দেহ দ্বারাই তো বান্দা শক্তি অর্জন করে নামাজ রোজা ও জিহাদ ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ শরিয়তের বিধানাবলি পালনে সামর্থ লাভ করে থাকে। এই সময়ই আবেগ ও উচ্ছাসগুলো পরিপক্ক হয়, যে ঘটনা ও অনুঘটনগুলো তরুণের সম্মুখে সংঘটিত হয় অথবা সে শুনতে পায় তাই তার আবেগকে উত্তেজিত করে। কিন্তু সেই আবেগ প্রবঞ্চিত হওয়া অথবা না হওয়া অথবা প্রশংসা ও ভর্ৎসনাকে অতিক্রম করে এমন এক অনুভূতির দিকে ধাবিত হয় যা কোন মহৎ কর্ম-তৎপরতার প্রেরণা যোগাতে সক্ষম হয়। যদি হয়, তাহলে এটা হবে ইতিবাচক আবেগ। এক্ষেত্রে একজন তরুণ প্রত্যক্ষ অথবা বাহ্যিক ভূমিকার ওপর তুষ্ট থাকতে পারবে না। বরং তার ভেতরে সৃষ্ট এ ইতিবাচক আবেগই এই সৎ তরুণকে সৎ কাজের নির্দেশ ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকবে। ফলে এমনকি যদি সেই কর্ম সম্পাদনে তাকে বিপদের সম্মুখীনও হতে হয় তুবও সে এ ব্যাপারে আপোষহীন থাকবে। কারণ তার রয়েছে উচ্চ আত্ম-বিশ্বাস। লক্ষ করুন, দুই আনসারী বালক যখন আবু জাহল কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়া সম্পর্কে জানতে পারল, তখন তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। যার পূর্ণ বিবরণ আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. এর যবানীতে : তিনি বলেন, ‘আমি বদরের দিন যুদ্ধের সাড়িতে দণ্ডায়মান অবস্থায় অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ডানে বামে তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমি আনসারদের দুই বালককে দেখতে পেলাম যাদের সবেমাত্র দাঁত উঠেছে। আমি উভয়ের মধ্যে কে বেশী শক্তিশালী তা প্রত্যক্ষ করছিলাম, তখন তাদের মধ্যে একজন আমাকে চেপে ধরে বললো : চাচাজান, আপনি কি আবু জাহলকে চেনেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে ভ্রাতুস্পুত্র, তার কাছে তোমার কি প্রয়োজন? তারা বলল, আমরা জানতে পেরেছি, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়। ঐ সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমাদের প্রাণ, আমরা যদি তাকে দেখতে পাই তাহলে আমাদের মধ্যে একজন নিহত না হয়ে একজনের ছায়া অন্য জন থেকে পৃথক হবে না। ফলে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। অতঃপর অপর জন আমার হাত ধরে অনুরূপ কথাই বললো। এরপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আমি আবু জাহলকে লোকের ভেতর ঘোরাফেরা করতে দেখে বললাম : এই হলো তোমাদের শিকার যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে। অতঃপর উভয়ে তাদের তরবারী কোষমুক্ত করে তাকে হত্যা করে ফেললো। এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমাদের দু’জনের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছে? উভয়ে বললো- ‘আমিই তাকে হত্যা করেছি।’ অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমরা কি তোমাদের তলোয়ার মুছে ফেলেছো? তারা উভয়ে বললো, না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় তলোয়ারের দিকে লক্ষ করে বললেন- ‘তোমরা দু’জনেই তাকে হত্যা করেছো।’ তবে তার পরিত্যক্ত সম্পদ পাবে মুয়ায বিন আমর বিন আল-জামুহ। এ তরুণ দুজনের নাম ছিল, মুআয বিন আফরা ও মুআয বিন আমর বিন আল-জামুহ।’ আরেকটি ঘটনা আমিরুল মু’মিনীন উমার বিন আব্দুল আজিজ রহ. এর ছেলে আব্দুল মালেকের। তখন তার বয়স ছিলো উনিশ বছর। যখন তিনি স্বীয় পিতাকে দেখলেন, তিনি জন সাধারণকে সুন্নতের অনুসরণের প্রতি অনুপ্রাণিত করছেন। তার বাবা তাদেরকে পুরোপুরি সুন্নাতের ওপর উঠাক এটা তারও একান্ত ইচ্ছা ছিল। তার নিকট এসে তিনি তার সম্মানিত পিতাকে বললেন : ‘হে আমিরুল মু’মিনীন, আপনি কি কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর আলোকে দেশ পরিচালনা করছেন না ? অতঃপর আল্লাহর শপথ! আমার ও আপনার চুলায় পাতিল জ্বলা না জ্বলার আমি কোন ভ্রুক্ষেপ করি না।’ এরপর তিনি তার ছেলেকে বললেন- ‘আমি জনগণকে কষ্টসাধ্য কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমি সুন্নাতের কোন অধ্যায় থেকে বেরিয়ে গেলে সেখানে প্রত্যাশার পর্ব রেখে দেই। তারা যদি সুন্নাতের জন্য বেরিয়ে পড়ে তাহলে প্রত্যাশার প্রশান্তি পাবে। আমি যদি পঞ্চাশ বছর বয়স পেতাম তাহলেও আমি মনে করতাম যে, আমার সকল প্রত্যাশা আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। কারণ আমি বেঁচে থাকলে আমার প্রয়োজনও বেড়ে যাবে; আর যদি মৃত্যু বরণ করি। তাহলে আল্লাহ তাআ’লাই আমার নিয়্যত সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ পরিপক্কতা ও পূর্ণতা তার বাহককে স্থিরতা ও ভারসাম্যতা, সত্যকে গ্রহণ ও মিথ্যা বর্জনের দিকে আহ্বান করে। কিন্তু যে পরিবেশে সে বসবাস করে সেখানে এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যা দ্ব্যর্থহীনভাবে বিবেক সম্মত প্রমাণাদির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অথবা যা সংঘটিত হয়েছে অথবা হওয়া উচিত। তখনই প্রকাশ পাবে, অস্থিরতা দোদুল্যপনা বিষণœতা নৈরাশ্য ও যুক্তি বিবর্জিত ক্রোধ তাড়িত আবেগ। এটা কিছু কাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যা কখনো দীর্ঘ আবার কখনো নাতিদীর্ঘও হতে পারে। অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্ববিরোধী বিষয়গুলো গ্রহণ করে তার সঙ্গে বসবাস করতে ও তাকে ভালোবাসতে হয়। ফলে সেগুলো সে ভালোবাসবে অথবা সেগুলোর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা পরিবর্তন করে ফেলবে। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী স্তরগুলোতে যদি একটি তরুণের বিশুদ্ধ পরিচর্যা ও প্রতিপালন না হয়, তাহলে এখন অনেক সমস্যা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। কারণ তরুণটি তখন তার মা-বাবা ও শিক্ষকবৃন্দ থেকে গবেষণাগত ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনুভব করতে শিখবে। আর এর অবশ্যম্ভাবলী ফসল হলো বন্ধু নির্বাচন, অবসর সময় কাটানোর পদ্ধতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা। এমনিভাবে অভিভাবক কর্তৃক প্রদত্ত দিক-নির্দেশনা ও উপদেশাবলি গ্রহণ না করলে অসংখ্য সমস্যা দেখা দেবে। একটি তরুণ চায় প্রত্যেকটি বিষয়ে তার একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক। এতে সে যদি প্রসিদ্ধ ও পরিচিত পথ থেকে বেরিয়েও যায় তবুও। تكليف
বা শরিয়তের নির্দেশ পালনে আদিষ্ট হওয়া একটি তরুণের এই স্তরে পৌঁছলে তার মধ্যে কয়েক প্রকারের বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে যেগুলো ইতিপূর্বে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কোন অহেতুক বিকাশ নয়, বরং এর পেছনে মহান উদ্দেশ্য লুক্কায়িত রয়েছে। তা হলো, আল্লাহপাক তার বান্দাদেরকে এই স্তরে পৌঁছার সাথে সাথে আদিষ্ট করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান আনয়ন করে সৎকাজ করবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। পক্ষান্তরে যে অস্বীকার করবে তার জন্য জাহান্নাম। (আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহে আমরা এর থেকে মুক্তি ও পরিত্রাণ চাই।) ফলে এর বিকাশ বান্দার বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপন করবে। তবে কখনোই তা বান্দার জন্য আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধে প্রমাণ হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ. (النساء-১৬৫ ) ‘যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর কাছে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে।’ অতএব দৈহিক বিকাশ বিধানাবলি পালনে সামর্থ্য লাভের জন্য অবশ্যম্ভাবী। বুদ্ধিগত বিকাশ, প্রমাণ অনুধাবনে সামর্থ অর্জন ভ্রষ্টতার পথগুলো ও হেদায়েতের প্রমাণাদি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারে। আবেগ ও উচ্ছাসের মধ্যে বিকাশ সাধন, জনসাধারণের জন্য সত্য গ্রহণ ও অসত্য অপনোদন সর্বোপরি আল্লাহর পথে সমূহ কষ্ট যথাসম্ভব সহ্য করতে সহায়ক হবে। অতএব দৈহিক বিকাশ বলতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসম ও শৃঙ্খলাহীন বিকাশ নয় ; যার কারণে তরুণ তার মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলবে। তার স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। অন্য দিকে বুদ্ধির বিকাশের অর্থ এই নয় যে, সে তার মা-বাবা ও শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিরোধ করবে ও তার বিরোধীদের মতামতকে নির্বুদ্ধিতা ঠাওরাবে। যেমনিভাবে লিঙ্গগত পরিপক্কতার অর্থ এই নয় যে, একটি তরুণ অদৃশ্য আহ্বানকারী যোগাযোগকারী ও বিপরীত লিঙ্গ নিয়ে সদা তৎপর থাকবে। আবেগের বিকাশ বলতে একগুয়েমী স্বভাব, ক্রুদ্ধ প্রভাবান্বিত, অপারগতা ও রাগান্বিত হওয়া নয়, যার ফলে সে অপরের সঙ্গে কোন দুর্ঘটনা ঘটায় ও মারামারি করতে উদ্যত হয়। সুতরাং একজন তরুণের সুষ্ঠ বিকাশ যা আল্লাহ তাআলা তাকে দান করেছেন তাহলো : আল্লাহ তাআলার অবশ্যপালনীয় বিধান পালনে সামর্থ্য অর্জনের জন্য। সেই বিকাশকে তার উদ্দেশ্যের বিপরীত খাতে প্রবাহিত করা হলে দেখা দেবে বহু রোগ ব্যাধি ও ত্র“টি বিচ্যুতি। অথচ এই ত্র“টি বিচ্যুতিগুলো এই বয়োঃস্তরের বৈশিষ্ট্যাবলির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কারণ, যে মহান সত্ত্বা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তো এর জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করেননি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ. (الذاريات-৫৬ ) ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এই জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ সে কারণেই অভিভাবককে প্রকাশিত লক্ষণগুলোর সাথে আচরণ করতে হবে এমনভাবে, যেন সেগুলো হলো কতগুলো রোগ- যার চিকিৎসা একান্ত প্রয়োজন। এগুলো ‘এই বয়সেরই অপ্রতিরোধ্য প্রতিক্রিয়া, ‘তরুণটি এ ব্যাপারে অনন্যোপায় এখানে তার কোন ইচ্ছাশক্তিই কাজ করে না’ ভেবে কখনোই তাদের সঙ্গে সে অনুযায়ী আচরণ করা যাবে না। অনন্তর মানুষ একটি অবসর জীবন পায়নি, বরং মানুষ জীবনকে জন্মগত অভ্যাসপূর্ণ অবস্থায় পেয়েছে- যে অভ্যাসের ওপর আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর মা-বাবা, অভিভাবকবৃন্দের তৎপরতা অথবা পরিবেশের কারণে তার পরিবর্তন ঘটে থাকে। পক্ষান্তরে সে যদি তার স্বভাবজাত প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে ও তার কোন কিছুরই পরিবর্তন সাধিত না হয়। তাহলে সে ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করবে, যা তাকে সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রতিটি সুন্দরতম নান্দনিক চরিত্রে নির্দেশ করবে। সকল অকল্যাণ ও নিন্দনীয় মন্দ চরিত্র থেকে তাকে বিরত রাখবে। অতএব একজন তরুণ যখন জন্মগত স্বভাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ও ইসলামী পরিবেশে প্রতিপালিত হবে, তখন উল্লেখিত কর্মকাণ্ডগুলো তাকে স্পর্শ করতে পারে এমন সাধ্য কি তার আছে? বরং তা আসে একটি স্বভাববিকৃত পরিবেশ থেকে। ‘অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহুদী, খৃষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়।’ অথবা তার প্রতিপালন আল্লাহ তাআলার বিধানের আলোকে করা হয় না। সর্বোপরি কথা হলো যার মধ্যে ত্র“টি রয়েছে সেখান থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হবে। তবে অবশ্যই তা ‘এ বয়সের বৈশিষ্ট্য নয়’ কথাটা সব সময় মাথায় রাখতে হবে।
সাহসিকতা, অগ্রগামিতা ও কষ্টসাধ্য কর্মসম্পাদন এই বয়োঃস্তরে তরুণের শরীরে যে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি সাধিত হয় ও তার নিকট গবেষণা করার যে ক্ষমতা অর্জিত হয়, তা-ই নিজের কাছেও ঐ শক্তি ও সামর্থের অনুভূতির জন্ম দেয়। আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন- اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً . (الروم:৫৪ ) ‘আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি ; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ শৈশবের দুর্বলতা থেকে ক্রমান্বয়ে তারুণ্য ও যৌবনের শক্তির দিকে সে রূপান্তরিত হয়। শক্তি ও সামর্থের অনুভূতি তাকে অগ্রগামিতা ও কষ্টসাধ্য কর্মসম্পাদনে অনুপ্রাণিত করে। সেহেতু অধিকাংশ সময় সে কোন প্রতিকূলতার প্রতি ভ্রুক্ষেপই করে না। এটা তার ভালো একটি দিক যদি তরুণটি সত্যাশ্রয়ী হয়। পক্ষান্তরে আবেগতাড়িত হয়ে যদি সঠিক দিক-নির্দেশনা থেকে দূরে সরে যায় তাহলে এটা হবে তরুণটির ধ্বংস ও মন্দ দিক। অতএব অভিভাবককে এক্ষেত্রে খুবই সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে যাতে তিনি তরুণটিকে কল্যাণের পথে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সর্বকালেই এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে : একাধিক সাহাবায়ে কেরাম জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন অথচ এরপর তারা তারুণ্যে গমন করেছেন। তারা এক্ষেত্রে যার পর নাই উদগ্রীবও ছিলেন বটে। এমনকি তারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য নিজেদের বয়স বেশী দেখানোর কৌশল অবলম্বন করতেন। সামুরাহ বিন যুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার মা বিধবা হওয়ার পর তিনি মদীনায় চলে আসলে লোকেরা তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। এরপর তিনি বলেন, ‘এই অনাথের দায়িত্বভার যে ব্যক্তি গ্রহণ করতে রাজি হবে আমি শুধুমাত্র তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি। অতঃপর তাকে এক আনসারী বিবাহ করলো। তিনি (হাদিসের বর্ণনাকারী) বলেন, ‘প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আনসারী বালকদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য পেশ করা হতো। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদের বয়স হয়েছে তাদেরকে মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীতে তালিকাভুক্ত করে নিতেন। তিনি (হাদীসের বর্ণনাকারী) বলেন, ‘আমাকে এক বছর পেশ করা হলো। তখন এক বালককে ভর্তি করা হলো আর আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি ওকে ভর্তি করে নিলেন আর আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। অথচ আমি তার সঙ্গে কুস্তি ধরে তাকে ধরাশায়ী করতে পারি। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তাহলে দেরি করছো কেন? কুস্তি ধরেই দেখাও না।’ অতঃপর আমি কুস্তি ধরে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলি। ফলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন।’ আব্দুল্লাহ বিন উমার রা.থেকে বর্ণিত, ‘অহুদের দিন তাকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপস্থাপিত করা হলো, অথচ সে তখন চৌদ্দ বছরের কঁচি বালক। তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। অতঃপর দ্বিতীয় বার আমাকে খন্দকের দিন পেশ করা হলো, অবশ্য তখন আমার বয়স পনের বছর পূর্ণ হয়েছিলো। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলো।’ (হাদীস বর্ণনাকারী) নাফে’ বলেন, ‘আমি উমার বিন আব্দুল আজিজের দরবারে গেলাম, যখন তিনি মুসলিম জাহানের সম্রাট। অতঃপর এই হাদীসটি তার নিকট বর্ণনা করলে তিনি সকল প্রাদেশিক গভর্নরদের নিকট শাহী ফরমান লিখে পাঠালেন- ‘পনের বছর পূর্ণ হয়েছে এমন বালকদের জন্য সেনাবাহিনীর তহবিল থেকে ভাতা নির্ধারণ করে দেয়া হোক।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসামা বিন যায়েদ রা. এর হাতে আঠারো অথবা বিশ বছর বয়সে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই অসংখ্য অপরাধ যা এমন লোকদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে যারা জীবনের এই ঈর্ষণীয় ও প্রসন্ন বয়সে উপনীত। এই প্রেক্ষাপটে এই বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত বয়সকে যথাযথ ব্যবহার করে শ্রমসাধ্য কল্যাণকর কর্ম সম্পাদনের জন্য তরুণকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে এখান থেকে উপকৃত হওয়া অভিভাবকের কর্তব্য। সাথে সাথে না দেখে না বুঝে কোন কাজে আসক্ত হওয়া ও নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হতে তাকে সতর্ক করতে হবে ।
দ্বিতীয় অধ্যায় :
অন্তরায় ও সমস্যাবলী পূর্ববর্তী স্তরগুলোয় যখন উত্তম রূপে একজন যুবকের প্রতিপালন ও পরিচর্যা সাধিত হবে। তখন পূর্ববর্তী অন্তরায় ও সমস্যাগুলোও দূরীভূত বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই স্তর সংশ্লিষ্ট প্রকট একটি সমস্যা প্রকাশিত হতে পারে। তা হলো তরুণ তরুণীদের বয়োঃসন্ধি সংশ্লিষ্ট সমস্যা। আর এটা শুধুমাত্র উত্তম পরিচর্যা ও প্রতিপালনের অভাবেই দেখা দিতে পারে। অথবা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেই নষ্ট পরিবেশের কারণে যেখানে সেই তরুণ-তরুণীরা বসবাস করছে। আল্লাহ তাআলা তো এই সুন্দর বসুন্ধরাটাকে আবাদ ও মানব প্রজন্মকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে কামোত্তেজনা ও সঙ্গমের সামর্থ প্রোথিত করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে এটা যদি নিরেট একটা কর্ম হতো যেখানে কোন কামভাব থাকবে না, উপভোগ করা যাবে না তা সম্পাদনে কোন স্বাদ তাহলে কেউ বিবাহ করতে কিংবা এর ব্যয় ভার বহন করতে অগ্রসর হতো না। ফলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে মানব প্রজাতি বিলুপ্তির মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস ডেকে আনতো। অনন্তর আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বকে এই জন্য সৃষ্টি করেননি। কিন্তু এই কামভাবকে যদি শরিয়তের বিধানাবলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না করা হয়, তখনই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর তা হলো তরুণ-তরুণীদের অবৈধ পথে কামক্ষুধা চরিতার্থ করা। ইসলাম এই সম্ভাব্য সমস্যার অসংখ্য উপকারী ও ফলপ্রসূ সমাধান দিয়েছে। অভিভাবকদের এই সমাধানগুলো থেকে উপকৃত হওয়া ও তা প্রয়োগ করা কর্তব্য। কারণ এইগুলোই আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে। তা হতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হলো ঃ ১- মহিলাদের গৃহ অভ্যন্তরে অবস্থান করা ও শরিয়ত সম্মত প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া। ২- শরিয়ত সম্মত প্রয়োজনে বের হওয়ার সময় মহিলাদের পোশাকের ব্যাপারে সমাজকে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করা। বের হওয়ার সময় বাঞ্ছনীয় কর্ম : আবৃত হওয়া ও সৌন্দর্য প্রকাশ না করার প্রতি যতœবান হওয়া। ৩- দৃষ্টি অবনত রাখা। আল্লাহ তাআলা যে দিকে তাকাতে নিষিদ্ধ করেছেন সে দিকে না তাকানো। ৪- উম্মোচিত হওয়া, দ্রষ্টব্য হওয়া অথবা স্পর্শকৃত হওয়া থেকে লজ্জা স্থানকে সংরক্ষণ করা। ৫- তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সংশ্রব না ঘটা। চাই তা পথে, ঘরে অথবা কর্মক্ষেত্র যেখানেই হোক না কেন। ৬- নির্জনতা পরিহার করা, অর্থাৎ কোন তরুণ তরুণীর সঙ্গে একান্তে মিলিত হবে না। কারণ শয়তান হয় তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি। ফলে সে তাদেরকে অবৈধ কাজের জন্য কুমন্ত্রণা দেবে ও তাদেরকে অপকর্মের দিকে ভালো করে ঠেলে দিতে সক্ষম হবে। ৭- সময় হলে বিবাহ কর্ম দ্রুত সম্পন্ন করা ও এতে বিলম্ব না করা। ৮- যার বিবাহ করার আর্থিক সামর্থ নেই তার জন্য রোজাব্রত পালন করা। ৯- উত্তেজনাবর্ধনকারী বিষয় থেকে দূরে থাকা। যেমন : উপন্যাস, সিনেমা ও গান-বাজনা ইত্যাদি। ১০- একাকীত্ব ও সমাজ বিমুখতা পরিহার করা। কারণ তখন মানুষের ওপর শয়তানের প্রভাব বিস্তার সহজ হয়। ১১- শক্তি সঞ্চয়ের জন্য বৈধ শরীর চর্চার প্রতি যতœবান হওয়া। ১২- গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান ও তাকে কর্মের মধ্যে ব্যস্ত রাখা। ১৩- সৎ সঙ্গ অবলম্বন করা। যা তাকে পুণ্য ও সংযমের কাজে সহায়তা করবে এবং পাপাচার ও সীমা লংঘনের কাজে বাধা দেবে। ১৪- ইবাদতের প্রতি যতœবান হওয়া। যা মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের অনুভূতি জাগ্রত করে। যেমন : তাহাজ্জুদ নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াত। ১৫- আল্লাহ থেকে লজ্জার দিকটাকে বেশি শক্তিশালী করা। আল্লাহ তাআলা বান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফলে বান্দার কোন কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকতে পারে না। ১৬- আল্লাহর নিকট দোয়া করার ক্ষেত্রে কাকুতি-মিনতি করা ও সন্তানাদি তথা ছেলে- মেয়েদের সার্বিক হেফাজতের জন্য তার কাছে প্রার্থনা করা। সুতরাং কিভাবে এই সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে তার পদ্ধতিসমূহ খুঁজে বের করা একজন দায়িত্বশীল অভিভাবদের কর্তব্য। আর তা হলো এমন তৎপরতা যা তরুণ- তরুণীদের মনের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করতে সক্ষম। যেহেতু তা জন্মগত স্বভাবের অনুকূল যার ওপর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে কারণেই এর প্রভাব যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা পছন্দ করে তাদের প্রভাবের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। পক্ষান্তরে উল্লেখিত উপকরণের মাধ্যমেও যদি অভিভাবক এই সমস্যাটির সমাধান করতে না পারেন। তাহলে এক্ষেত্রে শিথিলতার পরিণাম তিন দিকে আবর্তিত হবে। সমাজ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী। প্রত্যেকেই তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বহন করবে। সে কারণে এ প্রেক্ষিতে সফলতার কার্যকর রূপ তখনই প্রতিফলিত হবে, যখন এই মৌলিক উপাদানত্রয় একই দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করবে। এই তিনটি মৌলিক উপাদানের যে কোন একটির মধ্যে যদি কোন দুর্বলতা অথবা বিচ্ছিন্নতা সংঘটিত হয়, তাহলে অবশিষ্ট দুটি উপাদানকে আল্লাহর ইচ্ছায় জাহাজের পাল তুলে মুক্তি তীরে নিয়ে নোঙ্গর করতে হবে (যদি এক্ষেত্রে কোন দুর্বলতা থাকে)। কিন্তু বিপদ প্রকট আকার ধারণ করবে যখন দুটি উপাদানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও দুর্বলতা সংঘটিত হয়ে যাবে। কারণ অচিরেই এটা তৃতীয় উপাদানকেও সংক্রমিত করে ফেলবে। আল্লাহ ভাল কাজের সহায়ক।
তৃতীয় অধ্যায় :
উপকরণ ও পদ্ধতিসমূহ একটি তরুণ এই বয়োঃস্তরে পৌঁছেই আদিষ্ট হয়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের ওপর দৃঢ়তা অবলম্বনই হবে তার একমাত্র কাজ ও এটাই তার কাছ থেকে কাম্য। প্রথম পদক্ষেপেই সংঘটিত শিথীলতার জন্য তাকে জবাবদিহী করতে হবে। এর অর্থ হলো তার ওপর বাঞ্চনীয় কর্ম সম্পাদনে প্রচেষ্টা চালানো তার কর্তব্য। যেমন : ইল্ম, আমল ও আদব। সুতরাং তখন তরুণের প্রতিপালনের মহৎ কর্মটি তরুণ ও তার অভিভাবকের মধ্যে যৌথভাবে শিক্ষা দিতে হবে উপদেশ ও উদাহরণ উপস্থাপনের মাধ্যমে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার মাধ্যমেÑ যা কোরআনে কারীম বিরুদ্ধাচারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য অসংখ্যবার প্রয়োগ করেছে। আল্লাহ তাআলা এই উদাহরণ প্রসঙ্গে বলেন, وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ. (العنكبوت-৪৩ ) ‘এই সকল দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য দেই ; কিন্তু কেবল জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এটা বুঝে।’ যেমনিভাবে একটি তরুণের অনুসন্ধিৎসা ও রহস্য উদ্ঘাটনের আগ্রহ থেকে তার প্রতিপালন ও জ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে উপকৃত হওয়া সম্ভব। চাই তা অভিজ্ঞতা, পঠন, অধ্যয়ন অথবা শিক্ষা সফর ইত্যাদি প্রয়োগ করেই হোক না কেন। আল্লাহ তাআলা মিথ্যাবাদীদেরকে ভ্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে তারা জানতে পারে তিনি কিভাবে সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআ’লা বলেন, قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ (العنكبوت-২০ ) ‘বল, ‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর কিভাবে তিনি সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন ?’ এবং তিনি তাদের মৃত্যু সংবাদ দিলেন যারা তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণতি থেকেও কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ كَانُوا مِنْ قَبْلِهِمْ (غافر-২১ ) ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? তাহলে দেখতে পেতো তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিলো।’ জ্ঞান অন্বেষনের জন্য ভ্রমণ আলেম-উলামাদের নিকট প্রসিদ্ধ। তাদের লেখনীতে এ বিষয়ের ওপর ‘অধ্যায় : জ্ঞান অন্বেষণে ভ্রমণ’ নামে স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই ভ্রমণকাহিণীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মুসা আ. এর শিক্ষা সফর। যখন তিনি খিযির আ.-এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করলেন। তার সাক্ষাতের আবেদন করলেন, যাতে তার নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করতে পারেন। কারণ মুসা আ. জানতে পেরেছেন, তার নিকট এমন জ্ঞান রয়েছে যা তিনি জানেন না।
চতুর্থ অধ্যায় :
পুরস্কার ও শাস্তি পুরস্কার তরুণ যদিও সে এখন পুরুষের স্তরে উপনীত হয়েছে তথাপি পুরস্কারের প্রয়োজনীয়তা থেকে সে উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কোরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াত রয়েছে যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলার নেক আমলের বিনিময় পুরস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সুতরাং তরুণ ও তরুণীদের ব্যাপারে এটাকে গুরুত্বহীন ভাবা কোন অবস্থাতেই ঠিক হবে না। বিশেষ করে কষ্টসাধ্য কর্ম সম্পাদনে এবং যে কাজের জন্য বিরাট সাহসিকতার প্রয়োজন হয়। খন্দক যুদ্ধের ঘটনা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম সৈন্যদের মধ্য হতে এমন কাউকে চাচ্ছিলেন, যে শত্র“ সৈন্যদের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে পারবে। সে জন্য তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে হুজায়ফাহ রা. হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আহযাব যুদ্ধের রজনী, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথে দেখতে পেলেন। (প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া) তীব্র ও শীতল বায়ু আমাদেরকে স্পর্শ করে গেলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বললেন- ‘এমন কেউ আছো কি? যে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর এনে আমাকে দিতে সক্ষম, তাহলে আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গী করে উঠাবেন। তখন আমরা সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কোন উত্তর দিলো না। অতঃপর (দ্বিতীয় বার) তিনি সাল্লাল্লাহু আমাদেরকে বললেন- ‘এমন কেউ কি নেই? যে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর এনে আমাকে দিতে পারবে তাহলে আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গী করে উঠাবেন। তখন আমরা সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কোন উত্তর দিলো না। অতঃপর (তৃতীয় বার) তিনি আমাদেরকে বললেন- ‘এমন কেউ কি নেই? যে আমাকে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর এনে দিতে পারবে তাহলে আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গী করে উঠাবেন। তখন আমরা সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কোন উত্তর দিলো না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বললেন- ‘হুজাইফা, তুমি দাঁড়াও, যাও তুমি গিয়ে শত্র“বাহিনীর খবরাখবর নিয়ে এসো।’ আমার নাম ধরে আহ্বান করার পর আমি কোন উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন- ‘যাও শত্র“বাহিনীর খবর নিয়ে এসো! তাদেরকে তোমার পরিচয় বুঝতে দিও না।’ সেই রাতে প্রচণ্ড ও তীব্র শীতল ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিলো। সে কারণে উক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য দুর্দান্ত সাহসিকতা ও শক্তির প্রয়োজন ছিলো। এই কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দুঃসাহসিক কর্ম সম্পাদনের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। কাজেই যে তার ইচ্ছা পূরণ করবে তার সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন আমার সঙ্গী করবেন।’ তিনি কাউকে শুরুতেই এ ব্যাপারে নির্দেশ করেননি। কল্যাণকর কাজে সাহাবীদের আগ্রহ ও তা বাস্তবায়নে তাদের চূড়ান্ত প্রয়াস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে এই মহান মর্যাদার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি তা তিনবার পুনরাবৃত্তি করা পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায়নি। যা সেই দিনের তীব্র শীত ও প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার দরুণ সৃষ্ট দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে দুঃসাহসিক দায়িত্ব পালনের দিকেই ইঙ্গিত করে। সে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়োজন হয়েছে, তিনি নিজেই সেনাপ্রধান হিসেবে নির্দেশ করেন। সকল দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে যার আনুগত্য অপরিহার্য কর্তব্য। তিনি এই দুঃসাহসিক কাজের দায়িত্ব হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. কে অর্পণ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ ভূমিকা অহুদের যুদ্ধেও নিয়েছিলেন যখন তাঁকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কতিপয় সাহাবীকে মুশরিকরা অবরোধ করে ফেলেছিলো। আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহুদের দিন সাত জন আনসারী ও দুই কোরাইশকে নিয়ে একাকী হয়ে পড়লেন। অতঃপর তারা যখন সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হলো, তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘কে আছে যে আমাদের পক্ষ হয়ে শত্র“দের প্রতিহত করবে, ফলে বিনিময়ে তার জন্য রয়েছে জান্নাত অথবা সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’ এমনিভাবে অভিভাবকের কর্তব্য হলো প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। আর যে কাজটি আল্লাহ তাআলা আবশ্যক করেছেন তার প্রতিদান তো সেটাই যার প্রতিশ্র“তি আল্লাহ তাআলা তার সংযমী বান্দাদের সঙ্গে করেছেন ।
শাস্তি তরুণের এই বয়োঃস্তরে পৌঁছার সাথে সাথে সকল বিরুদ্ধাচরণ ও পাপাচার লিপিবদ্ধ হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা পরকালে এর জন্য তাকে পাকড়াও করবেন যদি মৃত্যুর পূর্বে তা হতে তওবা না হয়ে থাকে অথবা পাপ মোচনকারী কোন নেক আমল তার না থাকে। কোন কোন পাপাচার তো পৃথিবীতে দণ্ডবিধি কার্যকর করণকে অবধারিত করে। এ শাস্তি প্রয়োগের জন্য কেবল অভিভাবকই যথেষ্ট নয়। অতএব এই বয়োঃস্তরে অভিভাবকের উক্ত অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া প্রতিপালনের কোন উপকরণ নয়। বরং তখন প্রতিপালন হবে দণ্ডবিধি কার্যকর করণের মাধ্যমে। কিন্তু অসংখ্য বিরুদ্ধাচরণ রয়েছে যার ইয়ত্তা নেই। এই সকল অপরাধের ক্ষেত্রে অভিভাবকের কর্তব্য হলো, অভিভবক যখন জানতে পারবে তখন তা হতে তাকে বারণ করবে যদিও তা শাস্তির মাধ্যমেই হোক না কেন। উল্লেখ্য যে, শাস্তির উদ্দেশ্য এখানে অবশ্যই প্রহার নয়। বরং কখনো তা হতে পারে ধমক দিয়ে, কখনো ক্রোধ প্রকাশ ও ভীতি প্রদর্শন করে, কখনো ত্যাগ করে অথবা এক দুই দিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে। খেয়াল রাখতে হবে, বয়কট করাটা তার অবাধ্যতা বাড়িয়ে না দেয়। বিদাআ’তী ও পাপাচারীদের বয়কট করার বিধানাবলি সংক্রান্ত জ্ঞানের একটা বিশাল অধ্যায় রয়েছে। অবহেলা না করে প্রয়োজন হলে অভিভাবক তা প্রয়োগ করতে পারেন । আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘মহিলাগণ মসজিদে আসার জন্য অনুমতি চাইলে তোমরা তাদেরকে বারণ করো না!’ (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, ‘এ কথা শুনে তার ছেলে বিলাল বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমরা অবশ্যই তাদেরকে বাধা দেব।’ (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, অতঃপর তার পিতা ইবনে উমার তার দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে খুব করে বকা দিলেন। অনুরূপ আর কাউকে কখনো তাকে বকা দিতে দেখিনি। ইবনে উমার রা. তাকে বললেন-‘আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস বর্ণনা করছি। অথচ তুমি বলছো : ‘আমরা অবশ্যই তাদেরকে বাধা দেব।’ লক্ষ করুন! সন্তান যখন সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক মত প্রকাশ করলো, তাকে সে জন্য শাস্তি দিলেন ও তার থেকে এটা শ্রবণ করার পর তাকে ছেড়ে দেননি। অপরাধ ও ত্র“টি বড় হওয়ার দরুণ তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। অনেক অভিভাবক আছেন যারা তরুণ-তরুণীদেরকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে এমন আচরণ করে থাকেন যা আদৌ ঠিক নয়। সে কারণে তাদের এ ক্ষেত্রে যে সকল ভুল-ত্র“টি সংঘটিত হয়ে থাকে তার মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হলো :
শাস্তি-শাস্তি প্রদানে ত্র“টিসমূহ বহিস্কার করণ কোন কোন কাজ থেকে অভিভাবক যখন তাকে বারণ করতে সক্ষম হবে না অথবা তার তরুণ সন্তানটি তার দিকনির্দেশনায় সাড়া দেবে না। সে কারণে তার ভরণ-পোষণ স্থগিত করে দেবেন অথবা তার ঘরে প্রবেশ করাতে নিষেধাজ্ঞা জারী করবেন। কিন্তু কখনো এটা সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এটা বরং তখন সমস্যার প্রকট আকার ধারণ ও বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর শাস্তির আশঙ্কায় অবশ্য এতে তরুণটি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার এর যে কোন সমাধান নিজের থেকে খুঁজতে আরম্ভ করে দিতে পারে। অবশ্য তখন সর্বাপেক্ষা দ্রুত ও সহজ সমাধান হতে পারে বিপথে ভ্রমণের সূচনা। পরিচিত ভ্রমণটি হতে পারে তাদের পথে যাদেরকে বলা হয় মন্দ বন্ধুমহল। ফলতঃ তারাই হবে এ পথের মূল শিকার, যেখানে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়বে। চূড়ান্ত পর্যায় বাবা তাকে ফিরিয়ে আনার কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার আর কোন উপায়ই খুঁজে পাবে না। কিন্তু এরপর কি হবে ?
সন্তানকে অভিশাপ বা বদ-দোয়া করা মা-বাবা কর্র্তৃক সন্তানের জন্য সামগ্রিক কল্যাণের দোয়া করা যা নবী রাসূলগণের আমলে ঈমানদারদের সুন্নত ছিলো। দেখুন ইবরাহীম আ. যিনি বলতেন- رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي.(إبراهيم-৪০ ) ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে সালাত কায়েমকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও।’ যাকারিয়া আ. বলতেন- رَبِّ هَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً. (آل عمران-৩৮ ) ‘আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর।’ একজন ঈমানদারের প্রার্থনা - وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي. (الأحقاف-১৫ ) ‘আমার জন্য আমার সন্তান-সন্ততিদিগকে সৎকর্মপরায়ণ কর।’ ঈমানদারগণের প্রার্থনা- هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ. (الفرقان-৭৪ ) ‘আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর।’ সন্তানের সৌভাগ্যের অন্যতম সোপান মা-বাবার দোয়া। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী- ‘তিনটি দোয়া আল্লাহর নিকট নিশ্চিত কবুল যোগ্য।’ সেখানে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তানের জন্য বাবার দোয়াকেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক মানুষ এই দোয়াকে সন্তানের উপকারের জন্য ব্যবহার করার পরিবর্তে তারা বিষয়টাকে সম্পূর্ণরূপে উল্টিয়ে দিতে অভ্যস্ত। যখন তারা ওদের ওপর ক্রোধান্বিত হয় অথবা সন্তানরা এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে যা তাদের অসন্তুষ্টির কারণ হয়, তখন তারা ওদেরকে অভিশাপ দেয়, বদ-দোয়া করে থাকে। বলে থাকে - ‘আল্লাহ, ওকে ধ্বংস করে ফেল, ওকে শাস্তি দাও অথবা ওর ওপর অভিসম্পাত কর! কেন মৃত্যু তোকে চোখে দেখে না। কত মানুষকে আল্লাহ নিয়ে নেয়, তোকে নিতে পারে না?’ এগুলো বলার স্থলে তারা বলতে পারেন : হে আল্লাহ, ওকে হেদায়েত দাও, ওকে সংশোধন করে দাও, ওকে পরিপাটি করে দাও এবং ওর তাওবা কবুল কর ইত্যাদি। কারণ এটা হলো উত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। এর মধ্যে কারো জন্য কোন ক্ষতি নেই, বরং এতে সন্তান ও বাবা উভয়ের জন্য কেবল কল্যাণ আর কল্যাণই নিহিত রয়েছে। এমন দোয়া করা উচিত নয়, যদি তা বাস্তবায়িত হয়ে যায়, তাহলে মা-বাবা দুঃখ ও অনুতাপে তার হাতের আঙ্গুল কাটবে। ফলে সে হবে নিতান্ত লজ্জিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তানদেরকে অভিশাপ দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ এর মধ্যে এমন বিপদ নিহিত যেখানে কোন ধরনের উপকারিতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের, তোমাদের সন্তানদের ও তোমাদের সম্পদের ওপর অভিশম্পাত কর না। তোমরা ঐ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহর সঙ্গে ঐক্যমত্যে যেওনা যখন আল্লাহর নিকট কোন দান প্রার্থনা করলে তিনি তা তোমাদের জন্য কবুল করে থাকেন।’
জরিমানা অথবা ছোট ভাই-বোনদের সামনে তাকে লজ্জিত করা তরুণ-তরুণীদের এ বয়সে আত্মমর্যাদাবোধ প্রবলভাবে ঊজ্জীবিত হয়ে থাকে। এই পথ অথবা পদ্ধতি তাদের উভয়কেই ভীষণভাবে আঘাত করে। যার ফলে অনেক সময় অভিভাবকদের সাথে তাদের শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। উপরন্তু এই পদ্ধতির বারংবার প্রয়োগ তাকে অবাধ্যতা ও তার কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতার স্বপক্ষে যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন ও অভিভাবকের ভুলত্র“টিগুলো খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হতে উদ্যত করবে। অথচ অন্য দিকে অভিভাবকগণ কেবলমাত্র এতটুকু করেই ক্ষ্যন্ত থাকেন না। বরং তাদেরকে অপরিচিত ব্যক্তি অথবা সহপাঠি ও বন্ধুদের মত নিকটতম লোকদের সম্মুখে লজ্জা দেন ও তিরস্কার করে থাকেন। অথচ এর অবশ্যম্ভাবী অশুভ পরিণতি সম্পর্কে তার কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই।
অবমূল্যায়ন ও তুচ্ছ জ্ঞান করা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত উভয় প্রকারের ভুল-ত্র“টি থেকে কেউই মুক্ত নয়। কোন কোন অভিভাবক রয়েছেন যারা চান যে, তার সন্তান হবে একেবারে নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ। ফলে কোন পদস্খলনকেই তারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারেন না। বরং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও কঠিন হিসাব নিয়ে থাকেন। এ কারণে অনেক সময় তরুণ সন্তানটি অভিভাবককে তুচ্ছজ্ঞান ও অবমূল্যায়ন করতে পারে। যার বহিঃপ্রকাশ কয়েকভাবে ঘটতে পারে। যেমন : কথাবার্তা অথবা কোন সময় কর্মের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ। যথা, ছোটদেরকে তার ওপর প্রাধান্য দেয়া, তার উর্ধ্বতনের স্থানে তাকে স্থাপন করা, বড়কে উপেক্ষা ও তার দিকে কোনরূপ ভ্রক্ষেপ না করে ছোটদের সঙ্গে পরামর্শ করা ও তার মত অনুযায়ী কর্ম প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেন সে অনুপস্থিত প্রভৃতি।
কোন অপরাধ বা বিরোধিতাকে হালকা করে দেখা একদিকে যেমন এমন অভিভাবক রয়েছেন যারা সামান্য অপরাধে কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকেন। অপর দিকে বড় বড় অপরাধের ক্ষেত্রেও শাস্তি দানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে থাকেন এমন অভিভাবকের সংখ্যাও একেবারে কম নয় অথচ উভয় কাজই নিন্দনীয়। তরুণ- তরুণীদের থেকে কোন ত্র“টি সংঘটিত হয়ে গেলে তা হালকা করে দেখা অথবা এক্ষেত্রে এমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা যে, ‘এ বয়সে এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার’ উচিত নয়। যদি সে স্বীয় অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ওখান থেকে মুক্তির পথ অনুসন্ধানরত অবস্থায় তাওবা করে ফিরে আসে তবুও। কারণ, এ অবস্থায় তাকে যদি কোন ভর্ৎসনা তিরস্কার ও লজ্জা দেয়া না হয় ‘সে অপরাধ স্বীকার করে তাওবা করে ফিরে এসেছে’ শুধূমাত্র এ কারণে, তাহলে সে বিষয়টিকে হাল্কা মনে করে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। ঐ লোকটির দিকে লক্ষ করুন, যে, পবিত্র রমজান মাসে স্ত্রী সম্ভোগ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট ফতওয়া জিজ্ঞাসা করার জন্য এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন- ‘পবিত্র রমাদান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাতে এক লোক মসজিদে নববীতে এসে বলে- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি দগ্ধ হয়ে গেছি, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন- ‘তোমার কি হয়েছে ?’ উত্তরে সে বললো- ‘আমি স্ত্রীর সাথে মিলন করে ফেলেছি।’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘সদকা কর।’ এরপর সে বললো- ‘হে আল্লাহর নবী, আমার তো কোন সম্পদই নেই। সুতরাং আমি সদকা করতে সক্ষম নই।’ তিনি বললেন- ‘তুমি বসো!’ তখন লোকটি বসে রইল। ইতিমধ্যে খাদ্য সামগ্রী বোঝাই গাধা হাঁকিয়ে এক ব্যক্তি আগমন করলো। এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘একটু আগে যে দগ্ধলোকটি এসেছিল সে কোথায়?’ তখন লোকটি দাঁড়িয়ে গেলে পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘যাও এটা নিয়ে সদকা করা গিয়ে।’ অতঃপর সে বললো, ‘আমাদের ছাড়া অন্য কাউকে?’ আল্লাহর শপথ! আমরা ক্ষুধার্ত ও কপর্দকশূন্য।’ এরপর তিনি বললেন- ‘তাহলে তোমরাই তা আহার করো!’ ভদ্রলোক তার অপরাধ স্বীকার ও তাওবা করে সমাধান জানার জন্য এসেছে। এর প্রমাণ তার কথা ‘আমি দগ্ধ হয়ে গেছি, আমি পুড়ে গেছি’ যার অর্থ তার কৃত অপরাধ বোধ ও তার অবগতি। যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার তাওবার দিকে তাকিয়ে তাকে কোন শাস্তি দেননি। আর তা ছাড়া তার কর্মটি দণ্ডবিধির আওতায় পড়ে এমন অপরাধও নয়। এতদসত্ত্বেও তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অপরাধটিকে খাটো করে না দেখে বললেন- ‘একটু আগে যে দগ্ধ লোকটি এসছিলো সে কোথায়?’ যা থেকে প্রতিভাত হয় যে, তার সে অপরাধকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যাবে না। অনন্তর পাপের বৈশিষ্ট্য হলো তা আগুনের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় যা মানুষকে ভষ্মীভূত করে দেয়। এই হলো পদ্ধতি, তরুণ-তরুণীদের এ জাতীয় দণ্ডবিধিমুক্ত অপরাধে নিমজ্জিত হওয়ার পর যা অভিভাবকের প্রয়োগ করা একান্ত কর্তব্য। ইমাম বুখারী রহ. এ বিষয়ের ওপর একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। ‘পর্ব : যে ব্যক্তি দণ্ডবিধির আওতাধীন নয় এমন কোন অপরাধ করলো, অতঃপর তা রাষ্টপ্রধান বা বিচারপতিকে অবহিত করা হলো। যদি অপরাধী তাওবা বা আত্মসমর্পণ করে সমাধান জানার জন্য আসে তাহলে তার ওপর শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। তরুণ ও তরুণীদের থেকে অপরাধ সংঘটিত হলে তা তুচ্ছ করে না দেখার অর্থ এ নয় যে, অভিভাবক তাকে অব্যাহতভাবে লজ্জা দিতেই থাকবে। যখন সে আলোচনা করবে, কোন কথা অথবা কোন কাজ করবে তখনই তাকে বলা হবে : তুমি হলে এই, এই। কারণ, এই পদ্ধতি সংশোধন নয় তাকে কেবল ধ্বংস করতে পারবে। সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে :التعيير হলো বর্তমানকালে কারো পূর্ব সংঘটিত অপরাধের জন্য তিরস্কার ও দোষারোপ করা, চাই তার তাওবা জ্ঞাত হোক বা অজ্ঞাত। তবে অন্যায়ে লিপ্ত হওয়ার সময় বা তার পরক্ষণে লজ্জা দেয়ার যার সামর্থ আছে তার ওপর এটা কর্তব্য। আবার কখনো বা দণ্ডবিধি অথবা শাস্তি বিধান করা অবশ্যক হয়ে যায়। এসবই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের পর্যায়ভুক্ত। দোষ-ত্র“টি অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করা ও অজুহাত পেশ অগ্রাহ্য কিংবা অবিশ্বাস করার ফলে কখনো কখনো তরুণ-তরুণীদের থেকে এমন অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে যা কেউ দেখেনি অথবা কেউ টের পায়নি। সে কারণে অভিভাবক অনুসন্ধান ও ছিদ্রান্বেষণ করতে থাকে তার কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে যেতে পারে এ আশংকায়। অতঃপর সেটা নিয়ে তার মুখোমুখি হয়। অথচ কেবলমাত্র কিছু অলীক কল্পনা ও নিছক আশঙ্কা ছাড়া তার কাছে কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। এতে সম্পর্ক ছিন্ন করা, সন্দেহের বীজ বপণ ও আস্থা হীনতা ব্যতীত অন্য কোন উপকারিতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘রাষ্টপ্রধান যদি প্রজা সাধারণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেন, তাহলে তিনি যেন তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন। কখনো কখনো তরুণ-তরুণীদের থেকে এমন কিছু কর্মও সংঘটিত হয়ে থাকে যাকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় যদি এ ব্যপারে সে কোন ওজর পেশ করে তবুও। বাস্তবেও যদি সেটা যুক্তিসঙ্গত অপারগতার উপযুক্ত হয় তবুও অভিভাবকের এই কথা বলে তাকে দিকনির্দেশনা উচিত হবে না - তুমি মিথ্যাবাদী ইত্যাদি। এমনকি এ মর্মে একাধিক আলামত তার নিকট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঐ বাহানা প্রকাশ তার জন্য বিশুদ্ধ নয়। কারণ এভাবে পরিত্রাণের প্রচেষ্টাই প্রমাণ করে যে, তার কর্মকাণ্ডের মন্দানুভূতি তার হয়েছে। কেবল এই অনুভূতিই তাকে সে কর্ম থেকে দূরে রাখতে সক্ষম। ‘সে বলেছে অথবা করেছে’ অভিভাবক কর্তৃক এ মর্মে চাপ প্রয়োগ অভিভাবকের অন্তরের রুক্ষতা ও কাঠিন্য প্রমাণ ভিন্ন অন্য কোন ফল দেবে না। কারণ, সে যতক্ষণ বিশ্বাস করবে যে, তার এ কর্ম সম্পর্কে কেউ অবহিত নয়, তা গোপন রাখতে ও কারো নিকট প্রকাশ না করতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এটাই তার কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়ার সঠিক পথ। পক্ষান্তরে যখন জানতে পারবে যে, জনসাধারণ তার ঐ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনে গেছে তখন এ ধারণাটাই তাকে উক্ত অপরাধ লুক্কায়িত না রাখতে ও জন সম্মুখে তা প্রকাশ করে দিতে উস্কানি দেবে। সাধারণত এটা অকল্যাণ ও মন্দের পথ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আমার প্রত্যেক উম্মতকে ক্ষমা করা হবে তবে যারা নিজেদের অপরাধ প্রকাশ করে দেয় তাদের নয়।’ এ প্রেক্ষিতে অভিভাবককে অতি সূক্ষ্ম পদ্ধতিসমূহ অবলম্বন করতে হবে যা তরুণ তরুণীদের মধ্যে ‘অভিভাবকের নিকট তাদের কোন কৌশল প্রকাশিত হয়নি’ এ উপলব্ধি জন্ম দিতে সক্ষম হবে। যদিও তিনি ঐ মুহূর্তে তাদেরকে কোন দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন না। অভিভাবকের বিচক্ষণতা সম্পর্কে তার অবগতির কারণে এ পদ্ধতি উক্ত অপরাধের মূলোৎপাটন ও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে ও দ্বিতীয় বার ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে সহায়ক হবে । পক্ষান্তরে তরুণের অজুহাত যদি একেবারে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ কখনো কৌশলটি তার নিকট প্রকাশিত হয়ে গেছে মর্মে ইঙ্গিত করে থাকে তাহলে তা তাকে আরো ঔদ্ধ্যত্যপনা ও অপরাধ করতে উস্কানি দিয়ে থাকবে। আবার কখনো কখনো অস্বীকৃতি ও মিথ্যা প্রতিপন্নতার দ্বারা তাদেরকে সম্মোধন করলে বিষয়টা দুঃখজনক পরিস্থিতির অথবা মিথ্যা শপথের দিকে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। অবশ্য এরূপ ঘটনা খুব স্বল্প সংখ্যক লোকের বেলায় ঘটে থাকে। এমনটি হতেই পারে। আমরা সেই ঘটনার দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাবো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে তার সমাধান দিয়েছেন। যায়েদ বিন আসলাম রা. থেকে বর্ণিত, খাওয়াত বিন যুবাইর রা. বলেন, ‘আমরা র্মারায-যাহরান নামক স্থানে অবতরণ করি। (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, ‘আমি আমার তাবু থেকে বের হলাম। দেখলাম কয়েকজন মহিলাকে পরস্পর কথাবার্তা বলছে। আমার ভাল লাগল। অতঃপর আমি আমার সফরের ব্যাগটা বের করি। এরপর সেখান থেকে একজোড়া কাপড় বের করে পরিধান করি। অতঃপর আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে বসে পড়ি। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর তাবু থেকে বের হয়ে এসে বলেন, ‘হে আব্দুল্লাহর বাপ, তুমি মহিলাদের আসরে বসলে কি কারণে? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে তাঁর ব্যক্তিত্বে অভিভূত ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছি। আমি বললাম- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার একটি উট ছুটে গেছে, আমি তাকে বাঁধতে চাই। অতঃপর তিনি সামনে চললেন। আমি তাঁর অনুসরণ করলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমার নিকট তার চাদর নিক্ষেপ করলেন ও বৃক্ষরাজির আড়ালে চলে গেলেন। আমি বৃক্ষের শষ্য শ্যামলিমার মধ্যে যেন তাঁর মেরুদণ্ডের শুভ্রতা প্রত্যক্ষ করছিলাম। অতঃপর তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন সম্পন্ন করলেন ও অজু করে সামনে আসলেন। তখনো অজুর পানি তার দাড়িগুচ্ছ থেকে গড়িয়ে বক্ষদেশ স্পর্শ করছিলো। অতঃপর তিনি বললেন- ‘হে আব্দুল্লাহর পিতা, তোমার ছুটে যাওয়া উট সম্পর্কে কী করলে?’ অতঃপর আমরা পথ চলা শুরু করলাম, এরপর পথিমধ্যে কেবল বলতেন ‘হে আব্দুল্লাহর পিতা, তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, সেই পলাতক উটটির কি হলো?’ যখন ‘আমি ধরা খেয়েছি’ অনুভব করলাম তখন দ্রুত মদীনায় ফিরে গেলাম। মসজিদ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মজলিস থেকে দূরে থাকলাম। যখন এ অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকল, এক সময় আমি মসজিদে না যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করলাম। এরপর আমি মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর একটি কক্ষ থেকে হঠাৎ বের হয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে দুই রাকাআত সালাত আদায় করে নিলেন। তবে আমি সালাত দীর্ঘ করি এই আশায় যে, তিনি আমাকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তিনি বললেন- ‘আব্দুল্লাহর বাপ, তোমার যতক্ষণ মন চায় সালাত দীর্ঘ কর। তবে আমি তোমার সালাত শেষ না করা পর্যন্ত দাঁড়াচ্ছি না। তখন আমি মনে মনে সংকল্প করলাম- ‘অবশ্যই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গিয়ে আমার ভুল স্বীকার করব ও আমার ব্যাপারে তাঁর পবিত্র অন্তরকে সংশয়মুক্ত করবই। এরপর যখন তিনি বললেন- ‘হে আব্দুল্লাহর বাপ, তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমার সেই ছুটে যাওয়া উঁটটি সম্পর্কে কী করলে? অতঃপর আমি বললাম- ‘সেই সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যের আহ্বান নিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে ঐ উটটি আর কখনো হারিয়ে যায়নি। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি রহম করুন।’ কথাটি তিনবার বলেছেন। এরপর কখনো তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পেছনের কোন বিষয় পুনরাবৃত্তি করেননি। এখানে বাহ্যিক অবস্থা দৃষ্টেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তার অজুহাত পেশ শুদ্ধ নয়। তা সত্ত্বেও তিনি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাননি। কিন্তু যখনই তার সঙ্গে সাক্ষাত হতো প্রশ্নের পুনরাবৃত্তির করার মাধ্যমে ঐ কর্মটি উল্লেখ করতেন। ফলে অনন্যোপায় হয়ে কৃতকর্ম স্বীকার করতে বাধ্য হতো। যখন তার পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় হয়ে যাবে তখন তাকে ডাকবে ও দ্বিতীয় বার সেই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করবে না। কারণ স্বীকারোক্তির পর লজ্জা দেয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শের পরিপন্থী।
পঞ্চম অধ্যায় :
দিকনির্দেশনা ও উপদেশাবলি (পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে আলোচিত দিকনির্দেশনা ও উপদেশবালির সঙ্গে পার্থক্য নির্ণয়সহ একটি সংযোজন।)
তরুণের অন্তরের সংরক্ষণ তরুণের বিভিন্ন দিকের পরিপূর্ণতা অর্জনের সাথে সাথে পরিবার, মসজিদ ও বিদ্যালয়ের মত পরিচিত গণ্ডির বাহির থেকেও জ্ঞান আহরণ ও গ্রহণ করার সামর্থ্য অর্জিত হয়ে থাকে। অতএব দুষ্ট লোকের দুষ্টামী যেন কল্যাণকামী লোকের কল্যাণের ওপর কার্যত দ্রুতগামী হতে না পারে। সমগ্র দেহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ড সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকলে গোটা দেহই সুস্থ থাকবে। পক্ষান্তরে তা অসুস্থ্য হয়ে পড়লে গোটা শরীরটাই অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ সুতরাং এই হৃদপিণ্ডের সযতœ পরিচর্যার জন্য যার মাধ্যমে হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকতে পারবে ঐ বিষয়গুলোর দিকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো : কিয়ামুল লাইলের প্রতি অনুপ্রাণিত করা। সাহাবায়ে কেরামের প্রাথমিক প্রজন্মগুলো কিয়ামুল লাইলের ওপর প্রশিক্ষিত ও প্রতিপালিত হয়েছিলেন- যাদের সৌজন্যে সেকালে ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আল্লাহ তাআলা কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে ইরশাদ করেন- إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا. (المزمل-৬ ) ‘নিশ্চয় এবাদতের জন্য রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল।’ ইবনে কাছির রহ. বলেন, ‘উদ্দেশ্য হলো কিয়ামূল লাইল রসনা ও হৃদপিন্ডের মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন স্থাপনকারী এবং কোরআন তেলাওয়াতে একাগ্রতা সৃষ্টিকারী। সেকারণে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا’ অর্থাৎ তা কিয়ামুন্নাহারে কোরআন তেলাওয়াত ও তা অনুধাবন করার চেয়ে অন্তরে বেশি একাগ্রতা সৃষ্টিকারী। কারণ দিবস হলো মানুষের কাজের জন্য বেরিয়ে পড়া শব্দদুষণ ও জীবিকা নির্বাহের সময়।’ কতই না উত্তম সেই অভিভাবক যে নিজে কিয়ামুল লাইল আদায় করে ও তার তরুণ ছেলে মেয়েদেরকেও নামাজের জন্য জাগ্রত করে তাদেরকে নিয়ে যতটুকু সম্ভব এক সঙ্গে জামাত সহকারে সালাত আদায় করার চেষ্টা করে থাকেন। তাদের নিদ্রা ভঙ্গের জন্য যৎ কিঞ্চিত পানি ছিটানোর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইঙ্গিতও রয়েছে। যেভাবে তরুণ- তরুণীদের সামনে পরকালের তথা জান্নাতের আলোচনারও পুনরাবৃত্তি করতে পারে। জান্নাতে প্রবেশ করার করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে পারেন। এমনিভাবে জাহান্নামের বিবরণ দিবেন। তাদের সামনে নবী ও রাসূলদের ইতিহাস, জীবনী ও আল্লাহর পথে তারা যে অবর্নণীয় দুঃখ কষ্ট ও অসহনীয় নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিভাবে তারা এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করেছেন। নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য কি কি সাহায্য এসেছে তা পর্যালোচনা করতে পারেন।
কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঁকড়ে ধরা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে রাসূলের বিশুদ্ধতা এবং এতদুভয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী সকল কিছুর অসারতা মুসলিম উম্মাহর নিকট একটি জাজ্জ্বল্যমান ও দিবালোকের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। অধিকাংশ মুসলমান এমনকি তাদের শিশুরা পর্যন্ত বিষয়টা সংক্ষিপ্তভাবে অনুধাবন করে থাকে। কিন্তু অনৈসলামী সমাজগুলো থেকে অসংখ্য দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণা আমাদের সমাজের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। যার কোনোটা লেখনী আবার কোনোটা প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কোনোটা আবার কোন কোন মুসলিম দেশের শিক্ষাকারিকুলামকেও দংশন করতে সক্ষম হয়েছে। এ দৃশ্যপটে একজন অভিভাবকের কর্তব্য হলো, ঐ দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণাগুলো সম্পর্কে সতর্ক হওয়া যা তার চতুর্পাশের পরিবেশের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সেগুলোর কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী হওয়ার বিবরণ দেয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ের ওপর রচিত ছোট ছোট পুস্তিকার সহায়তা নেয়া যেতে পারে। যার মধ্যে অত্যন্ত সহজ সাবলীলভাবে উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও তরুণকে পরিতুষ্ট করা এই বয়সে তরুণ-তরুণীদের বুদ্ধিমত্তা শরিয়তের বিধানাবলির ক্ষেত্রে সে নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়ার প্রমাণে পরিপূর্ণতা অর্জন করে থাকে। এই অবস্থায় অভিভাবকের গবেষণাসমূহ, দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা চর্চার প্রয়াস যদি অতৃপ্তিদায়ক হয়, তাহলে সেটা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। তরুণ-তরুণীদের নিকট তার কোন গ্রহণযোগ্যতা অথবা আহ্বান না থাকলে তা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। কাজেই আলোচনা, পরিতুষ্ট করা ও প্রমাণসহ দাবী উত্থাপণ ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। কারণ, তরুণ-তরুণীরা এ বয়সে পৌঁছলে আলোচনা হৃদয়ঙ্গম করা ও অপরাপর বিষয়গুলো বোঝার মত আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা তাদের অর্জিত হয়ে থাকে। এমনকি তারা ভুল ও শুদ্ধ এবং এতদুভয়ের প্রমাণাদিও উপলব্ধি করতে পারে। কথোপকথন ও পরিতুষ্ট করণের দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, অভিভাবক যা বলবে সবকিছুই সে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে। কারণ দৃষ্টিভঙ্গি গবেষণা ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত গবেষণামূলক বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক ও নিক্ষেপযোগ্য। কোন প্রকারের চাপ অথবা বল প্রয়োগ না করে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করে যাবেন। তবে নিশ্চিত প্রমাণিত বিষয়, অধিকাংশ ওলামার বক্তব্য অথবা পার্থিব বিষয়ে অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতামত কেবলমাত্র বাধ্যমূলক করা যাবে। কিন্তু তা নিরেট অভিভাবকের মত হতে পারবে না। এ সবই হলো জ্ঞানগত অথবা তথ্যগত বিষয়ে। যেমন : বিশ্বাস পরিকল্পনা ও গবেষণা। পক্ষান্তরে অভিভাবকের জন্য কার্যগত বিষয়সমূহ সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক করা বৈধ, যেখানেই কর্ম সম্পাদনই হলো মূখ্য কাম্য। তবে অবশ্যই তা তরুণ-তরুণী সন্তানদের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্তভর্ূুক্ত হতে হবে। উদাহরন স্বরূপ, বাবা যদি এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায় অথবা এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে স্থানান্তরিত হতে সংকল্প করে থাকেন, তাহলে বিষয়টা তিনি সন্তানদের সামনে উপস্থাপন করবেন এবং এ ব্যাপারে তাদের মতামত নেবেন। কিন্তু আলোচনার পরও যদি তারা কোনরূপ পরিতুষ্টি অর্জন করতে না পারে তাহলেও এক্ষেত্রে অভিভাবকের উক্ত কর্ম সম্পন্ন করা বৈধ হবে।
প্রজ্ঞা অথবা কারণ বর্ণনাসহ উপদেশ দান আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন তরুণদের উপদেশ দানের ক্ষেত্রে খুব সংক্ষিপ্ত করে থাকেন। অথচ উপদেশ হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ অনিবার্য বিষয়। কিন্তু তা এককভাবে যথেষ্ট নয় ; বিশেষতঃ এমন বিষয়ে যার পরিণতি সম্পর্কে সে অবগত। যেমনিভাবে শরিয়তের একটি বিধান এককভাবে আলোচনা করা এ অবস্থায় যথেষ্ট নয়। বরং এজাতীয় পরিস্থিতিতে উপদেশ ও বিধান বর্ণনার সাথে যদি কারণ নির্ণয় অথবা রহস্য উদ্ঘাটন করা হয় ; তাহলেই আল্লাহর ইচ্ছায় কেবল তা উপকারী হতে পারে। নিম্নের ঘটনা থেকে আমরা তার উদাহরণ পেশ করতে পারি। ইমাম আহমদ রহ. তার মুসনাদে আবু উমামা রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘জনৈক উদীয়মান তরুণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল- ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন! উপস্থিত জনসাধারণ তাকে তিরস্কার করতে লাগলো। তারা বললো, থামো। চুপ করো। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তুমি আমার কাছে এসো! এরপর সে তাঁর একেবারে নিকটে চলে গেল। (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, ‘এরপর সে বসে পড়লে তিনি বলেন, ‘এটা কি তুমি তোমার মায়ের জন্য পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার মায়ের সঙ্গে এটা পছন্দ করতে পারে না।’ আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার কন্যার জন্য তা পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার কন্যার জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।’ আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার বোনের জন্য তা পছন্দ করবে? সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার বোনের জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।’ তিনি আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার ফুফির জন্য তা তুমি পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন। তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার ফুফির জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।’ তিনি আবার বললেন- ‘তাহলে তোমার খালার জন্য তা তুমি পছন্দ করবে?’ সে বলল না, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যেন আপনার জন্য আমার জীবনের কুরবানী কবুল করেন।’ তিনি বললেন- ‘কোন মানুষই তার খালার জন্য এটা পছন্দ করতে পারে না।” (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন, অতঃপর তিনি তাঁর হাত মুবারক তার গায়ে সস্নেহে বুলাতে বুলাতে বললেন- ‘হে আল্লাহ, তুমি ওর পাপরাশি ক্ষমা করে দাও। ওর অন্তরকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে দাও। এবং ওর লজ্জাস্থানকে তুমি সুসংহত কর।’ এরপর সেই উদীয়মান তরুণটি আর কোন দিকে তাকায়নি।’ লক্ষ্য করুন, এখানে তরুণটির নিকট ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টা গোপন ছিলো না। এ কারণেই সে অনুমতি প্রার্থনা করতে এসেছিল। ‘আল্লাহকে ভয় কর! এটা হারাম অথবা বৈধ নয়’ এখানে এই কথা বললে হয়তো বা তরুণটির কোন উপকারে নাও হতে পারতো। তা ছাড়া এ বিধান তারও গোচরীভূত হওয়ার ফলে তার অন্য কোন বিষয়ের প্রয়োজন ছিল। সে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সঙ্গে বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তা হলো ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন। রহস্যটা হলো ভিকটিম নিশ্চয় কারো মা, কন্যা, বোন, ফুফি অথবা খালা হয়ে থাকবে। এছাড়া অন্য কিছূ হওয়া সম্ভব নয়। তরুণ যখন নিজের জন্য তা অনুমোদন করতে পারল না, তাহলে অন্যেরা নিজেদের জন্য তা পছন্দ করবে কিভাবে। কীভাবে এর বৈধতা দেবে? অতএব এই আত্মিক প্রমাণ ঐ উদীয়মান তরুণের অন্তর থেকে উক্ত কুকর্মের বাসনা চিরতরে দমন করে দিয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে সত্য ও সংযমের ওপর দৃঢ়পদ থাকার জন্য দোয়া করা হল। অতএব এজাতীয় পরিস্থিতিতে আমরাও এরকম পদক্ষেপ নিতে পারি। মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারি। এ ধরনের কর্মের ক্ষেত্রে এরূপ বলা যেতে পারে : ‘তুমি তার স্থানে যাও, এবং আমাকে বল তুমি কি করছ?’ মানুষ যদি অসংখ্য ব্যাপারে এরূপ কর্ম করতে পারতো, তাহলে মানুষের মধ্যে অনেক সমস্যার সৃষ্টিই হত না। কোন মানুষ যদি নিজেকে তার স্থানে উপস্থান করে যে তার আচরণ ও কর্ম তৎপরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাহলে কখনো কখনো সে ঐ পথটি অথবা তার নিকটবর্তী কোন পথ অবলম্বন করে থাকবে। সুতরাং কর্তব্য হলো তাকে এই পথের দিশা দেয়া।
নৈকট্য অর্জন ও পরস্পর বন্ধুত্ব স্থাপন এই বয়সে তরুণ অথবা তরুণীরা গবেষণা ও পরিকল্পনায় অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। অবশ্য এটা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। বরং তারা মনে করে গভীর গবেষণা করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে যার মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য থেকে ফলাফল চয়ন করা যায় ও গবেষণার উক্ত বিষয়কে তার অংশসমূহের মধ্যে বিভক্ত করা যায়- যার দ্বারা বিষয়টা গঠিত হয়েছে। ফলে তার অন্তর্নিহিত তথ্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে। ফলশ্র“তিতে সে যখন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকবে তখন তার চেয়ে যে অভিজ্ঞ ও বড় তার মত দ্বারা আলোকিত অথবা কোন পরামর্শ ব্যতিরেকে অথবা যে কোন পরামর্শের উপযুক্ত নয় এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে সমাধানের প্রচেষ্টা চালাবে। তবে তরুণ, অভিভাবক, মা-বাবা ও শিক্ষকের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে। যেখানে থাকবে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মূল্যায়ন। থাকবে না কোন তাচ্ছিল্য ও অবমূল্যায়ন। সেখানে শুধু থাকবে তরুণ সন্তানদের প্রতি উৎসাহ, স্নেহ ও মমতা। তাহলে সে এজাতীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অবশ্যই অভিভাবকের নিকট বিষয়টা উপস্থাপন করবে নিশ্চয়। তার পরামর্শ নেবে, তিনি যে দিকনির্দেশনা ও উপদেশ দেবেন তা সাদরে গ্রহণ করবে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে তরুণের নৈকট্য অর্জন ও তার মধ্যে সুসম্পর্কের বীজ বপণ করা এবং যে সমস্যা তার ভেতরে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে খুব কাছ থেকে জানতে সচেষ্ট থাকা মা-বাবা ও শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য।
পবিত্রতা বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ তরুণ-তরুণীরা বয়োঃসন্ধিক্ষণে উপস্থিত হলে প্রত্যেকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পবিত্রতা অর্জনের বিধানাবলি সংক্রান্ত বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। কারণ এ স্তরে নতুন এমন অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয় যা ইতোপূর্বে ছিলো না। যে কোন মসজিদে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তাহারাতের বিধানাবলি বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা উচিত। সেখানে একজন বিজ্ঞ শিক্ষক দরস পরিবেশন করবেন। অপর দিকে একই সাথে তরুণীদের জন্য কোন মহিলা শিক্ষক ক্লাশ নেবেন। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্যার প্রকৃত সমাধান। বিশেষ করে আলোচনাটা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয় বরং দলকে সম্মোধন করে হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোন সমস্যা নেই। বরং মসজিদে এজাতীয় প্রশিক্ষণের অনুষ্ঠান আলোচ্য বিষয়ের ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদাটাকে একটু বৃদ্ধি করে বৈকি। সুতরাং এ বিষয়ে কোন অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য অথবা অযৌক্তিক মন্তব্য করার আর কোন অবকাশ থাকল না। বরং সকলেই অনুভব করতে পারবেন যে, এই হলো প্রকৃত দ্বীন। কারণ এখানে তো একজন বিজ্ঞ আলেমের পক্ষ থেকে দ্বীন অথবা তালেবে ইলম সম্পর্কে আলোচনা হয়ে থাকে। তা আবার এমন স্থানে বসে যেটা কোরআন তেলাওয়াত ও সালাতের মত সৎ কর্ম সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত।
নম্রতা, অনুগ্রহ প্রদর্শন ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ না করা ছাত্রের উচ্চ স্থান অর্জনের আগ্রহ কখনো কখনো অভিভাবককে তার করণীয় পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়ে থাকে। ফলে তা শিক্ষার্থীর জন্য দুঃসাধ্য হয়ে যায়। এমনকি শিক্ষার্থী এতে বেশ বিরক্ত হয়েও উঠে। কিন্তু তাদের ধারণ ক্ষমতার দিকে সযতœ দৃষ্টি রাখলে তবে প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালন ফলপ্রসূ হতে পারে। আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট সমবয়স্ক একদল যুবক আসল। তারা তাঁর নিকট বিশটি রাত অবস্থান করল। অতঃপর যখন তিনি অনুধাবন করলেন যে, তাদের নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়টা তাদের নিকট একটু কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, তখন তাদেরকে অন্তিম উপদেশ দিলেন। এ প্রসঙ্গে আমাদের নিকট হযরত মালেক বিন হুওয়াইরিছ রা. হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট আগমন করলাম, তখন আমরা সমবয়স্ক টগবগে যুবক ছিলাম। আমরা তাঁর নিকট বিশ দিন বিশ রাত অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কোমলহৃদয় ও বিনম্্র প্রকৃতির মানুষ। এরপর যখন তিনি বুঝতে পারলেন আমরা নিজেদের পরিবারের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছি এবং আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমরা যাদের পেছনে রেখে এসেছি তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। তখন আমরা তার নিকট সবকিছূ খুলে বললাম। তিনি বললেন- ‘তোমরা তোমাদের পরিবারের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মধ্যে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষা দাও। তাদেরকে আদেশ করো।’ আরো কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন যা আমি মনে রাখতে পেরেছি অথবা আমার মনে নেই। ‘তোমরা সালাত আদায় করো যেভাবে তোমরা আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ। অতএব যখন নামাজের সময় উপস্থিত হবে তখন তোমাদের মধ্যে একজন আযান দেবে ও তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞজন নামাজে তোমাদের ইমামতি করবে।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের পরিবারের দিকে আগ্রহ লক্ষ্য করলেন তখন তাদেরকে সেদিকে ফিরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিলেন। এই হাদীস থেকে এ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হওয়া ও তার প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত হওয়া তাদের প্রতি বিনম্র হওয়া ও মানবিক দুর্বলতাকে অবজ্ঞা না করা শিক্ষক ও অভিভাবকবৃন্দের একান্ত কর্তব্য। সুতরাং তাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করবেন না যাতে তাদের কষ্ট হয়। তারা ফেরেশ্তা নয়, বরং তারাও অন্য মানুষের মতই মানুষ।
তাকে পুরুষদের সমাজে নিয়ে যাওয়া যার বয়োঃসন্ধির নিদর্শনগুলো ফুটে উঠেছে সেই তো একজন পুরুষ। এই ভিত্তিতে সে পূরুষদের সমাজে যেতে পারে। তার সঙ্গে এই দৃষ্টিতে আচরণ করতে হবে। তারা এখনো শিশু অথবা বাচ্চা এই ভিত্তিতে আচরণ করা কখনোই সমীচীন হবে না। অনুরূপ তরুণীরাও। ফলে এই আচরণই তাদের কর্ম তৎপরতাকে পুরুষ অথবা মহিলাদের মত বড় ও তাৎপর্য মণ্ডিত করে দেবে। বড়দের সমাজে তাদের অংশগ্রহণকে সহজ করে দেবে। অন্য দিকে তাদের প্রাক্তন শৈশব সমাজকে খুব দ্রুত অতিক্রম করতে সহায়ক হবে।
দায়িত্বভার গ্রহণে কার্যকর অংশগ্রহণ এই স্তরে এসে সেই ছোট্র শিশুটি একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণে পরিণত হয়ে গেল। ফলশ্র“তিতে শরিয়তের বিধানাবলি তার ওপর বাধ্যতামূলক হল। অর্থাৎ দায়িত্বভার বহণের পরিপূর্ণতা ও তার কৃত সকল কর্মতৎপরতার ফলাফল বের করতে সে সক্ষম হয়ে গেছে। সে কারণে তার দায়িত্বভার গ্রহণে সদা তৎপর থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। যদি এ ক্ষেত্রে শিশু কোন ভুল করে বসে তারপরও অভিভাবক তাকে এ বিষয়ে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করবে। অভিভাবক অসংখ্য বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ ও আলোচনা করে নিতে পারেন। তিনি তার কথা অনুযায়ী কাজ করবেন যদি তা শুদ্ধ প্রমাণিত হয়। তরুণ সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের পরামর্শ তার এই অনুভূতি জাগ্রত করবে যে, তার মতামতের একটা মূল্য আছে এবং সেও নির্ভরশীল হওয়ার যোগ্য। তার দায়িত্বানুভূতি ও সম্পাদনের আগ্রহ এবং তা বহনে কষ্টসহিষ্ণুতাকে বেশ শক্তিশালী করবে। ফলে তার মত ও চিন্তাকে অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ পর্যায় নিয়ে পৌঁছাতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকবে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত ফল হবে যদি তাকে অবজ্ঞা ও তার মতামতের দিকে ভ্রুক্ষেপ করা না হয়। প্রকাশ থাকে যে, পরামর্শের পুনরাবৃত্তি তাদেরকে অনুগত নয় বরং যারা অপরের পেছনে চলে তাদেরকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। ফলে তারা শ্রমসাধ্য কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। তরুণীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তরুণদের মতই। অভিভাবকের কর্তব্য হলো এগুলো শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে সে আহরণ করবে। নিশ্চয়ই মানুষের অনেক প্রয়োজন থাকতে পারে। তার একজন সাহায্যকারীরও প্রয়োজন আছে। এখন থেকেই যদি তরুণের দায়িত্বভার গ্রহণে তাকে অংশগ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে তৎপর না হওয়া যায়, তাহলে সে নিজেকে ঐ প্রয়োজনগুলোর আয়োজন সাধনে কষ্টের সম্মুখীন হবে। অথবা অন্য লোকদের সাহায্য নিতে প্রয়াস পাবে যারা তাকে সহায়তা করতে পারে। এর মধ্যে যদিও সাহায্য প্রার্থনার দিক থেকে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায় তা কখনো কখনো সন্তানদেরকে নিষ্কর্মা ও ব্যর্থ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে ফেলবে। ফলে তাদের ভূমিকা হবে অন্যের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ানো। যার অশুভ পরিণতি হতে অভিভাবকগণও মুক্ত থাকতে পারবেন না। যে সকল কাজ এই বয়সে তরুণদের সম্পন্ন করা কর্তব্য তার মধ্যে অন্যতম হলো, পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন কাজ যা গাড়ী ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। সে একই সঙ্গে তখন ড্রাইভ করার আগ্রহ দেখাতে পারে। কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদারক করা কর্তব্য। কারণ, অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য এটাই একমাত্র কারণ হয়ে থাকে। প্রথমেই তাকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়া কর্তব্য। তাকে গাড়ি ড্রাইভ করার অনুমতি দেয়া যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার নিজের ও অপরের জীবন কার্যতঃ সংরক্ষণে সক্ষম না হবে। তেমনিভাবে তাকে স্থায়ীভাবে গাড়ির চাবি দেয়া যাবে না। বরং তা ঘরে মা-বাবার সাথে থাকবে। কেবল প্রয়োজনের সময় তাকে তা দিতে হবে। তাও আবার বের হওয়া ও প্রত্যাবর্তনের সময় তদারকি করতে হবে। তরুণের কর্মতৎপরতা, কর্মের স্থীরতা ও গাড়ীটি যেন রীতি বহির্ভূতভাবে বের হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে সে ব্যপারে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত।
শ্রমসাধ্য কর্ম জ্ঞান ও তথ্য ভাণ্ডারের দিকে তরুণ সন্তানের অগ্রগতি ও অনুরাগ মূল্যায়ন মুসলিম বিশ্বের অনেক বরং সিংহভাগ দেশের শিক্ষাগত পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করলে যা প্রতিভাত হয় তা হল : কোন বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের সূচনা সাধারণত এই বয়োঃস্তরেই হয়ে থাকে। অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানের আগ্রহ সামর্থ্য ও তার প্রস্তুতির দিকে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ না করেই তাদের সন্তানদেরকে এমন অধ্যয়ন অথবা উচ্চ পর্যায়ের প্রবাস চাকুরীর দিকে দিকনির্দেশনা দিতে প্রয়াস পানÑ যাকে তারা অপেক্ষাকৃত উচ্চ মানের বলে জ্ঞান করে থাকেন। অতঃপর তারা এ বিষয়ে তরুণের ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে থাকেনÑযা অনেক সময় প্রত্যাশিত ফলাফল প্রাপ্তি থেকে তাদেরকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেবে। বহু বাবা অথবা অভিভাবক রয়েছেন (যে বিষয়ে তার সন্তান ভালো অথবা সক্ষম নয় সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে নিজ সন্তানের জীবন থেকে অনেকগুলো বছর নষ্ট করার কারণে) যারা অনুতাপ ও লজ্জায় আঙ্গুল কাঁটছেন। এখানে আমাদের একথা বলে রাখা উচিত : প্রত্যেকটি উপকারী জ্ঞান অথবা কারিগরি বিদ্যা -চাই তা যে মানেরই হোক না কেন- মুসলিম উম্মাহর তা নিতান্ত প্রয়োজন। সন্তান যখন সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে। সে ওখান থেকে যে ফল লাভ করতে পারবে তা পার্থক্যবোধহীন ভোগবাদী সমাজের দৃষ্টিতে এর চেয়ে কোন উৎকৃষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে প্রভুত অর্জনের চেয়ে অনেক মহৎ ও বড়। (উদাহরণ স্বরূপ) একজন অভিজ্ঞ মেকানিক্স অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের চেয়ে অনেক বেশি সমাজের উপকার করে থাকেন। সম্পদও তার চেয়ে বেশি উপার্জন করেন। সন্তানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও ভর্তি করা অথবা মেধার দুর্বলতার দরুণ যা অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তার জন্য চাপ প্রয়োগ অভিভাবকদের উচিত নয়। কারণ এর দ্বারা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বরং যে বিষয়ে উৎকর্ষ সাধন ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সামর্থ্য কিংবা তাদের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় সেই দিকেই তাদেরকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। কিন্তু সন্তানের আগ্রহশূন্যতা নিরসনকল্পে অভিভাবককে সজাগ ও সচেষ্ট থাকতে হবে। এটা তার দুর্বলতা, সামর্থ্যহীনতা নাকি কর্মটা তার জন্য দুঃসাধ্য সেটা বুঝতে হবে। ইবনে কাইউম রহ. এর এ সংক্রান্ত একটি উৎকৃষ্ট বাণী রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সন্তানের অবস্থা দেখে তার শিক্ষার বিষয়টি নির্ধারণ করা উচিত। এটা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিলে অন্যটা করতে সে উদ্যত হবে না।। সে যদি তার জন্য নির্ধারিত কর্মের বিপরীতটা করতে উদ্যত হয়, তাহলে কখনো সফলকাম হতে পারবে না। তার জন্য যা প্রস্তুত ছিল তাও হারিয়ে যাবে। যদি দেখা যায় পড়াশুনা না করে সে অশ্বারোহণ, তীর নিক্ষেপ ও তীর নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করে। তাহলে তাকে আপনি অশ্বারোহণের উপকরণ ও এর ওপর অনুশীলন গ্রহণের সুযোগ দিন। কারণ এটা তার নিজের ব্যক্তি ও গোটা মুসলিম জাতির জন্য উপকারী। যদি দেখে তার নয়ন যুগল কোন কারিগরি পেশার দিকে উম্মোচিত, প্রস্তুত ও গ্রহণকারী হিসেবে দেখতে পায়। যা হবে বৈধ জনহিতকর কারিগরি পেশা, তাহলে তাকে এর জন্য সুযোগ দেয়া উচিত। এ সকল বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ভর্তি করাতে হবে ধর্ম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদানের পর। কারণ তা বান্দার ওপর আল্লাহ তাআলার প্রমাণ উপস্থাপন সহজ করে দেয়। যেহেতু বান্দার বিরুদ্ধে পেশ করার মত তাঁর রয়েছে অকাট্য প্রমাণ। যেমনিভাবে বান্দার ওপর তার রয়েছে অফুরন্ত নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী রহ. এর রয়েছে মূল্যবান বক্তব্য, যা তিনি সবিস্তারে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সমগ্র সৃষ্টিকুলকে যখন সৃজন করেছেন তখন তারা নিজেদের পার্থিব ও পারলৌকিক প্রয়োজন ও কল্যাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর ছিল। আপনি কি আল্লাহ তাআ’লার এই বাণীর দিকে লক্ষ করেননি ? وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا.(النحل-৭৮ ) ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না।’ অতঃপর তাদেরকে প্রতিপালনের প্রয়োজন সাপেক্ষে আস্তে আস্তে এ সম্পর্কিত জ্ঞান দান করেছেন। একবার নবজাতকের অন্তরে প্রত্যাদেশ করেন। যেমন : জননীর স্তন্য স্পর্শ করা ও তা চোষার প্রত্যাদেশ। দ্বিতীয় বার শিক্ষার মাধ্যমে। অতএব মানুষের জন্য সকল কল্যাণকর বিষয় গ্রহণ ও ক্ষতিকর বস্তু নিরসন করার জন্য তার শিক্ষাগ্রহণ ও জ্ঞান অন্বেষণ করা কর্তব্য। ঐ স্বভাবগত এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভাগুলো তার মধ্যে বিকশিত হওয়ার পর যা প্রতিফলিত হবে। কারণ, বিস্তারিত ও সামগ্রিক কল্যাণ আহরণের জন্য এটা হল যেন ভিত্তিমূল। তা হতে পারে কতগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিশ্বাস গত বিষয় অথবা ইসলামী ও অভ্যাসগত শিষ্টাচারসমূহ। এসবের প্রতি যতœবান হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে তার জন্মগত স্বভাব ও তার প্রতি যে বিস্তারিত অবস্থা ও কর্মসমূহ প্রত্যাদেশ করা হয়েছে তা আরো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হতে থাকবে। ফলে এটা প্রকাশিত হয়ে যাবে তার মধ্যে প্রতিফলিত হবার সাথে সাথে তার ঐ সকল বন্ধুদের মধ্যেও প্রতিফলিত হবে যারা এ প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। সুতরাং বোধ ও বুদ্ধির এমন সমন্বয় আর কখনোই সূচিত হতে পারবে না। প্রাথমিক বয়সে যা তার জন্মগত স্বভাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তার বিপরীত কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া তার পৃষ্ঠে পরিস্ফুট হবে। যার ফলে আপনি লক্ষ করে থাকবেন : একজন প্রস্তুতি নিচ্ছে জ্ঞান অন্বেষণের ও অন্যজন করছেন নেতৃত্বের অন্বেষণ। আর একজন প্রয়োজনীয় কারিগরি বিদ্যা ও অপর ব্যক্তি প্রস্তুতি নিচ্ছেন সকল বিষয়ে লড়াই ও তর্ক করার জন্য। প্রত্যেকের মধ্যে যদি সামগ্রিক কর্ম তৎপরতা প্রোথিত করা হয়ে থাকে তাহলে এক অভ্যাসকে অপর অভ্যাসের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। ফলে তার আদিষ্ট হওয়াটা শিক্ষাপ্রাপ্ত ও শিষ্টাচার সমৃদ্ধ অবস্থায় হবে যার ওপর বর্তমানে সে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এমতাবস্থায় সেই আবেদনটি প্রত্যেক আদিষ্ট ব্যক্তির ওপর তাৎক্ষণিকভাবে প্রযোজ্য হবে সেই কর্মকাণ্ডসমূহে সে তৎপর। ফলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সেই দিকে দৃষ্টিপাত নির্ধারিত হয়ে গেল। অতঃপর সামর্থ অনুযায়ী তার পরিচর্যা করবে। সুতরাং তাদেরকে এমনভাবে যতœ নিতে হবে যেন অভিভাবকের হাতেই ওরা সঠিক পথের ওপর উঠতে পারে। এটা বাস্তবায়নে তাদের সহায়তা করবে। এরও অনেক পর স্থায়ীত্ব অর্জনের জন্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। যাতে প্রত্যেকের মধ্যে তার বিজিত চরিত্র প্রতিফলিত হয় এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, সে দিকে তার ঝোঁক রয়েছে। এরপর তারা পরিবারের মাঝে থাকলে তাদের সাথে সুসামঞ্জস্য আচরণ করা যেতে পারে। ফলশ্র“তিতে তারা তার অধিকারী হয়ে যাবে যদি তা তাদের জন্যই হয়ে থাকে। যেমন জন্মগত গুণাবলি ও প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলো। ফলে সাধিত হবে প্রভুত কল্যাণ ও প্রকাশিত হবে উক্ত প্রতিপালনের ফলাফল। উদাহরন স্বরূপ : ধরুন, কোন শিশুর মধ্যে উত্তম অনুভূতি, উৎকৃষ্ট বোধ ও শ্র“ত বিষয়ের পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ইত্যাদি গুণাবলি প্রকাশিত হয়, যদিও এসব ছাড়া অপর গুণাবলিও তার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে তা সত্ত্বেও তাকে উক্ত মহৎ লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করতে হবে। সার কথা হলো : তার মধ্যে এ নিশ্চিত গুণাবলি তার মধ্যে শিক্ষার কল্যাণ সংক্রান্ত যে তৎপরতা প্রত্যাশা করছেন তার মূল্যায়ন করা নিতান্ত কর্তব্য। অতএব শিক্ষা গ্রহণ ও সকল বিদ্যা সম্পর্কে সমন্বিত শিষ্টাচারে সমৃদ্ধি অর্জন তার কাছ থেকে কাম্য। সেখান থেকে অন্য দিকেও দৃষ্টি ফেরানো কর্তব্য। ফলে তার থেকে গ্রহণ ও তার সহায়তা নেয়া যাবে। কিন্তু তা একটা নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে হতে হবে। যে সম্পর্কে বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরাম নির্দেশ করেছেন। যখন উক্ত ‘অন্য’ এর মধ্যে প্রবেশ করবে তার স্বভাব বিশেষতঃ সে দিকেই ঝুঁকে পড়বে। ফলে তাকে অপরের থেকে বেশি ভালোবাসবে। তাকে এ ব্যাপারে সচেতন করা পরিবারের ওপর কর্তব্য। যাতে তাকে কোনরূপ অবজ্ঞা অথবা অবমূল্যায়ন ব্যতিরেকে তার কাছ থেকে সে পরিমিতভাবে গ্রহণ করতে পারে। এরপর সে যদি এখানেই অবস্থান করে তাহলে ভালো। যদি অভিভাবক অথবা অপরের থেকে আরো গ্রহণ কাম্য হয়। তাহলে সেক্ষেত্রে তার সাথে তেমন আচরণ করবে যা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। অনুরূপ এটার সমাপ্তি ও এ কথা বলা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখবে :‘অনুরূপ ক্রমবিন্যাস প্রযোজ্য হবে তার ক্ষেত্রেও যার পদক্ষেপ গ্রহণ, সাহসিকতা ও কর্ম পরিচালনার গুণাবলি ইতিমধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং তাকেও ঐ দিকে ধাবিত করবে ও সামগ্রিক বিদ্যা সংক্রান্ত সমন্বিত শিষ্টাচার শিক্ষা দেবে। এরপর তাকে উন্নত থেকে উন্নততর ব্যবস্থাপনার পেশাগত দক্ষতার দিকে নিয়ে যাবে। যেমন : চিকিসা, সংগঠন, সমর, পথ প্রদর্শন অথবা নেতৃত্ব প্রভৃতি থেকে সে যেটার যোগ্য, তার ইচ্ছা, সেটা সে গ্রহণ করবে। সে কারণে প্রতিটি কর্মের ব্যাপারে তাকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে, যেন তা সমগ্র জাতির দায়িত্ব। কারণ, সেই প্রথম এই সমন্বিত পথের অগ্রপথিক। অতএব অগ্রপথিক যদি দাঁড়িয়ে যায় এবং ভ্রমণে অপারগতা প্রকাশ করে, তাহলে তো প্রকারান্তরে তার জন্য অপেক্ষমান সমগ্র জাতিই দাঁড়িয়ে থাকবে। পক্ষান্তরে তার নিকট যদি এমন শক্তি থাকে যা সার্বজনীন কর্তব্যসমূহ পালন ও যে কর্মসমূহ সম্পাদনের জন্য ব্যক্তির দু®প্রাপ্র্যতা রয়েছে সে ক্ষেত্রে তার ভ্রমণকে গতিশীল করতে সক্ষম। যেমন : শরিয়তের বিধনাবলির বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রপরিচালনার প্রচেষ্টা- যার মাধ্যমে পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও পারলৌকিক আমলসমূহ সুস্থির ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। এ সকল ক্ষেত্রে তাকে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাতে সক্ষম। এখানেই এই সংকলনের সমাপ্তি। আমি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছি। তিনি যেন এর দ্বারা লেখক, পাঠক ও সকল মুসলিম সন্তানকে উপকৃত করেন। আমীন! وصلى الله تعالى وسلم على نبينامحمد بن عبدالله النبى الخاتم وآله وصحبه ومن تبعهم بإحسان. গ্রন্থপঞ্জি ১- আহমামূল কোরআন- আবু বকর আল-জাস্সাস ২- আত্ তাহরীর ওয়াত্ তানভীর- তাহের বিন আশুর ৩- তাফসীরে ইবনে কাছীর- হাফেজ ইবনে কাছীর ৪- তাফসীরে ইবনে সাউ’দ- ইবনে সাউ’দ ৫- তাফসীরে বাগভী- বাগভী ৬- তাফসীরে বায়দাভী- বায়দাভী ৭- তাফসীরে কুরতুবী- ইমাম কুরতুবী ৮- জামেউ’ল বয়ান- ইমাম তাবারী ৯- সহিহ্ আল-বুখারী- ইমাম মুহম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী ১০- সহিহ মুসলিম- ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জায আন্-নিশাপুরী ১১- ফাত্হুল বারী- ইবনে হাজার ১২- উমদাতুল কারী- বদরুদ্দীন আইনী ১৩- সুনানে আবি দাউদ- আবু দাউদ ১৪- সুনানে তিরমিযি- ইমাম তিরমিযি ১৫- আল-মুসনাদ- ইমাম আহমদ ১৬- সহিহ ইবনে খুযাইমা- ইবনে খুযাইমা ১৭- সহিহ ইবনে হিব্বান- ইবনে হিব্বান ১৮- সুনানে বায়হাক্বী- বায়হাক্বী ১৯- আল-মুস্তাদরেক- আল-হাকেম ২০- আল-মু’জামূল কবীর- তাবরানী ২১- আল-মুসান্নাফ- আব্দুর রাজ্জাক সানআনী ২২- মুসনাদুশ্ শামিয়্যীন- আবুল কাসেম তাবারানী ২৩- মুসনাদে আবি ইয়া’লা- আবু ইয়া’লা ২৪- মুসান্নাফে আবি শাইবা- আবু শাইবা ২৫- শারহে মাআ’নিল আছার- ইমাম তাহাবী ২৬- তাহজিবুল কামাল- হাফেজ মুযাই ২৭- আউনুল মা’বুদ শারহে সুনানে আবি দাউদ- শামসুল হক আজীমাবাদী ২৮- আল-মুহায্যআব-শিরাজী ২৯- তুহফাতুল মাওদুদ ফি আহকামিল মাওলুদ- ইবনে কাইয়্যূম যাওজিয়া ৩০- আত্ তাম্হীদ- ইবনে আব্দুল র্বার ৩১- এহ্য়ায়ে উলুমুদ্দীন- আবু হামেদ গাযালী ৩২- লিসানুল আরব- ইবনে মানযুর ৩৩- ইলমু নাফসিল মারাহিলিল উমরিয়্যাহ- আ. ড. উমার বিন আঃ রহমান মুফ্দা ৩৪- ইলমু নাফসিন নামুব্বি আত-তাফুলাতি ওয়াল মুরাহিক্বাহ- ড. হিশাম মুহম্মদ মুখাইমার ৩৫- আল-মুরাহিকুন দিরাসা নাফসিয়্যা ইসলামিয়া- ড. আব্দুল আযীয বিন মুহম্মদ নুগাইমিশী
No comments:
Post a Comment