জিলহজের প্রথম দশ দিনঃ তৎপর্য ও ফজিলত-1
সংকলনে : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
যিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত
ইসলামে যতগুলো মর্যাদাবান ও ফজিলতপূর্ণ দিবস রয়েছে
তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হল যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। এর মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআন
ও হাদিসে অনেক বাণী রয়েছে। এ সংক্রান্ত কতিপয় আয়াত ও হাদিস নিম্নে উল্লেখ করা হল—
(১) আল্লাহ রাববুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এ দিবসগুলোর
রাত্রিসমূহের শপথ করেছেন। আমরা জানি আল্লাহ তাআলা যখন কোন বিষয়ের শপথ করেন তখন তা তার
গুরুত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। তিনি এরশাদ করেন—
وَالْفَجْرِ ﴿1﴾ وَلَيَالٍ عَشْرٍ ﴿2﴾
সাহাবি ইবনে আববাস রা., ইবনে যুবাইর ও মুজাহিদ রহ.
সহ আরো অনেক মুফাসসিরে কেরাম বলেছেন যে, দশ রাত বলতে এ আয়াতে যিলহজ মাসের প্রথম দশ
রাতের কথা বলা হয়েছে। ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন ‘এ মতটিই বিশুদ্ধ।’[ii]
নবী কারীম স. থেকে এ দশ রাতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোন
বাণী পাওয়া যায় না।
(২) রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : যিলহজের প্রথম দশ দিন
হল দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন। এ প্রসঙ্গে বহু হাদিস এসেছে। যার কয়েকটি তুলে ধরা হল—
১.
عن ابن عباس- رضى الله عنهما- أن النبى- صلى الله عليه وسلم- قال : ما من أيام العمل الصالح فيهن أحب إلى الله من هذه الأيام العشر، فقالوا يا رسول الله، ولا الجهاد في سبيل الله ؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم- : ولا الجهاد في سبيل الله، إلا رجل خرج بنفسه وماله فلم يرجع من ذلك بشيء. (رواه البخاري ৯৬৯ والترمذي ৭৫৭ واللفظ له)
সাহাবি ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স.
বলেছেন : যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন আমল
নেই। তারা প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহর পথে জিহাদ করা কি তার চেয়ে প্রিয়
নয় ?
রাসূলুল্লাহ স. বললেন : না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়।
তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল
অত:পর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এল না।[iii]
২.
عن عبد الله بن عمر- رضى الله عنهما- عن النبى- صلى الله عليه وسلم- قال : ما من أيام أعظم عند الله، ولا أحب إليه من العمل فيهن من هذه العشر، فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد.) رواه أحمد ১৩২ وقال أحمد شاكر :إسناده صحيح)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত নবী কারীম স.
বলেছেন : এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাববুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও মহান
কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ
(আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে পাঠ কর।[iv]
৩.
ما من أيام أفضل من أيام عشر ذي الحجة، قال : فقال رجل : يا رسول الله، هن أفضل أم عدتهن جهاداً في سبيل الله ؟ قال : هن أفضل من عدتهن جهادا في سبيل الله...(صحيح ابن حبان ৩৮৫৩ و ذكر محققه أنه حديث صحيح انظر ৯১৬৪)
যিলহজের প্রথম দশ দিনের চাইতে উত্তম কোন দিন নেই।
বর্ণনাকারী বলেন, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! এ দশ দিন (আমলে সালেহ) উত্তম,
না আল্লাহর পথে জিহাদের প্রস্ত্ততি উত্তম ? তিনি বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদের প্রস্ত্ততি
চেয়ে তা (আমল) উত্তম।[v]
এ তিন হাদিসের অর্থ হল—বছরে যতগুলো পবিত্র
দিন আছে তার মাঝে এ দশ দিনের প্রতিটি দিন হল সর্বোত্তম। যেমন এ দশ দিনের অন্তর্গত কোন
জুমআর দিন অন্য সময়ের জুমআর দিন থেকে উত্তম বলে বিবেচিত।
(৩) আল্লাহর রাসূল স. এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য
তার উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তার এ উৎসাহ এ সময়ের ফজিলত প্রমাণ করে।
(৪) নবী কারীম স. এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল
ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আলোচিত হয়েছে উপরে ইবনে আববাসের হাদিসে। আল্লাহ
রাববুল আলামিন বলেন—
لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ . (الحج
: 28)
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে
চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিন সমূহে আল্লাহর
নাম স্মরণ করতে পারে।’[vi]
এ আয়াতে নির্দিষ্ট ‘দিনসমূহ’ বলতে কোন দিনগুলোকে বুঝানো
হয়েছে এ সম্পর্কে ইমাম বোখারি রহ. বলেন—
قال ابن عباس: أيام العشر
‘ইবনে আববাস রা. বলেছেন :
‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে।’[vii]
(৫) যিলহজ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে আরাফা ও কোরবানির
দিন। আর এ দুটো দিনের রয়েছে অনেক বড় মর্যাদা। যেমন হাদিসে এসেছে—
عن عائشت- رضى الله عنها- قالت : إن رسول الله- صلى الله عليه وسلم- قال : ما من يوم أكثر من أن يعتق الله فيه عبداً من النار من يوم عرفة، وإنه ليدنو ثم يباهي بهم الملائكة، فيقول : ما أراد هؤلاء؟ .( رواه مسلم ১৩৪৮)
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন :
‘আরাফার দিন আল্লাহ রাববুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম
থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের
নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন—‘তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ?’[viii]
আরাফাহ (যিলহজ মাসের নবম তারিখ)-এ-দিনটি ক্ষমা ও মুক্তির
দিন। এ দিনে সওম পালন করলে তা দু বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হিসেবে গণ্য হয়। যেমন হাদিসে
এসেছে—
عن أبي قتادة- رضى الله عنه- أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم- قال :...صيام يوم عرفة احتسب على الله أن يكفرا السنة التي قبله والسنة التي بعده )...رواه مسلم ১৬৬২)
সাহাবি আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স.
বলেন : ‘আরাফার দিনের সওম আল্লাহ রাববুল আলামিন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে
গ্রহণ করেন।’[ix]
তবে আরাফার এ দিনে আরফাতের ময়দানে অবস্থানকারী হাজীগণ
সওম পালন করবেন না। কোরবানির দিনের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে :—
عن عبد الله بن قرط- رضى الله عنه- قال: قال رسول الله- صلى الله عليه وسلم- : أعظم الأيام عند الله تعالى يوم النحر، ثم يوم القر. (رواه أبو داود ১৭৬৫ وصححه الألباني ১৫৫২)
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত যে,
রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : ‘আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে উত্তম দিন হল কোরবানির দিন তারপর
কোরবানি পরবর্তী মিনায় অবস্থানের দিনগুলো।’[x]
(৬) যিলহজ
মাসের প্রথম দশকের এ দিনগুলো এমন মর্যাদাসম্পন্ন যে, এ দিনগুলোতে সালাত, সওম, সদকা,
হজ ও কোরবানি আদায় করা হয়ে থাকে। অন্য কোন দিন এমন পাওয়া যায় না যাতে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ
নেক আমল একত্র হয়।
একটি জিজ্ঞাসা : রমজানের শেষ দশক অধিক ফজিলতপূর্ণ
না কি যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন বেশি ফজিলতসম্পন্ন ?
যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক ফজিলতপূর্ণ—এ ব্যাপারে কোন
মতভেদ নেই। করণ, এ বিষয়ে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ রয়েছে। তবে মতভেদের অবকাশ রয়েছে রাত্রির
ফজিলত নিয়ে। অর্থাৎ, রমজানের শেষ দশকের রাত বেশি ফজিলতপূর্ণ না যিলহজের প্রথম দশকের
রাতসমূহ বেশি ফজিলতের অধিকারী ?
বিশুদ্ধতম মত হল, রাত হিসেবে রমজানের শেষ দশকের রাতগুলো
ফজিলতের দিক দিয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। আর দিবসের ক্ষেত্রে যিলহজ মাসের প্রথম দশ
দিবস অধিক মর্যাদার অধিকারী।
ইবনে রজব রহ. বলেন : যখন রাত্র উল্লেখ করা হয় তখন
দিবসগুলোও তার মাঝে গণ্য করা হয়। এমনিভাবে, যখন দিবস উল্লেখ করা হয় তখন তার রাত্রিগুলো
তার মাঝে গণ্য হয়—এটাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রে শেষ যুগের উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন সেটাই চূড়ান্ত বলে
বিবেচিত হতে পারে। তাহল, সামগ্রিক বিচারে যিলহজ মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমজানের
শেষ দশকের দিবস সমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমজানের শেষ দশকের লাইলাতুল
কদর হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন।
ইবনুল কায়্যিম রহ. এ ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে
বলেছেন : রমজানের শেষ দশকের রাতগুলো সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ। কারণ, তাতে লাইলাতুল কদর
রয়েছে। অপরদিকে, যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের দিবসসমূহ অধিকতর ফজিলতপূর্ণ, কারণ এ দিনগুলোতে
তালবীয়াহ-এর দিন, আরাফার দিন, কোরবানির দিন রয়েছে।[xi]
যিলহজ মাসের প্রথম দশকে নেক আমলের ফজিলত
عن ابن عباس- رضى الله عنهما- أن النبى- صلى الله
عليه وسلم- قال : ما من أيام العمل الصالح فيهن أحب إلى الله من هذه الأيام العشر،
فقالوا يا رسول الله، ولا الجهاد في سبيل الله ؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم-
: ولا الجهاد في سبيل الله، إلا رجل خرج بنفسه وماله فلم يرجع من ذلك بشيء. (رواه
البخاري ৯৬৯ والترمذي ৭৫৭ واللفظ له)
সাহাবি ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স.
বলেছেন : যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন আমল
নেই। তারা (সাহাবিগণ) প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহর পথে জিহাদ করা কি তার
চেয়ে প্রিয় নয় ?
রাসূলুল্লাহ স. বললেন : না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়।
তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল
অত:পর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এল না।[xii]
ইবনে রজব রহ. বলেছেন : বোখারির এই হাদিসটি দ্বারা
বুঝা যায় যে, নেক আমল করার মৌসুম হিসেবে যিলহজ মাসের প্রথম দশক হল সকল দিবসসমূহের চেয়ে
আল্লাহ রাববুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয়। যা আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় তা তাঁর কাছে
বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। হাদিসের কোন কোন বর্ণনায় আহাববু (প্রিয়) শব্দটি এসেছে আবার কোন
কোন বর্ণনায় আফজালু (মর্যাদাসম্পন্ন) কথাটা এসেছে।
অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোন সময়ে নেক
আমল করার চেয়ে বেশি মর্যাদা ও ফজিলতের অধিকারী হবে। তাই তো এ সময়ে হজ, কোরবানির মত
গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহ সম্পন্ন করা হয়।
www.facebook.com/pages/Al-Quran-Modern-Science/140069416050931
No comments:
Post a Comment