দর্শক সংখ্যা

Thursday, March 21, 2013

মাযারে প্রচলিত বিদআতসমূহ



মাযারে প্রচলিত বিদআতসমূহ
লেখক : কাউসার বিন খালেদ
স্মরণ রেখ, শর্তহীনভাবে, নির্দিষ্ট দিন-মাস ও সময় ব্যতীত দলবদ্ধ না হয়ে কবর যিয়ারত করা পুরুষের জন্য সুন্নত। কারণ, এর মাধ্যমে তার অন্তরে মৃত্যুর স্মরণ সদা জাগ্রত থাকবে। মগ্ন হবে সে পরকাল চিন্তায়। পার্থিবের ব্যাপারে সৃষ্টি হবে নিরাসক্তি ও নৈরাশ্য। এ উদ্দেশ্য ব্যতীত ভিন্ন কোন কারণে কবর জেয়ারতে গমন অবৈধ সর্বৈবে। কবর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত হতে ভ্রমণ করা, কিংবা কবর জেয়ারতের জন্য দিন-মাস ও সময় নির্ধারণ করা, কবরকে কেন্দ্র করে উৎসব ও ওরস যাপন, তাতে আলোকসজ্জা, কেবল কবরকে উদ্দেশ্য করে কবরস্থানে মসজিদ নির্মাণ, নারীদের কবর জেয়ারতে গমন, (এ নিষেধাজ্ঞা কেবল এমন নারীর জন্য, যে তথায় গমন করে শরিয়ত বিরোধী কাজে অংশ নেয় ; যার উদ্দেশ্য কবর জেয়ারতের মাধ্যমে মৃত্যুর স্মরণ করা, পরকালের চিন্তা মনে জাগ্রত রাখা, তার জন্য অবৈধ নয়) কবরের উপর চাদর টানান, পাকা করা, কবরস্থান বা কবরের শিয়রে মৃতের মৃত্যু তারিখ, তাদের নাম, কোরআনের আয়াত—ইত্যাদি অঙ্কন করা, কবরের উপর ...নির্মাণ, এক ...চেয়ে উঁচু কবর বানান, পুণ্যের কাজ মনে করে কবরের পাশে সালাত আদায়, কবরের পাশেই আবাস স্থাপন, মসজিদের সাথে যে আচরণ ও সম্মান প্রদর্শন কাম্য, তা কবরের সাথে করা,—এ উদ্দেশ্য করে কবরকে কেন্দ্র করে আনন্দ উদযাপন করা যে, এর মাধ্যমে কবর-বাসীর চিত্ত বিনোদন হবে, এবং সে প্রাপ্ত হবে অশেষ সওয়াব—এসব কিছুই মাকরূহ, হারাম ও চূড়ান্ত বেদআত। যারা এরূপ কাজে অংশ নেয়, তাদের অধিকাংশের উদ্দেশ্য এই থাকে যে, তারা তাদের উক্ত পূর্বসূরিদের মনে করে প্রয়োজন পূরণকারী ও সমস্যার সমাধান দাতা। তারা তাদের কাছে নিজেদের ইচ্ছাগুলো পেশ করে—তাই, তাদের সন্তুষ্ট রাখতে এ কাজগুলোয় অংশ নেয়। বস্তুত: প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যার সমাধান এক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কবর-বাসী এ মহান পূর্বসূরিগণ স্বয়ং ছিলেন আল্লাহ তা‘আলার মুখাপেক্ষী, জীবিতকালে তাদের প্রতি বক্তব্যে, কথায়-আচরণে আল্লাহর মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ পেত। এই কারণে তারা মহান ছিলেন যে, সমস্ত কিছুই তারা প্রার্থনা করতেন একমাত্র আল্লাহর কাছে। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে সমাধান দাতা হিসেবে স্বীকার করতেন না। সুতরাং, কীভাবে অন্যের জন্য সমাধান দাতা হতে পারেন তারা ? মুসলমানদের সমাজে এ অপ-সংস্কারের বিস্তৃতি ঘটেছে মূলত: ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনুকরণের ফলশ্র“তিতে। এরা পয়গম্বর ও মহান ব্যক্তিত্বদের মৃত্যুর পর তাদের সমাধিগুলো বাধাই করে এভাবে এবাদত করত।
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ.
আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবিগণ ! আমরা এবং তোমরা একমত—এমন ঐকমত্যে এসো যে, আল্লাহ ব্যতীত আমরা কারো এবাদত করব না, তার সাথে কোন শরিক করব না, আল্লাহ ব্যতীত আমরা একে অপরকে প্রভুর স্বীকৃতি প্রদান করব না। যদি তারা পিছু হটে যায়, তবে তোমরা বলে দাও—সাক্ষী থাক, আমরা মুসলমান।
ইহুদিরা বিশ্বাস করে, উজাইর আ: আল্লাহর পুত্র ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাই, তারা তার আত্মার পূজা করে, তাদের ইচ্ছাগুলো নিবেদন করে তার কাছে। তাদের সমাজের কোন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব কিংবা জ্ঞানী মৃত্যুবরণ করলে তার কবরের উপর সমাধি নির্মাণ করে পুজো করতে আরম্ভ করে। তাকে কেন্দ্র করে মসজিদ নির্মাণ করে তাতে নামাজ পড়া ও ধ্যান করাকে উত্তম জ্ঞান করে। খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা আ:-কে মনে করে আল্লাহর পুত্র। ইহুদিরা হজরত ঈসা আ:-কে যে স্থানে—তাদের ধারণা মতে—শূলীতে চড়িয়েছিল, সেখানে, এবং আনতাকিয়ায় ঈসা আ:-এর এক সহযোগী ইউহানার সমাধিতে মেলার আয়োজন করে। তাদের কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি কিংবা ফকির-বেশধারী কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার জন্য নির্মাণ করা হয় বিশাল ও সুদৃশ্য সমাধি। তাকে কেন্দ্র করে উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়। সজ্জিত করা হয় আলো জ্বালিয়ে। পয়গম্বর ও অলিদের সমাধিতে ধ্যানের আয়োজন করা হয়। ইহুদি ও খৃষ্টান—উভয় গোষ্ঠীই তাদের কওমের মহান ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর পক্ষ হতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারপ্রাপ্ত ও প্রয়োজন পূরণকারী সমাধানদাতা হিসেবে জ্ঞান করে। তাদের জ্ঞানীরা যে বক্তব্য প্রদান করে, যাচাই-বাছাই ব্যতীতই তাকে খোদার বিধান হিসেবে সাব্যস্ত করে। আল্লাহ তাআলা তাদের এ বিশ্বাস ও পন্থাকে ঘোষণা করেছেন শিরক হিসেবে, এবং বলেছেন—তোমাদের পয়গম্বর, আলেম ও দরবেশরা ছিলেন তোমাদের মতই নিতান্ত মানুষ, সুতরাং, তোমরা কীভাবে তাদের এবাদতে অংশ গ্রহণ কর ? তাদের আনীত ধর্মগ্রন্থ তাওরাত বা ইঞ্জিলে তাদেরকে প্রভুর স্বীকৃতি প্রদান করতে বলা হয় নি, কিংবা তারাও দাবি করেন নি যে, তোমরা আমার এবাদত কর, প্রভু মান আমাদের—সুতরাং এভাবে শিরকি আক্বীদা প্রসারের কী অর্থ থাকতে পারে ?
পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, তোমরা আমাকে ব্যতীত কারো পুজো করো না, কিংবা প্রার্থনা জানিয়ো না কারো কাছে। সুতরাং, কোরআন, তাওরাত ও ইঞ্জিল—ইত্যাদি ঐশী গ্রন্থ একই মতবাদ প্রচার করছে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, ইহুদি ও খ্রিস্টানগণ তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে জীবন-যাপন করে না। উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার নবীকে সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন—আপনি তাদের জানিয়ে দিন, তোমরা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে গায়রুল্লাহর আত্মা ও সমাধিগুলোর এবাদতে লিপ্ত হয়ো না। এবং আমাদের সকলের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি একক অবস্থান তৈরি করো যে, আমরা সকলে আল্লাহকে পরিত্যাগ করে অন্ন কোন পীর, পয়গম্বর, সাধুপুরুষ, জিন-পরী, বৃক্ষ, সমাধি—ইত্যাদির পূজা করব না। কোন কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করাব না। আল্লাহ ব্যতীত আমরা কাউকে প্রভুর স্বীকৃতি প্রদান করব না। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা যদি তোমাদের এ বক্তব্য না গ্রহণ করে,—বরং তাদের অলি, বুজুর্গদের আত্মা ও সমাধির পুজোয় নিয়োজিত থাকে, তবে তোমরা তাদের বলে দাও যে, আমরা আল্লাহ পাকের আদেশের খুবই অনুবর্তী—এ ব্যাপারে তোমরাও সাক্ষী থাক।
এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন পীর ও পয়গম্বরকে মান্য করা, তাকে সমাধানদাতা হিসেবে জ্ঞান করা, প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে তার কবরে গমন—আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রেরিত যে কোন ঐশী গ্রন্থের বিধানের বিরোধী। কোন শরিয়তেই এর বৈধতা প্রদান করা হয় নি। এ হচ্ছে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সৃষ্ট শিরকি প্রথা। বর্তমানের মূর্খ মুসলমানগণ অনুরূপ আচরণ করছে তাদের নবী ও অলিদের সাথে। যদি তাদের কেউ এ ব্যাপারে অনুরোধ করে যে, তোমরা এগুলো ত্যাগ করো, কারণ কোরআনে একে হারাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তবে অনর্থক প্রমাণ উপস্থিত করে বসে, তাদের প্রজ্ঞা ব্যক্তিদের বক্তব্যকে কোরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস চালায়। সুতরাং, তাদেরকে এমন বলাই কর্তব্য যে, আমাদের উভয়ের মাঝে যে ঐক্যমতের যে সূত্র রয়েছে যে, আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কারো উপাসনা হারাম—এসো, তাতেই প্রত্যাবর্তন করি। এসো, আমরা উভয়েই সম্মিলিতভাবে আল্লাহ পাকের এবাদতে মগ্ন হই। আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কাউকে আমাদের রক্ষাকারী ও সমাধানদাতা হিসেবে স্বীকার করব না, কাউকে তার অংশীদার হিসেবে তার সমকক্ষ রূপে দাঁড় করাব না। তিনি ব্যতীত কাউকে আমাদের প্রভু ও কল্যাণ দাতা মনে করব না। এতে যদি তারা একমত হয়, তবে তা খুবই আনন্দের, যদি মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তবে তাদের এমন বলে দেওয়া কর্তব্য যে, আমরা আল্লাহর বিধানের অনুবর্তী, গ্রহণযোগ্য কেবল তারই বিধান—এ ব্যাপারে তোমরাও সাক্ষী থাক।

কোরআনে এসেছে—
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ.
অর্থ : ‘কোন মানুষের জন্য এটা বৈধ বা শোভনীয় নয় যে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিতাব ও হিকমত দান করবেন, অত:পর সে মানুষকে বলবে যে, তোমরা আল্লাহকে ত্যাগ করে আমার বান্দায় পরিণত হও। বরং (তার পক্ষে শোভনীয় ও উচিত হল, এমন বলা যে,) তোমরা রব্বানীতে পরিণত হও, যেভাবে তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতে ও নিজেরা তা পাঠ করতে। সে তোমাদের এ আদেশ প্রদান করে না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীদের প্রভু হিসেবে গ্রহণ করো। তোমরা মুসলমান হওয়ার পরও কি সে তোমাদের কুফরের নির্দেশ প্রদান করবে ?’
অর্থাৎ, আল্লাহ পাক যাকে জ্ঞান, বুদ্ধি, সচেতনতা ও নবুয়্যত দান করেছেন, তার উদ্দেশ্য কখনো এই নয় যে, মানুষকে সে বলবে তোমরা আল্লাহকে ত্যাগ করে আমার পূজারি হয়ে যাও। আমাকেই মান্য করো, আমিই তোমাদের সমাধান দাতা, আল্লাহ আমাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে পাঠিয়েছেন। আমার উপাসনার পর খোদার উপাসনার কোন প্রয়োজন নেই।
মানুষকে উদ্দেশ্য করে পয়গম্বরগণের বক্তব্য ও বাণী এই ছিল যে, তোমরা আল্লাহ ওয়ালা হয়ে যাও—যেভাবে তোমাদের কিতাবে তোমাদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে কিতাব শিক্ষা দাও, এবং নিজেরাও তা পাঠ করো। উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, কোন পয়গম্বর শিরকের আদেশ করেন নি, এ ধরনের দু:সাহস করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তাবৎ নবীগণের বক্তব্য ছিল, এবাদত করো একক আল্লাহর, তাকে আপন মালিক, অভিভাবক ও প্রয়োজন পূরণকারী জ্ঞান করো। সুতরাং, কেউ কোন মহা পুরুষের বক্তব্যের উদ্ধৃতি প্রদান করে বলে যে, আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কারো এবাদত করা বৈধ, তবে নিশ্চয় সে মিথ্যাবাদী। কারণ, নবী বা অলী—কারো পক্ষেই এ সম্ভব নয় যে, তারা আল্লাহ বিরোধিতায় অবতীর্ণ হবে। যদি তাদের থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনা থাকে, তবে বুঝতে হবে এর ভিন্ন কোন মানে রয়েছে।
বস্তুত : এ সময়ের মানুষগণ মৃতের কাছে প্রার্থনা করে, তাদের উৎসর্গ করে নানা কিছু। দূরদূরান্ত হতে কবরের উপাসনায় গমন করে। তাওয়াফ করে কবরের। প্রত্যাবর্তনের কালে কবরের দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে না। চুম্বন করে কবরের মাটি ও দেয়ালে। এদের জানা উচিত যে, যাদের প্রতি তারা এরূপ আচরণ প্রদর্শন করছে, তারা তাদের মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তারা তাদের এ আদেশ প্রদান করে নি। বরং কেয়ামত দিবসে তাদের বিরুদ্ধে তারা শত্র“তায় অবতীর্ণ হবেন।
কোরআনে ঈসা আ: প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে—
وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِنْ كُنْتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ ﴿১১৬﴾ مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ﴿১১৭﴾ إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ.
আর যখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে ঈসা বিন মারইয়াম ! তুমিই কি বলেছ যে, তোমরা আমাকে ও আমার মাকে আল্লাহ ব্যতীত ইলাহ রূপে গ্রহণ করো ? তিনি বলবেন, আপনি মহান ! যা সত্য নয়, তা বলা আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমি যদি তা বলে থাকি, তবে আপনি নিশ্চয় সে সম্পর্কে অবগত হতেন। আমার অন্তরে যা রয়েছে, সে ব্যাপারে আপনি সম্যক অবগত, আমি আপনার অন্তরের কথা জানি না। নিশ্চয় আপনি যাবতীয় অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। আপনি আমাকে যে ব্যাপারে আদেশ প্রদান করেছেন, আমি তাদেরকে কেবল তাই বলেছি যে, তোমরা আমার ও তোমাদের রব আল্লাহ তাআলার এবাদত কর। আমি যতদিন তাদের মাঝে অবস্থান করেছি, আমি তাদের সাক্ষী ছিলাম। যখন আপনি আমাকে মৃত্যু দিয়েছেন, তখন আপনিই ছিলেন তাদের একমাত্র দায়িত্বশীল। আপনিই কেবল সমস্ত কিছুর প্রকৃত সাক্ষী। আপনি যদি তাদের শাস্তি প্রদান করেন, তবে তারা আপনারই বান্দা (এ ব্যাপারে কাউকে জবাবদিহিতা করার নেই) আর যদি তাদের ক্ষমা করে দেন, তবে আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান।
যেহেতু ঈসা আ: পিতা ব্যতীতই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে মৃত ব্যক্তি জীবন-লাভ করেছিল, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীরা লাভ করেছিল পরিপূর্ণ আরোগ্য—তাই তার এই আশ্চর্যজনক মোজেজা দেখে খ্রিস্টানরা তাকে খোদার পুত্র ও তার মাতা হজরত মারইয়ামকে খোদার স্ত্রী বলে ঘোষণা করল। (নাইজুবিল্লাহ)। তাদের বিশ্বাস, তারা উভয়েই খোদার নিকট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তারা তার উপাসনায় আত্মনিয়োগ করে। ইহুদিরা তাদের ধারণা অনুসারে, ঈসা আ:-কে শূলীতে চড়িয়ে দেয়। খ্রিস্টানরা পরবর্তীতে সেই শূলীর প্রতিরূপ ধারণকেই এক উপাসনা জ্ঞান করতে আরম্ভ করতে লাগল। তাদের ধারণা এই যে, এতে আল্লাহ তাআলা খুশি হবেন। কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলা হজরত ঈসা আ:-কে জিজ্ঞাসা করবেন যে, তুমিই কি তাদেরকে আদেশ করেছিলে যে, তোমরা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে আমাকে ও আমার মার এবাদতে আত্মনিয়োগ করো ? ঈসা আ: উত্তর করবেন, হে আল্লাহ, আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আমার এমন কোন ক্ষমতা নেই যে, আপনার শানে দখলদারিত্ব করব, এবং মানুষের মাঝে এমন কথা ছড়াব, যা আমার জন্য শোভনীয় নয় কোনভাবেই। পৃথিবীতে আমার আগমনের হেতু এই ছিল যে, আমি মানুষ ও তার প্রতিপালকের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করে দেব, বিচ্ছিন্নতা তৈরি আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ, যদি আমি এমন বলে থাকি, তবে তা আপনার লিপিকায় লিপিবদ্ধ আছে, এবং আপনি সে ব্যাপারে জ্ঞাত। আমার জন্য এটা কখনো বৈধ নয় যে, মানুষ আমার উপাসনায় নিরত হবে। আপনি আমার অন্তরে যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত। আমি মানুষ, আমার হাতে যে মোজেজার প্রকাশ ঘটেছে, তা আপনার দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। আমি আপনার ইচ্ছা সম্পর্কে পুরোপুরি অনবগত। কীভাবে আমার পক্ষে এমন করা সম্ভব ? মানুষের অন্তরে লুক্কায়িত থাকে যে কথা ও ইচ্ছা, তা আপনার অনবজ্ঞাত নয়। আমাকে আপনি যা নির্দেশ দিয়েছেন, আমি কেবল তাদের তাই বলেছি যে, তোমরা কেবল আল্লাহরই উপাসনা কর, যিনি আমাদের সকলের রব ও প্রতিপালক। আমাকে উর্ধ্বলোকে উত্তোলন করার পর আমার ও আমার মাতার উপাসনা করা শুরু হয়। আমি যতদিন পৃথিবীতে যাপন করেছি, তাদেরকে তাওহীদের সরল ও ঋজু পথে আহ্বান করেছি, তার দাওয়াত দিয়েছি। আমাকে আপনি ঊর্ধ্বলোক হতে আহ্বান করেছেন, তার পর থেকে আমি আর কিছুই অবগত নই। আপনি যদি তাদের শাস্তি প্রদান করেন, তবে তারা তো আপনারই বান্দা, এ ব্যাপারে আপনার কাউকে জবাবদিহিতা করতে হবে না। আপনার আজাব হতে আমি তাদেরকে রক্ষা করতে পারি না। আমি তাদের রক্ষাকারী নই, কারণ, আপনি সকলের উপর জয়ী। আর যদি তাদের ক্ষমা করে দিন, তবে আপনি প্রজ্ঞাবান।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, কোন নবী বা অলির পক্ষে এ সম্ভব নয় যে, তিনি মানুষ তার এবাদত করার আদেশ করবেন। তারা যখন এই নশ্বর পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছেন, এর পর এ পৃথিবীতে কি কি ঘটছে এবং ঘটেছে—সে ব্যাপারে তারা কিছুই অবগত নন। মানুষ তার স্মৃতি ও সমাধির কি আচরণ করছে, কেয়ামতের দিবসে যখন তারা সে ব্যাপারে অবগতি লাভ করবে, তখন তারা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হবেন—এতদিন যারা তার উপাসনায় লিপ্ত ছিল, তারা পরিণত হবেন তাদের শত্র“তে। আল্লাহর দরবারে তাদের ব্যাপারে নিজেদের অসন্তুষ্টি জ্ঞাপন করবে। সুতরাং, যারা কবর পূজায় লিপ্ত, তাদের জেনে রাখা কর্তব্য—কেয়ামতের কঠিন দিবসে তাদের উপাস্যগণ তাদের শত্র“তে পরিণত হবেন, প্রবল ঘৃণায় তাদের তাড়িয়ে দেবেন। কারণ, কবর-পূজা কোরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্ট কুফর ও শিরক। হজরত আলী রা. কিংবা শায়েখ আব্দুল কাদের জ্বিলানী কোথাও কবর পূজার আদেশ কিংবা তার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেন নি। এগুলো পরবর্তী মানুষের সৃষ্টি, এ অপভ্রংশ তারাই মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে।
কোরআনে এসেছে—
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ.
তারা আল্লাহকে ত্যাগ করে এমন কিছুর এবাদতে লিপ্ত, যা তাদের উপকার ও ক্ষতি করতে পারে না। তারা বলে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী হবেন। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহকে এমন কিছুর সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছ, আকাশ ও জমিনের যা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। মানুষ তার সাথে যা শরিক করে, তিনি তা হতে পবিত্র ও মহান।
অর্থাৎ, যারা তাদের মহান ব্যক্তিদের চিত্র, মূর্তি, ঝান্ডা, নিশান, আবাস, আত্মা—আল্লাহকে ত্যাগ করে তারা ইত্যাদির পূজা করে। তাদের উপাস্যগুলো এমন, যা তার উপাসনাকারীর উপকার কিংবা অপকার— কোনটাই করতে সক্ষম নয়। তারা তাদের কর্মকে বৈধ করার জন্য মানুষের মাঝে যে বিশ্বাস ছড়াই যে, আমরা তাদের কেবল এ কারণে এবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য দানে সহায়তা করবে, আমাদের পক্ষ হয়ে সুপারিশ করবে তার নিকট— কোরআন ও হাদিসের কোথাও এর প্রতি সমর্থন জানানো হয় নি। আল্লাহ বলে দেন নি যে, আমার নিকট অমুক অমুক ব্যক্তি সুপারিশ করতে সক্ষম হবে। এরা কি আল্লাহর চেয়েও বেশি জ্ঞানী, তারা কি জেনে গেছে কেয়ামত দিবসে কে কে সুপারিশকারীর মর্যাদা লাভ করবে ?
ছোট হোক কিংবা বড়—আকাশ জমিনের কোথাও এমন কোন সুপারিশকারী নেই, যার আত্মা কিংবা কবর, ঝান্ডা কিংবা নিশান অথবা ছড়ির উপাসনার করলে পরকাল দিবসে বিন্দুমাত্র উপকার সাধন হবে। নবী ও অলিগণের সুপারিশ আল্লাহ পাকের ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল—এমন শিরকি পদ্ধতিতে তাদের সাথে আচরণের ফলে ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। এর দ্বারা মানুষ পরিণত হয় স্পষ্ট মুশরিকে। এমনকি যদি তারা সে মহান ব্যক্তিদের খোদা মনে না করে—বরং তাকে কেবল খোদার দরবারে তাদের জন্য সুপারিশকারীর মর্যাদাই দান করে, সুপারিশ-লাভের এই হীন উদ্দেশ্যেই তাদের উপাসনা করে, তাহলেও তারা পাক্কা মুশরিকে পরিণত হবে। যতক্ষণ না নিষ্কলুষ অন্তরে তারা তওবা করে, ততক্ষণ তাদের ঈমান ফিরে আসবে না।
কোরআনে এসেছে—
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ.
আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবীগণ ! তোমরা অনৈতিকভাবে তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। এমন কওমের প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করো না, যারা ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, এবং ভ্রষ্ট করেছে অনেককে। তারাও সরে গিয়েছে সঠিক পথ থেকে।
যে কোন ধর্মে এ এক মৌলিক বিধান যে, আল্লাহ ও তার রাসূল কর্তৃক যা সাব্যস্ত, তার উপরই আমল করা হবে, নিজেদের পক্ষ হতে কোন বাড়াবাড়ির আশ্রয় নেয়া হবে না। বাড়াবাড়ি সর্বৈবে হারাম। কারণ, বাড়াবাড়ির মাধ্যমে সংযোজন-বিয়োজনের ফলে তা আর ধর্ম থাকে না, পরিণত হয় সকলের পথভ্রষ্টতার কারণ-এ। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মপন্ডিতরা নিজেদের পক্ষ হতে ধর্মের নামে নানা অধর্মের উদপাদন করেছে, এক সময় ধর্মগ্রন্থগুলোতে তা প্রক্ষেপন করা হয়েছে—উদাহরণত যে ব্যক্তি অমুক মহান ব্যক্তির উপাসনা করবে, তার অমুক অমুক মর্যাদা হাসিল হবে, অমুক কর্ম অমুক মহান ব্যক্তির নামে সূচনা করা হলে শুভ পরিণতি লাভ হয় ; অমুকের সমাধিতে গমনের ফলে ইচ্ছাপূরণ হয় ;—পরবর্তী প্রজন্ম যখন কিতাবে এগুলো লিপিবদ্ধ আকারে পেয়েছে, ভেবে নিয়েছে যে এগুলো কিতাবেরই অংশ, এগুলো মান্য তাদের একান্ত কর্তব্য। ফলে ধীরে ধীরে আক্রান্ত হতে থাকে কবরপূজা, নিশানাপূজা—ইত্যাদি হয়ে দাঁড়ায় তাদের ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে। আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে বলেছেন—দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহর কিতাবই তোমাদের একমাত্রিক অবলম্বন, একে অতিক্রম করো না, পূর্ববর্তী যে সমস্ত ধর্মপন্ডিতরা গোমরাহ হয়েছে, যে অপভ্রংশের মাধ্যমে তোমাদের ভুল পথে চালিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছে, তাকে অবলম্বন করো না। কারণ, তারা নিজেরাও ভ্রষ্ট, অপরকেও ভ্রষ্ট করার জন্য তৎপর। তাদের কথার কোন মূল্য নেই।
সুতরাং, কোন আলেম বা পীর যদি কোরআন ও হাদিস বিরোধী বক্তব্য প্রদান করেন, তবে তা পরিত্যাজ্য সর্বার্থে। কেউ যদি এর পক্ষে হয়ে কথা বলে, তবে তাকে প্রতিরোধ করতে হবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
আল্লাহর এক মূর্খ বান্দা এমন বক্তব্য প্রদান করে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছে যে, আমার পীরের কবর হতে আমি সেই ফয়েজ ও রূহানী শক্তি প্রাপ্ত হই, যা জীবতাবস্থায় তার মাধ্যমে প্রাপ্ত হতাম। আমার পীর কবরে থেকেই মুরিদদের প্রতি মনোযোগ নিবেশ করেন। মূর্খরাই এমন বক্তব্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করে, এবং নিমজ্জিত হয় চূড়ান্ত ভ্রান্তিতে। আরম্ভ করে চরম বাড়াবাড়ি। আলেম ও বিজ্ঞজনেরাও এ ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকে নি। পার্থিব ও ঐহিক হাজারো কর্ম ত্যাগ করে তারা আত্মনিয়োগ করেছে কবরপূজায়, এর জন্য তারা ভ্রমন করেছে দূর-দূরান্ত হতে। ইসলামে কেবল তিন স্থানের উদ্দেশ্যে সফর বৈধ করা হয়েছে—
عن أبي سعيد الخدري قال قال رسول الله صلي الله عليه و سلم لا تشدوا الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد، المسجد الحرام، و المسجد الاقصى، و مسجدي هذا.
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, কেবল তিন মসজিদের উদ্দেশ্যেই সফর করা যাবে—মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা, ও আমার মসজিদের উদ্দেশ্যে। (বোখারি, মুসলিম)
অর্থাৎ, মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা ও মসজিদে ননবী ব্যতীত পুন্যময় কোন স্থানের উদ্দেশ্যে সফর বৈধ নয়। ইসলামের আগমনের পূর্বে অন্যান্য জাতিগণ তুর পর্বতের গুহার উদ্দেশ্যে, ঈসা আ.-এর আবাসভূমি, ইউহানার সমাধি—ইত্যাদির যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করত। উল্লেখিত হাদিসের আলোকে এ প্রমাণ হল যে, উক্ত তিন স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও য়েয়ারত বৈধ নয়।
হাদিসে আছে—
عن أبي هريرة رضي الله عنه سمعت رسول الله صلي الله عليه وسلم يقول: لا تجعلوا قبري عيدا و صلوا علي، فان صلاتكم تبلغني حيث كنتم.
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি—তিি বলছেন, তোমরা আমার রওজাকে ঈদগাহ বানিয়ো না, আমার উদ্দেশ্যে দরুদ পাঠ কর, তোমরা যেখানেই থাক, তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে।
রাসূল যখন দেখতে পেলেন যে, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের মহান ব্যক্তিদের কবরকে বাৎসরিক উৎসব স্থল বানিয়ে নিয়েছে, এমনকি তারা তাদের কাছে নিজেদের ইচ্ছাগুলো পেশ করছে, মান্যত করছে, তাদেরকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করছে—তখন তিনি নিজের উম্মতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা আমার রওজাকে ঈদগাহ বানিয়ো না, মানুষ যেভাবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি দিনে উত্তম পোশাক পরিধান করে আনন্দচিত্তে ঈদগাহে গমন করে, আমার রওজার সাথেও তেমন আচরণ করো না। সওয়াবে আকাঙ্খা হলে তোমরা আমার উদ্দেশ্যে দরুদ পাঠ কর, এতে আমার ও তোমাদের সম্মিলিতভাবে উভয়ের সওয়াব লাভ হবে। দরুদ পাঠের জন্য কবরের পাশে আগমন জরুরী নয় ; আপন আপন স্থানে থেকে যদি আমার উদ্দেশ্যে দরুদ পাঠ কর, আল্লাহ তাআলা তা আমার কাছে পৌঁছে দিবেন। কারণ, আল্লাহ পাক দরুদ প্রেরণের জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করে রেখেছেন। দরুদ হল আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা জানান যে, হে আল্লাহ ! আপনি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আল্লাহ পাক যে কোন স্থান হতে বান্দার ডাক শুনেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে—নির্দিষ্ট মাস, নির্দিষ্ট দিনে রওজায়ে পাকে সমবেত হওয়া না-জায়েজ। যেখানে রাসূলের কবরে সমবেত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে অন্যের কবরের ক্ষেত্রে কী হুকুম হবে তা বলাই বাহুল্য। কারো কবরকে কেন্দ্র করে ওরস পালন, মেলা উদযাপন, এবং নির্দিষ্ট দিনে কারো কবর যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন—ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। কবরকে কেন্দ্র করে, কিংবা কবরের কারণে আনন্দ উদযাপন জায়েজ নয়। হাদিসটি আরো প্রমাণ করে, মৃতের জন্য সওয়াব প্রেরণ করতে হলে তা করতে হবে দরুদের মাধ্যমে, কিংবা তার নামে কিছু সদকা করে দিতে হবে। এর জন্য কবরের নিকটে গমন জরুরী নয়।
উক্ত হাদিসের মাধ্যমে এও জানা গেল যে, মানুষের মাঝে দরুদকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে আছে যে, এক ধরনের অপবিশ্বাস—দরুদ পাঠ কালিন রাসূলের আত্মা তথায় এসে উপস্থিত হয়—সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কারণ, আল্লাহ তাআলা উক্ত পাঠকৃত দরুদ রাসূলের কাছে পৌঁছানোর ভিন্ন ব্যবস্থা করেছেন, ফেরেশতাগণ সে দায়িত্ব পালন করেন, রাসূলের আত্মা স্বয়ং সেখানে উপস্থিত হয় না।
হাদিসে এসেছে—
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه و سلم: لعن الله زوارات القبور.
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—আল্লাহ তাআলা কবরস্থানে গমনকারী নারীদের লা’নত দিয়েছেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে, কবর যেয়ারতের উদ্দেশ্যে নারীদের কবরস্থানে গমন হারাম।
عن عطاء بن يسار قال قال رسول الله صلي الله عليه و سلم: اللهم لا تجعل قبري وثناً يعبد، اشتد غضب الله على قوم  اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد.
হযরত আতা বিন য়াসার হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—হে আল্লাহ ! আমার কবরকে পুজনীয় মূর্তির মত বানাবেন না। আল্লাহর ক্রোধ তাদের উপর প্রবল হয়েছে, যারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
অর্থাৎ, মসজিদে সালাত আদায় ও ইতেকাফ করা খুবই সওয়াবের কাজ। মসজিদ কেন্দ্রিক আরো বিভিন্ন কর্ম রয়েছে—মসজিদ ঝাড়– দেওয়া হবে, ফরশ বিছিয়ে পানি পানের ব্যবস্থা রেখে লোকজনকে বিশ্রাম করার সুযোগ করে দেওয়া হবে। এই সমস্ত কাজের সওয়াব রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের লোকেরা মসজিদের সাথে নয়—এমন আচরণ করত তাদের নবীদের কবরের সাথে ; এর ফলে তারা একদিন আল্লাহর গজবে পতিত হয়। কারণ, এগুলোর ফলে কবর আর কবর থাকে নি, বরং তা পরিণত হয়েছে পূজনীয় মূর্তিতে।
হাদিসটি প্রমাণ করে, মসজিদের বিশিষ্ট কোন কাজ কবরের সাথে করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। যারা এর সাথে জড়িত, তাদের উপর আল্লাহর প্রবল ক্রোধ আপতিত হবে। যেভাবে হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাঈল, লাত ইত্যাদির চিত্র ও কবর মানুষের উপসনার ফলে মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল, এমনিভাবে এ কবরগুলোও মানুষের উপসনার ফলে মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়। হাদিসে এসেছে—
عن عائشة رضي الله عنه أن رسول الله صلي الله عليه و سلم قال في مرضه الذي لم يقم منه، لعن الله اليهود والنصارى، اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد.
হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম রোগশয্যায়—যে রোগশয্যা হতে তিনি আর উঠে দাঁড়াননি, এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা ইহুদি ও নাসারাদের লা’নত দিয়েছেন—তারা তাদের নবীর কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। (বোখারি, মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুশয্যায় উম্মতকে সতর্ক করার জন্য তাদের উদ্দেশ্য করে এরশাদ করেছেন—ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপর আল্লাহ লা’নত বর্ষণ করেছেন, কারণ, তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। যেভাবে আল্লাহকে মসজিদে উপস্থিত হয়ে সেজদা করতে হয়, ঠিক সেভাবে তারা কবরকে সেজদা করতে আরম্ভ করে। মসজিদের অনুরূপ তারা কবরকে শক্ত ও মজবুত রূপে নির্মাণ করত। আলোকসজ্জা করত তাতে, কবরের পাশে এবাদত করত, ইতেকাফ করত।
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment