দর্শক সংখ্যা

Sunday, March 3, 2013

ইসলামে সালাতের গুরুত্ব (পর্ব : ১)

ইসলামে সালাতের গুরুত্ব (পর্ব : ১)

লেখক : জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের  
সালাত ত্যাগকারীর বিধান ও জামাতে সালাত পড়ার গুরুত্ব আল্ল¬াহ মানুষকে তার এবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। শুধু মানুষ নয় ; মানুষ ও জ্বীন—উভয় জাতিকে আল্লাহ তার এবাদত তথা তার দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন- وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ অর্থাৎ “আমি মানব ও জ্বীন জাতিকে একমাত্র আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” ফলে তিনি মানুষের জন্য কিছু দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক এবাদতের প্রচলন করেছেন। দৈহিক এবাদতের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান এবাদত হল সালাত। সালাত এমন একটি এবাদত যাকে আল্ল¬¬াহ তার মাঝে এবং তার বান্দার মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন। সালাতের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সাথে দেয়া প্রতিশ্র“তির বার বার প্রতিফলন ঘটায়। সে তার প্রভু বা স্রষ্টাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সে তার প্রতিশ্র“তি পালন করে যাচ্ছে। এ সালাতের মাধ্যমেই মানুষ আল্ল¬¬াহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ কংটকমুক্ত হয়। সালাত ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মমতাবোধ ফিরিয়ে আনে। গড়ে উঠে সামাজিক ঐক্য। সালাতের মাধ্যমে ছগীরা তথা ছোট ছোট গুনাহগুলো হতে পরিত্রাণ লাভ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়।
 সালাতের বৈশিষ্ট্য :— সালাত এমন এক এবাদত যা সারা বছর দৈনিক পাঁচ বার আদায় করতে হয়। মৃত্যু ছাড়া আর কোন অবস্থাতেই সালাত মাফ হয় না এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও সালাত হতে বিরত থাকার কোন বিধান নেই। আল্ল¬¬াহ তাআলা প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। তারপর আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়া করে তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসেন। তবে সওয়াব ও বিনিময় পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই জারী রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব প্রদান করবে। সালাত একমাত্র এবাদত যা আল্ল¬াহ তাআলা সাত আসমানের উপরেই ফরজ করাকে শ্রেয় মনে করেছেন। তাই রাসূল (সা:) যখন মেরাজে গমন করেন তখন আল্ল¬াহ তাআলা সরাসরি—কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই রাসূল (সা:)-কে সালাতের দায়িত্ব দেন। এতে সালাতের মহত্ত্ব, মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটে। রব ও স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভিপ্রায়ী একজন মুসলমানের কর্তব্য হল, সে এ মহান এবাদতটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করবে। এবং তার যথার্থতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। এছাড়া ও সালাতের অনেক লাভ ও ফজিলত আছে। নিম্নে এর কয়েকটি ফজিলত
আলোচনা করা হল। ১- আল্লাহর একাত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সা.) এর রেসালাতের স্বাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত হল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। রাসূল (সা:) ঈমাননের পরেই সালাতের কথা উল্লে¬খ করেন। অত:পর তিনি বলেন— بني الإسلام علي خمس شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمد رسول الله وإقام الصلاة وإيتاء الزكاة و صوم رمضان وحج البيت ( رواه البخاري:৭ و مسلم:১৯) ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি:— ১-এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্ল¬¬হ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সা:) আল্লা¬হর রাসূল। ২-সালাত কায়েম করা। ৩-জাকাত প্রদান করা। ৪-রমজানের রোজা রাখা। ৫-বাইতুল্লাহর হজ করা। (বোখারি : ৭ মুসলিম : ১৯) তিনি আরো বলেন— رأس الأمر الإسلام وعموده الصلاة و ذروة سنامه الجهاد. ( رواه الترمذي:৩৫৪১) সবকিছুর মূল হল ইসলাম, আর ইসলামের খুঁটি সালাত, আর ইসলামের শীর্ষ পীঠ হল জিহাদ। (তিরমিযি:৩৫৪১) ২-সালাত আল্ল¬¬াহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বোত্তম আমল। রাসূল (সা:) বলেন :— استقيموا ولن تحصوا واعملوا وأن خير أعمالكم الصلاة ولن يحافظ على الوضوء إلا مؤمن. (رواه ابن ماجة:২৭৩) তোমরা অটুট ও অবিচল থাক, গণনা করো না, তোমরা কাজ করো, আর মনে রাখবে তোমাদের সর্বোত্তম আমল হল সালাত, একজন মোমিন অবশ্যই সর্বদা ওজুর সংরক্ষণ করতে থাকে। (ইবনে মাজাহ :২৭৩) ৩- সালাত নুর—যেমন রাসূল (সা:) বলেন:— الطهور شطر الإيمان والحمد لله تملأ الميزان و سبحان الله والحمد لله تملان أوتملأ ما بين السماء والأرض والصلاة نور والصدقة برهان و الصبر ضياء و القران حجة لك أو عليك. رواه مسلم:৩২৭) পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক আর আলহামদুলিল্ল¬াহ পাল্ল¬¬াকে সম্পূর্ণ করে, সুবহানাল্ল¬হ ও আলহামদুলিল্লা¬¬হ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পূর্ণ করে। সালাত নূর-আলো। দান খয়রাত প্রমাণ স্বরূপ। ধৈর্য উজ্জলতা আর কোরআন তোমার পক্ষে প্রমাণ অথবা তোমার বিপক্ষে প্রমাণ। (মুসলিম:৩২৭) ৪- সালাত আল্ল¬¬াহর নৈকট্য ও উচ্চ-মর্যাদা লাভের উপকরণ। সাওবান (রা:) নবী (সা:)-কে এমন আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন যা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে—রাসূল (সা:) উত্তরে বললেন, তুমি বেশি করে আল্ল¬াহর জন্য সেজদা-সালাত আদায় করতে থাক, কারণ তোমার প্রতিটি সেজদার কারণে আল্ল¬াহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ মাপ করবেন। (মুসলিম:৭৩৫ ) তিনি-সা. আরো বলেন— أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد فأكثروا الدعاء ( رواه مسلم:৭৪৪) বান্দা আল্ল¬াহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করে যখন সে সেজদারত থাকে। সুতরাং তোমরা সেজদার অবস্থায় বেশি বেশি প্রার্থনা কর। (মুসলিম:৭৪৪) ৫-সালাত পাপ মোচনকারী এবং ছোট ছোট গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ। রাসূল (সা:) বলেন:— الصلوات الخمس و الجمعة إلي الجمعة كفارة لما بينهن مالم يغش الكبائر ( رواه مسلم:৩৪৪) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমা হতে আরেক জুমা মধ্যবর্তী গুনাহ সমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হয়। (মুসলিম:৩৪৪) এবং রাসূল (সা:) গুনাহ প্রায়শ্চিত্তের একটি দৃষ্টান্ত এভাবে বর্ণনা করেন ; তিনি বলেন— أرأيتم لوأن نهرا بباب أحدكم يغتسل فيه كل يوم خمس مرا ت هل يبقي من درنه ؟ قالوا لا يبقي من درنه شيئ قال فكذالك مثل الصلوات الخمس يمحو الله بهن الخطايا) رواه مسلم:৪৯৭) যদি তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় একটি পুকুর থাকে আর তাতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কোন ময়লা আবর্জনা অবশিষ্ট থাকে ? সাহাবিরা উত্তরে বললেন, না। রাসূল সা. বলেন—অনুরূপ ভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ; আল্ল¬¬াহ তাআলা দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করা দ্বারা গুনাহ-পাপাচারগুলো ধুয়ে মুছে ফেলেন। (মুসলিম:৪৯৭) তিনি আরো একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে বলেন— إن العبد المسلم ليصلي الصلاة يريد بها وجه الله فتهافت عنه ذنوبه كما يتهافت هذا الورق عن هذه الشجرة. رواه أحمد:২০৫৭৬) মুসলিম বান্দা যখন একমাত্র আল্ল¬াহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করে তখন তার গুনাহ এমনভাবে ঝরে পড়তে থাকে যেমন এই বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। (আহমদ : ২০৫৭৬) ৬Ñসর্ব প্রথম বান্দার সালাতের হিসাব নেয়া হবে। তাতে হয় সে মুক্তি পাবে অথবা ধ্বংস হবে। নবী করিম (সা:) বলেন :— أول ما يحاسب به العبد يوم القيامة الصلاة فإن صلحت صلح سائر عمله وإن فسدت فسد سائر عمله. ( رواه الترمذي:২৭৮) কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি সালাত ঠিক হয় তবে তার সকল আমল সঠিক বিবেচিত হবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয় তবে তার সকল আমলই বিনষ্ট বিবেচিত হবে। (তিরমিযি:২৭৮) ৭সফলতা ও সম্মানিত স্থান জান্নাতে প্রবেশকে আল্ল¬¬হ তাআলা সালাতের উপরই স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন:— قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ﴿১﴾ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ ﴿২﴾. سورة المؤمن:১,২ মোমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা ও ভীতির সাথে দণ্ডায়মান হয়। (সুরা আল-মোমিন : ১-২) অতঃপর বলেন :— وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ ﴿৯﴾ أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ ﴿১০﴾ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿১১﴾ “আর যারা তাদের সালাতে যতœবান, তারাই জান্নাতের ওয়ারিশ—যারা ফিরদাউসের ওয়ারিশ হবে এবং তথায় তারা চিরকাল থাকবে।” (সুরা আল-মোমিন:৯,১০,১১) মনে রাখতে হবে সালাত যেহেতু আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল আল্ল¬াহর নৈকট্য লাভের ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ, সালাতের হেফাজত করলে মুক্তি, অন্যথায় ধ্বংস ইত্যাদি—তাই নি:সন্দেহে বলা যায় যে সালাত একটি মহান কাজ যার গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। আর তা বাস্তবায়িত হয় সালাত, তার বিধানাবলী তথা রুকন ও ওয়াজিবসমূহ শিক্ষা, সালাতে একাগ্রতা ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমেই।

 উল্লেখিত ফজিলত লাভের উপযোগী কে হবেন ? যার সালাতে নিম্ন বর্ণিত বিষয় পাওয়া যাবে, সেই একমাত্র উক্ত ফজিলত লাভের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। ১-শরয়ি পদ্ধতি—যে পদ্ধতিতে রাসূল (সা:) সালাত আদায় করতেন। শর্ত পূর্ণ করা, সালাতের রুকন ও ওয়াজিব যথাযথ ভাবে আদায় করা এবং সুন্নতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করতে চেষ্টা করা। ২- সালাত খুশু ও একাগ্রতার সাথে আদায় করা। আল্ল¬াহ বলেন:— قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ﴿১﴾ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ ﴿২﴾. سورة المؤمن:১,২ “মোমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা ও ভীতির সাথে দাঁড়ায়।” (সুরা আল-মোমিন:১,২) রাসূল (সা:) বলেন :— ما من مسلم تحضره صلاة مكتوبة فيحسن وضوءها وخشوعها وركوعها إلا كانت كفارة لما قبلها من الذنوب ما لم تؤت كبيرة وذالك الدهر كله. رواه مسلم :৩৩৫) “যে কোন মুসলমানের জন্য যখন ফরজ সালাতের সময় উপস্থিত হয়, অত:পর সে সুন্দরভাবে ওজু করে এবং সুন্দরভাবে রুকু সেজদা করে, এতে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যদি সে কোন কবিরা গুনাহ না করে, আর এভাবে সর্বদা চলতে থাকে।” (মুসলিম:৩৩৫) ৩-সময় মত সালাত আদায় করা— وقدسئل النبي صلي الله عليه وسلم أي العمل أحب إلى الله ؟ فقال الصلاة علي وقتها قيل ثم أي؟ قال بر الوالدين قيل ثم أي؟ قال الجهاد في سبيل الله) رواه البخاري:৪৯৬) রাসূল (সা:)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, আল্ল¬াহর নিকট কোন আমল সবচেয়ে বেশি প্রিয় ? তিনি বলেন—সময়-মত সালাত আদায় করা, আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে তিনি বলনে—মাতা পিতার সাথে সদাচরন করা। আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে বললেন আল্ল¬াহর পথে জিহাদ করা। (বোখারি:৪৯৬) ৪-মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করা। জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব। (জামাতের বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীতে করা হবে।)
 সালাত ফরজ হওয়ার হিকমত ও উপকারিতা:— আল্ল¬াহ সালাতকে তার ও বান্দার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন, আল্ল¬াহ অবশ্যই তার বান্দাদের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তার বান্দাদের অবস্থা ও স্বভাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তিনি মহা মর্যাদাবান-পরাক্রমশীল তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন। আল্ল¬াহ মানুষের স্বভাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, কারণ তিনি তাদের স্রষ্টা। তিনি বলেন— أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ ( الملك ১৪ ) “যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না ? তিনি সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবগত।” (সুরা মুলুক ) আল্ল¬াহ মানুষের দুর্বলতা, অক্ষমতা, দরিদ্রতা ও অভাব—সবই জানেন। তিনি এও জানেন যে, তাদের এমন এক মহা শক্তি বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন, যার নিকট তারা বিপদে আশ্রয় নিবে, তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে, অতপর আল্ল¬হ নিজেই তার বান্দাদের জন্য এর পথ ও প্রবেশদ্বার খুলে দেন—দৈনিক পাঁচ বার নির্দিষ্ট সময়ে বান্দা সে পথ ও প্রবেশদ্বারের ফটক খুলবে এবং এ ছাড়াও যখন ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। যেমন বলেন বকর আল মুযানী (রহ:)— হে বনী আদম-আদম সন্তান ! তোমার মত আর কে হতে পারে ? তোমার মাঝে আর মিহরাবের ও পানির মাঝে কোন বাধা অবশিষ্ট রইল না। যখনই তুমি চাও আল্লাহর দরবারে প্রবেশ করতে পার তোমার ও প্রভুর মাঝে কোন মধ্যস্থতা কারী নেই। মুসলিম বিন ইয়াছার বলেন, এমন স্বাদ আর কোন স্বাদগ্রহনকারীই উপভোগ করতে পারেনি, যেমনটি উপভোগ করেন ঐ ব্যক্তি যে আল্ল¬াহর সাথে নির্জনে কথোপকথন করে। আল্ল¬াহর- স্বীয় বান্দার প্রতি -অপার অনুগ্রহ হল, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের বিনিময়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব দান করবেন। এ মানুষের জন্য একটি মহান প্রতিদান, যাতে মানুষ এ সালাতকে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে এবং একে অধিক মনে না করে এবং তা আদায়ে কোন প্রকার অলসতা না করে। উলে¬খিত বিষয়গুলো অনুধাবন করা ছাড়াও সালাত ফরজ হওয়ার হিকমত ও কিছু উপকারিতা জানা অতীব জরুরি। আর তা নিম্নরূপ— ১-আল্ল¬াহর জিকিরের প্রতিষ্ঠা করা। সালাত মানুষকে তার স্রষ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং সালাতে অন্তরের উপস্থিতি প্রয়োজন। সালাত শুধু প্রাণহীন নড়াচড়ার নাম নয় এই সালাত সম্পর্কে রাসূল সা: বলেন :— (وجعلت قرة عيني في الصلاة) رواه النسائي:৩৮৭৮) সালাতেই আমার চোখ জুড়ানো ও শীতলতা নিহিত। (নাসাঈ:৩৮৭৮) এবং বেলাল রা: তিনি বলেন: أقم الصلاة وأرحنابها رواه أبوداود:৪৩৩৩) তুমি সালাতের ব্যবস্থা কর এবং তার মাধ্যমে আমাকে তৃপ্ত কর। (আবু দাউদ:৪৩৩৩) মূলত প্রকৃত মোমিনের জন্য সালাত এমন, মাছের জন্য পানি যেমন। মাছ পানি ছাড়া বাঁচতেই পারে না। অপর দিকে মুনাফেক দুর্বল ইমানদার সে সালাতে খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মত, যে কোন উপায়ে সে তা হতে মুক্তি চায়। ২-সালাত একজন মুসলমানের মনোবল চাঙ্গা করে এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে সে তার জন্য ইহকালীন জীবনের কষ্ট ক্লেশ এবং জাগতিক সকল প্রকার বিপদ আপদ মোকাবিলা করা সহজ হয়। আল্ল¬াহ বলেন :— وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ ﴿৪৫﴾ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ﴿৪৬﴾(البقرة ৪৫.৪৬) “এবং তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্যই তা কঠিন কিন্তু বিনীতগণের জন্যে নয়। যারা ধারণা করে যে নিশ্চয় তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে এবং তারা তারই দিকে প্রতিগমন করবে।” (সুরা বাকারাহ : ৪৫,৪৬) একারণেই যখন রাসূল সা: কোন বিষয়ে চিন্তিত হতেন তাড়াতাড়ি সালাতে মগ্ন হতেন। সালাতের মাধ্যমে একজন মোমিন সরাসরি তার প্রভুর সান্নিধ্য পৌঁছে। এবং আল্ল¬াহর নিকট বিপদাপদ ও দু:শ্চিন্তার কারণ গুলো তুলে ধরেন। তার রহমতের ফটক উন্মুক্ত বা খুলে দেয়ার জন্য আকুতি পেশ করেন। একজন সত্যিকার মোমিন অবশ্যই সালাতে তৃপ্তি, প্রশান্তি ও সন্তুষ্টি অনুভব করে। সে আল্ল¬াহ আকবর বলে সালাত আরম্ভ করার সময় অনুভব করে নিশ্চয় আল্ল¬াহ তাআলা সব কিছু হতে বড়। এবং সুরা ফাতেহা পড়ার সময় যখন—(আলহামদুলিল্লাহ) বলে তখন আল্ল¬াহর নেয়ামতের অনুভূতিতে তার মন ভরে যায়। আর যখন সে الرحمن الرحيم) ( পড়ে তখন সে অনুভব করে যে আমি রহমানের প্রতি কতই না মুখাপেক্ষী। তখন তার মানস্পটে আশা আরো বিশাল আকার ধারণা করে। আর যখন পড়ে (مالك يوم الدين) তখন আল্ল¬াহর বড়ত্ব ও ইনসাফের কথা তার অন্তরে ফুটে উঠে আর ভয়ভীতি অনুভূত হয়। অত:পর সে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, এবাদত একমাত্র আল্ল¬াহর জন্য, আর তা আদায় করতে হলে প্রয়োজন আল্ল¬াহর সাহায্য। সে প্রার্থনা করে এ বলে (–إياك نعبد وإياك نستعين ) অতঃপর সে স্মরণ করে যে, সে সর্বদা সঠিক পথের সন্ধান পাওয়ার মুখাপেক্ষী। তাই সে আল্লাহর নিকট দোয়া করে- إهدنا الصراط المستقيم রাসূল সা: জিকির পবিত্রতা ও সালাতের ভূমিকা ও প্রভাবের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন— يعقد الشيطان على قافية أحدكم إذا هو نام ثلاث عقد يضرب على كل عقدة عليك ليل طويل فارقد فإن إستيقط فذكر الله انحلت عقدة فإن توضأ انحلت عقدة فإن صلى انحلت عقدة فأصبح نشيطا طيب النفس وإلا أصبح خبيث النفس كسلان. ( رواه البخاري:১০৭৪) ٍ শয়তান ঘুমন্ত মানুষের ঘাড়ের পশ্চাতে তিনটি গিরা দেয়। আর প্রতিটি গিরায় সে বলে—আরে এখনও অনেক রাত বাকি তুমি ঘুমাও। আর যখন লোকটি ঘুম থেকে উঠে আল্ল¬াহর জিকির করে তখন একটি ঘিরা খুলে যায়। আর যখন ওজু করে তখন তার আর একটি গিরা খুলে যায় আর যখন সালাত পড়ে আর একটি গিরা খুলে যায়। ফলে সে সকাল করে আলস্য অকর্মা এবং অপবিত্র মন নিয়ে (বোখারি:১০৭৪ ) এবং কাফেররাও সালাতের পর আত্মতৃপ্তি ও অধিক কর্মোদ্যমী হওয়ার কথা স্বীকার করে। তাদের সালাতের যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে মুসলমানদের সালাতের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত ? ৩- সালাত মোমিনের অন্তর ও মনুষত্বকে শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করে এবং তাকে কল্যাণকর কাজে উৎসাহ জোগায় ও খারাপ কাজ হতে বিরত থাকার জন্য শক্তি জোগায়। এছাড়া সালাত অন্তরে আল্ল¬াহর ধ্যানকে বদ্ধমূল করে এবং ওয়াক্ত সংরক্ষণের প্রতিশ্র“তি পূরণে সমর্থন দেয় এবং প্রবৃত্তির চাহিদা ও আলস্যকে পরাজিত করে। আল্লাহ বলেন :— إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا ﴿১৯﴾ إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا ﴿২০﴾ وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا ﴿২১﴾ إِلَّا الْمُصَلِّينَ ﴿২২﴾ الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ ﴿২৩﴾ (المعارج১৯-২৩) মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থির চিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন হয় অতি কৃপণ। তবে নামাজিরা ব্যতীত, যারা তাদের সালাতে সদা নিষ্ঠাবান। (সুরা মাআরিজ ১৯-২৩) আল্লাহ আরো বলেন— وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ (العنكبوت ৪৫) এবং সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত রাখে। (সুরা আনকাবুত -৪৫)

 সালাত ত্যাগকারীর বিধান সালাত ত্যাগ করার মত আর কোন বড় গুনাহ হতে পারে না। সালাত ত্যাগ করার মানে হচ্ছে ইসলামের স্তম্ভ-খুঁটি ভেঙে চূর্ণবিচুর্ণ করা। ইসলামের মাঝে সালাত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও সালাত পরিত্যাগ করা যে কত বড় গুনাহ তা বর্ণনা দেয়ার অবকাশ রাখে না। আমরা কোরানের আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে আল্লাহ সালাত ত্যাগকারীদের নয়, বরং ভুলে সালাত আদায় করেনি এমন ব্যক্তিকে কঠিন হুমকি দিয়েছেন, আর যারা নামাজ ত্যাগকারী ও সালাত নষ্টকারী, তাদের কি পরিণতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।,দেখুন আল্লাহ সালাত ভুলে যাওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেন— فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿৪﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿৫﴾ (الماعون) “আর পরিতাপ সেই নামাজিদের জন্য, যারা তাদের সালাতে অমনোযোগী।” (সুরা মাঊন:৪-৫) সালাত বিনষ্টকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন— فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا (مريم:৫৯) “তাদের পর আসল অপদার্থ পরবর্তীগণ—তারা সালাত নষ্ট করল ও লালসা পরবশ হল ; সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সুরা মারয়াম :৫৯) অসংখ্য হাদিস দ্বারাও সালাত ত্যাগ কারীর ক্ষতি প্রমাণিত হয় এবং কোন কোন হাদিসে সালাত ত্যাগকারীকে কাফেরও বলা হয়। যেমন, রাসূল সা: এর বাণী, তিনি বলেন:— بين الرجل و بين الشرك و الكفر ترك الصلاة ) رواه مسلم:১১৬) ব্যক্তি ও কুফর-শিরকের মাঝে ব্যবধান হল সালাত ত্যাগ করা। (মুসলিম:১১৬ ) তিনি আরো বলেন— العهد الذي بينناوبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر . )رواه أحمد:২১৮৫৯) “আমাদের মাঝে আর অমুসলিমদের মাঝে চুক্তি হল সালাত, যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে যাবে।” (আহমদ:২১৮৫৯) রাসূল সা: জামাতে সালাত পড়া হতে বিরত থাকে এমন লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সমগ্র ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেন যে, যারা নামাজ ফরজ হওয়াকে অস্বীকার করে তারা কাফের, আর যারা সালাতের প্রতি উপহাস-বিদ্রƒপ ও সালাতকে গুরুত্বহীন মনে করে ছেড়ে দেয় তারাও কাফের। ওলামাগণ বলেন—আর যে ব্যক্তি সালাত ওয়াজিব হওয়াকে স্বীকার করে কিন্তু অলসতা বা অমনোযোগী হওয়ার কারণে সালাত ত্যাগ করে, তখন কর্তৃপক্ষ তাকে তওবা করার জন্য আদেশ দেবে। যদি সে তাওবা করে তাকে ক্ষমা করা হবে আর যদি তওবা না করে এবং সালাত ত্যাগের উপর অটল থাকে—তাকে হত্যা করার ব্যাপারেও সকলে ঐক্যমত পোষণ করেন। তার এ হত্যা করাটা কি হদ হিসেবে নাকি মুরতাদ বা কাফের হিসাবে ?—এ বিষয়ে ওলামাদের মাঝে মত পার্থক্য আছে। যারা বলেন হদ হিসাবে হত্যা করা হবে তাদের মতানুসারে তার জানাজা পড়া হবে, মুসলমানদের কবরে তাকে দাফন করা হবে, এবং মুসলমান উত্তর সুরীরা তার সম্পত্তিতে মীরাছ পাবে। আর যেসব ওলামা বলেন—তাকে কাফের হিসেবে হত্যা করা হবে, তাদের মতে তার উপর জানাজা পড়া হবে না, তাকে মুসলমানদের কবরে দাফন করা হবে না এবং তার সম্পত্তি মুসলমানদের বাইতুল মালে ‘মালে ফাই’ বলে গণ্য হবে তার পরিবার পরিজন কেউ ওয়ারিশ হতে পারবে না। সালাত ত্যাগের পরিণতির বিষয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তা করে দেখুন। সালাত ত্যাগী অবশ্যই প্রদীপ্ত আগুন তথা জাহান্নামের সন্নিকটেই অবস্থান করছে। তাই আমাদের উচিত খুব তাড়াতাড়ি তওবা করা এবং দ্রুত সালাত প্রতিষ্ঠা করা এবং সালাতে যতœবান হওয়া।

No comments:

Post a Comment