দর্শক সংখ্যা

Friday, March 22, 2013

আল্লাহ তাআলার দশ অসিয়ত


আল্লাহ তাআলার দশ অসিয়ত
লেখক : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
প্রথম কথা: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর পবিত্র কুরআনের সূরা আনআমে দশটি নির্দেশ উল্লেখ করেছেন মানুষের জন্য। এ দশটি নির্দেশ তিনি তিনটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন। প্রত্যেকটি আয়াতের শেষে তিনি বলেছেন, ‘এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের অসিয়ত করেছেন’। এ কারণেই এ নির্দেশগুলোকে ইমাম ও  মুফাসসিরগন এক কথায় ‘দশ অসিয়ত’ বলে অভিহিত করেছেন। আসলে এ দশটি বিষয় এমন যার মধ্যে মুসলমানদের দীন-ধর্ম, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নির্ভর করে। শুধু আল-কুরআনেই নয় অন্যান্য আসমানী কিতাবেও এ দশটি অসিয়তের কথা উল্লেখ রয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ ﴿১৫১ وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ﴿১৫২ وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿১৫৩
‘বল, ‘আস, তোমাদের প্রভূ তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন তোমাদেরকে তা পাঠ করে শুনাই। তা এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না, পিতা-মাতার প্রতি সদাচার করবে, দারিদ্র্যতার কারণে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি। প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে অশ্লীল নিকটবর্তী হবে না। আল্লাহ যাকে  হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত তোমরা তাকে হত্যা করবে না। তোমাদেরকে তিনি এ অসিয়ত করলেন, যেন তোমরা অনুধাবন কর’। (১৫১)
‘ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ব্যতীত তোমরা তার সম্পত্তির কাছে যাবে না এবং পরিমাণ ও মাপে ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দেবে। আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত ভার অর্পন করি না। যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায় পরায়ণতা অবলম্বন করবে, স্বজনদের সম্পর্কে হলেও। আর আল্লাহর সাথে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। তোমাদেরকে তিনি অসিয়ত করলেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’। (১৫২)
‘আর এ পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এর অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে। তিনি তোমাদের অসিয়ত করলেন, যেন তোমরা সাবধান হও’। (১৫৩)
(সূরা আল-আনআম : আয়াত -১৫১-১৫৩)
এ আয়াতগুলো হল সূরা আনআমের ১৫১, ১৫২ ও ১৫৩ নং আয়াত। এ তিনটি আয়াত সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন:
من أراد أن يقرأ صحيفة رسول الله صلى الله عليه وسلم التي عليها خاتمه فليقرأ هؤلاء الآيات. رواه الترمذي.
‘ যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহীফা পাঠ করতে চায় যার উপর তাঁর মোহর রয়েছে। সে যেন এ আয়াতগুলোকে পাঠ করে।’ বর্ণনায় : তিরমিজী
‘যার উপর তাঁর মোহর রয়েছে’ এর অর্থ হল:  এ আয়াতগুলো হল মুহকাম বা স্পষ্ট এবং  তার নির্দেশগুলো কোন অবস্থাতেই রহিত হবার  নয়।
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. আল-কুরআনের ব্যাখ্যায় খুবই খ্যাতিমান ছিলেন তিনি এ আয়াতগুলো সম্পর্কে বলেন:
في الأنعام آيات محكمات هن أم الكتاب ثم قرأ- قُلْ تَعَالَوْا .. . . أخرجه الحاكم
“সূরা আল-আনআমে কতগুলো মুহকাম আয়াত রয়েছে। এগুলো  আল-কুরআনের মূল বিষয়’। এ কথা বলে তিনি এ আয়াতগুলো পাঠ করতেন। বর্ণনায় : হাকেম
তাফসীরবিদগণ বলেন, দশটি অসিয়ত-সংবলিত এ তিনটি আয়াত ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করে, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
প্রথম আয়াতটিতে পাঁচটি অসিয়ত রয়েছে। দ্বিতীয়টিতে চারটি এবং তৃতীয়টিতে একটি। আর এর প্রতিটি আয়াত একটি অভিন্ন বাক্য দিয়ে শেষ করা হয়েছে। তাহলো:

ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ
“এটা, যা তিনি তোমাদেরকে অসিয়ত করলেন ”।
‘আদেশ’ বা ‘নির্দেশ’ শব্দ ব্যবহার  না করে ‘অসিয়ত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বিষয়বস্তুর গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে। চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় আদেশ-নির্দেশকে অসিয়ত বলা হয়ে থাকে। যেমন কোন ব্যক্তি মৃত্যুর সময় তার সন্তানদের অসিয়ত করে যান। এর অর্থ হলো এগুলো আমার জীবনের শেষ কথা। যা কখনো পরিবর্তন হবে না। যা আমি আমার স্বার্থে নয়, তোমাদের কল্যাণে তোমাদের স্বার্থেই বলে গেলাম। তোমরা এ থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না। এগুলো আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে চূড়ান্ত কথা।
এমনিভাবে এ দশটি অসিয়ত হলো মহান প্রভু, সর্বজগতের প্রতিপালক, সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ তাআলার অসিয়ত বা চূড়ান্ত নির্দেশ। এরপর তিনি আর কোন নির্দেশ দিবেন না। এ নির্দেশ পালন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষ ইহ-পরকালীন জীবনে সফলতা অর্জন করবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি সফলতা ও নিরাপত্তা অর্জনের এ এক অনন্য ব্যবস্থাপত্র।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আয়াতের শুরুতে তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেন,
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ
‘বলো, এসো আমি তোমাদের পাঠ করে শুনাই যা নিষিদ্ধ করেছেন তোমাদের প্রভু তোমাদের জন্য’। তাই এ নির্দেশসমূহ যেমন নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা জরুরি তেমনি অন্যকে তা শুনিয়ে দেয়াও অপরিহার্য।
এ তিনটি আয়াতের পূর্বের আয়াতগুলো দ্বারা বুঝা যায় যে, মুশরিকরা এমন কিছু বিষয়কে হারাম গণ্য করত, যা আল্লাহ হারাম করেননি। তারা ও তাদের পাদ্রী-পুুরোহিতরা নিজেদের পক্ষ থেকে তা হারাম করেছে। আসলে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো হারাম কিংবা হালাল করার অধিকার নেই। তিনিই কোন বিষয় হারাম করতে পারেন। তিনিই পারেন হালাল করতে। এ বিষয়টির প্রতি জোর দিয়ে আল্লাহ বলেছেনঃ
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ
“তুমি  বলো, আসো! আমি তোমাদের পাঠ করে শুনিয়ে দেই, যা  হারাম করেছেন তোমাদের প্রভূ তোমাদের জন্য।”
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো ইরশাদ করেন :
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ .
“তোমাদের জিহবা মিথ্যা আরোপ করে বলে, তোমরা বলোনা যে, এটা হালাল আর এটা হারাম। এ রকম বলে তোমরা  আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে থাকো। যারা আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যারোপ করে থাকে তারা সফলকাম হবে না।” সূরা আন-নাহল : ১১৬
কোন মানুষের ক্ষমতা নেই নিজেদের পক্ষ থেকে কোন বস্তুকে হারাম করবে, বা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাকে হালাল করবে।
হারাম হালালের বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত।
তাহলে আসুন, আমরা শুনে নেই আল্লাহ তার দশটি অসিয়তে কি হারাম করেছেন। আর কি করতে বলেছেন।
প্রথম অসিয়ত : শিরক বর্জন করা 
أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا
“তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না।”
ঘৃণ্যতম হারাম হল শিরক। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
আল্লাহ তাআলা লুকমান হাকীমের উপদেশ উল্লেখ করে বলেন :
لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
“তুমি আল্লাহর সাথে শিরক করবে না। নিশ্চয় শিরক মারাতœক অন্যায়।” সূরা লুকমান, আয়াত ১৩
শিরক এতবড় অপরাধ যে, আল্লাহ রাহমানুররহীম, ক্ষমাশীল হওয়া সত্বেও তা ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
“নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, তার সাথে শরীক করা-কে। তা ছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। যে কেহ আল্লাহর সাথে শরীক করে সে মহাপাপে আবদ্ধ হয়ে পড়ল।” সূরা আন-নিসা, আয়াত ৪৮
হাদীসে এসেছে -
يقول ابن مسعود قلت يا رسول الله أي الذنب أكبر؟ قال أن تجعل لله نداً وهو خلقك (متفق عليه)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সবচেয়ে মারাতœক অপরাধ কী? তিনি বললেন, “তুমি আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম
শিরক কাকে বলে?
আল্লাহর সৃষ্টি ও কর্তৃত্বে অন্য কারো কোন প্রকার দখল আছে বলে বিশ্বাস করা, আল্লাহর যে সকল নাম ও গুণাবলি রয়েছে তার কোন একটি বা একাধিক অন্য করো আছে বলে বিশ্বাস করা, ইবাদত হিসাবে যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহর জন্য নিবেদন করা উচিত, তার কোন কিছু আল্লাহ ব্যতীত অন্য করো জন্য নিবেদন করার নাম হল শিরক।
তাই মুলত শিরক তিন প্রকার :
এক. আল্লাহ তাআলার প্রভূত্ব ও কর্তৃত্বে শিরক :
আল্লাহ তাআলা আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবী ও তার মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই পরিচালনা করেন। সকল সৃষ্টির রিযক, জন্ম, মৃত্যু, কল্যাণ, অকল্যাণ তারই হাতে। তার কর্তৃত্ব ব্যতিরকে একটি পাতাও নড়ে না। এ বিষয়ে তার কোন সহযোগী নেই, নেই কোন অংশীদার। এ বিশ্বাস সকল মুসলমানের। শুধু মুসলমানেরই নয় এমনকি ইসলামপূর্ব যুগের মক্কার পৌত্তলিক-মুশরিরাও এ বিশ্বাস পোষণ করতো। তার এ কর্তৃত্বে ও প্রভূত্বে অন্য কারো অংশ আছে বলে বিশ্বাস করা হল শিরক।
দুই. আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে শিরক :
আল্লাহর যে সকল নাম রয়েছে এবং তার যে সকল গুণ রয়েছে তার কোনটি অন্যের জন্য নির্ধারণ করা হল শিরক। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা ও সর্বশ্রোতা। কোথায় কী হচ্ছে, তিনি সকল কিছু দেখছেন। কোন নবী, অলী, গাউস-কুতুব, ফেরেশেতা, দেব-দেবীর জন্য বা যে কোন সৃষ্টির জন্য এটা প্রয়োগ করা হল শিরক। এ গুণটা শুধু তারই। অন্য কারোর নয়।
তিন. ইবাদত বা উপাসনার ক্ষেত্রে শিরক:
যে সকল আকীদা-বিশ্বাস, কথা ও কাজ আল্লাহর জন্য নিবেদন করা হয়ে থাকে, তা অন্য কোন সৃষ্টির জন্য নিবেদন করা হল শিরক।
অর্থ্যাত ইবাদতের কোন কিছুই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য পেশ করা যাবে না। আর এ ক্ষেত্রেই অধিকাংশ মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
যেমন সেজদা দেয়া বা মাথা নত করা একটি ইবাদত। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা একটি ইবাদত। বিপদে-আপদের তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া একটি ইবাদত। তার কাছে দুআ করা একটি ইবাদত . . . .। এর কোন কিছু আপনি যদি কোন মানুষ, নবী, অলী, গাউস-কুতুব, ফেরেশতা, জিন, দেব-দেবী, প্রতিমার জন্য নিবেদন করেন তাহলে আপনি শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়লেন।
শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়লে মানুষের সকল সৎকর্ম নষ্ট হয়ে যায়। কোন ভালোকাজ আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
শিরকের বিপরীত হলো তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। আর এ তাওহীদ হল মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়। দীন-ধর্মের রক্ষা-কবচ হলো তাওহীদ। আর দীন- ধর্ম বিনষ্টকারী হলো শিরক। শিরক প্রত্যাখান করার উপরই হল দীনে ইসলামের মূল ভিত্তি। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রথম অসিয়তে এ বিষয়টিকে স্থান দিয়েছেন।
দ্বিতীয় অসিয়ত : মাতা-পিতার সাথে সদাচারণ 
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
“আর মাতা-পিতার সাথে সদাচারণ করবে।” অর্থাৎ আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন নিজ মাতা ও পিতার সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। তাদের অবাধ্য হওয়া ও তাদের কষ্ট দেয়া-কে হারাম করেছেন। তারা বিরক্ত হয় এমন কোন আচরণ করা যাবে না।
যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ﴿২৩﴾ وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا ﴿২৪﴾
“তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না ও পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপণীত হয় তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। এবং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।”
সূরা আল-ইসরা, আয়াত ২৩-২৪
এমনিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর কালামের একাধিক স্থানে তাঁর ইবাদত করার আদেশের সাথে সাথে মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মাতা-পিতা যদি কাফের বা মুশরিক হয় তবুও তাদের সাথে সদাচারণ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ . وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
“আমি তো মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দু বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। তোমার মাতা-পিতা যদি আমার সাথে শিরক করাতে তোমাকে পীড়াপীড়ি করে- যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই- তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সৎভাবে বসবাস করবে ।” সূরা লুকমান, আয়াত  ১৪-১৫
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে এমনিভাবে সাতটি স্থানে মাতা-পিতার সাথে সুন্দর ব্যবহার ও সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বুঝে আসে বিষয়টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া কত বড় অপরাধ।
হাদীসে এসেছে -
يقول ابن مسعود رضي الله عنه (سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم أي الأعمال أحب إلى الله؟ قال : الصلاة على وقتها، قلت ثم أي؟ قال ير الوالدين، قلت ثم أي ؟ قال الجهاد في سبيل الله.    متفق عليه.
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “সময় মত নামাজ আদায় করা।” আমি বললাম, এরপর কোন আমল আল্লাহর কাছে প্রিয়? তিনি বললেন, “মাতা - পিতার সাথে সুন্দর আচরণ ও সদ্ব্যবহার।” আমি বললাম, এরপর কোন আমলটি আল্লাহর কাছে প্রিয়? তিনি বললেন, “আল্লাহর পথে জিহাদ করা।”
বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম
পারিবারিক জীবনে শান্তি, সফলতা লাভ ও পরিবারের স্থিতি লাভ করতে মাতা - পিতার সুন্দর সেবা-যতœ ও সদাচারণের কোন বিকল্প নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন :
رغم أنف رجل أدرك عند أبواه الكبر فلم يدخلاه الجنة.  (رواه أحمد)
“ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় মলিন হয়ে যাক, যে বৃদ্ধ মাতা- পিতাকে পেল কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না।”
বর্ণনায় : আহমাদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন :
“মাতা - পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর মাতা - পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।” বর্ণনায় : তিরমিজী
তৃতীয় অসিয়ত : দারিদ্রতার কারণে সন্তান হত্যা না করা
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ.
“দারিদ্রতার কারণে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি।”
প্রথম অসিয়তে আল্লাহ নিজের অধিকারের কথা বললেন। দ্বিতীয় অসিয়তে আল্লাহ মাতা - পিতার অধিকারের কথা বললেন। তৃতীয় অসিয়তে আল্লাহ তাআলা সন্তানের অধিকারের কথা বলছেন। মাতা পিতা ও সন্তান বাদ দিলে মানুষের পারিবারিক জীবন বলতে আর কি থাকে? ইসলামে পরিবারকে এভাবেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সমাজ জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান ধাপ হল পরিবার। পরিবার ব্যতীত মানুষ মানুষে পরিণত হতে পারে না।
দারিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা করাকে আল-কুরআনের একাধিক স্থানে কঠোর ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের কাজের নিন্দা করা হয়েছে প্রচণ্ডভাবে। যেমন :
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا
“তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র-ভয়ে হত্যা করবে না। তাদেরকে আমিই রিয্ক দেই এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ।” সূরা আল-ইসরা, আয়াত ৩১
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ভবিষ্যত দারিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। আর সূরা আনআমের এ আয়াতে দারিদ্রতার কারণে সন্তান হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। কাজেই ফলাফল দাড়াল বর্তমান কিংবা ভবিষ্যত দারিদ্রতা, বাস্তব দারিদ্রতা কিংবা দারিদ্রতার আশংকা,  যে কোন কারণেই হোক, সন্তান হত্যা করা বিরাট অপরাধ
যে সকল সন্তানদের হত্যা করা হয়, হাশরের ময়দানে তাদেরকে উপস্থিত করে হত্যাকরীদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হিসাবে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন :
وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ ﴿৮﴾ بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ ﴿৯﴾
“যখন জীবন্ত-সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?” সূরা আত-তাকবীর, আয়াত ৮-৯
হাদীসে এসেছে
يقول ابن مسعود قلت يا رسول الله أي الذنب أعظم؟ قال : أن تجعل
لله ندا وهو خلقك، قلت ثم أي؟ أن تقتل ولدك خشية أن يطعم معك، قلت ثم أي؟ قال : أن تزاني حليلة جارك، ثم تلا رسول الله صلى الله عليه وسلم : وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا . يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا .
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! সবচেয়ে বড় পাপ কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তার সাথে তুমি যদি শরীক কর।” তারপর আমি প্রশ্ন করলাম, এর পরে সবচেয়ে বড় পাপ কী? তিনি বললেন, “তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে তুমি যদি তোমার সন্তানকে হত্যা কর।” আমি আবার প্রশ্ন করলাম তারপরে বড় পাপ কী? তিনি বললেন, “তুমি যদি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করো।” এ কথা বলে তিনি আল-কুরআনের এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا . يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا .
অর্থ : “যারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহ আহবান করে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরকে তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে এগুলো করে সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়।” সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৬৮-৬৯
হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে
সর্বাবস্থায়ই সন্তান হত্যা করা হারাম। দারিদ্রের কারণে হোক বা অন্য কোন কারণে বা কোন কারণ ব্যতীত। এ আয়াতে দারিদ্রতার কারণে সন্তান হত্যা করার নিষেধ এসেছে এ জন্য যে, জাহেলী যুগে দারিদ্রতার কারণে বা অপমানের ভয়ে সন্তান হত্যার প্রচলন ছিল।
সন্তান-সন্তদি, স্ত্রী পরিজন আল্লাহর নেআমাতসমূহের মধ্যে একটি বিরাট নেআমাত। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَةِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ . (النحل :৭২)
“আর আল্লাহ তোমাদের থেকেই তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন। এবং তোমাদের যুগল থেকে তোমাদের জন্য সন্তান-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছেন। তবুও কি তারা মিথ্যায় বিশ্বাস করবে এবং তারা আল্লাহর নেআমাত অস্বীকার করবে?” সূরা আন-নাহল, আয়াত ৭২
মাতা পিতা, স্ত্রী, সন্তানাদি, নাতী-নাতনী নিয়ে সংসার ও পরিবার যে আল্লাহ তাআলার কত বড় দান, কত বিশাল নেআমাত তা ঐ ব্যক্তি কিছুটা অনুধাবন করেছে যার এগুলো ছিল এখন নেই। কিংবা এখন আছে কিন্তু থেকেও নেই।
তাই সন্তান হত্যা করা একজন মানুষ হত্যা করার অপরাধ তো বটেই, সাথে সাথে আল্লাহর এ বিশাল নেআমাতকে প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে অপরাধী হবে।
বর্তমান পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজে পরিবার গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। আমাদের সমাজেও এর হাওয়া লেগেছে। ইসলামী সমাজে পরিবারের গুরুত্ব ও ভূমিকাকে কোন অবস্থাতে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। যা কিছু পারিবারিক শৃংখলার বিরুদ্ধে যায়, ইসলাম অবশ্যই তার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান।
মানুষ একটি ভুল দৃষ্টিভংগির উপর ভিত্তি করে সন্তান হত্যা করত। সেটি হল দারিদ্রতা বা দারিদ্রতার ভয়। পিতা মনে করত এ সন্তানের খাবার দাবারে দায়িত্বটা আমার নিজের। আমি কিভাবে এ দায়িত্ব পালন করব? কিন্তু তার এ ধারণাটা মোটেই ঠিক নয়। প্রতিটি প্রাণীর রিযক তথা জীবনোপকরণের দায়িত্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। তিনি বলেন :
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا.
“ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই।”
 সূরা হুদ, আয়াত ৬
তিনি আরো বলেন :
وَكَأَيِّنْ مِنْ دَابَّةٍ لَا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللَّهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“এমন কত জীবজন্তু আছে যারা নিজেদের খাদ্য বহন করে না। আল্লাহই রিয্ক দান করেন তাদেরকে ও তোমাদেরকেও, এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” সূরা আনকাবুত, আয়াত ৬০
এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, সন্তান হত্যা করা হারাম। কিন্তু সন্তান যেন জন্ম গ্রহণ করতে না পারে এ জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে কি হারামের মধ্যে গন্য হবে? সেটা কি আল্লাহর এ নিষেধের আওতায় পড়বে?
দারিদ্রতার ভয়ে নয়, বরং অন্য কোন কারণে যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তবে তা জায়েয বলে অনেক আলেম মতামত দিয়েছেন। কিন্তু যদি দারিদ্রতার কারণে কিংবা দারিদ্রতার ভয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা যে হারাম হবে, এতে কারো দ্বিমত নেই। এ আয়াতও তার প্রমাণ। আর আমাদের সমাজে দারিদ্রতার ভয় দেখিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য মানুষকে উৎসাহ দেয়া হয় এবং প্রচার চালানো হয়। এটা জায়েয হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে দারিদ্রতার ভয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা পৃথিবীতে চলে আসা একটি জীবন্ত সন্তান হত্যা করার মত সমান অপরাধ যে নয়, তাতে সন্দেহ নেই। তবে তা যে অপরাধ, এটা নি:সন্দেহে বলা যায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ অসীয়তের আলোকে।
চতুর্থ অসিয়ত : অশ্লীলতা পরিহার করা
وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.
“প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে অশ্লীল কাজের কাছে যাবে না”
এটি এমন একটি অসিয়ত যার উপর নির্ভর করে মুসলিম পরিবার ও সমাজের পবিত্রতা, শৃংখলা, সুখ, পারস্পারিক আস্থা ও ভালোবাসা। এটি যেমন বাহ্যিকভাবে ব্যক্তি ও পরিবারকে পবিত্র রাখে তেমনি আধ্যাতিœকভাবে তাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখে।
সকল প্রকার অশ্লীলতা-বেহায়াপনাই অপরাধ। এ আয়াতে অশ্লীল কাজ বলতে জেনা-ব্যভিচার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশাকে বুঝানো হয়েছে। এটি গোপনে করা যেমন অপরাধ তেমনি প্রকাশ্যে করা বা করে প্রকাশ করা আরো বড় অপরাধ।
ব্যভিচার সম্পর্কে আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন :
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
“আর ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।” সূরা আল- ইসরা, আয়াত ৩২
শুধু যেনা-ব্যভিচার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়নি, বরং তার ধারে-কাছে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে। যা কছিু তার দিকে আহবান করে, তার দিকে যেতে উৎসাহ যোগায় তার সবগুলোই নিষিদ্ধ।
এমন অনেক মানুষ আছেন যারা এ সকল অশ্লীলতা  থেকে পুত-পবিত্র থাকেন। কিন্তু অন্য লোকেরা এ গুলো করলে তার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন না। মনে মনে ভাবেন, এরা করে করুক। তাতে আমার কি আসে যায়। এগুলো তাদের করা ছাড়া উপায় নেই। এ বয়সে বা এ সমাজে এগুলোর প্রয়োজন আছে, ইত্যাদি মানসিকতা পোষণ করেন। এ সকল মানুষদেরকে আল্লাহর এ বাণীটি শুনিয়ে দেয়া যায় :
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آَمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
“যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন তোমরা জান না।” সূরা আন- নূর, আয়াত ১৯
পঞ্চম অসিয়ত : মানুষ হত্যা না করা
وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ
“আল্লাহ যা হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত তোমরা তা হত্যা করবে না।”
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের প্রাণ দান করেছেন, তিনি তা রক্ষা করবেন। এ প্রাণ হরণ করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। তার স্পষ্ট নির্দেশ ব্যতীত কোন মানুষকে হত্যা করা বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না। যে সকল ব্যাপারে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়েছেন শুধু সে সকল ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবেন। যেখানে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান শিথিল করে নিহত ব্যক্তির আতœীয়-স্বজনের সাথে বোঝা পড়া করে বা রক্ত পণ দিয়ে অব্যাহতি লাভের ব্যবস্থা দিয়েছেন সেখানে সে ব্যবস্থা বাস্তবায়ন না করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাও হত্যার মত অপরাধ।
একটু বিস্তারিত না বললে  বিষয়টি হয়তো স্পষ্ট হবে না। মনে করুন কাবীল  নামের  এক ব্যক্তি হাবীল নামক ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করল। আদালত স্বাক্ষ্য প্রমাণে রায় দিল যে, কাবীল, হাবীলের হত্যাকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই কাবীল-কে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। এখানে ইসলামী বিধান হল হাবীলের পরিবার যদি কাবীল-কে ক্ষমা করে দেয় কিংবা  কাবীলের কাছ থেকে রক্তপণ গ্রহণ করে, তাহলে কাবীলের প্রাণটা বেঁচে যায়। এতে কাবীলের পরিবারের যেমন কাবীলকে হারানোর বেদনা বহন করতে হবে না। তেমনি হাবীলের অসহায় পরিবারটি অর্থ পেয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতিতে কাজে লাগাতে পারবে। আর যদি হাবীলের পরিবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবীতে অটল থাকে, তাহলে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। অন্য কোন শক্তির ক্ষমতা নেই তা রোধ করার। এটা হলো ইসলামের বিধান। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা মুসলমান হয়েও ইসলামের এ কল্যাণকর বিধান থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশের আইনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে কোন মৃত্যুদণ্ড রহিত করার। এটি সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধী। রাষ্ট্রপতি যদি কাবীলের মৃত্যুদণ্ড রহিত করেন তাহলে হাবীলের পরিবারের লাভ কি হলো? অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে কাবীল জেল থেকে বের হয়ে নিহত হাবীলের পরিবারের জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। হাবীলের পরিবার হাবীলকে হারানোর বেদনা বহন করে এখন কাবীলের ভয়ে বাড়ী-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বৃটিশের গড়া মানুষগুলো এটতা ইসলাম বিদ্বেষী যে, তারা মনে করে ইসলামী আইন-কানুন যতই কল্যাণকর হোক তা বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ দেশে বৃটিশর রাজত্ব শেষ হয়েছে, কিন্তু তাদের গোলামী ও দাসত্বের অবসান হয়নি।
অন্যায়ভাবে শুধু মুসলমানদের হত্যা করা অপরাধ নয়। যে কোন মানুষকে হত্যা করাই অপরাধ। এ আয়াতে তাই মানুষকে হত্যা হারাম করা হয়েছে। হোক সে মুসলিম বা হিন্দু কিংবা অন্য ধর্মালম্বী।
মানুষ হত্যা কত জঘন্য অপরাধ তা আল্লাহ তাআলার এ বানী থেকেও অনুধাবন করা যায় :
أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا
“যে ব্যক্তি প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।” সূরা আল- মায়েদা, আয়াত ৩২
আল্লাহর এ অসিয়তের ভাষায় ‘যথাযথ কারণ ব্যতীত হত্যা করা’ হারাম বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন তাহলে যথাযথ কারণ কী, যা পাওয়া গেলে হত্যা করা যায় বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দিয়েছেন সে কারণগুলো। তিনি বলেছেন :
لا يحل دم إمرىء مسلم إلا بإحدى ثلاث- الثيب الزاني والنفس بالنفس والتارك لدينه المفارق للجماعة . متفق عليه
“তিনটি কারণের কোন একটি কারণ ব্যতীত মুসলমানের রক্ত প্রবাহ বৈধ নয় - বিবাহিত ব্যভিচারকারী, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ ও ইসলাম ধর্ম ত্যাগকারী মুসলিম সমাজে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী।” বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম
অর্থাত এ তিন কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করা বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া বৈধ নয়। যদি বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হয় ও তার ব্যভিচার প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়। যদি কেহ কাউকে হত্যা করে, তাহলে এর শাস্তি হিসাবে হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়। যদি কোন মুসলামান ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায় এবং মুসলিম সমাজ বা রাষ্ট্রে বিভেদ কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়।
এ সকল অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ও তা কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের। কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দল মৃত্যুদণ্ড দিতেও পারবে না। কার্যকর করতেও পারবে না। এটা ইসলামের বিধান।
মানুষ হত্যা কত বড় অন্যায়, আল্লাহ তাআলার আরেকটি বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারি। তিনি ইরশাদ করেন :
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
“কেহ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।”
সূরা আন-নিসা, আয়াত ৯৩
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ইসলাম ও মুসলিমদের শত্র“দের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অনেক দল নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করে থাকেন। তাদের আক্রমনে যারা নিহত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই নিরাপরাধ। এ সকল নির্বিচার আক্রমণ দ্বারা তারা শত্র“কে আতংকিত করতে চান কিংবা নিজেদের প্রচার প্রসারের লক্ষ্য স্থির করেন। বাস্তবে দেখা যায় এ ধরনের নির্বিচার আক্রমণ দিয়ে শত্র“কে আতংকিত করা যাচ্ছেনা বরং এতে তাদের হিংস্রতা, পাশবিকতা  ও বর্বরতা আরো বেড়ে যায়। সবেচেয়ে বড় কথা হলো এ ধরনের আক্রমণ যাতে নিরাপরাধ মানুষ নিহত হয়, ইসলাম কখনো অনুমোদন করে না। এ রকম কার্যকলাপ সম্পর্কে আল-কুরআনে যেমন নিষেধ আছে, আছে হাদীসেও। এ ছাড়া ইসলামে জিহাদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস আমাদের সামনে। সে ইতিহাসে এ ধরনের কোন দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুধুমাত্র শত্র“দের আঘাত করতে হবে অন্যকে নয়। এ ধরনের কার্যকলাপ দ্বারা তারা যেমন মানুষ হত্যার অপরাধে অপরাধী, তেমনি ইসলামের নামে এ অপকর্ম করে ইসলামের নকল চেহারা প্রদর্শনের অপরাধেও তারা অপরাধী।
হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে নির্বোধ ব্যক্তিরা যা করছে সে কারণে আমাদের পাকড়াও করো না। তাদের কারণে আমাদের শাস্তি দিও না।
এ পাঁচটি অসিয়ত করার পরে আল্লাহ তাআলা বলেন :
ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
“তোমাদেরকে তিনি এ অসিয়ত করলেন যেন তোমরা অনুধাবন কর।”
এ পাঁচটি অসিয়ত দুর্বোধ্য নয়। একেবারে সহজ সরল ভাবে, সহজ ভাষায় বলা হলো। যাতে তোমরা বুঝতে পারো। ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারো। আর এটা কোন হালকা বিষয় নয়। তোমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহর চুরান্ত অসিয়ত।
ষষ্ঠ অসিয়ত : ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস না করা
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ.
ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ব্যতীত তোমরা তার সম্পত্তির কাছে যাবে না
ইয়াতীমের সম্পদ ও তার স্বার্থ রক্ষা সম্পর্কে এ হল এক ঐশী অসিয়ত। ইয়াতীম হল, এমন শিশু যার পিতা মারা গেছে আর সে এখনো বয়ো:প্রাপ্ত হয়নি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শুধু ইয়াতীমের মাল আত্মসাত বা ভক্ষণ করতে নিষেধ করেননি বরং তার ধারে কাছে যেতেও নিষেধ করেছেন। তবে ইয়াতীম সম্পদ সংরক্ষণ, তার বৃদ্ধি ও তার জন্য খরচ করার লক্ষে ব্যবস্থা নিতে তার কাছে যাওয়া যাবে। যেমন এ আয়াতেই বলা হয়েছে ‘উত্তম ব্যবস্থা ব্যতীত’ ইয়াতীমের সম্পদের কাছে যেও না। উত্তম ব্যবস্থা বলতে ইয়াতীমের সম্পদ তারই জন্য খরচ, সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করা-কে বুঝায়।
ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাত বা ভোগ দখল করা কত বড় মারাত্মক অন্যায় তা এ আয়াত দিয়েও অনুধাবন করা যায়ঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
“যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করে, নিশ্চয় তারা স্বীয় উদরে আগুন ব্যতীত কিছুই ভক্ষণ করে না এবং সত্যিই তারা অগ্নি শিখায় উপনীত হবে।” সূরা আন- নিসা, আয়াত ১০
ইয়াতীম প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তার সম্পদ ভক্ষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এর অর্থ এ নয় যে, সে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার সম্পদ ভোগ করা যাবে। বরং এ কথার অর্থ হল: ইয়াতীম প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে তার সম্পদ তার কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَإِنْ آَنَسْتُمْ مِنْهُمْ رُشْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ
“অতঃপর যদি তাদের মধ্যে বিবেকবুদ্ধি পরিদৃষ্ট হওয়া লক্ষ কর, তবে তাদের ধন-সম্পত্তি তাদেরকে সমর্পণ কর।” সূরা আন-নিসা, আয়াত ৬
যে কোন মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাত করা বড় পাপ, তা সত্বেও বিশেষভাবে ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতের বিষয়ে ভিন্ন করে সাবধানবাণী এসেছে। বিষয়টি গুরুতর বিধায় এ অসিয়ত করা হয়েছে।
এ অসিয়তে আমরা ইয়াতীমের লালন-পালন ও তার কল্যাণে কাজ করার জন্য নির্দেশ লাভ করতে পারি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
أنا وكافل اليتيم في الجنة هكذا وأشار بالسبابة والوسطي وفرج بينهما. رواه البخاري .

“আমি এবং ইয়াতীমের লালন-পালনকারী জান্নাতে এমনিভাবে এক সাথে থাকব।” এ কথা বলে তিনি তার হাতের মধ্যমা ও তর্জনী অঙ্গুলিদ্বয় একত্র করে ও পৃথক করে দেখিয়েছেন। বর্ণনায় : বুখারী
সপ্তম অসিয়ত : ওযন ও পরিমাপে কম না দেয়া
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا.
“এবং পরিমাণ ও মাপে ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দিবে।”
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তারা যে লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়ে মাপে ও ওযনে পুরোপুরি দেয়, কম না দেয়। কেহ যেন তার অধিকারের চেয়ে বেশী ভোগ না করে। এমনিভাবে কেহ যেন তার অধিকারের চেয়ে কম না পায়।
মাপে কম দেয়ার এ খাছলতের কঠোর নিন্দা করেছেন, শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন আল্লাহ পবিত্র কুরআনে :
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ ﴿১﴾ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ ﴿২﴾ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ ﴿৩﴾ أَلَا يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوثُونَ ﴿৪﴾ لِيَوْمٍ عَظِيمٍ ﴿৫﴾ يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿৬﴾
“দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকদের নিকট হতে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন তাদের জন্য মাপে বা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে  মহাদিবসে? যে দিন দাড়াবে সকল মানুষ জগতসমূহের প্রতিপালকের সম্মুখে।” সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত ১-৬
নবী শুয়াইব আ. এর যুগে মানুষেরা মাপে ও ওযনে কম দিত। তাদের এ অভ্যাস থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহ শুয়াইব আ. কে প্রেরণ করেন তাদের কাছে। তিনি মাপে কম দেয়া থেকে তাদের বারণ করতে থাকলেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। ফলে আল্লাহ তাদের উপর গযব নাযিল করে ধ্বংস করে দেন। যেমন আল্লাহ তার বিবরণ দিয়েছেন আল-কুরআনে :
وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ وَلَا تَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِنِّي أَرَاكُمْ بِخَيْرٍ وَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ مُحِيطٍ ﴿৮৪﴾ وَيَا قَوْمِ أَوْفُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ ﴿৮৫﴾
“মাদইয়ানবাসীদের নিকট তাদের ভাই শুয়াইবকে আমি পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নাই। আর মাপে ও ওযনে কম দিও না; আমিতো তোমাদের সমৃদ্ধশালী দেখছি, কিন্তু আমি তোমাদের জন্য ভয় করছি এক সর্বগ্রাসী দিবসের শাস্তি।
হে আমার জাতি! তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে ঠিকমত মেপে দিবে ও ওযন করবে, লোকদের তাদের সামগ্রীতে কম দিবে না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে না।” সূরা হুদ, আয়াত ৮৪-৮৫
কিন্তু তারা নবীর আহবানে সাড়া দিল না। তারা মনে করল, তাদের অর্থনৈতিক ব্যাপারে নবীর কথা বলার কী প্রয়োজন আছে? নবী নামাজ পড়বেন। আল্লাহর গুনগান করবেন। লোকের তাদের অর্থনীতি ও  সম্পদের আদান-প্রদানে যা ইচ্ছা তা করবে। এখানে ধর্মের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন কী? আল্লাহ তাদের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন :
قَالُوا يَا شُعَيْبُ أَصَلَاتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا أَوْ أَنْ نَفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَاءُ إِنَّكَ لَأَنْتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ
“তারা বলল, হে শুয়াইব! তোমার নামায কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা যার ইবাদত করত আমাদের তা বর্জন করতে হবে অথবা আমরা আমাদের ধন-সম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও বর্জন করতে? তুমি তো অবশ্যই ধৈর্যশীল, ভাল মানুষ।” সূরা হুদ, আয়াত ৮৭
পরে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিলেন।
وَأَخَذَتِ الَّذِينَ ظَلَمُوا الصَّيْحَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دِيَارِهِمْ جَاثِمِينَ
“আর যারা সীমালংঘন করেছিল মহানাদ তাদের আঘাত করল, ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে নতজানু অবস্থায় পড়ে রইল।” সূরা হুদ, আয়াত ৯৪
এ অসিয়তটি করার পর আল্লাহ বলেন :
لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
“আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত ভার অর্পন করি না।” সঠিক মাপ ও ওযনে ক্রয়-বিক্রয় করা। ব্যবসা-বাণিজ্যে মানুষকে না ঠকানোর যে নির্দেশ আমি দিলাম তা পালন করা কঠিন কোন কাজ নয়। বরং মানুষ্য প্রকৃতি ও বিবেক এটাকে সমর্থন করে। এর বিপরীত আচরণকে সমর্থন করে না।
অষ্টম অসিয়ত : কথা ও কাজে ন্যায় ও সততা রক্ষা করা
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى
যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায় পরায়ণতা অবলম্বন করবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও।
যখন কারো সম্পর্কে কোন কথা বলা হয়, হোক তা সমালোচনামুলক বা কারো পক্ষে-বিপক্ষে স্বাক্ষ্য অথবা করো সম্পর্কে মুল্যায়ন কিংবা বিচার-ফয়সালা করা হয়, তখন অবশ্যই সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করতে হবে। ন্যায়পরায়ণতার সাথে কথা বললে তা যদিও শত্র“র পক্ষে যায় কিংবা আপনজনের বিপক্ষে যায় তবুও কোন ছাড় নেই। সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক কথাই বলতে হবে। এমনিভাবে যখন বিচার- ফয়সালা, শালিসি করা হবে তখন ন্যায় ভিত্তিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজ দলীয় - ভিন দলীয়, আতœীয়-পর, উচ্চ বংশীয়-নিম্ন বংশীয়, ধনী-গরীব নির্বিশেষে কারো সাথে বৈষম্য করা যাবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
“হে মুমিনগণ!  তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ় থাকবে আল্লাহর স্বাক্ষী স্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আতœীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে ধনী হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং তোমরা ন্যায় বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কেটে যাও তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।” সূরা নিসা, আয়াত ১৩৫
তিনি আরো বলেন :
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো ন্যায় বিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। ন্যায় বিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।”  সূরা মায়িদা, আয়াত ৮
আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ বাস্তবায়নে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত রেখেছেন তাঁরই প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিচারের ক্ষেত্রে কোন পক্ষপাতিত্ব করতেন না। কেহ করতে শুপারিশ করলে তিনি তা সহ্য করতেন না। তিনি আরো বলেছেন, বিচারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ও জুলুম করার কারণে দেশ, জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে মাত্র একটি হাদীস পেশ করা হল:
َعَنْ عَائِشَةَ رضِيَ اللَّهُ عَنْهَا ، أَنَّ قُرَيْشاً أَهَمَّهُمْ شَأْنُ المرْأَةِ المخْزُومِيَّةِ الَّتي سَرَقَتْ فَقَالُوا : منْ يُكَلِّمُ فيها رَسُولَ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، فَقَالُوا : وَمَنْ يَجْتَريءُ عَلَيْهِ إِلاَّ أُسَامَةُ بْنُ زَيدٍ، حِبُّ رسولِ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ،فَكَلَّمَهُ أُسَامَةُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم:্রأَتَشْفَعُ في حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ تَعَالى ؟গ্ধ ثم قام فاحتطب ثُمَّ قَالَ : ্র إِنَّمَا أَهلَكَ الَّذينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهمْ كَانُوا إِذا سَرَقَ فِيهم الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ ، أَقامُوا عَلَيْهِ الحَدَّ ، وَايْمُ اللَّهِ لَوْ أَنَّ فاطِمَةَ بِنْبتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتَ لَقَطَعْتُ يَدَهَا গ্ধمتفقٌ عليه .
“আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, কুরাইশ বংশের লোকেরা তাদের বংশীয় মাখযুম গোত্রের এক মহিলার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়ল। যে মহিলা চুরি করছিল। কুরাইশরা বলল, কোন ব্যক্তি এ মহিলার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের সাথে কথা বলতে পারে? তারাই বলল, যে উসামা বিন যায়েদ রাসূলের কাছে প্রিয়। সে এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলবে। উসামা মহিলাকে শান্তি না দেয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আবেদন করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে শুপারিশ করছ?” অথঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাড়ালেন, বক্তব্যে বললেন, “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো এ কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের মধ্যে যখন প্রভাবশালী, বংশীয় লোক চুরি করত তাকে ছেড়ে দিত (বিচার না করে)। আর যখন দুর্বল ব্যক্তি চুির করত তখন তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমা চুরি করত, তাহলে আমি তার হাতও কেটে দিতাম।” বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম।
লোকদের ধারনা ছিল, কুরাইশ হল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিজ বংশ। তার বংশের এক মহিলা চুরি করেছে। তাঁর কাছে শুপারিশ করলে হয়ত তিনি নিজের বংশ ও মহিলার সম্মানের দিক বিবেচনা করে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাফ জানিয়ে দিলেন, বিচারে কোন পক্ষপাতিত্ব চলতে পারে না। বংশ তো পরের কথা, আমার কলিজার টুকরা ফাতেমা যদি চুরি করে তাহলে তার উপরও শাস্তি প্রয়োগ করা হবে যথাযথভাবে। আর এ ধরনের অন্যায়-অবিচার ও আইন প্রয়োগ ও বিচারে বৈষম্য করা দেশ, জাতি ধ্বংশের একটি বড় কারণ।
এ জন্য অনেক মনীষি বলেছেন, ‘আল্লাহ কাফের রাষ্ট্র বা সরকারকে টিকে থাকতে দেন, সহ্য করেন, কিন্ত জালেম রাষ্ট্র ও সরকারকে  বরদাশত করেন না, ধ্বংস করে দেন।’ যদি তারা মুসলিম হয় তবুও। জুলুম করে ইসলামের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়া যাবে না।
এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর দশ অসিয়তের মধ্যে ন্যায়-বিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে স্থান দিয়েছেন।
আমাদের সমাজে আইন-প্রয়োগ, বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য মুলক আচরণ ব্যাপক ভাবে দেখা যায়। যাদের টাকা-পয়সা, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা দাপট আছে, তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ ও শাস্তি এক ধরনের। এমনকি তাদের জন্য আদালত ও জেল ভি আই পি গোছের। আর যাদের তেমন কিছু নেই তাদের ক্ষেত্রে আইন ও শাস্তির প্রয়োগ হয় কঠোরের চেয়েও কঠোর। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যেন আগেকার যুগের রাজা-বাদশাদের রাজপুত্র আর রাজ-কন্যার মত। তারা সাতটি খুন করলেও তা খুন বলে ধরা হতো না। এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল অবরোধের নামে যত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, যত মানুষ পিটিয়ে মেরেছে, তার কি কোন একটিরও বিচার হয়েছে? কেহ কি এর বিচারের দাবী তুলেছে? এটাইতো জুলুম। এ জুলুমের জন্যইতো দেশ, জাতি ধ্বংস হয়ে যায় বলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে গেছেন। ইতিহাসও তাই বলে।
যারা সংবাদ-পত্র বা বিভিন্ন মিডিয়াতে কাজ করেন, তাদের জন্য রয়েছে এ আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। অনেক সময় দেখা যায় তারা সংবাদ পরিবেশনে ন্যায়নীতির ধার ধারে না। সত্য ও মিথ্যা বলতে যেন তাদের অভিধানে কিছু নেই। যা ইচ্ছা তা প্রচার করে অপরকে অপমানিত করতে তাদের বিবেক কোন বাধা দেয় না।
এমনকি অনেক আলেম-উলামাকে দেখা যায় যে, কোন তুচ্ছ বিষয়ে কারো সাথে মতভেদ হলে তারা তাদের বিরোধী পক্ষকে গালিগালাজ করেন। গোমরাহ, বিভ্রান্ত, মুর্খ, ইসলামের শত্র“ ইত্যাদি বাক্য প্রয়োগ করতে দ্বিধা করে না। এটা আল্লাহর এ অসিয়তের চরম লংঘন। মানুষ যা বলে তার সব কিছুর ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করা হবে।
নবম অসিয়ত : আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পুরণ করা
وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا
আল্লাহর সাথে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে
রব হিসাবে ও উপাস্য বা ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সাথে সকল ওয়াদা পুরণ করতে হবে। যে সকল বিষয় এ দশ অসিয়তের মধ্যে উল্লেখ করা হয়নি তার সকল এ নবম অসিয়তে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। যা কিছু আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা হল আল্লাহর সাথে ওয়াদা পুরণ। যেমন সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা, চুরি করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা হল আল্লাহর সাথে ওয়াদা।
এ আয়াতের চারটি অসিয়ত শেষে আল্লাহ তাআলা বললেন,
ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
“তোমাদেরকে তিনি অসিয়ত করলেন, তোমরা যেন মনে রেখ ও  উপদেশ গ্রহণ কর।”
দশম অসিয়ত : কাফেরদের পথ অনুসরণ না করা ও বেদআত বর্জন করা
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ.
আর এ পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এর অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রদর্শিত এ সরল পথ হল আস-সিরাতুল মুস্তকীম। একমাত্র পথ, দ্বিতীয় কোন পথ নেই। নেই কোন বক্রতা, দ্বিমুখীতা বা পরস্পর বিরোধীতা। সত্য এ পথ একটাই। তাহলে আল-কুরআন ও সুন্নাহর পথ। যে পথ অনুসরণ করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম। আর বাতিল পথ ও মত হল অনেক। তাইতো আল্লাহ এ আয়াতে বললেন, “ভিন্ন পথগুলো অনুসরণ করবে না।”
হাদীসে এসেছে
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : إن رسول الله صلى الله عليه وسلم خط خطوطا بيده ثم قال هذا سبيل الله مستقيما وخطا عن يمينه وعن شماله ثم قال هذه السبل ليس منها إلا عليه شيطان يدعو إليه ثم قرأ وأن هذا صراطي مستقيما . . .

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার নিজ হাত দিয়ে একটি রেখা টানলেন, অতঃপর বললেন, “এটা হল আল্লাহর সরল পথ।” এরপর ডানে বামে অনেকগুলো রেখা টানলেন, অতঃপর বললেন, “এ গুলো হল বিভিন্ন পথ। এর প্রত্যেকটি পথে শয়তান আছে। সে এ পথের দিকে মানুষকে আহবান করতে থাকে। এরপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন,
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ.
আরই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এর অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে।” বর্ণনায় : নাসায়ী, আহমাদ, দারামী
যেভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুসরণ করেছেন, ঠিক সেভাবে যদি অনুসরণ না করা হয় তাহলেই সেটা হবে শয়তানের পথ। সেটা কখনো আস-সিরাতুল মুস্তাকীম বলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আস-সিরাতুল মুস্তাকীম ব্যতীত যত পথ ও মত আছে সব বাতিল। এগুলো সাধারণত দু ধরনের : (ক) কাফের বা অমুসলিমদের পথ। (খ) ইসলামের নামে এমন আচার-আচরণ, অনুষ্ঠান, ইবাদত যা কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এটা হল বেদআত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর এ দশম অসিয়তে উভয় প্রকার বাতিল পথসমূহ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। যদি কাফেরদের অনুসরণ করা হয় তাহলেও আস-সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। আবার যদি ইসলামের মধ্যে অবস্থান করে কেহ কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা অনুমোদিত নয় এমন কাজ বা আচার-অনুষ্ঠান  ধর্মীয় আচার হিসাবে  পালন  করে তাহলে আস-সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। উভয় পথই শয়তানের পথ।
এ বেদআত সম্পর্কে আল্লার রাসূল বহু হাদীসে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। বেদআতের শাস্তি উল্লেখ করেছেন।
ঈমান ও ইসলাম অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো নেআমাত মুসলমানদের। এ দশটি অসিয়তের প্রথমটিতে আল্লাহ তাআলা শিরক বর্জন করতে বলেছেন। শিরক বর্জন করলে ঈমানের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। আর সর্বশেষ অসিয়তে বেদআত বর্জন করতে বলেছেন। বেদআত বর্জন করলে ইসলামের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। ধর্মে বেদআত প্রবেশ করার কারণে  ধর্ম, অধর্মে পরিণত হয়ে যায়। খৃষ্ট ধর্ম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তেমনি ইসলামে যদি বেদআত প্রচলন করা হয় তাহলে ইসলামের মূল রূপ চলে যায়।
বেদআত কাকে বলে ?
যে বিশ্বাস বা কাজ আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীনে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা পালন করতে নির্দেশ দেননি সে ধরনের বিশ্বাস ও কাজকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত মনে করা, তা করলে সওয়াব হবে বলে বিশ্বাস করা ও পালন করার নাম হল বেদআত।
আলোচ্য এ তিনটি আয়াত বর্ণনা কালে প্রথম আয়াত শেষে আল্লাহ বললেন, ‘যাতে তোমরা অনুধাবন কর।’
দ্বিতীয় আয়াত শেষে বললেন, ‘যাতে তোমরা মনে রাখ ও উপদেশ গ্রহণ কর।’ তৃতীয় আয়াত শেষে বললেন, ‘যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহর ব্যাপারে সাবধানী হও।’
তাই বলা যায় প্রথমে বুঝতে ও শিখতে হবে। তারপরে মনে রাখার জন্য ও বাস্তবায়ন করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় তথা তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে।
এ আয়াতসমূহে বর্ণিত দশ অসিয়ত সম্পর্কে হাদীসে আরো এসেছে :
عن عبادة بن الصامت قال: قال رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم: (أيكم يبايعني على هؤلاء الآيات الثلاث، ثم تلا: (قل تعالوا أتل ما حرم ربكم) إلى ثلاث آيات، ثم قال: (من وفى بهن فأجره على الله، ومن انتقص منهن شيئاً فأدركه الله في الدنيا كانت عقوبته، ومن أخره إلى الآخرة كان أمره إلى الله إن شاء آخذه وإن شاء عفا عنه).
উবাদা ইবনে সামেত থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “তোমাদের মধ্যে কে আছে এ তিন আয়াতের বিষয়ে আমার হাতে বাইয়াত (শপথ) নেবে। এরপর তিনি এ আয়াত তিনটি পাঠ করলেন। অতঃপর বললেন, যে ব্যক্তি এ অসিয়তগুলো পালন করবে তার পুরস্কার আছে আল্লাহর কাছে। আর যে এর কোনটিতে শিথিলতা করবে আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়াতেই শাস্তি দিতে পারেন। আর যদি তিনি আখেরাত পর্যন্ত শাস্তিকে বিলম্বিত করেন, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছা তিনি শাস্তি দেবেন বা ক্ষমা করবেন।”  (তাফসীর ইবনে কাসীর)
এ তিনটি আয়াতে যে দশটি হারাম বর্ণনা করা হলো তা মনে রাখার সুবিধার্থে সংক্ষেপে এ রকম বলা যায়ঃ
এক. আল্লাহর সাথে শিরক করা
দুই. মাতা পিতার অবাধ্য আচরণ করা
তিন. দারিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা করা
চার. ব্যভিচার ও অশ্লীলতা
পাঁচ. অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা
ছয়. ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা
সাত. মাপে ওযনো কম দেয়া
আট. অন্যায় বিচার-ফয়সালা ও অন্যায় কথা বলা
নয়. আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদাসমূহ পূরণ না করা
দশ. কাফেরদের অনুসরণ ও বিদআতে লিপ্ত হওয়া
এ দশটি হারাম কাজ,কবীরা গুনাহ সন্দেহ নেই। এর সমমানের আরো যে সকল কবীরা গুনাহ বা মারাতœক পাপ আছে তা হলো : সূদ খাওয়া, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা, যাদু করা, সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া। এগুলোকে হাদীসে মুহলিকাত বা ধ্বংসাতœক পাপ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment