মানব
জীবনে ভ্রষ্টতা
লেখক
: সালেহ বিন ফাওযান আলÑফাওযান
অনুবাদ
: মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
আল্লাহ
তার ইবাদতের জন্য সমস্ত সৃষ্টি জগত সৃষ্টি করেছেন এবং ইবাদতের কাজে সহায়ক, তাদের জন্য
এমন রিযকের সকল ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ﴿৫৬﴾ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ ﴿৫৭﴾ إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ ﴿৫৮﴾ سورة الذريات
‘আমার
ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জ্বিন জাতি সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাইনা
এবং এটাও চাইনা যে, তারা আমাকে আহার্য যোগাবে। আল্লাহই তো রিয্ক দান করেন, তিনি প্রবল,
পরাক্রান্ত।
মানবাত্মাকে
যদি তার ফিতরাতের উপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে সে অবশ্যই আল্লাহর উলুহিয়াত তথা ইলাহ হওয়ার
স্বীকৃতি প্রদান করবে। আল্লাহর প্রতি ভালবাসা পোষণ করবে, তাঁর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে
কোন কিছুর শরিক করবেনা। কিন্তু যখন মানুষও জ্বিন শয়তান, তাদের সুন্দর অথচ প্রতারনামূলক
কথাবার্তা তার কাছে সুশোভিত করে তোলে, তখনই তার বিপর্যয় ঘটে এবং সত্যপথ থেকে সে দূরে
সরে যায়। কেননা তাওহীদ মানব প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যামন। আর শিরক হচ্ছে মানব প্রকৃতির
উপর অনুপ্রবিষ্ট একটি নুতন জিনিস।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿৩০﴾ سورة الروم
‘তুমি
একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর ফিতরাত (অর্থাৎ তাঁর দেয়া
সহজাত প্রকৃতি তথা সত্য ধর্মের) অনুসরণ কর, যে ফিতরাত অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নাই।
নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
كلًّ مَوْلُودٍ يُوْلَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أوْ يُنَصِّرَانِهِ أوْ يُمَجِّسَانِهِ (البخاري ومسلم)
‘প্রত্যেক
মানব শিশু ফিতরাত তথা ইসলামের উপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতাÑমাতাই তাকে ইয়াহুদী কিংবা খৃষ্টান
অথবা পৌত্তলিকে পরিণত করে দেয়।
সুতরাং
বনী আদমের আসল ও সহজাত প্রকৃতি হল তাওহীদমুখী। আর আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে সুদীর্ঘ
কাল ধরে আগত তার সকল বংশধরদের যুগে ইসলামই হল একমাত্র দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা।
আল্লাহ
তাআলা বলেনঃ
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ ﴿২১৩﴾ سورة البقرة
‘সকল
মানুষ একই জাতি সত্ত্বার অন্তর্ভূক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নবীদেরকে পাঠালেন সুসংবাদ
দাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসাবে।’
শিরকের
প্রচলন এবং আক্বীদার বিকৃতি নূহ আলাইহিস সালাম এর জাতিতেই প্রথম ঘটেছিল। তিনি ছিলেন
আল্লাহর প্রথম রাসূল।
إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِنْ بَعْدِهِ ﴿১৬৩﴾ سورة النساء
‘আমি
আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি যেমন করে ওহী প্রেরণ করেছিলাম নূহ এবং তাঁর পরবর্তী সকল
নবীগণের প্রতি।
ইবনে
আব্বাস রা. বলেনঃ আদম আলাইহিস সালাম ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মধ্যে দশটি প্রজন্ম অতিবাহিত
হয়েছে। এ সুদীর্ঘ সময়ের সকল মানুষ ইসলামের উপর ছিল। আল্লামাহ ইবনুল কাইয়েম বলেন এ কথাটি
নিশ্চিতরূপে সঠিক। কেননা সূরা বাক্বারার উল্লেখিত ২১৩ নাম্মার আয়াতে উবাই বিন কা‘বের
কিরআতে রয়েছে:
فاَخْتَلَفُوْافَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّيْن مُبَشِّرِيْن.
‘অতঃপর
তারা মতভেদ করলে আল্লাহ নবীগণকে পাঠালেন...।’
আর এ
ক্বিরাআতের পক্ষে সূরা ইউনুসের আয়াতটি সাক্ষ্য দিচ্ছে, যাতে আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلَّا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا ﴿১৯﴾ سورة يونس
‘আর সমস্ত
মানুষ একই উম্মতভুক্ত ছিল, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে।
এর দ্বারা
ইবনুল কাইয়্যেম র. এটাই সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন যে, নবীগণের প্রেরণের কারণ ছিল, বিশুদ্ধ
দ্বীন সম্পর্কে লোকদের মতভেদ। যেমন আরবের লোকেরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দ্বীনের উপর
ছিল। অতঃপর আমর বিন লুহাই আলÑখুযাঈ
নামক এক ব্যক্তি এসে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দ্বীনকে বদলে দিল এবং আরব ভূমিতে বিশেষ
করে হিজায প্রদেশ মূর্তি আমদানী করল। এভাবে আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে মূর্তি পূজা আরম্ভ
হয়ে গেল এবং এ পবিত্র শহর ও তার আশে পাশের অন্যান্য লোকালয়েও শিরক ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শেষ নবীরূপে প্রেরণ
করলেন। তিনি মানুষকে তাওহীদ ও দ্বীনে ইবরাহীমের প্রতি আহবান জানালেন এবং আল্লাহর পথে পূর্ণাঙ্গ জিহাদ করলেন।
শেষ পর্যন্ত তাওহীদ ও মিল্লতে ইবরাহীমের আক্বীদা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হল এবং মূর্তিসমূহ
ভেঙ্গে চুরমার করা হল। আল্লাহ তাঁকে দিয়ে দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলেন এবং সমস্ত জগতের
উপর স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করলেন। আর তাওহীদ ও রিসালাতের এই নীতির উপরই চলেছেন উম্মতের
নেতৃস্থানীয় শ্রেষ্ঠ যুগের ব্যক্তিবর্গ। পরবর্তী শতাব্দীসমূহে অজ্ঞতা ও মূর্খতার ব্যাপকতা
বেড়ে গেলো। অপরাপর ধর্মসমূহের বহুকিছু তাতে অনুপ্রবেশ করলো। অতঃপর
ভ্রষ্টতার প্রতি
আহবানকারী লোকদের কারণে এবং বুযুর্গ ও আওলিয়াদের প্রতি সম্মান ও মহব্বত প্রদর্শনার্থে
কবরসমূহে সৌধ তৈরী করার ফলে উম্মাতের বহু লোকের মধ্যে আবার শিরক ছড়িয়ে পড়ল। দোয়া করা,
সাহায্য প্রার্থনা, যবেহ করা ও মান্নতের ন্যায় নানা প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর
পরিবর্তে গায়রুল্লাহ পূজাÑঅর্চনা
শুরু হলো। আর এ ধরনের শিরকী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ নিজেদের কাজের এমন ব্যাখ্যা দিল
যে, এসব কাজে বুযুর্গদের ইবাদত করা হয়না, বরং এতে তাদেরকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ ও তাদরে
প্রতি মহব্বত প্রকাশ করা হয়। এ ধরনের ব্যাখ্যা দেয়ার সময় এই লোকেরা ভুলে যায় যে, প্রাথমিক
যুগের মুশরিকগণও এই একই কথার মাধ্যমে তাদের শিরকী কাজের দলীল পেশ করতেন। কেননা তারা
বলতোঃ
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى ﴿৩﴾ سورة الزمر
‘আমরা
তাদের ইবাদাত এ জন্যই করি যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।’
অতীত
ও বর্তমানে মানুষের মধ্যে শিরকের এ ঘনঘটা সত্ত্বেও অধিকাংশ মুশরিকগণ কিন্তু ‘তাওহীদুর
রুবুবিয়াত’ তথা রব হিসাবে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। আর তারা
শিরক করতে থাকে শুধুমাত্র ইবাদতের ক্ষেত্রে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ ﴿১০৬﴾ سورة يوسف
‘তাদের
অধিকাংশ আল্লাহে বিশ্বাস করে, সাথে সাথে শিরক ও করে।’
মানুষের
মধ্যে খুব কম লোকই ‘রব’ তথা বিশ্ব জাহানের পরিচালকের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। এ কম
সংখ্যক লোকের মধ্যে রয়েছে ফেরাউন, বিবর্তনবাদী নাস্তিকগণ এবং বর্তমান যুগের কমিউনিস্টগণ।
তারা যে ‘রব’ কে অস্বীকার করছে, তা হল তাদের হঠকারিতা। বরং সত্য কথা হলো তারা মনে মনে
ও ভেতরে ভেতরে ‘রব’ এর অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا ﴿১৪﴾ سورة النمل
‘তারা
অন্যায় ও অহংকার করে নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলো সত্য
বলে বিশ্বাস করেছিল।’
এদের
বিবেক ও বুদ্ধি কিন্তু সাক্ষ্য দেয় যে, প্রত্যেক সৃষ্টিরই কোন না কোন স্রষ্টা আছেন। এবং অস্তিত্বশীল প্রত্যেক বস্তুরই অস্তিত্বদানকারী
কেউ আছেন। আর সুক্ষ্ম ও নিয়মাতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত এ বিশ্বের যাবতীয় নিয়মÑকানুন
ও শৃংখলা তদারক করছেন নিশ্চয়ই কোন প্রাজ্ঞ সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ তদারককারী। একথা যে
অস্বীকার করবে, সে হয় বিবেক বুদ্ধিহীন নতুবা এমন হঠকারী যে, স্বীয় বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয়
করে দিয়েছে এবং নিজেকে বেওকুফ বানিয়ে ছেড়েছে। এ ধরনের লোকদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নাই।
No comments:
Post a Comment