আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব (পর্ব: ২)
ভাইয়ের উপর ভাইয়ের দায়িত্ব**-প্রয়োজনের সময়ে সঙ্গ দেয়া এবং পাশে দাঁড়ানো। এর বিভিন্ন স্তর হতে পারে-
প্রথমত: সর্বনিম্ন স্তর, অর্থাৎ যদি ভাই সাহায্য করে, তবে তাকে সাহায্য করা।
দ্বিতীয়ত: মধ্যবর্তী স্তর, অর্থাৎ সাহায্য প্রার্থনা ব্যতীতই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
তৃতীয়ত: সর্বোচ্চ স্তর, অর্থাৎ ভাইয়ের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অধিক গুরুত্ব প্রদান করা। আমাদের মহান পূর্বপুরুষদের মাঝে এমনও দৃষ্টান্তও বিরল নয় যে, কারো মৃত্যুর পর তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর অনবরত তার পরিবারকে সেবা দিয়ে গেছেন, তাদের প্রয়োজন সমূহ অভিভাবকের অনুরূপ পূরণ করেছেন- **ভাইয়ের উপস্থিতিতে কিংবা অনুপস্থিতিতে, সর্বাবস্থায় তার দোষ-ত্র“টি উল্লেখ হতে বিরত থাকা। এবং সরাসরি তার বিরোধিতায় লিপ্ত না হওয়া—তবে বিষয়টি যদি আমর বিল মা’রুফ ও নেহি আনিল মুনকারের পর্যায়-ভুক্ত হয়, তবে তা বৈধ এবং সিদ্ধ বলে গণ্য হবে। **তার ভুল-ত্র“টিকে ক্ষমা সুন্দর মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখা। ত্রুটিহীন মানুষের কল্পনা এক অবাস্তব কল্পনা, এটি ভিত্তিহীন একটি বিষয়। বরং, যে ব্যক্তির মাঝে অনুত্তমের তুলনায় উত্তম আচরণ অধিক-হারে বিদ্যমান, সেই আমাদের কাছে পরম ব্যক্তিত্ব। ইবনে মুবারক রহ. বলেন, মোমিন অপরের মাঝে অপরাগতার সন্ধান করে, আর মোনাফিক খুঁজে বেড়ায় ত্র“টি ও পদস্খলন। **ভালো এবং মন্দ—উভয় অবস্থায় তাকে সহায়তা প্রদান করা। **ভাইয়ের কষ্টকে বরদাশত না করা, এবং তার প্রতিকারার্থে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভাইয়ের দু:খ-কষ্টে ভারাক্রান্ত হওয়া। **সাক্ষাৎকালীন সালাম প্রদান। তার ডাকে সাড়া দেওয়া। অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া। ইন্তেকাল করলে জানাজায় শরিক হওয়া। যদি উপদেশ প্রার্থনা করে, তবে সৎ উপদেশ প্রদান করা। **ভাইয়ের কল্যাণে উৎফুল্ল হওয়া, এবং কল্যাণ পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান, যেভাবে মানুষ নিজের কল্যাণে উৎফুল্ল হয়ে উঠে এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় রত হয়। **মুসলিম ভাইদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : —জালেম এবং মাজলুম—উভয় অবস্থায় তুমি তোমার ভাইকে সহযোগিতা কর। এক ব্যক্তি বলল, যখন ব্যক্তি মাজলুম হবে তাকে সহযোগিতা করব। কিন্তু যখন সে জালেম হবে, তাকে কীভাবে সহযোগিতা করব ? রাসূল বললেন : তোমরা তাকে জুলুম হতে বাধা প্রদান করবে, এটিই তার জন্য সহযোগিতা।
এ হাদিস ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইবনে উসাইমিন রহ. বলেন : উক্ত হাদিসে প্রশ্নকারী বলেছিল : হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি বলুন, যদি সে জালেম হয়, তবে কীভাবে তাকে সহযোগিতা করব ? সে কিন্তু এ কথা বলেনি যে, এ অবস্থায় আমি তাকে সহযোগিতা করব না। সে বরং, বলেছে, আমি কীভাবে তাকে সহযোগিতা করব ? অর্থাৎ তাকে তো অবশ্যই সহযোগিতা করব, কিন্তু তার প্রক্রিয়াটি কি হবে ? রাসূল এর উত্তরে বলেছেন : তাকে জুলুম হতে বাধা প্রদান করবে, এটিই তার জন্য সহযোগিতা। যদি দেখ জালেম মানুষের উপর অত্যাচার করছে, তবে তাকে বাধা প্রদান করবে, এটিই তার জন্য সহযোগিতা। এ হাদিসের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, উক্ত প্রক্রিয়ায় জালেম এবং মাজলুম—উভয়কে সহযোগিতা করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য- **কঠিন বিষয়গুলো তার জন্য সহজ করে তোলা। **সর্বদা তার জন্য দোয়া করা। **উপদেশ প্রদান। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত- তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মোমিন তার ভাইয়ের জন্য আয়না তুল্য, মোমিন অপর মোমিনের ভাই স্বরূপ। সে তার সম্পদ রক্ষা করে এবং তার অবর্তমানে তা হেফাজত করে।
**মানুষের জন্য নয়, আল্লাহর জন্য এখলাস ও বিশ্বস্ততা অবলম্বন করা। বিশ্বস্ততার মর্ম হচ্ছে সহমর্মিতা ও ভালোবাসার উপর অটল থাকা এবং ব্যক্তির মৃত্যু অবধি, এমনকি, মৃত্যুর পরও অব্যাহত রাখা। মৃত্যুর পর—কারণ, অপরের প্রতি ভালোবাসার প্রাপ্তি পরকালীন, পার্থিব নয় কোন অর্থেই। যদি মৃত্যুর পূর্বে তাতে ব্যাঘাত ঘটে, তবে এ যাবৎকালের সব কিছু বিফলে পর্যবসিত হবে। খাদীজা রা.-এর জীবৎকালে যে নারী রাসূলের পরিবারে যাতায়াত করতেন, পরবর্তীতে তার অনুপস্থিতিতে যখন উক্ত নারী রাসূলের দরবারে আগমন করতেন, তিনি তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। এ ঘটনাটি এ বিষয়টির জন্য সর্বোত্তম দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। **সহজ আচরণে তাকে আপ্লুত করা, অতিরঞ্জন এবং কঠিন আচরণ পরিহার করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম জাফর সাদেক বলেন : আমার কাছে সে ভাইয়ের সাহচর্য কষ্টকর, যে আমার কাছে নিজেকে উপস্থিত করে কঠিন করে, এবং আমি তার থেকে বেঁচে থাকি। আর সহজ এমন ব্যক্তির সাহচর্য, যার সাথে আমি নিজের মত থাকতে পারি। যেভাবে আমি একাকী থাকি, সেভাবে তার সাথেও কাটাতে পারি। **আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর সাক্ষাৎ করা। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
আমি কি তোমাদের জান্নাতীদের সুসংবাদ দেব না ? নবী জান্নাতে অবস্থান করবেন, শহীদ জান্নাতে অবস্থান করবেন, সিদ্দীক জান্নাতে অবস্থান করবেন, নবজাতক জান্নাতে অবস্থান করবে এবং যে ব্যক্তি শহরের কোথাও তার ভাইয়ের সাথে আল্লাহর জন্য মিলিত হয়, জান্নাতে অবস্থান করবে।
শোভনীয় সামাজিকতা-
উত্তম সামাজিকতার শোভা হচ্ছে অহংকারহীন গাম্ভির্যে নিজেকে পূর্ণ করে তোলা। লাঞ্ছনা এড়িয়ে নিজেকে বিনয়ের ভূষণে সজ্জিত করা। ভয় এবং তাচ্ছিল্য পরিহার করে স্মিত মুখে শত্র“ কিংবা বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করা। যখন তুমি ভরা মজলিসে অবস্থান করবে, তখন অযথা নাকে আঙুল দেয়া পরিহার করবে, হাই তোলা, থুথু ফেলা, ইত্যাদি বর্জন করবে। বক্তার প্রতি মনোনিবেশ করবে পরিপূর্ণভাবে। অযথা পিছনে ফিরে তাকাবে না। হাসি তামাশা এড়িয়ে যাবে। ভ্রাতৃত্বের উদ্বোধক-
কিছু মৌলিক আচরণীয় নীতিমালা রয়েছে যার সঠিক অনুবর্তনের ফলে মানুষের মনে গভীর হৃদ্যতা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে উঠে। তার অন্যতম হচ্ছে ভালো-মন্দ যাবতীয় ক্ষেত্রে নিজের সাথে অপরের তুলনা করা এবং সে অনুসারে অপরের সাথে আচরণ করা। পরস্পর সহমর্মিতা, ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের আদান-প্রদান, আন্তরিকতার বহি:প্রকাশের মাধ্যমে। হাদিসে এসেছে—তোমরা পরস্পর মোসাফাহা কর, বিদ্বেষ লোপ পাবে। একে অপরকে হাদিয়া প্রদান কর, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। এবং ঘৃণা দূরীভূত হবে। পারস্পরিক সালাম ও হাদিয়া প্রদান বিদ্বেষী মনোভাব গলিয়ে দিয়েছে, একে-অপরের মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি করেছে—এমন দৃষ্টান্ত আমরা অহরহ দেখতে পাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : —
সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ ! তোমরা ঈমান আনয়ন ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পারস্পরিক হৃদ্যতা ব্যতীত তোমাদের ঈমান আনয়ন পূর্ণাঙ্গ হবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছুর সন্ধান দেব না, যা পালন করলে তোমরা একে অপরে হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে ? তোমরা নিজেদের মাঝে সালামের প্রচলন ঘটাও।
ভাইয়ের প্রতি সহমর্মিতা ও হৃদ্যতার সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছে তার অনুপস্থিতিতে, অজ্ঞাতে তার জন্য দোয়া করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
মুসলিম তার ভাইয়ের অজ্ঞাতে তার জন্য যে দোয়া করে, তা কবুল করা হয়। (দোয়াকালীন) তার সম্মুখে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকেন, যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দোয়া করে, নিয়োজিত ফেরেশতা বলেন : আমিন,তোমাকেও এরূপ প্রদান করা হোক।
ইমাম নববী রহ. বলেন : মহান সালাফগণ যখনই নিজের জন্য দোয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন ভাইয়ের জন্য অনুরূপ দোয়া করতেন। কারণ, এর ফলে তার দোয়া কবুল করা হয় এবং ভাইয়ের জন্য দোয়ার সমপরিমাণ তাকেও প্রদান করা হয়। মানুষের মাঝে এ জাতীয় হৃদ্যতার সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ় করে তোলে অপরের সাথে স্মিত সম্ভাষণ, বিনয় ও করুণার আচরণ, আন্তরিক উপস্থাপন। এভাবে, যাবতীয় মতবিরোধ লোপ পায়, বিদ্বেষ বিলুপ্ত হয়, দৈহিকভাবে নানা কাঠামে বিভক্ত হলেও, মানুষ আন্তরিকভাবে হয়ে উঠে এক, সুমহান ঐক্যে একই মনোভাবনার অভিলাষী। ফুজাইল বিন আয়াজ—আবেদুল হারামাইন—মন্তব্য করেন : ব্যক্তি তার সঙ্গীদের সাথে হৃদ্যতামূলক আচরণ করা, উত্তম সামাজিকতার অনুবর্তী হওয়া রাত জেগে এবাদত এবং দিনভর রোজা রাখার চেয়ে উত্তম। ভ্রাতৃত্বের সুফল- আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন : وَاعْتَصِمُوابِحَبْلِاللَّهِجَمِيعًاوَلَاتَفَرَّقُواوَاذْكُرُوانِعْمَةَاللَّهِعَلَيْكُمْإِذْكُنْتُمْأَعْدَاءًفَأَلَّفَبَيْنَقُلُوبِكُمْفَأَصْبَحْتُمْبِنِعْمَتِهِإِخْوَانًا. তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্র“ এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।
ভ্রাতৃত্ব আল্লাহ প্রদত্ত এক পরম নেয়ামত, তিনি প্রিয় বান্দা ও নির্বাচিত বন্ধুদের তা দান করেন। ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে ফুল ও পল্লবে শোভিত এক বরকতপূর্ণ বৃক্ষ, নানাভাবে নিরবধি যা ফলদায়ক। ভ্রাতৃত্বের অন্যতম সুফল এই—- -**ঈমানের স্বাদ অনুভব, এবং সৌভাগ্যবানদের জীবন উপভোগ করা যায়। -**ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধদের আল্লাহ তাআলা তার করুণা দ্বারা পরিবেষ্টন করে রাখেন। কেয়ামতের ভয়াবহ দিবসে তাদের রক্ষা করেন। -**আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ব ও হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ যারা, তারা শান্ত ও উৎফুল্ল সময় যাপন করে, যেদিন একমাত্র আল্লাহ পাকের আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, এবং সেদিন যে-সাত শ্রেণির লোকদের ছায়া প্রদান করবেন, তারা তাদের অন্যতম হিসেবে গণ্য হবেন। আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত এক মুত্তাফাক আলাইহি হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তার ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোন ছায়া থাকবে না...(তাদের মাঝে তিনি উল্লেখ করেন)...এমন দু ব্যক্তিকে, যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছে। তার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাকেই কেন্দ্র করে।
**যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে-অপরে ভালোবাসায় আবদ্ধ হন, তারা অনুভব করেন এক অনাবিল আন্তর স্বাদ, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
**আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এক মজবুত রজ্জু, যে ব্যক্তি একে আঁকড়ে থাকবে, সে নাজাত পাবে।
আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব বাস্তবায়নে প্রতিকূলতা ও বিপদ- আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনার পরও, পাঠক বিশেষের মন্তব্য হতে পারে, এ প্রক্রিয়ার অনৈতিক দিকগুলো এড়ানো এবং তাকে যথার্থ অর্থে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা রূপে রূপায়ণ করার রক্ষাকবচ কি হবে ? এর বিবিধ ভালো দিক রয়েছে, এবং তুলনায় সেগুলোই অধিকাংশ সন্দেহ নেই, কিন্তু এর সংঘটনে, পাশাপাশি, রয়েছে এমন কিছু প্রতিকূলতা ও বিপদ যা এড়িয়ে যাওয়া এবং যা হতে নিজেকে রক্ষা অতীব আবশ্যক। নিম্নে আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা উপস্থাপনে প্রয়াস পাব-
প্রথম বিপদ : স্বার্থপরতা, আমিত্ব, অহমিকা মানুষের মাঝে যদি স্বার্থপরতা ও আমিত্ব প্রকট হয়ে দেখা দেয়, তবে তা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, নষ্ট হয়ে যায় একে একে তার চরিত্রের যাবতীয় গুণ-বৈশিষ্ট্য। অহমিকা যদি হয়ে উঠে ব্যক্তির চরিত্রের প্রধান উপাদান, তবে লোপ পায় তার কল্যাণ, জেগে উঠে তার মাঝে এক কঠিন দুরাচারী সত্তা। তাকে আবদ্ধ করে সংকীর্ণ এমন এক ইতর বলয়ে, যেখানে সে নিজেকে ব্যতীত ভিন্ন কাউকে দেখতে পায় না। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : অহংকার হচ্ছে সত্যের অপলাপ, এবং মানুষের সাথে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।
দ্বিতীয় বিপদ : অপরের সাথে তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রপ ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করে চূড়ান্তভাবে। মূর্খতা ও অনবধানতার ফলে মানুষের মাঝে এ আচরণের উদ্ভব ঘটে। দুর্বলের দৌর্বল্যের দাবিই হচ্ছে তাকে সহায়তা করা। বিভ্রান্তকে ঠাট্টা নয় ; পথ দেখানোই হচ্ছে মানবিকতা।
তৃতীয় বিপদ : বংশ ও বিত্ত নিয়ে গর্ব- মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সংরক্ষণ ও রূপায়ণ, তাদের মাঝে চাপিয়ে দেওয়া শ্রেণিভেদ দূরীকরণ, সামাজিক যাবতীয় সাম্য সংঘটনের লক্ষ্যে ইসলাম বংশ অহমিকাকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। কারণ, আদম আ. মানব জাতির পিতা, এবং সেই সূত্রে সকলই একই বংশের, একই রক্তের উত্তরাধিকারী। কারো মাঝে কোন তারতম্য নেই।
চতুর্থ বিপদ : মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লাহর আইনকে মান্য না করা ইসলাম সমাজব্যবস্থার অনুবর্তনই তার সদস্যদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব সংঘটনের অন্যতম চালিকাশক্তি। এ সমাজব্যবস্থার অন্যতম গুণ হবে এই যে, এর সদস্যরা একে অপরকে ভালোবাসবে আল্লাহর জন্য, তারই জন্য বিদ্বেষ পোষণ করবে অপরের প্রতি, দান করবে তারই জন্য, দানের হাত গুটিয়ে নিবে তারই স্মরণে। এমন সমাজ ব্যবস্থার প্রধান চালিকা শক্তি প্রণোদনা হবেন মহান আল্লাহ তাআলা। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে : فَلَاوَرَبِّكَلَايُؤْمِنُونَحَتَّىيُحَكِّمُوكَفِيمَاشَجَرَبَيْنَهُمْثُمَّلَايَجِدُوافِيأَنْفُسِهِمْحَرَجًامِمَّاقَضَيْتَوَيُسَلِّمُواتَسْلِيمًا.
অর্থ : কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ ! তারা মোমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার উপর অর্পণ না করে ; অত:পর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।
পঞ্চম বিপদ : আল্লাহ প্রদত্ত বিধান পরিত্যাগ- শায়খুল ইসলাম ইবনে তাই-মিয়া বলেন : মূর্খতা কিংবা প্রবৃত্তির প্রতারণার শিকার হয়ে মানুষ যখন আল্লাহর দেয়া বিধান পরিত্যাগ করে, তখন তাদের মাঝে জন্ম নেয় শত্র“তা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কারণ, তখন সকলের সম্মিলিত কোন দায় থাকে না যাকে কেন্দ্র করে তারা একত্রিত হবে। তারা, বরং, বিভক্ত হয়ে পড়ে, তুষ্ট থাকে যে যার মতিতে। উল্লেখিত প্রতিকূলতা ও বিপদকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনের মুণ্ডনকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরশাদ করেন : পারস্পরিক বিশৃঙ্খলাই মুণ্ডনকারী। আমি বলছি না যে, তা চুল মুণ্ডন করে, বরং তা দীন মুণ্ডন করে। আমরা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
www.facebook.com/pages/Al-Quran-Modern-Science/140069416050931
No comments:
Post a Comment