দর্শক সংখ্যা

Wednesday, February 20, 2013

শিশুদের লালন-পালন [মাতা-পিতার দায়িত্ব ও সন্তানের করণীয়]- ১

শিশুদের লালন-পালন
[মাতা-পিতার দায়িত্ব ও সন্তানের করণীয়]- ১
মূল: শাইখ মুহাম্মাদ ইবন জামীল যাইনূ রহ. অনুবাদ: জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
প্রথমে লোকমান আ. তার ছেলেকে যেভাবে উপদেশ দিয়েছেন, তা আলোচনা করা হল। কারণ, লোকমান আ. তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণ যোগ্য যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তা কুরআনে করীমে উল্লেখ করে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য তিলাওয়াতে উপযোগী করে দিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্তের জন্য তা আদর্শ করে রেখেছেন। লোকমান আ. তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন তা নিম্নরূপ: মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ
অর্থ, “আর স্মরণ কর, যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল...।” এ উপদেশগুলো ছিল অত্যন্ত উপকারী, যে কারণে মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে লোকমান হাকিমের পক্ষ থেকে উল্লেখ করেন।  

প্রথম উপদেশ: তিনি তার ছেলেকে বলেন,
﴿يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾
অর্থ, “হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।” এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথমে তিনি তার ছেলেকে শিরক হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। একজন সন্তান তাকে অবশ্যই জীবনের শুরু থেকেই আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাসী হতে হবে। কারণ, তাওহীদই হল, যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার একমাত্র মাপকাঠি। তাই তিনি তার ছেলেকে প্রথমেই বলেন, আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করা হতে বেচে থাক। যেমন, মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা অথবা অনুপস্থিত ও অক্ষম লোকের নিকট সাহায্য চাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এছাড়াও এ ধরনের আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো শিরকের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “দোআ হল ইবাদত” الدعاء هو العبادة সুতরাং আল্লাহর মাখলুকের নিকট দোআ করার অর্থ হল, মাখলুকের ইবাদত করা, যা শিরক। মহান আল্লাহ তা‘আলা যখন তার বাণী, ﴿وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ﴾ অর্থাৎ “তারা তাদের ঈমানের সাথে যুলুমকে একত্র করে নি।” এ আয়াত নাযিল করেন, তখন বিষয়টি মুসলিমদের জন্য কষ্টকর হল, এবং তারা বলাবলি করল যে, আমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে তার উপর অবিচার করে না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আলোচনা শোনে বললেন,
} ليس ذلك ، إنما هو الشرك ، ألم تسمعوا قول لقمان لابنه :يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾ .
অর্থাৎ, “তোমরা যে রকম চিন্তা করছ, তা নয়, এখানে আয়াতে যুলুম দ্বারা উদ্দেশ্য হল, শিরক। তোমরা কি লোকমান আ. তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছে, তা শোন নি? তিনি তার ছেলেকে বলেছিলেন,
}يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾ .
অর্থ, হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।”
 দ্বিতীয় উপদেশ: মহান আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ﴾ .
অর্থ, “আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে [সদাচরণের] নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে, তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন-তো আমার কাছেই।” [সূরা লোকমান: ১৪] তিনি তার ছেলেকে কেবলই আল্লাহর ইবাদত করা ও তার সাথে ইবাদতে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করার সাথে সাথে মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার উপদেশ দেন। কারণ, মাতা-পিতার অধিকার সন্তানের উপর অনেক বেশি। মা তাকে গর্ভধারণ, দুধ-পান ও ছোট বেলা লালন-পালন করতে গিয়ে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট সইতে হয়েছে। তারপর তার পিতাও লালন-পালনের খরচাদি, পড়া-লেখা ও ইত্যাদির দায়িত্ব নিয়ে তাকে বড় করছে এবং মানুষ হিসেবে ঘড়ে তুলছে। তাই তারা উভয় সন্তানের পক্ষ হতে অভিসম্পাত ও খেদমত পাওয়ার অধিকার রাখে।
 তৃতীয় উপদেশ: মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে মাতা-পিতা যখন তোমাকে শিরক বা কুফরের নির্দেশ দেয়, তখন তোমার করণীয় কি হবে তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾
অর্থ, “আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না। এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে করবে সদ্ভাবে। আর আমার অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।” [সূরা লোকমান: ১৫] আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘যদি তারা উভয়ে তোমাকে পরি-পূর্ণরূপে তাদের দ্বীনের আনুগত্য করতে বাধ্য করে, তাহলে তুমি তাদের কথা শুনবে না এবং তাদের নির্দেশ মানবে না। তবে তারা যদি দ্বীন কবুল না করে, তারপরও তুমি তাদের সাথে কোন প্রকার অশালীন আচরণ করবে না। তাদের দ্বীন কবুল না করা তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাতে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। তুমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করবে। আর মুমিনদের পথের অনুসারী হবে, তাতে কোন অসুবিধা নাই।’ এ কথার সমর্থনে আমি বলব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীও বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী করেন, তিনি বলেন,
« لا طاعة لأحد في معصية الله ، إنما الطاعة في المعروف »
“আল্লাহর নাফরমানিতে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলবে না। আনুগত্য-তো হবে একমাত্র ভালো কাজে।”
 চতুর্থ উপদেশ: লোকমান হাকিম তার ছেলেকে কোন প্রকার অন্যায় অপরাধ করতে নিষেধ করেন। তিনি এ বিষয়ে তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন, মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তার বর্ণনা দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ﴾ .
অর্থ, “হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা [পাপ-পুণ্য] যদি সরিষা দানার পরিমাণও হয়, অত:পর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমান সমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ।” [সূরা লোকমান: ১৬] আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, অন্যায় বা অপরাধ যতই ছোট হোক না কেন, এমনকি যদি তা শস্য-দানার সমপরিমাণও হয়, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা‘আলা তা উপস্থিত করবে এবং মীযানে ওজন দেয়া হবে। যদি তা ভালো হয়, তাহলে তাকে ভালো প্রতিদান দেয়া হবে। আর যদি খারাপ কাজ হয়, তাহলে তাকে খারাপ প্রতিদান দেয়া হবে।
 পঞ্চম উপদেশ: লোকমান হাকিম তার ছেলেকে সালাত কায়েমের উপদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ﴿يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ﴾ অর্থাৎ, “হে আমার প্রিয় বৎস সালাত কায়েম কর”, তুমি সালাতকে তার ওয়াজিবসমূহ ও রোকনসমূহ সহ আদায় কর।
 ষষ্ঠ উপদেশ:
﴿وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ﴾
অর্থাৎ “তুমি ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ কর।” বিনম্র ভাষায় তাদের দাওয়াত দাও, যাদের তুমি দাওয়াত দেবে তাদের সাথে কোন প্রকার কঠোরতা করো না। সপ্তম উপদেশ: আল্লাহ বলেন, ﴿وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ﴾ “যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর।” আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যারা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ ও মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ করবে তাকে অবশ্যই কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে এবং অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। যখন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে তখন তোমার করণীয় হল, ধৈর্যধারণ করা ও ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। রাসূল সা. বলেন,
«المؤمن الذي يخالط الناس ويصبر على أذاهم ، أفضل من المؤمن الذي لا يخالط الناس ولا يصبر على أذاهم».
“যে ঈমানদার মানুষের সাথে উঠা-বসা ও লেনদেন করে এবং তারা যে সব কষ্ট দেয়. তার উপর ধৈর্য ধারণ করে, সে— যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা বা লেনদেন করে না এবং কোন কষ্ট বা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না—তার থেকে উত্তম।”
﴿إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ﴾
অর্থ, “নিশ্চয় এগুলো অন্যতম সংকল্পের কাজ।” অর্থাৎ, মানুষ তোমাকে যে কষ্ট দেয়, তার উপর ধৈর্য ধারণ করা অন্যতম দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ।  
অষ্টম উপদেশ:
﴿وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ﴾
অর্থ, “আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না।” আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, ‘যখন তুমি কথা বল অথবা তোমার সাথে মানুষ কথা বলে, তখন তুমি মানুষকে ঘৃণা করে অথবা তাদের উপর অহংকার করে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না। তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে কথা বলবে। তাদের জন্য উদার হবে এবং তাদের প্রতি বিনয়ী হবে।’ কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
تبسمك في وجه أخيك لك صدقة .
“তোমার অপর ভাইয়ের সম্মুখে তুমি মুচকি হাসি দিলে, তাও সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে।”  
নবম উপদেশ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحاً﴾
“অহংকার ও হঠকারিতা প্রদর্শন করে জমিনে হাটা চলা করবে না।” কারণ, এ ধরনের কাজের কারণে আল্লাহ তোমাকে অপছন্দ করবে। এ কারণেই মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ﴾
“নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” অর্থাৎ যারা নিজেকে বড় মনে করে এবং অন্যদের উপর বড়াই করে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের পছন্দ করে না।
 দশম উপদেশ: নমনীয় হয়ে হাটা চলা করা। মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে বলেন: ﴿وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ﴾ “আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।” তুমি তোমার চলাচলে স্বাভাবিক চলাচল কর। খুব দ্রুত হাঁটবে না আবার একেবারে মন্থর গতিতেও না। মধ্যম পন্থায় চলাচল করবে। তোমার চলাচলে যেন কোন প্রকার সীমালঙ্ঘন না হয়।
 একাদশ উপদেশ: নরম সূরে কথা বলা। লোকমান হাকীম তার ছেলেকে নরম সূরে কথা বলতে আদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ﴾ “তোমার আওয়াজ নিচু কর।” আর কথায় কোন তুমি কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না। বিনা প্রয়োজনে তুমি তোমার আওয়াজকে উঁচু করো না। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ﴾
“নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ।” আল্লামা মুজাহিদ বলেন, ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ। অর্থাৎ, মানুষ যখন বিকট আওয়াজে কথা বলে, তখন তার আওয়াজ গাধার আওয়াজের সাদৃশ্য হয়। আর এ ধরনের বিকট আওয়াজ মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট একেবারেই অপছন্দনীয়। বিকট আওয়াজকে গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করা প্রমাণ করে যে, বিকট শব্দে আওয়াজ করে কথা বলা হারাম। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা এর জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। যেমনিভাবে— ক. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
»ليس لنا مثل السوء ، العائد في هبته كالكلب يعود في قيئه«
“আমাদের জন্য কোন খারাপ ও নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হতে পারে না। কোন কিছু দান করে ফিরিয়ে নেয়া কুকুরের মত, যে কুকুর বমি করে তা আবার মুখে নিয়ে খায়।” খ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
»إذا سمعتم أصوات الديكة ، فسلوا الله من فضله ، فإنها رأت ملكاً ، وإذا سمعتم نهيق الحمار فتعوذوا بالله من الشيطان ، فإنها رأت شيطاناً» .
“মোরগের আওয়াজ শোনে তোমরা আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ কামনা কর, কারণ, সে নিশ্চয় কোন ফেরেশতা দেখেছে। আর গাধার আওয়াজ শোনে তোমরা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কারণ, সে অবশ্যই একজন শয়তান দেখেছে।”
দেখুন: তাফসীর ইবন কাসীর, খ. ৩ পৃ. ৪৪৬

আয়াতের দিক-নির্দেশনা:-
  1. আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, যে সব কাজ করলে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হয়, পিতা তার ছেলেকে সে বিষয়ে উপদেশ দিবে।
  2. উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে তাওহীদের উপর অটল ও অবিচল থাকতে এবং শিরক থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেবে। কারণ, শিরক হল, এমন এক যুলুম বা অন্যায়, যা মানুষের যাবতীয় সমস্ত আমলকে বরবাদ করে দেয়।
  3. প্রত্যেক ঈমানদারের উপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হল, মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া আদায় করা। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা, কোন প্রকার খারব ব্যবহার না করা এবং তাদের উভয়ের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা।
  4. আল্লাহর নাফরমানি হয় না, এমন কোন নির্দেশ যদি মাতা-পিতা দিয়ে থাকে, তখন সন্তানের উপর তাদের নির্দেশের আনুগত্য করা ওয়াজিব। আর যদি আল্লাহর নাফরমানি হয়, তবে তা পালন করা ওয়াজিব নয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «لا طاعة لأحد في معصية الله إنما الطاعة في المعروف» অর্থ: “আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলে না; আনুগত্য-তো হবে ভালো কাজে”।
  5. প্রত্যেক ঈমানদারের উপর কর্তব্য হল, আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী মুমিন-মুসলিমদের পথের অনুকরণ করা, আর অমুসলিম ও বিদআতিদের পথ পরিহার করা।
  6. প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আর মনে রাখবে কোন নেক-কাজ তা যতই ছোট হোক না কেন, তাকে তুচ্ছ মনে করা যাবে না এবং কোন খারাপ-কাজ তা যতই ছোট হোক না কেন, তাকে ছোট মনে করা যাবে না এবং তা পরিহার করতে কোন প্রকার অবহেলা করা চলবে না।
  7. সালাতের যাবতীয় আরকান ও ওয়াজিবগুলি সহ সালাত কায়েম করা প্রত্যেক মুমিনের উপর ওয়াজিব; সালাতে কোন প্রকার অবহেলা না করে, সালাতের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া এবং খুশুর সাথে সালাত আদায় করা ওয়াজিব।
  8. জেনেশুনে, সামর্থানুযায়ী সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। না জেনে এ কাজ করলে অনেক সময় হিতে-বিপরীত হয়। আর মনে রাখতে হবে, এ দায়িত্ব পালনে যথা সম্ভব নমনীয়তা প্রদর্শন করবে; কঠোরতা পরিহার করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من رأى منكم منكراً فليغيره بيده ، فإن لم يستطع فبلسانه ، فإن لم يستطع فبقلبه ، وذلك أضعف الإيمان»
অর্থ: “তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে, তখন সে তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তার মুখ দ্বারা। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এ হল, ঈমানের সর্বনিম্নস্তর।”
  1. মনে রাখতে হবে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণকারীকে অবশ্যই-অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। ধৈর্যের কোন বিকল্প নাই। ধৈর্য ধারণ করা হল, একটি মহৎ কাজ। আল্লাহ তা‘আলা ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন।
  2. হাটা চলায় গর্ব ও অহংকার পরিহার করা। কারণ, অহংকার করা সম্পূর্ণ হারাম। যারা অহংকার ও বড়াই করে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না।
  3. হাটার সময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে হাটতে হবে। খুব দ্রুত হাঁটবে না এবং একেবারে ধীর গতিতেও হাঁটবে না।
  4. প্রয়োজনের চেয়ে অধিক উচ্চ আওয়াজে কথা বলা হতে বিরত থাকবে। কারণ, অধিক উচ্চ আওয়াজ বা চিৎকার করা হল গাধার স্বভাব। আর দুনিয়াতে গাধার আওয়াজ হল, সর্ব নিকৃষ্ট আওয়াজ।

শিশুদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ছিলাম, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “হে বৎস! আমি কি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দেব?” এ বলে রাসূল আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে কিছু উপদেশ দেন। নিম্নে তা তুলে ধরা হল:
 প্রথম উপদেশ: احفظ الله يحفظك “তুমি আল্লাহর হেফাজত কর আল্লাহ তোমার হেফাজত করবে” : অর্থাৎ, তুমি আল্লাহর নির্দেশ মেনে চল এবং যে সব কাজ হতে আল্লাহ তোমাকে নিষেধ করেছে, সে সব কাজ হতে বিরত থাক। আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাপত্তা বিধান করবে।

দ্বিতীয় উপদেশ: احفظ الله تجده تجاهك (أمامك) “তুমি আল্লাহকে হেফাজত কর, তখন তুমি তাঁকে তোমার সম্মুখেই পাবে।” অর্থাৎ, তুমি আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সংরক্ষণ ও আল্লাহর হক রক্ষা কর; তবে তুমি আল্লাহকে এমন পাবে যে, তিনি তোমাকে ভাল কাজের তাওফিক দেবে এবং তোমাকে তোমার যাবতীয় কর্মে সাহায্য করবে।  
তৃতীয় উপদেশ: إذا سألت فاسأل الله ، وإذا استعنت فاستعن بالله “যখন তুমি কোন কিছু চাইবে, আল্লাহর নিকট চাইবে। যখন কোনো সাহায্য চাইবে, আল্লাহ্‌র কাছেই চাইবে।” অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কোন বিষয়ে সাহায্যের প্রয়োজন হলে, তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। বিশেষ করে, যে কাজ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সমাধান করতে পারে না, তা আল্লাহর নিকটই চাইবে; কোন মাখলুকের নিকট চাইবে না। যেমন, সুস্থতা, রিযক, হায়াত, মওত ইত্যাদি। এগুলি এমন কাজ, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সমাধান করতে পারে না।
 চতুর্থ উপদেশ:
وأعلم أن الأمة لو اجتمعوا على أن ينفعوك بشيء لم ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك ، وإن اجتمعوا على أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه الله عليك
“একটি কথা মনে রাখবে, যদি সমস্ত উম্মত একত্র হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য যতটুকু উপকার লিপিবদ্ধ করেছে, তার বাইরে বিন্দু পরিমাণ উপকারও তোমার কেউ করতে পারবে না, যদি আল্লাহ তোমার উপকার না চায়। আর সমস্ত উম্মত একত্র হয়ে যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য যতটুকু ক্ষতি লিপিবদ্ধ করেছে, তার বাইরে বিন্দু পরিমাণ ক্ষতিও তোমার কেউ করতে পারবে না, যদি আল্লাহ তোমার ক্ষতি না চায়।” অর্থাৎ, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য ভালো ও মন্দের যে, ভাগ্য নির্ধারণ করেছে, তার বাইরে কোন কিছুই বাস্তবায়িত হবে না। এ বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক।  
পঞ্চম উপদেশ: رفعت الأقلام وجفت الصحف “কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে ও কাগজ শুকিয়ে গেছে।” তাই আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করতে হবে। তাওয়াককুল করার অর্থ হল, উপকরণ অবলম্বন করে তাওয়াককুল/ভরসা করা। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উষ্ট্রীর মালিককে বলেন, তুমি আগে উষ্ট্রীকে বেঁধে রাখ এবং আল্লাহর উপর তাওয়াককুল কর।
 ষষ্ঠ উপদেশ: تعرف إلى الله في الرخاء يعرفك في الشدة “সচ্ছল অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর, বিপদে তোমাকে আল্লাহ স্মরণ করবে।” অর্থাৎ, সচ্ছল অবস্থায় তুমি আল্লাহর হক ও মানুষের হক্ব আদায় কর, বিপদে আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবে।  
সপ্তম উপদেশ:
وأعلم أن ما أخطأك لم يكن ليصيبك ، وما أصابك لم يكن ليخطئك
“মনে রেখো— যা তুমি পেলে না, তা তোমার পাবার ছিল না; আর যা তুমি পেলে তা তুমি না পেয়ে থাকতে না।” অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাকে কোন কিছু দান না করলে, তা কখনোই তুমি লাভ করতে পারবে না। আর যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে কোন কিছু দান করে, তা বাধা দেয়ার কেউ নাই।  
অষ্টম উপদেশ: واعلم أن النصر مع الصبر “আর জেনে রাখ, বিজয় ধৈর্যের সাথে।” অর্থাৎ, শত্রু ও নফসের বিপক্ষে সাহায্য বা বিজয় লাভ ধৈর্য ধারণের উপর নির্ভর করে। সুতরাং, আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
 নবম উপদেশ: وأن الفرج مع الكرب “বিপদের সাথেই মুক্তি আসে।” মুমিন বান্দা যেসব বিপদের সম্মুখীন হয়, তারপরই মুক্তি আসে।  
দশম উপদেশ: وأن مع العسر يسرا “কষ্টের সাথেই সুখ।” এক মুসলিম যে কষ্টের মুখোমুখি হয়, তা কখনোই স্থায়ী হয় না। কারণ, তারপর অবশ্যই আরাম বা সুখ আসে এবং আসবেই।
 হাদিসের নির্যাস:
  1. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের ভালোবাসতেন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে নিজের পিছনে বসান এবং আদর করে তিনি তাকে হে বৎস বলে আহ্বান করেন, যাতে সে সতর্ক হয় এবং রাসুলের কথার প্রতি মনোযোগী হয়।
  2. শিশুদের তিনি আল্লাহর আনুগত্য করা ও তার নাফরমানি হতে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিতেন, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
  3. যখন কোন বান্দা সচ্ছলতা, সুস্থতা ও ধনী অবস্থায় আল্লাহ ও তার বান্দাদের অধিকার আদায় করে, আল্লাহ তা‘আলা বিপদে তাকে মুক্তি দেবে এবং সাহায্য করবে।
  4. আল্লাহর নিকট কোন কিছু চাওয়া ও সাহায্য প্রার্থনার তালীম দেয়ার মাধ্যমে শিশুদের অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করে দেয়া, মাতা-পিতা ও অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ছোট বেলা থেকেই শিশুদের অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করে দিতে হবে, যাতে বড় হলে তার পথভ্রষ্ট না হয়।
  5. ঈমানের রোকনসমূহ হতে একটি রোকন হল, ভাল ও মন্দের তকদীরের উপর বিশ্বাস করা। বিষয়টি শিশুদের অন্তরে গেঁথে দিতে হবে।
  6. শিশুদের ইতিবাচক মনোভাবের উপর গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সাহসিকতার সাথে তাদের জীবনের ভবিষ্যৎ রচনা করে এবং তাদের জাতির জন্য কর্ণধার ও ত্রাণকর্তা হিসেবে আর্ভিভাব হতে পারে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وأعلم أن النصر مع الصبر ، وأن الفرج مع الكرب ، وأن مع العسر يسرا» .
“আর জেনে রাখ: ধৈর্যের সাথেই বিজয়, বিপদের সাথেই মুক্তি, কষ্টের সাথেই সুখ।”
  ইসলামের রোকনসমূহ জীবনের শুরুতেই শিশুদের ঈমান ও ইসলামের রোকনসমূহ তালীম দিতে হবে, যাতে তারা বড় হয়ে, তা হতে দূরে সরে না যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি: এক. “এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নাই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।” অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন ইলাহ নাই আর আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে মুহাম্মদ এর আনুগত্য করা ওয়াজিব।[1] দুই. “সালাত কায়েম করা” : সালাতের আরকান ও ওয়াজিবসমূহ সহ খুশুর সাথে সালাত আদায় করা। তিন. “যাকাত প্রদান করা” : যদি কোন মুসলিম তার মৌলিক প্রয়োজনের বাইরে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ বা তার সমপরিমাণ অর্থের মালিক হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে যখন তার এ সম্পদের উপর এক বছর অতিবাহিত হয়; তখন তাকে শতকরা ২.৫ টাকা যাকাত দিতে হবে। এ-ছাড়াও আরও অনেক সম্পদ আছে যেগুলোর উপর যাকাত ওয়াজিব হয়। সে সব সম্পদের যাকাত শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত হারে প্রদান করতে হয়। চার. “বায়তুল্লাহর হজ করা” : হজ তার উপর ফরয হবে, যে হজ করার সামর্থ্য রাখে। পাঁচ. “রমযানের রোজা রাখা:” রোজা বলতে আমরা বুঝি, নিয়ত সহকারে ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা-পিনা ও রোজার পরিপন্থী সবধরনের কাজ হতে বিরত থাকা।  
ঈমানের রোকনসমূহ ১. “আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা”: আল্লাহর অস্তিত্ব এবং ইবাদতে ও সিফাতসমূহে তাঁর একত্ব সম্পর্কে প্রগাঢ় বিশ্বাস করা। ২. “আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনা” : ফেরেশতা হল, আল্লাহরই মাখলুক; যারা আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করে এবং তিনি যা করতে বলেন, তাই করে; তার কোন প্রকার এদিক সেদিক করে না এবং করার ক্ষমতা রাখে না। ৩. “আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনা” : আল্লাহর নাযিল-কৃত আসমানি কিতাব তাওরাত, জবুর, ইঞ্জিল ও সর্বোত্তম কিতাব কুরআনের প্রতি ঈমান আনা। ৪. “আল্লাহর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা” : সর্ব প্রথম রাসূল হলেন নূহ আ. আর সর্বশেষ রাসূল হল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ৫. “আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা” : এর অর্থ হল, হিসাব দিবসের প্রতি বিশ্বাস করা। মানুষের যাবতীয় কর্মের উপর অবশ্যই হিসাব নেয়া হবে এবং তার কর্মের বিনিময়ে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে, যদি তার কর্ম ভালো হয়, তবে ভালো প্রতিদান আর যদি খারাপ হয়, তবে খারাপ প্রতিদান। ৬. “তাকদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান রাখা” : ভালো ও মন্দের তকদীরের উপর রাজি-খুশি থাকা। কারণ, এটা আল্লাহরই নির্ধারণ। (তবে শুধু এর উপর নির্ভর না করে থেকে বৈধ উপায়- উপকরণ গ্রহণ করতে হবে।)
[মূল হাদীসটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন]

আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর কুরআনের আয়াত, বিশুদ্ধ হাদিস, সত্যিকার জ্ঞান ও সঠিক স্বভাব প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরই আছেন। একজন মুসলিমের আক্বীদা বা বিশ্বাস এটিই হতে হবে। নিম্নে এর সপক্ষে কয়েকটি প্রমাণ উপস্থাপন করা হল। ১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾ অর্থাৎ “আল্লাহ আরশের উপর উঠেছেন।” [সূরা ত্বাহা] استوى এর অর্থ উপরে উঠা এবং উন্নীত হওয়া। যেমনটি বুখারির বর্ণনায় তাবেয়ীদের থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ২. বিদায় হজের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিন যে ভাষণ দেন, তাতে তিনি বলেন, “আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে আমার উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব তোমাদের নিকট পৌছাইনি?” উপস্থিত সবাই সমস্বরে বললে, হ্যাঁ। তারপর তিনি তার আঙ্গুলকে আসমানের দিকে উঁচু করলেন এবং সমবেত লোকদের দিকে ঝুঁকিয়ে তাদের সম্বোধন করে বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।” [মুসলিম] ৩. সালাতে মুসল্লিরা বলেন, سبحان ربي الأعلى “আমার সুউচ্চ রব কতই না পবিত্র!” অনুরূপভাবে দো‘আর সময় মানুষ আসমানের দিকেই হাত উঠায়। [এতেও এ কথা স্পষ্ট হয় যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা উপরেই আছেন।] ৪. শিশুদের যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, আল্লাহ কোথায়? তখন সে স্বভাবতই বলে, আল্লাহ আসমানে অথবা ইশারা করে আসমানের দিকে দেখায়। ৫. মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, {وَهُوَ اللّهُ فِي السَّمَاوَاتِ} “ আর আল্লাহ, তিনি-তো আসমানসমূহে।” [সূরা আল-আন‘আম] আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, তাফসীরবিদগণ এ বিষয়ে ঐকমত পোষণ করেন যে, পথভ্রষ্ট দল জাহমিয়ারা যে কথা বলে, আমরা তা বলবো না। তারা বলে ‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান’, অথচ মহান আল্লাহ তা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। আর في السموات বা আল্লাহ আসমানে এ কথার অর্থ হল على السموات- আল্লাহর আসমানের উপর। তবে মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দেখেন, আমাদের কথা শোনেন, যদিও তিনি আরশের উপর অবস্থান করছেন।  
অসাধারণ উপদেশমূলক কাহিনী এ বিষয়ে হাদিসে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে:—
عن معاوية بن الحكم السلمي رضي الله عنه قال : « وكانت لي جارية ترعى غنماً لي قبل «أحد والجوانية» فاطلعت ذات يوم ، فإذا بالذئب قد ذهب بشاة من غنمها ، وأنا رجل من بني آدم ، آسف كما يأسفون ، لكني صككتها صكة ، فأتيت رسول الله صلى الله عليه وسلم فعظم ذلك عليّ ، قلت يا رسول الله ، أفلا أعتقها ؟ قال : أئتني بها ، فقال لها : أين الله ؟ قالت في السماء ، قال : من أنا ؟ قالت : أنت رسول الله ، قال : أعتقها فإنها مؤمنة » .
অর্থ, মুয়াবিয়া ইবনে হাকাম আস-সুলামী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার একজন বাঁদী ছিল, সে ওহুদ পাহাড়ের প্রান্তে আমার ছাগল চড়াত। একদিন সে বাড়িতে আসলে, তখন একটি নেকড়ে বাঘে এসে আমার একটি ছাগল ধরে নিয়ে যায়। আর আমি যেহেতু একজন আদম সন্তান— মানুষ, এতে স্বভাবতই অন্যান্য মানুষের মত আমিও খুব কষ্ট পেলাম। ফলে আমি বাঁদীটিকে সজোরে একটি প্রহার করলাম। পরবর্তীতে বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করলে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে আজাদ করে দেব? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। তারপর আমি তাকে নিয়ে এলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করল, “আল্লাহ কোথায়?” উত্তরে সে বলল, “আল্লাহ আসমানে।” তারপর জিজ্ঞাসা করল, “আমি কে?” সে বলল, “আপনি আল্লাহর রাসূল।” তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলল, “তুমি তাকে আজাদ করে দাও, কারণ সে মুমিন।” [মুসলিম ও আবু দাউদ] (‘আসমানে’ অর্থ হলো ‘আসমানের উপরে’)।  

হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ: ১. ছোট হোক অথবা বড় হোক যে কোন ধরনের সমস্যায় সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে তার সমাধান করত, যাতে তারা এ বিষয়ে আল্লাহর বিধান কী তা জানতে পারে। ২. আর বিচার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের নিকটই যেতে হবে। আল্লাহ ও তার রাসূলকে বাদ দিয়ে কারো নিকট বিচার ফায়সালার জন্য যাওয়া কোন ঈমানদারের কাজ হতে পারে না। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে বলেন,
﴿فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا﴾ .
“আমি আপনার রবের শপথ করে বলছি, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের বিবাদ মীমাংসায় আপনাকে ফায়সালাকারী না বানায়। অতঃপর আপনি যে ফায়সালা দিয়েছেন, তাতে তাদের অন্তরে কোন প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে এবং তারা পুরোপুরি আত্মসমর্পন করে।” [সূরা আন-নিসা: ৬৫] ৩. বাঁদীটিকে প্রহার করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেন নি, শুধু তাই নয়, বিষয়টি তার নিকট খুব কষ্টকর ও দুঃখনীয় ছিল। ৪. হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাধারণত মুমিনদেরই আজাদ করে দেয়া হয়, কাফেরদের নয়। কারণ, এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে বাঁদীটির পরীক্ষা করেছেন। তারপর যখন তিনি তার ঈমানের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন, তখন তাকে আজাদ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। আর যদি কাফের হত, তাহলে তিনি তাকে আজাদ করতে নির্দেশ দিতেন না। ৫. এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, তাওহীদ বিষয়ে মানুষের নিকট জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক। আর আল্লাহ তা‘আলা যে, আরশের উপর তা প্রতিটি মুমিন মুসলিমের জানা থাকা আবশ্যক। ৬. ‘আল্লাহ কোথায়?’ এ বলে কাউকে জিজ্ঞাসা করা যে সুন্নত তা এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কারণ, এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ কোথায়? এ বলে বাঁদীটিকে জিজ্ঞাসা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আসমানে! এ বলে উত্তর দেওয়া যে বৈধ তা এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উত্তরের উপর স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং কোন প্রকার আপত্তি করেননি। এ ছাড়া উত্তরটি আল্লাহ তা‘আলার বাণীর অনুরূপ। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন,
﴿أَأَمِنتُم مَّن فِي السَّمَاء أَن يَخْسِفَ بِكُمُ الأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ﴾ .
“যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদেরসহ জমিন ধসিয়ে দেয়া থেকে কি তোমরা নিরাপদ হয়ে গেছ, অতঃপর আকস্মিকভাবে তা থরথর করে কাঁপতে থাকবে।” ইবনে আব্বাস রা. বলেন, তিনি হলেন, মহান আল্লাহ তা‘আলা। আর আয়াতে في السماء কথাটির অর্থ على السماء - আসমানের উপর। ৭. একজন মানুষের ঈমান তখন বিশুদ্ধ হবে, যখন সে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাত বিষয়ে সাক্ষী প্রদান করবে। আল্লাহর উপর ঈমান আনল, অথচ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে স্বীকার করল না, তাহলে সে ঈমানদার হতে পারবে না। ৮. মহান আল্লাহ তা‘আলা আসমানে এ কথার উপর বিশ্বাস করা, প্রমাণ করে যে, তার ঈমান সঠিক ও নির্ভেজাল। আর এ বিষয়ের উপর বিশ্বাস করা প্রতিটি মুমিনের আবশ্যক। ৯. এ হাদিস দ্বারা তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করা হল, যারা বলে মহান আল্লাহ সশরীরে সর্বত্র বিরাজমান। তাদের কথাটি ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সত্যি কথা হল, আল্লাহ তা‘আলা আসমানে। তবে তার জ্ঞান আমাদের সাথে আছেন এবং তার ইলম বা জ্ঞান আমাদের পরিবেষ্টন করে আছেন, তিনি সশরীরে আমাদের সাথে নাই। তার ইলম ও কুদরাত সর্বত্র বিরাজমান। যারা বলে ‘আল্লাহ তা‘আলা সশরীরে সর্বত্র বিরাজমান’ তাদের কথা ভ্রান্ত ও ভুল। ১০.রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীটিকে পরীক্ষা করার জন্য তার নিকট নিয়ে আসার জন্য যে, নির্দেশ দিয়েছেন, তা প্রমাণ করে যে, তিনি গায়েব জানেন না। যদি গায়েব জানতেন তাহলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা না করেই ফায়সালা দিতে পারতেন। এ হাদিস দ্বারা সূফীদের দাবীও বাতিল বলে প্রমাণিত হয়; কারণ, তারা বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েব জানে। প্রকৃত সত্য হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন গায়েব জানেন না। এ কারণে মহান আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে নির্দেশ দেন যে,
﴿قُل لاَّ أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاء اللّهُ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَاْ إِلاَّ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾ .
“হে রাসূল! আপনি বলুন, আমি আমার নিজের জন্যও উপকার ও ক্ষতির নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নই। তবে আল্লাহ যা চায়। আর আমি যদি গায়েব জানতাম, তবে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম আমাকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমি-তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদ-দানকারী।”

[1] ক. ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হক ইলাহ নেই’ সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ হলো: আল্লাহ ব্যতীত কারো ইবাদত না করা, অন্য কাউকে না ডাকা; তাঁকে তার কেবল শরী‘আতের মাধ্যমেই ইবাদত করা; আর শুধুমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে নির্গত শরী‘আত অনুযায়ীই বিচার-ফয়সালা করা। খ. ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ হলো: যে আদেশ তিনি দিয়েছেন তা আনুগত্য করা; যে সংবাদ তিনি এনেছেন তা বিশ্বাস করা; আর যা থেকে তিনি বিরত থাকতে বলেছেন ও সাবধান করেছেন, তা থেকে দূরে থাকা। কেননা, তার আনুগত্যই আল্লাহর আনুগত্য।

No comments:

Post a Comment