সম্রাট নিরো ৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দে গণ-আন্দোলনের মুখে আত্মহত্যা করা পর্যন্ত ১৪ বছর রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। দু’টি কাজের জন্য তিনি ইতিহাসে অন্যতম ধিকৃত সম্রাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। নিরো ক্লদিয়াস সিজার অগাস্টাস জারমানিকাস (Nero Claudius Caeser Augustus Germanicus) নামের এই প্রায় বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তিটি তার শাসনামলে রোমান সাম্রাজ্যের সংখ্যালঘু খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের ওপর অকল্পনীয় নির্যাতন চালিয়েছিলেন। আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে নিরোর এই দুষ্কর্মটি নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও রোম শহরের দরিদ্র মানুষগুলোর বাড়িতে আগুন দিয়ে প্রাসাদ থেকে সেই লেলিহান শিখা দেখে মনের ফুর্তিতে বাঁশি বাজানোর গল্পটি মোটামুটি লেখাপড়া জানা ব্যক্তিমাত্রই জানেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এহেন নিরোও নাকি তার ক্ষমতাপ্রাপ্তির প্রথম দিকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সাময়িক জনপ্রিয়তা নিরোর মানসিক বিকারকে প্রশমিত না করে বরঞ্চ উসকে দিয়েছিল। ১৮৯৫ সালে নিরোর জীবনের রোমাঞ্চকর ঘটনাবলী এবং লোমহর্ষক কার্যকলাপ অবলম্বনে পোলিশ লেখক হেনরিক সিয়েনকিউইজ (Henrik Sienkiewicু) বিখ্যাত গ্রন্থ Quo Vadis : A narrative of the Time of Nero রচনা করেছিলেন। সেই কাহিনী নিয়ে একাধিক ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দু’হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি ছেড়ে বর্তমানের রক্তস্নাত বাংলাদেশে ফেরা যাক।
ক্ষমতাসীনরা পরিকল্পিতভাবে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত করেছে। এই অপকর্মটি তারা একদিনে করেনি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের অনুচরগোষ্ঠী ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই সেক্যুলারিজমের ছদ্মাবরণে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অকল্পনীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হয়েছে। এখানেই দু’হাজার বছর আগের রোমের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য। সে সময় রোমে খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু ছিল এবং সম্রাট নিরো তাদের ওপর খড়্গহস্ত ছিলেন। নিরো নিজে কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন, সে নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ দাবি করেন যে, তিনি জেরুজালেম ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। অবশ্য এই কাহিনীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন, এমন ইতিহাসবিদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে সম্রাট নিরোর উগ্র খ্রিস্টানবিদ্বেষের যুক্তিগ্রাহী ব্যাখ্যা
খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার সমর্থকরা দাবি করেন যে, তিনি নাকি অত্যন্ত ধর্মভীরু ও আচারনিষ্ঠ মুসলমান। শেখ হাসিনা একাধিকবার পবিত্র হজ্ব পালন করেছেন এবং অসংখ্যবার ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব গেছেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আল্লাহর দরবারে ইবাদতরত নিমীলিত নেত্র শেখ হাসিনার অসংখ্য পোস্টারে সারাদেশ ছেয়ে ফেলা হয়েছিল। আওয়ামী ও বামধারার বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, দল দু’টি নাকি রাজনীতিতে অন্যায়ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। অথচ শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের সেই বিখ্যাত নির্বাচনী পোস্টারের বিষয়ে তাদের কাছ থেকে অদ্যাবধি কোনো আপত্তি উত্থাপিত হতে শুনিনি। এবারের মেয়াদে অবশ্য শেখ হাসিনাকে আমরা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হতে দেখেছি। শপথ গ্রহণ করা থেকেই তিনি এবং তার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্যরা ইসলাম ধর্মের নজিরবিহীন বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার সংবিধানের মূল নীতি থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করেছে। নারীনীতি ও শিক্ষানীতি প্রণয়নে এবং গত চার বছরে স্কুলের জন্য নতুনভাবে লিখিত পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে। তার মন্ত্রীরা ধারাবাহিকভাবে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। ২০১১ সালের ১০ আগস্ট ‘বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম’ শিরোনামে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনে সরকারের শীর্ষমহলের এ-জাতীয় কর্মকাণ্ডের ১২টি উদাহরণ দিয়েছিলাম। সেখান থেকে মাত্র তিনটি আজকের লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করছি : “১. ২০০৯ সালের ২৮ মার্চ ‘সন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রয়েছে, তার সবই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে (!)। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়। ২. ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল এদেশের আওয়ামীপন্থী শিল্পপতিদের অর্থে পরিচালিত সুশীল (?) থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ওয়ার্কশপে বক্তৃতায় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, কওমি মাদরাসাগুলো এখন জঙ্গিদের প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কওমি মাদরাসাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এসব কওমি মাদরাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা কূপমণ্ডূকতার সৃষ্টি করছে। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে ’৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাত্ করার ফলেই এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। ৩. ২০১১ সালের ২ জুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ দাবি করেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি— এ তিনটির বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতবিনিময় সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকলে হরতাল দেয়া হবে।” পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাতক্রমেই শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেছিলেন। সেই আঁতাতের পেছনে এদেশে ইসলামিক চিন্তা-চেতনা দমন শর্ত হিসেবে ছিল কি-না তা আমাদের অজানা। তবে মহাজোটের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ এবং ভারত যে বেজায় সন্তুষ্ট হয়েছে, সেটা তারা গোপন রাখেনি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের চরম ইসলামবিরোধী মানসিকতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই গত মাসে শাহবাগে ধর্মদ্রোহী বিকারগ্রস্ত ব্লগারদের নেতৃত্বে তথাকথিত জাগরণ মঞ্চের জন্ম দেয়া হয়েছে। সেখানে নেতৃত্বদানকারী বিপথগামী তরুণ প্রজন্মের একজন আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী ও সরকারপন্থী বাম সংসদ সদস্যরা তাকে কথিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে ১৯৭১ সালের শহীদদের চূড়ান্ত অবমাননা করেছেন। নিহত তরুণটির সম্পর্কে সংসদে আলোচনাকালে আবেগের তোড়ে সবাই মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছিলেন। রাজীবের অবিশ্বাস্য ইসলামবিরোধী কুকর্ম পরবর্তী সময়ে ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আওয়ামী প্রচারণাযন্ত্র থেকে এখন দাবি করা হচ্ছে যে, তার ব্লগে হ্যাক করে শিবিরের ছেলেরা নাকি মহানবী (সা.) সম্পর্কে কলমের ডগা অথবা জিহ্বাগ্রে আনার অযোগ্য এসব নোংরা লেখালেখি করেছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ক’দিন আগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রাজীবের পক্ষাবলম্বন করে উপরোক্ত ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। ঘটনাক্রমে জাসদ নেতা ইনু এবং আমি একই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া এবং একই ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিগ্রি নিয়েছি। আমরা দু’জনই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি সরাসরি প্রকৌশল পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও রাজনীতিবিদ ইনু তার পেশাজীবনে কোথায় ইঞ্জিনিয়ারিং চর্চা করেছেন, আমার ঠিক জানা নেই। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছি, ব্লগার রাজীবের ফেসবুক পেজে যাবতীয় অশ্লীল ও ইসলামবিরোধী পোস্ট নিশ্চিতভাবে তারই দেয়া। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সব তথ্যপ্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। আমার দাবির সমর্থনে মিডিয়ার সামনে যে কোনো স্থানে আমি মন্ত্রী ইনুর সঙ্গে ল্যাপটপ নিয়ে বিতর্ক করতে প্রস্তুতি আছি। আজ পাঠককে একটা আগাম তথ্য শুধু দিয়ে রাখছি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখের পর রাজীব ওরফে থাবা-বাবার ফেসবুক পেজে নতুন কোনো পোস্ট দেয়া নেই। কারণটি সম্ভবত সরকারি প্রশাসনযন্ত্র রাজীবের পাসওয়ার্ডটি কোনোভাবে জানতে পারেনি। রাজীব ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ন’টার দিকে নিহত হয়েছিল। তার মৃত্যুর সঙ্গে তাই থাবা-বাবা ফেসবুক পেজটিরও সমাপ্তি ঘটেছে। পথভ্রষ্ট তরুণটির একটি পোস্টের উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে দিয়ে রাখছি। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে রাজীব তার ফেসবুকে পোস্ট করেছিল, “দুনিয়াতে আসিয়াছে যেই দিন ইন্টারনেট সেই দিনই হইয়াছে আল্লাতালার ডেথ্!—- থাবা বাবা” (নাউজুবিল্লাহ)। মহাজোট সরকারের উত্সাহক্রমে বাংলাদেশে যত্সামান্য লেখাপড়া জানা একদল ডিজিটাল তরুণের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা সহজে পরিচিতি পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করাটাকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্বাসিত জীবন যাপনকারী তসলিমা নাসরিনই সম্ভবত তাদের আদর্শ। নিহত রাজীবের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পত্রিকায় যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ছেলেটিকে আদর্শ চরিত্র হিসেবে মেনে নেয়ার উপায় নেই। এমন এক নষ্ট চরিত্রের ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার মহাজোট সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং শাহবাগিদের কাছে বিস্ময়করভাবে এখনও হিরো ও শহীদের মর্যাদা পাচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহার সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবধানবাণী এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি একবার মার্কিন তরুণদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, তোমরা এমনকিছু ফেসবুক পেজে লিখবে না, যা ভবিষ্যতে তোমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। কারণ এসব লেখালেখি মুছে দেয়া আর সম্ভব হয় না। আশা করি, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আধুনিক প্রযুক্তির সমস্যাটি বারাক ওবামার মন্তব্য থেকে অনুধাবন করতে পারছেন। যাই হোক, রাজীবের সমগোত্রীয়রাই আজ শাহবাগে ভারতের মদতে (Ref: Times of India) এক বিচিত্র ভিন্ন রাষ্ট্র গঠন করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বর্ণনা অনুসারে নবগঠিত সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, ব্লগার ইমরান শুধু শাহবাগ চত্বরেরই অধিপতি নন, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতিও তিনি প্রায় প্রতিদিন নিত্যনতুন হুকুম জারি করছেন। তার সেই হুকুম অবহেলা করার সাধ্য বাংলাদেশের সচিবালয়, সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দফতর কারোরই নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তার আয়ত্তাধীন কি-না, তা অবশ্য বলতে পারব না। গত রোববার পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে এক সমাবেশে বক্তৃতাকালে সেই ইমরান শাহবাগ সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এমন একটি দাবি করে সমগ্র দেশবাসীকে চমকে দিয়েছে। গুরুত্বের বিবেচনায় দিল্লির কাছেও বর্তমানে সম্ভবত এহেন ক্ষমতাধর ব্লগার ইমরানের পরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ সফরকালে তিনি কখন, কোথায় শাহবাগের ‘রাষ্ট্রপতি’ ব্লগার ইমরানকে সাক্ষাত্ দিয়েছেন সে সংবাদ আমাদের মতো আমজনতার জানার উপায় নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যেমন করে দানব সৃষ্টি করেছিলেন, অনুরূপ শেখ হাসিনাও ব্লগার ইমরানের জন্ম দিয়েছেন। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এমন এক সময় বাংলাদেশ সফর করে গেলেন, যখন দেশে অঘোষিত গৃহযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালে বর্বর, হানাদার পাক বাহিনীর গণহত্যার ৪২ বছর পর আওয়ামী বাহিনী বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো গণহত্যা চালাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া সেই গণহত্যায় এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, যুবক সবাই আছেন। গত শুক্রবার বিরোধীদলীয় নেত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলে অভিহিত করায় সরকার ও তার তল্পিবাহকদের হৃদয়ে কাঁপন ধরে গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের প্রচারণার আবরণে ৪২ বছর পর যদি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়, তাহলে কোনো না কোনো দিন বর্তমানের গণহত্যারও নিশ্চয়ই বিচার হবে। এই আশঙ্কা মনে জাগরূক হওয়াতেই মহাজোট সরকারে ইয়াহিয়া খানের প্রেতাত্মারা বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার মতো করে চমকে উঠেছেন। গণহত্যার আন্তর্জাতিক আইনগত ব্যাখ্যা দেয়ার মতো বিশেষজ্ঞ আমি নই। তবে সাধারণভাবে গণহত্যাকে ইংরেজিতে genocide, mass killing অথবা mass murder বলা যেতে পারে। গত ক’দিন ধরে বাংলাদেশে একদল হিংস্র পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তাকে mass killing অথবা mass murder বলা হলে আওয়ামী লীগের একেবারে নিম্নশ্রেণীর দালাল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির আপত্তি করার কথা নয় বলেই আমি মনে করি। বিতর্ক অবশ্য উঠতে পারে genocide শব্দের ব্যবহার নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল। বর্তমান আওয়ামী সরকার এবং তার অধীনস্থ প্রশাসনযন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে ও ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে ব্লগার ইমরানের ‘শাহবাগি সরকার’ সেই দলটির বিরুদ্ধে যে Hate Campaign (ঘৃণা প্রচার) চালিয়েছে, তার সঙ্গে একমাত্র নািস জার্মানির ইহুদি ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পরিচালিত Hate Campaign-এর তুলনা চলে। রাতদিন ‘ফাঁসি চাই’ এবং ‘জবাই কর’ মার্কা স্লোগান দিয়ে দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর উন্মত্ততা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অব্যাহতভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর একপর্যায়ে পুলিশ ও র্যাব তার সর্বশক্তি দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়ে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। সমাজে ঘৃণা ছড়ানোর বিষময় ফলে নোয়াখালীতে ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে অতিউত্সাহী আওয়ামী লীগারদের চোখের সামনে এক এতিম শিশুর করুণ মৃত্যু ঘটেছে। সরকার তার সমর্থকদের মধ্যকার এক বিপুল অংশকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ থেকে কীভাবে দানবে পরিণত করতে পেরেছে, তার আরও একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন সাইটে পাঠকদের মন্তব্য দেয়ার সুযোগ রয়েছে। অশ্লীল শব্দাবলী না থাকলে আমরা সচরাচর সেসব মন্তব্য এডিট (Edit) করি না। আমার বিরুদ্ধে লেখা কুত্সাপূর্ণ বক্তব্যও আমি অবিকৃতভাবে রেখে দেই, যাতে পাঠকসমাজ আওয়ামী চরিত্রের নোংরা দিকটা সম্পর্কে অধিকতর অবহিত হয়। দেশব্যাপী নির্বিচার মানুষ হত্যা সংক্রান্ত একটি সংবাদের ওপর আওয়ামী সমর্থক জনৈক করিমউল্লাহ খান লিখেছেন, ‘বেজন্মা পাকিস্তানি জামায়াতিদের মৃত্যু কারো সহানুভূতি জাগাবে না।’ পাঠক কি এই হিংস্র মন্তব্যের মধ্যে ১৯৩০ সালের ফ্যাসিস্ট জার্মানির খুনি প্রজন্মকে খুঁজে পাচ্ছেন না? জাতিসংঘ কনভেনশনের আর্টিকেল-২-এ জেনোসাইডের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে : “acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group” (জাতিগত, সম্প্রদায়গত, বংশ বা কুলগত অথবা ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্য থেকে গৃহীত কার্যাবলী)। এই সংজ্ঞার আলোকে মহাজোট সরকারের চার বছরের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থাকে mass killing-এর পাশাপাশি genocide নামে অভিহিত করলে মাথায় আসমান ভেঙে পড়ার কারণ দেখি না। আগেই বলেছি, সেক্যুলারিজম ও নাস্তিকতার আড়ালে চরম ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের স্বল্পসংখ্যক এদেশীয় দালালের কৃত যুদ্ধাপরাধকে পুঁজি করে সরকারের প্ররোচনায় উপরোক্ত গোষ্ঠী এদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল এতখানি বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন যে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজান মানবাধিকার রক্ষায় তার সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়ে উল্টো গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে নিরস্ত্র আক্রান্তদের উচিত শিক্ষা দেয়ার প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন। তার এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণ মিলছে যে, বাংলাদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের মধ্য থেকে একটি অংশকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেই সরকারের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মিডিয়ার এক বিরাট অংশের ভূমিকাও বিস্ময়করভাবে একপেশে ও লজ্জাকর। গত রোববার সকালে চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে হঠাত্ করে আরটিভির সংবাদে চোখ আটকে গেল। সংবাদপাঠিকা কণ্ঠে যথোচিত আবেগ নিয়ে জাগরণ মঞ্চের গুণকীর্তন করছিলেন। সেদিন সকাল ১০টায় কথিত জাগরণ মঞ্চ থেকে হরতালবিরোধী মিছিল করার কথা ছিল। সংবাদের একপর্যায়ে শাহবাগ চত্বর লাইভ দেখানো হলো। বুম হাতে বিব্রত মুখে টেলিভিশন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে ঘিরে সাকুল্যে জনাপাঁচেক দাঁত কেলানো উত্সুক মুখ। ক্যামেরা প্যান করার উপায় নেই, কারণ শাহবাগ চত্বর তখনও একেবারেই ফাঁকা। সাংবাদিকতার পরিবর্তে অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিক শেষপর্যন্ত কবুল করতে বাধ্য হলেন যে, লোকজন এখনও আসেনি। কেবল আরটিভিকে অবশ্য দোষ দেয়াটা অন্যায় হবে। গত মাসের ৫ তারিখ থেকে দিনের পর দিন প্রতিটি টিভি চ্যানেলের একই ভূমিকা আমাদের দেখতে বাধ্য করা হয়েছে। কয়েকশ’ লোককে কয়েক হাজার এবং কয়েক হাজারকে অবলীলাক্রমে কয়েক লাখ বানাতে এসব সাংবাদিকের বাধেনি। তাদের বর্ণনায় শাহবাগে সরকারি মদতে কয়েকশ’ লোকের উপস্থিতি ‘গণজাগরণ’ হলেও সারা দেশে লাখ লাখ লোকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ গণজাগরণ তো নয়ই, শুধুই জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব! সুতরাং সরকার ও তল্পিবাহক মিডিয়ার সমন্বয়ে সৃষ্ট এই কলুষিত পরিবেশে গত এক সপ্তাহ ধরে যে হত্যাকাণ্ড চলছে, তাকে genocide নামে অভিহিত না করতে পারলে এই অপরাধটিকে জাতিসংঘ কনভেনশন থেকে উঠিয়ে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চরিত্রগত প্রতিশোধস্পৃহা এবং হিংস্রতা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করায় ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে যে ভয়ঙ্কর বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিণতিতে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই আজ হুমকির সম্মুখীন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেক্যুলারিস্ট ও নাস্তিকগোষ্ঠী দেশের বাদবাকি ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ বানানোর ফলে এখন আক্রান্তদের সামনে মাত্র দু’টি পথই খোলা রয়েছে। একসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আওয়ামী লীগের আধিপত্য মেনে নিয়ে গৃহাভ্যন্তরে সর্বদা গুম ও গ্রেফতারের আতঙ্ক মাথায় নিয়ে যার যার ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম পালন করতে হবে। অথবা জীবন ও আদর্শ বাঁচানোর প্রয়োজনে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী এবং কয়েকটি ইসলামী দল মিলে দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিয়েছে। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রের এই বিভাজন আর দূর করা সম্ভব হবে না। জাতির সর্বাঙ্গে তিনি যে ক্ষত তৈরি করলেন, তার নিরাময় কীভাবে হবে আমার জানা নেই। তবে সন্দেহ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত উদ্দেশ্য সাধনেই মহাজোট নেত্রী এবারের মেয়াদে বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করে দিল্লির কাছে তার ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করলেন। বাংলাদেশে নজিরবিহীন সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতির বিভাজন যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে। এই পরামর্শে সরকারের সংবিত্ ফেরার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশরূপে ক্রমেই সেক্যুলারিস্ট এবং ইসলামিস্টরা যুধ্যমান অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন রক্তস্রোত বয়ে যাওয়ার কালে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফর বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। আমি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ ভিন্ন পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তার পূর্বনির্ধারিত সফরসূচি থাকলে নিরাপত্তার বিবেচনায় তিনি সেই সফর স্থগিত করতেন। অথচ প্রিয়পাত্রী ভাতিজিকে ভরসা দেয়ার জন্য রক্তাক্ত বাংলাদেশেই তাকে আসতে হয়েছে। তার সফরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ভোজসভায় যখন দলবেঁধে রসনা তৃপ্তির আয়োজন চলেছে, ঠিক তখনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো নাম না জানা দরিদ্র মায়ের বুক খালি হয়েছে, স্বামী হারানো গাঁয়ের বধূর জীবনের রঙ মুছে গেছে, অসহায় পুত্র-কন্যা পিতৃহারা হয়েছে। এমনকি নারীরাও এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এসব অনুষ্ঠানে মদিরা পানের আয়োজন থাকতো না। এখন সেক্যুলার জামানায় ওইসব ইসলামী বিধিনিষেধ উঠে গেছে কি-না, বলতে পারব না। ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে যদি রেড ওয়াইন পরিবেশনের রীতি চালু হয়ে থাকে, তাহলে মদভর্তি সেই গ্লাসের মধ্যে অভ্যাগতরা বাংলাদেশের জনগণের রক্তের রঙ দেখতে পেয়েছেন কি-না, তাও জানি না। প্রণব মুখার্জির তিনদিনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে এক ডজন মানুষ গণহত্যার মিছিলে যোগ হয়েছেন। গণভবনে, বঙ্গভবনে এবং পাঁচতারা হোটেলে তাতে অবশ্য আনন্দ-ফুর্তিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, আর এ যুগের দেশি-বিদেশি নিরোরা দু’হাজার বছর আগের মতো করেই সুখাদ্য, উত্তম পানীয় এবং সঙ্গীতের মূর্ছনা উপভোগ করেছেন। এদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত নেমে আসুক। ব্যতিক্রম হিসেবে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত্কার বাতিল করে গভীর দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়বদ্ধতার প্রমাণ রেখেছেন। প্রণব মুখার্জির অবিবেচনাপ্রসূত বাংলাদেশ সফর পুনর্বার প্রমাণ করেছে যে, এদেশের মানুষের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণী অবমাননাকর অবজ্ঞার মনোভাব পোষণ করেন। কেবল ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য রাজনীতি চর্চার স্বার্থপর চিন্তা পরিত্যাগ এবং সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানছি।
খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার সমর্থকরা দাবি করেন যে, তিনি নাকি অত্যন্ত ধর্মভীরু ও আচারনিষ্ঠ মুসলমান। শেখ হাসিনা একাধিকবার পবিত্র হজ্ব পালন করেছেন এবং অসংখ্যবার ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব গেছেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আল্লাহর দরবারে ইবাদতরত নিমীলিত নেত্র শেখ হাসিনার অসংখ্য পোস্টারে সারাদেশ ছেয়ে ফেলা হয়েছিল। আওয়ামী ও বামধারার বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, দল দু’টি নাকি রাজনীতিতে অন্যায়ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। অথচ শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের সেই বিখ্যাত নির্বাচনী পোস্টারের বিষয়ে তাদের কাছ থেকে অদ্যাবধি কোনো আপত্তি উত্থাপিত হতে শুনিনি। এবারের মেয়াদে অবশ্য শেখ হাসিনাকে আমরা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হতে দেখেছি। শপথ গ্রহণ করা থেকেই তিনি এবং তার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্যরা ইসলাম ধর্মের নজিরবিহীন বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার সংবিধানের মূল নীতি থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করেছে। নারীনীতি ও শিক্ষানীতি প্রণয়নে এবং গত চার বছরে স্কুলের জন্য নতুনভাবে লিখিত পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে। তার মন্ত্রীরা ধারাবাহিকভাবে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। ২০১১ সালের ১০ আগস্ট ‘বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম’ শিরোনামে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনে সরকারের শীর্ষমহলের এ-জাতীয় কর্মকাণ্ডের ১২টি উদাহরণ দিয়েছিলাম। সেখান থেকে মাত্র তিনটি আজকের লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করছি : “১. ২০০৯ সালের ২৮ মার্চ ‘সন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রয়েছে, তার সবই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে (!)। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়। ২. ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল এদেশের আওয়ামীপন্থী শিল্পপতিদের অর্থে পরিচালিত সুশীল (?) থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ওয়ার্কশপে বক্তৃতায় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, কওমি মাদরাসাগুলো এখন জঙ্গিদের প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কওমি মাদরাসাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এসব কওমি মাদরাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা কূপমণ্ডূকতার সৃষ্টি করছে। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে ’৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাত্ করার ফলেই এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। ৩. ২০১১ সালের ২ জুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ দাবি করেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি— এ তিনটির বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতবিনিময় সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকলে হরতাল দেয়া হবে।” পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাতক্রমেই শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেছিলেন। সেই আঁতাতের পেছনে এদেশে ইসলামিক চিন্তা-চেতনা দমন শর্ত হিসেবে ছিল কি-না তা আমাদের অজানা। তবে মহাজোটের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ এবং ভারত যে বেজায় সন্তুষ্ট হয়েছে, সেটা তারা গোপন রাখেনি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের চরম ইসলামবিরোধী মানসিকতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই গত মাসে শাহবাগে ধর্মদ্রোহী বিকারগ্রস্ত ব্লগারদের নেতৃত্বে তথাকথিত জাগরণ মঞ্চের জন্ম দেয়া হয়েছে। সেখানে নেতৃত্বদানকারী বিপথগামী তরুণ প্রজন্মের একজন আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী ও সরকারপন্থী বাম সংসদ সদস্যরা তাকে কথিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে ১৯৭১ সালের শহীদদের চূড়ান্ত অবমাননা করেছেন। নিহত তরুণটির সম্পর্কে সংসদে আলোচনাকালে আবেগের তোড়ে সবাই মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছিলেন। রাজীবের অবিশ্বাস্য ইসলামবিরোধী কুকর্ম পরবর্তী সময়ে ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আওয়ামী প্রচারণাযন্ত্র থেকে এখন দাবি করা হচ্ছে যে, তার ব্লগে হ্যাক করে শিবিরের ছেলেরা নাকি মহানবী (সা.) সম্পর্কে কলমের ডগা অথবা জিহ্বাগ্রে আনার অযোগ্য এসব নোংরা লেখালেখি করেছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ক’দিন আগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রাজীবের পক্ষাবলম্বন করে উপরোক্ত ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। ঘটনাক্রমে জাসদ নেতা ইনু এবং আমি একই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া এবং একই ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিগ্রি নিয়েছি। আমরা দু’জনই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি সরাসরি প্রকৌশল পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও রাজনীতিবিদ ইনু তার পেশাজীবনে কোথায় ইঞ্জিনিয়ারিং চর্চা করেছেন, আমার ঠিক জানা নেই। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছি, ব্লগার রাজীবের ফেসবুক পেজে যাবতীয় অশ্লীল ও ইসলামবিরোধী পোস্ট নিশ্চিতভাবে তারই দেয়া। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সব তথ্যপ্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। আমার দাবির সমর্থনে মিডিয়ার সামনে যে কোনো স্থানে আমি মন্ত্রী ইনুর সঙ্গে ল্যাপটপ নিয়ে বিতর্ক করতে প্রস্তুতি আছি। আজ পাঠককে একটা আগাম তথ্য শুধু দিয়ে রাখছি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখের পর রাজীব ওরফে থাবা-বাবার ফেসবুক পেজে নতুন কোনো পোস্ট দেয়া নেই। কারণটি সম্ভবত সরকারি প্রশাসনযন্ত্র রাজীবের পাসওয়ার্ডটি কোনোভাবে জানতে পারেনি। রাজীব ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ন’টার দিকে নিহত হয়েছিল। তার মৃত্যুর সঙ্গে তাই থাবা-বাবা ফেসবুক পেজটিরও সমাপ্তি ঘটেছে। পথভ্রষ্ট তরুণটির একটি পোস্টের উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে দিয়ে রাখছি। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে রাজীব তার ফেসবুকে পোস্ট করেছিল, “দুনিয়াতে আসিয়াছে যেই দিন ইন্টারনেট সেই দিনই হইয়াছে আল্লাতালার ডেথ্!—- থাবা বাবা” (নাউজুবিল্লাহ)। মহাজোট সরকারের উত্সাহক্রমে বাংলাদেশে যত্সামান্য লেখাপড়া জানা একদল ডিজিটাল তরুণের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা সহজে পরিচিতি পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করাটাকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্বাসিত জীবন যাপনকারী তসলিমা নাসরিনই সম্ভবত তাদের আদর্শ। নিহত রাজীবের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পত্রিকায় যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ছেলেটিকে আদর্শ চরিত্র হিসেবে মেনে নেয়ার উপায় নেই। এমন এক নষ্ট চরিত্রের ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার মহাজোট সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং শাহবাগিদের কাছে বিস্ময়করভাবে এখনও হিরো ও শহীদের মর্যাদা পাচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহার সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবধানবাণী এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি একবার মার্কিন তরুণদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, তোমরা এমনকিছু ফেসবুক পেজে লিখবে না, যা ভবিষ্যতে তোমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। কারণ এসব লেখালেখি মুছে দেয়া আর সম্ভব হয় না। আশা করি, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আধুনিক প্রযুক্তির সমস্যাটি বারাক ওবামার মন্তব্য থেকে অনুধাবন করতে পারছেন। যাই হোক, রাজীবের সমগোত্রীয়রাই আজ শাহবাগে ভারতের মদতে (Ref: Times of India) এক বিচিত্র ভিন্ন রাষ্ট্র গঠন করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বর্ণনা অনুসারে নবগঠিত সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, ব্লগার ইমরান শুধু শাহবাগ চত্বরেরই অধিপতি নন, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতিও তিনি প্রায় প্রতিদিন নিত্যনতুন হুকুম জারি করছেন। তার সেই হুকুম অবহেলা করার সাধ্য বাংলাদেশের সচিবালয়, সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দফতর কারোরই নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তার আয়ত্তাধীন কি-না, তা অবশ্য বলতে পারব না। গত রোববার পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে এক সমাবেশে বক্তৃতাকালে সেই ইমরান শাহবাগ সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এমন একটি দাবি করে সমগ্র দেশবাসীকে চমকে দিয়েছে। গুরুত্বের বিবেচনায় দিল্লির কাছেও বর্তমানে সম্ভবত এহেন ক্ষমতাধর ব্লগার ইমরানের পরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ সফরকালে তিনি কখন, কোথায় শাহবাগের ‘রাষ্ট্রপতি’ ব্লগার ইমরানকে সাক্ষাত্ দিয়েছেন সে সংবাদ আমাদের মতো আমজনতার জানার উপায় নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যেমন করে দানব সৃষ্টি করেছিলেন, অনুরূপ শেখ হাসিনাও ব্লগার ইমরানের জন্ম দিয়েছেন। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এমন এক সময় বাংলাদেশ সফর করে গেলেন, যখন দেশে অঘোষিত গৃহযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালে বর্বর, হানাদার পাক বাহিনীর গণহত্যার ৪২ বছর পর আওয়ামী বাহিনী বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো গণহত্যা চালাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া সেই গণহত্যায় এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, যুবক সবাই আছেন। গত শুক্রবার বিরোধীদলীয় নেত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলে অভিহিত করায় সরকার ও তার তল্পিবাহকদের হৃদয়ে কাঁপন ধরে গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের প্রচারণার আবরণে ৪২ বছর পর যদি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়, তাহলে কোনো না কোনো দিন বর্তমানের গণহত্যারও নিশ্চয়ই বিচার হবে। এই আশঙ্কা মনে জাগরূক হওয়াতেই মহাজোট সরকারে ইয়াহিয়া খানের প্রেতাত্মারা বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার মতো করে চমকে উঠেছেন। গণহত্যার আন্তর্জাতিক আইনগত ব্যাখ্যা দেয়ার মতো বিশেষজ্ঞ আমি নই। তবে সাধারণভাবে গণহত্যাকে ইংরেজিতে genocide, mass killing অথবা mass murder বলা যেতে পারে। গত ক’দিন ধরে বাংলাদেশে একদল হিংস্র পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তাকে mass killing অথবা mass murder বলা হলে আওয়ামী লীগের একেবারে নিম্নশ্রেণীর দালাল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির আপত্তি করার কথা নয় বলেই আমি মনে করি। বিতর্ক অবশ্য উঠতে পারে genocide শব্দের ব্যবহার নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল। বর্তমান আওয়ামী সরকার এবং তার অধীনস্থ প্রশাসনযন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে ও ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে ব্লগার ইমরানের ‘শাহবাগি সরকার’ সেই দলটির বিরুদ্ধে যে Hate Campaign (ঘৃণা প্রচার) চালিয়েছে, তার সঙ্গে একমাত্র নািস জার্মানির ইহুদি ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পরিচালিত Hate Campaign-এর তুলনা চলে। রাতদিন ‘ফাঁসি চাই’ এবং ‘জবাই কর’ মার্কা স্লোগান দিয়ে দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর উন্মত্ততা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অব্যাহতভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর একপর্যায়ে পুলিশ ও র্যাব তার সর্বশক্তি দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়ে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। সমাজে ঘৃণা ছড়ানোর বিষময় ফলে নোয়াখালীতে ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে অতিউত্সাহী আওয়ামী লীগারদের চোখের সামনে এক এতিম শিশুর করুণ মৃত্যু ঘটেছে। সরকার তার সমর্থকদের মধ্যকার এক বিপুল অংশকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ থেকে কীভাবে দানবে পরিণত করতে পেরেছে, তার আরও একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন সাইটে পাঠকদের মন্তব্য দেয়ার সুযোগ রয়েছে। অশ্লীল শব্দাবলী না থাকলে আমরা সচরাচর সেসব মন্তব্য এডিট (Edit) করি না। আমার বিরুদ্ধে লেখা কুত্সাপূর্ণ বক্তব্যও আমি অবিকৃতভাবে রেখে দেই, যাতে পাঠকসমাজ আওয়ামী চরিত্রের নোংরা দিকটা সম্পর্কে অধিকতর অবহিত হয়। দেশব্যাপী নির্বিচার মানুষ হত্যা সংক্রান্ত একটি সংবাদের ওপর আওয়ামী সমর্থক জনৈক করিমউল্লাহ খান লিখেছেন, ‘বেজন্মা পাকিস্তানি জামায়াতিদের মৃত্যু কারো সহানুভূতি জাগাবে না।’ পাঠক কি এই হিংস্র মন্তব্যের মধ্যে ১৯৩০ সালের ফ্যাসিস্ট জার্মানির খুনি প্রজন্মকে খুঁজে পাচ্ছেন না? জাতিসংঘ কনভেনশনের আর্টিকেল-২-এ জেনোসাইডের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে : “acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group” (জাতিগত, সম্প্রদায়গত, বংশ বা কুলগত অথবা ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্য থেকে গৃহীত কার্যাবলী)। এই সংজ্ঞার আলোকে মহাজোট সরকারের চার বছরের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থাকে mass killing-এর পাশাপাশি genocide নামে অভিহিত করলে মাথায় আসমান ভেঙে পড়ার কারণ দেখি না। আগেই বলেছি, সেক্যুলারিজম ও নাস্তিকতার আড়ালে চরম ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের স্বল্পসংখ্যক এদেশীয় দালালের কৃত যুদ্ধাপরাধকে পুঁজি করে সরকারের প্ররোচনায় উপরোক্ত গোষ্ঠী এদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল এতখানি বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন যে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজান মানবাধিকার রক্ষায় তার সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়ে উল্টো গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে নিরস্ত্র আক্রান্তদের উচিত শিক্ষা দেয়ার প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন। তার এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণ মিলছে যে, বাংলাদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের মধ্য থেকে একটি অংশকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেই সরকারের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মিডিয়ার এক বিরাট অংশের ভূমিকাও বিস্ময়করভাবে একপেশে ও লজ্জাকর। গত রোববার সকালে চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে হঠাত্ করে আরটিভির সংবাদে চোখ আটকে গেল। সংবাদপাঠিকা কণ্ঠে যথোচিত আবেগ নিয়ে জাগরণ মঞ্চের গুণকীর্তন করছিলেন। সেদিন সকাল ১০টায় কথিত জাগরণ মঞ্চ থেকে হরতালবিরোধী মিছিল করার কথা ছিল। সংবাদের একপর্যায়ে শাহবাগ চত্বর লাইভ দেখানো হলো। বুম হাতে বিব্রত মুখে টেলিভিশন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে ঘিরে সাকুল্যে জনাপাঁচেক দাঁত কেলানো উত্সুক মুখ। ক্যামেরা প্যান করার উপায় নেই, কারণ শাহবাগ চত্বর তখনও একেবারেই ফাঁকা। সাংবাদিকতার পরিবর্তে অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিক শেষপর্যন্ত কবুল করতে বাধ্য হলেন যে, লোকজন এখনও আসেনি। কেবল আরটিভিকে অবশ্য দোষ দেয়াটা অন্যায় হবে। গত মাসের ৫ তারিখ থেকে দিনের পর দিন প্রতিটি টিভি চ্যানেলের একই ভূমিকা আমাদের দেখতে বাধ্য করা হয়েছে। কয়েকশ’ লোককে কয়েক হাজার এবং কয়েক হাজারকে অবলীলাক্রমে কয়েক লাখ বানাতে এসব সাংবাদিকের বাধেনি। তাদের বর্ণনায় শাহবাগে সরকারি মদতে কয়েকশ’ লোকের উপস্থিতি ‘গণজাগরণ’ হলেও সারা দেশে লাখ লাখ লোকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ গণজাগরণ তো নয়ই, শুধুই জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব! সুতরাং সরকার ও তল্পিবাহক মিডিয়ার সমন্বয়ে সৃষ্ট এই কলুষিত পরিবেশে গত এক সপ্তাহ ধরে যে হত্যাকাণ্ড চলছে, তাকে genocide নামে অভিহিত না করতে পারলে এই অপরাধটিকে জাতিসংঘ কনভেনশন থেকে উঠিয়ে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চরিত্রগত প্রতিশোধস্পৃহা এবং হিংস্রতা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করায় ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে যে ভয়ঙ্কর বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিণতিতে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই আজ হুমকির সম্মুখীন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেক্যুলারিস্ট ও নাস্তিকগোষ্ঠী দেশের বাদবাকি ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ বানানোর ফলে এখন আক্রান্তদের সামনে মাত্র দু’টি পথই খোলা রয়েছে। একসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আওয়ামী লীগের আধিপত্য মেনে নিয়ে গৃহাভ্যন্তরে সর্বদা গুম ও গ্রেফতারের আতঙ্ক মাথায় নিয়ে যার যার ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম পালন করতে হবে। অথবা জীবন ও আদর্শ বাঁচানোর প্রয়োজনে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী এবং কয়েকটি ইসলামী দল মিলে দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিয়েছে। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রের এই বিভাজন আর দূর করা সম্ভব হবে না। জাতির সর্বাঙ্গে তিনি যে ক্ষত তৈরি করলেন, তার নিরাময় কীভাবে হবে আমার জানা নেই। তবে সন্দেহ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত উদ্দেশ্য সাধনেই মহাজোট নেত্রী এবারের মেয়াদে বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করে দিল্লির কাছে তার ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করলেন। বাংলাদেশে নজিরবিহীন সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতির বিভাজন যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে। এই পরামর্শে সরকারের সংবিত্ ফেরার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশরূপে ক্রমেই সেক্যুলারিস্ট এবং ইসলামিস্টরা যুধ্যমান অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন রক্তস্রোত বয়ে যাওয়ার কালে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফর বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। আমি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ ভিন্ন পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তার পূর্বনির্ধারিত সফরসূচি থাকলে নিরাপত্তার বিবেচনায় তিনি সেই সফর স্থগিত করতেন। অথচ প্রিয়পাত্রী ভাতিজিকে ভরসা দেয়ার জন্য রক্তাক্ত বাংলাদেশেই তাকে আসতে হয়েছে। তার সফরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ভোজসভায় যখন দলবেঁধে রসনা তৃপ্তির আয়োজন চলেছে, ঠিক তখনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো নাম না জানা দরিদ্র মায়ের বুক খালি হয়েছে, স্বামী হারানো গাঁয়ের বধূর জীবনের রঙ মুছে গেছে, অসহায় পুত্র-কন্যা পিতৃহারা হয়েছে। এমনকি নারীরাও এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এসব অনুষ্ঠানে মদিরা পানের আয়োজন থাকতো না। এখন সেক্যুলার জামানায় ওইসব ইসলামী বিধিনিষেধ উঠে গেছে কি-না, বলতে পারব না। ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে যদি রেড ওয়াইন পরিবেশনের রীতি চালু হয়ে থাকে, তাহলে মদভর্তি সেই গ্লাসের মধ্যে অভ্যাগতরা বাংলাদেশের জনগণের রক্তের রঙ দেখতে পেয়েছেন কি-না, তাও জানি না। প্রণব মুখার্জির তিনদিনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে এক ডজন মানুষ গণহত্যার মিছিলে যোগ হয়েছেন। গণভবনে, বঙ্গভবনে এবং পাঁচতারা হোটেলে তাতে অবশ্য আনন্দ-ফুর্তিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, আর এ যুগের দেশি-বিদেশি নিরোরা দু’হাজার বছর আগের মতো করেই সুখাদ্য, উত্তম পানীয় এবং সঙ্গীতের মূর্ছনা উপভোগ করেছেন। এদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত নেমে আসুক। ব্যতিক্রম হিসেবে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত্কার বাতিল করে গভীর দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়বদ্ধতার প্রমাণ রেখেছেন। প্রণব মুখার্জির অবিবেচনাপ্রসূত বাংলাদেশ সফর পুনর্বার প্রমাণ করেছে যে, এদেশের মানুষের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণী অবমাননাকর অবজ্ঞার মনোভাব পোষণ করেন। কেবল ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য রাজনীতি চর্চার স্বার্থপর চিন্তা পরিত্যাগ এবং সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানছি।
No comments:
Post a Comment